একটা না, আমার মোট সাতটা বিড়াল আছে। সব কটি সাদা। সব কটির চোখ খয়েরি।
গম্ভীর মুখে বলল লোকটা। আমার প্রতিবেশী। পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এসেছে। লোকটা মধ্যবয়সী। কালো–সাদা মিলিয়ে একমাথা চুল। চোখ দুটো মাছের মতো ঠান্ডা। ঘর থেকে খুব একটা বেরোয় না। মাঝেমধ্যে বারান্দায় তাকে বসে থাকতে দেখা যায় বিড়াল কোলে। বিড়াল ছাড়া আর কেউ ওই বাড়িতে আছে বলে মনে হয় না।
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, যা হোক, আপনার কোনো একটা বিড়াল দরজা বা জানালা খোলা পেয়ে আমার বাসায় ঢুকে পড়েছিল। আমি তখন বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছিলাম। বিড়ালটা আমার বসার ঘরের ফুলদানি উল্টে সব পানি কার্পেটে ফেলে দিয়েছে। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে ময়লা ফেলার বিনটাও উল্টে ফেলেছে। এসব কী ধরনের আচরণ, অ্যাঁ?
—আমি দুঃখিত। নির্বিকার কণ্ঠে বলল লোকটা। যদিও তাকে একটুও দুঃখিত মনে হলো না। যেন তার বিড়ালটা কোনো অপরাধই করেনি!
—বুঝেছি, এটা বিটা। ওটাই সবচেয়ে দুরন্ত। আর এমনটি হবে না।
কথা শেষ করে লোকটা গলা তুলে একবার ডাকল—বিটা! বিটা!
আমার ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে ধীর ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল একটা সাদা বিড়াল। চোখ গাঢ় খয়েরি। ধীর কিন্তু অহংকারী ভঙ্গিতে হেঁটে এসে করিডর পেরিয়ে নিজের ডেরায় ফিরে গেল বিড়ালটা। ঠিক দরজা দিয়ে প্রবেশের মুহূর্তে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। দৃষ্টি দেখে কেমন যেন একটু ভড়কে গেলাম আমি। কেমন অদ্ভুত একটা চাহনি। যেন ওটা বিড়াল নয়, মানুষ। ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে আমাকে বলছে, না হয় একটু পানি আর ময়লা ফেলেছি, তাতেই নালিশ করতে গেলে? ছোটলোক কোথাকার!
বিড়াল-কুকুর আমার একদম পছন্দ নয়। পোষা প্রাণী আমার দুচোখের বিষ। তারা ঘরদোর নোংরা করে, অকারণে অন্ন ধ্বংস করে। একটু আদরযত্ন কম হলে রাগ–অভিমান করে। এমন একটা ভাব যেন সারাক্ষণ তাদের সেবা করা, তাদের দিকে মনোযোগ দেওয়া ছাড়া মালিকের কোনো কাজ নেই। কেন যে মানুষ প্রাণী পোষে! ফালতু।
আমি গট গট করে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলাম। অভদ্র একটা লোক। একবার অনুরোধও করল না যে আপনার ঘর পরিষ্কার করে দিই! ভাগ্যিস, বদমাশ বিড়ালটা আমার স্টাডিতে ঢোকেনি। ডেস্কটপ শাট ডাউন না করেই শাওয়ার নিতে চলে গিয়েছিলাম। এখনো ফান্ডের অ্যাকাউন্ট ফাইলটা ওপেন আছে। চেয়ারে না বসে উবু হয়ে দাঁড়িয়েই ডকুমেন্ট সেভ করলাম। ফোল্ডারে ভরলাম। অফিসের মেইল অ্যাড্রেসে মেইল করলাম। এরপর উইন্ডোজ শাট ডাউন করে জামাকাপড় পরে বেরিয়ে এলাম ঘর লক করে। নিচে নামার জন্য লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজার বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
গতকাল তো ব্যাংক বন্ধ ছিল বিদেশে, তাই টাকা ট্রান্সফার হয়নি। আজ, মানে সোমবার পুরো টাকা আমাদের লোকাল ব্যাংকে ট্রান্সফার হওয়ার কথা। এরপর নতুন ড্রাগের প্রপোজাল রেডি করতে হবে। সকাল ধরে এ কাজই করছিলাম।
—কী খবর জহির, শরীর ভালো তো?
—স্যার, আর কী কইতাম? ম্যানেজার হওয়ার বড় জ্বালা–যন্ত্রণা।
—কেন, আবার কী হলো?
—ওই যে স্যার বি সিক্স, মানে আপনের সামনে যে নতুন ভাড়াটে আসছে, বিলাই পালে অনেকগুলা।
শুনে কান খাড়া করলাম। হুম, কী হইছে তার?
জহির মুখ বিকৃত করে—বেডার বিলাইগুলা সবতেরে জ্বালাইতেছে। যখন–তখন অন্যের ফ্ল্যাটে ঢুইকা পড়ে, এইটা–ওইটা হাতড়ায়। নষ্ট করে। অসভ্য বিলাইগুলা। খালি কমপেলেইন আসতেছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ঠিক বলছ। আমার ঘরেও ঢুকছিল।
—স্যার, এই লোকটারে বিদায় করতে হইব। ফ্ল্যাট ওনাররে জানাইছি। একটা বিলাই কাইল সিকিউরিটি রুমে ঢুইকা টেবিলের ওপর সারা রাত শুইয়া ছিল। হারামজাদা সিকিউরিটি গার্ডও নাক ডাকায়া ঘুমাইতেছিল। কী জানি টেপাটিপি করছে বিলাইডা, অহন সিসিটিভি ক্যামেরা আর কাজ করতেছে না। সেক্রেটারি স্যার আমারে শাসাইতেছে এখন। আমার থিকা টেকা নিয়া নাকি ক্যামেরা সিস্টেম ঠিক করব! কন স্যার, আমার কী দোষ?
আমি কিছু না বলে নিচে নেমে উবার ধরে ল্যাবরেটরিতে এলাম। ওরাল গ্লুকাগনের ফোর্থ ফেজ ট্রায়াল প্রায় শেষ। সব ঠিক থাকলে আগামী মার্চেই বাজারে আসতে যাচ্ছে ওরাল গ্লুকাগন ট্যাবলেট। ডায়াবেটিসের রোগীদের হাইপোগ্লাইসেমিয়ার অব্যর্থ ওষুধ। এই গবেষণা ও ট্রায়ালের জন্য ফান্ড এসেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে। গতকাল তো ব্যাংক বন্ধ ছিল বিদেশে, তাই টাকা ট্রান্সফার হয়নি। আজ, মানে সোমবার পুরো টাকা আমাদের লোকাল ব্যাংকে ট্রান্সফার হওয়ার কথা। এরপর নতুন ড্রাগের প্রপোজাল রেডি করতে হবে। সকাল ধরে এ কাজই করছিলাম। এখন অফিসের ল্যাপটপে বসে বাকিটা করে ফেলতে হবে। পাসওয়ার্ড কেবল আমার জানা, তাই দুই জায়গায় ছোটাছুটি করতে হলো।
কাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে একটু হাসিঠাট্টা করে বেরিয়ে এলাম আবার। ছোটবেলার বন্ধু ভিকির সঙ্গে কফি খেতে যাওয়ার কথা। কফি শপে বিকেল চারটায় অপেক্ষা করবে ভিকি। ৩ নম্বর বাস দেরিতে আসার কারণে আমার কফি শপে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল। গিয়ে দেখি কোণের টেবিলে মুখ কালো করে বসে আছে ভিকি।
—সরি দোস্ত, দেরি হয়ে গেল। বসতে বসতে বললাম আমি।
ভিকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আর দেরি!
—কী হইছে? উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ভিকি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার রোজলিন প্রজেক্ট বাতিল হয়ে গেছে!
—মানে?
—মানে, ওই যে আমার এআই পেট প্রজেক্টটা! বৃদ্ধাশ্রমে বুড়োবুড়িদের দেখভাল করার জন্য রোজলিন নামের এআই কুকুর ছাড়ছিল আমার অফিস। বলছিলাম তো তোরে! কোটি টাকার প্রজেক্ট।
—হুম, তো?
—সরকার একটা রুল জারি করে এআই পেট তৈরি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিছে।
—কেন?
—সম্প্রতি এআই পেট ব্যবহার করে অপরাধ বা ক্রাইম করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। কুকুর-বিড়াল বা প্রাণীকে কেউ সন্দেহ করে না। তাদের কোনো পাসপোর্ট, আইডিও লাগে না। যেখানে–সেখানে যেতে পারে। তাই তারা যেকোনো কিছু করতে পারে। পরে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন সরকার নিয়ম করছে যে তাদেরও আইডি লাগবে। রেটিনা স্ক্যান লাগবে। সিকিউরিটি চেকিং লাগবে।
আমার বুকের ভেতরটা কেন যেন ছলাৎ করে উঠল। মনটাতে কুডাক দিচ্ছে কেন যেন। দুই কাপ কফির অর্ডার দিয়ে বললাম, কোনটা আসল প্রাণী, কোনটা নকল—এটা তোরা বুঝিস কেমন করে?
ভিকি হতাশ ভঙ্গিতে তাকাল। বলল, দোস্ত, এসব আজকাল আর বোঝা যায় না। দুনিয়ার প্রথম এআই পেট ছিল তামাগুচি। নিশ্চয় মনে আছে তোর। শিশুদের কাছে বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল তামাগুচি। মূলত শিশুদের মজা আর সঙ্গ দেওয়াই ছিল তার কাজ। এরপর বাজারে আসে আইবো। আইবো ছিল প্রায় সত্যিকারের পোষা কুকুরের মতো। তাদের গায়ে লোম ছিল, সেই লোমে বসানো ছিল টাচ সেন্সর। তাই কেউ আদর করলে তারা বুঝত এবং সাড়া দিত। গরগর করত। এমনকি তাদের স্লিপ সাইকেল ছিল। তারা সত্যিকারের কুকুরের মতো ঘুমাত। কিন্তু কান খাড়া থাকত সব সময়। কারণ, কানে ফিট করা ছিল শক্তিশালী সেন্সর। যেকোনো আদেশ বা শব্দে কর্তব্য পালনে মুহূর্তের বেশি সময় লাগত না তাদের।
—বাহ। মজা তো।
আমি আর বিশেষ কিছু না শুনে লিফটের অপেক্ষা না করেই লাফিয়ে লাফিয়ে ছয়তলায় এলাম। দরজা খুলে ছুটে গেলাম নিজের ডেস্কটপের সামনে। এরপর ফাইল ওপেন করে যা দেখলাম, তাতে শরীর হিম হয়ে এল আমার।
—হ্যাঁ। এর কিছুদিন পর এ রকম একটা অতি উন্নত মানের এআই কুকুর মফলি একজন পথচারীকে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলে। বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কুকুরটার মালিক দাবি করে যে এর এমন হিংস্র স্বভাবের কথা কোম্পানি আগে জানায়নি। এতে তার কোনো দায় নেই। অন্যদিকে কোম্পানি দাবি করে, এ রকম কোনো ফিচার মফলিকে দেওয়া হয়নি। হয় কুকুরটার সিস্টেম হ্যাকড হয়েছে, অথবা মালিক কোনো কারসাজি করেছে। বিষয়টা এখনো ঝুলে আছে।
—আশ্চর্য তো!
—আরও অবাক হওয়া বাকি আছে তোর। এখন এমন সব এআই পেট বেরিয়েছে, যারা সত্যিকারের প্রাণীর মতো ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়। এমনকি বুড়ো হলে মারাও যায়। তারা মালিকের রাগ-কষ্ট-আদর-অনুভূতি সবই বুঝতে পারে। মালিকের কমান্ড ফলো করে নির্ভুলভাবে। এমনকি তাদের নিজস্ব ইমোশনাল স্পেকট্রাম আছে। আর এক্সট্রিম লেভেলের বুদ্ধিমত্তা তো আছেই।
—বলিস কী?
—আর এর সুবিধা নিয়ে একশ্রেণির কোম্পানি অসাধু কাজ শুরু করেছে। গত সপ্তাহে একটা কোম্পানির সাপ্লাই দেওয়া বিড়াল যাদের কাছে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছিল, তাদের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস, আর্থিক লেনদেনের কাগজ চুরি যাওয়া শুরু হয়েছে। আর এরপরই সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু আরে আরে, তুই যাচ্ছিস কোথায়? কফি তো পড়ে আছে! অ্যাই, অ্যাই জনি…
ভিকি চিৎকার করতে থাকল পেছনে, আমি প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলাম কফি শপ থেকে। ছুটতে ছুটতে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে এসে দেখি নিচে ভিড় জমে গেছে। অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা নেমে এসেছেন নিচে। একি, একটা পুলিশের গাড়িও আছে দেখছি। ভয়ে হাত–পা জমে এল আমার।
ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে শুনি আটতলার একজন চিৎকার করছেন—আমার সায়েন্টিফিক পেপার! আমার এত দিনের পরিশ্রমের ডকুমেন্টস। সব হাওয়া! ওই বিড়ালওয়ালা, ওর একটা সাদা বিড়াল আমার ঘরে…
ছয়তলার ফ্যাশনদুরস্ত মহিলা ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছেন—অফিসার! আমার ভল্ট থেকে সব হীরার গয়না চুরি হয়ে গেছে। পাসওয়ার্ড ছিল আমার পিসিতে। গতকাল একটা সাদা বিড়াল, খয়েরি চোখ…
আমি আর বিশেষ কিছু না শুনে লিফটের অপেক্ষা না করেই লাফিয়ে লাফিয়ে ছয়তলায় এলাম। দরজা খুলে ছুটে গেলাম নিজের ডেস্কটপের সামনে। এরপর ফাইল ওপেন করে যা দেখলাম, তাতে শরীর হিম হয়ে এল আমার। ওরাল গ্লুকাগন ফান্ডের তিন মিলিয়ন ডলার আজ সকালেই ট্রান্সফার হয়ে গেছে ভিনদেশি কোনো এক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। আমাদের অ্যাকাউন্ট খালি! ওহ আল্লাহ! এটা কী হলো?
দরজা খুলে পাগলের মতো ছুটে গেলাম বি সিক্স নম্বর ফ্ল্যাটে। ওই বেটা আর তার বিড়ালগুলোকে আজ খুন করে ফেলব! কিন্তু ধু ধু করছে বি সিক্স নম্বর ফ্ল্যাট। কোথাও কেউ নেই। না সেই রহস্যময় লোক, না তার সাত–সাতটি সাদা রঙের বিড়াল। যাদের চোখগুলো ছিল গাঢ় খয়েরি!