‘এই যে শুনছেন,’ রাস্তা ধরে এগিয়ে আসা এক পথচারীকে দেখে বলল টাইম ট্রাভেলার, ‘আমি এসেছি বিশ শতক থেকে। হাতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় আছে, তারপরই আমাকে ফিরে যেতে হবে। আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছেন, তাই না?’
‘অবশ্যই, বুঝতে পারছি।’ জবাব দিল পথচারী।
‘আরে! আপনি দেখি বেশ ভালো ইংরেজি বলতে পারেন। কীভাবে সম্ভব?’
‘আমরা একে বলি “আমের-ইংরেজি”। আসলে একসময় এই মৃত ভাষা নিয়ে পড়ালেখা করেছি আমি।’
‘দারুণ তো! কিন্তু শুনুন, আমার হাতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি আছে। চলুন, শুরু করা যাক।’
‘শুরু করব মানে?’
‘হ্যাঁ, তা–ই। আপনি বুঝতে পারছেন না? আমি টাইম ট্রাভেলার। বিশ শতক থেকে ওরা আমাকে ভবিষ্যতে পাঠিয়েছে। কারণ, আমি গুরুত্বপূর্ণ।’
‘হুম। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, আমাদের এখানে একের পর এক টাইম ট্রাভেলার আসছে-যাচ্ছে। কোনো বিরাম নেই।’
‘দেখুন, ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগে। তবে এর গভীরে ঢোকার মতো আমার হাতে আসলে বেশি সময় নেই। বুঝলেন? এবার আসল কথা বলি।’
‘আচ্ছা। এখান থেকে কী পেলেন?’
‘কী পেলাম, মানে কী?’
পথচারী বলল, ‘আপনি যে ভবিষ্যতে এসেছেন, সে রকম কোনো প্রমাণ সংগ্রহের কথা কি ভাবছেন না? আপনাকে আগেই সাবধান করে দিচ্ছি, টাইম ট্রাভেলে কিছু প্যারাডক্স আছে। সে কারণে ভবিষ্যৎ থেকে কোনো জ্ঞান আপনি অতীতে নিয়ে যেতে পারবেন না। তাতে অতীত উল্টেপাল্টে যেতে পারে। অতীতে ফিরে যেতেই এখানে ঘটা সবকিছুই আপনার মাথা থেকে মুছে যাবে।’
টাইম ট্রাভেলার চোখ পিট পিট করে বলল, ‘ওহ! তাই নাকি?’
‘অবশ্যই তাই। তবে আপনার সঙ্গে একটা লেনদেন করতে পারলে আমি খুশিই হব।’
‘এতক্ষণে আসল কথাটা বললেন। কথাটার জন্যই মনে হয় আমি অপেক্ষা করে আছি। লেনদেন বলতে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’ টাইম ট্রাভেলার বলল।
টাইম ট্রাভেলার মনে মনে দুঃখ পেল। ‘আমাকে দেখে কি মনে হয়, আমি কোনো ছবি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। শুনুন, আপনার ওই ছুরির বিনিময়ে আমার কাছে যা আছে, সবই দিয়ে দেব। তবে আমার প্যান্টটা বাদে।
‘মানে, আপনার সময়ের কোনো কিছুর বিনিময়ে আমার সময়ের কিছু একটা বিনিময় করতে চাই। অবশ্য আপনার সময়ের জিনিসগুলো আমাদের জন্য ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়া অন্য কোনো মূল্য নেই।’ পথচারীর চোখ যেন একটু চিকচিক করে উঠল। গলা পরিষ্কার করে সে আবার বলল, ‘যা–ই হোক, আমার কাছে একটা পারমাণবিক পকেট ছুরি আছে। জিনিসটা আপনার সময়ের জন্যও বেশ কাজের, তা বলাই বাহুল্য।’
‘ঠিক আছে। আমার হাতে আর মাত্র ১০ মিনিট আছে। তবে বুঝতে পারছি, আপনার কথাই ঠিক। আমার এমন কিছু একটা দরকার, যেটা দিয়ে প্রমাণ করতে পারব যে আমি সত্যি সত্যিই ভবিষ্যতে এসেছিলাম।’ টাইম ট্রাভেলার বলল।
‘আমার পকেট ছুরিটা সেটা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করতে পারবে। কারণ, এই জিনিস অতীতে পাবেন না।’ মাথা নেড়ে বলল পথচারী।
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। শুনুন, আমি কিছুটা বিভ্রান্ত। আমাকে একদম শেষ পর্যায়ে এখানে পাঠিয়েছে তারা। আসলে আমার মতো প্রফেসর টাইপের কাউকে নিয়ে ওরা কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিল না। বুঝতে পারছেন? কিন্তু আপনার হাতের ছুরিটা দারুণ। প্রমাণ রাখার জন্য জিনিসটা আমাকে দিন।’
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। কিন্তু আপনাকে ছুরিটা কেন দেব? তার আগে বলুন, এই ছুরির বিনিময়ে আমাকে কী দেবেন?’ পথচারী প্রশ্ন করল।
‘কিন্তু আমি তো বিশ শতক থেকে এসেছি। আমার কাছ থেকে কী নেবেন?’
‘উমম, আর আমি হলাম ত্রিশ শতকের মানুষ।’
পথচারীর দিকে বেশ কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল টাইম ট্রাভেলার। অবশেষে বলল, ‘শুনুন, আমার হাতে বেশি সময় নেই। ওটার বিনিময়ে আমার ঘড়িটা রাখুন।’
‘উমম, শুধু ঘড়ি! ওতে হবে না। আর কী দেবেন?’
‘আচ্ছা আমার টাকাগুলোও রাখুন।’
‘ওই টাকা দিয়ে কী হবে! ওটা নিয়ে শুধু মুদ্রা সংগ্রাহকদেরই আগ্রহ থাকতে পারে। আমার নেই।’
‘শুনুন, আমি যে ত্রিশ শতকে এসেছিলাম, তার কিছু প্রমাণ দরকার আমার! বুঝতে পারছেন?’
‘অবশ্যই। কিন্তু বিজনেস ইজ বিজনেস। প্রবাদে তো তা–ই বলে।’
‘ইশ্! আমার কাছে যদি একটা বন্দুক থাকত।’
‘কিন্তু এই যুগে বন্দুক কোনো কাজে লাগে না।’ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল পথচারী।
‘না, কিন্তু আমার কাছে,’ তোতলাতে লাগল টাইম ট্রাভেলার। ‘দেখুন, আমার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনি কী চান? দেখতেই পাচ্ছেন আমার কাছে কী আছে—এই জামাকাপড়, মানিব্যাগ, কিছু টাকা, একটা চাবির রিং, এক জোড়া জুতা।’
‘আমি লেনদেন করতে রাজি, কিন্তু আপনার জিনিসগুলোর মূল্য একেবারেই কম। আপনার কাছে কোনো হাতে আঁকা ছবি আছে?’
টাইম ট্রাভেলার মনে মনে দুঃখ পেল। ‘আমাকে দেখে কি মনে হয়, আমি কোনো ছবি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। শুনুন, আপনার ওই ছুরির বিনিময়ে আমার কাছে যা আছে, সবই দিয়ে দেব। তবে আমার প্যান্টটা বাদে।’
‘ওই প্যান্টটা রাখতে চান? আপনি আসলে কী করতে চাচ্ছেন, “অ্যাংলো মি ডাউন” করতে চান নাকি? নাকি আপনি এই টার্ম জন্মেরও আগের যুগের মানুষ?’
‘কী বললেন, অ্যাংলো...কী? বুঝতে পারলাম না।’
‘দেখুন আমি হলাম এটোমোলজিস্ট, মানে শব্দের প্রকৃতিবিষয়ক তত্ত্ববিদ।’
‘বাজে ব্যাপার, কিন্তু...’
লোকটা আসলে বেশি ভদ্র।’ বিড়বিড় করল সে। ‘সম্ভবত প্রথমবার ভবিষ্যতে এসেছে। টাইম ট্রাভেলের প্যারাডক্সের ব্যাপারেও কিছু জানে না। অবশ্যই জানে না। অতীত থেকে ভবিষ্যতে জিনিসপত্র আনা যায়। কারণ, এটাই হলো মাত্রার স্বাভাবিক প্রবাহ। কিন্তু ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে কোনো কিছুই নেওয়া যায় না।
‘মোটেও নয়, দারুণ একটা হবি এটা।’ পথচারী বলল। ‘এখন ওই অ্যাংলো মি ডাউন সম্পর্কে বলি। এই পরিভাষা প্রথম জনপ্রিয় হয়েছিল ১৮৫০-৬০-এর দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব দিক থেকে আসা মানুষদের, বিশেষ করে ইংরেজ বংশোদ্ভূতদের এই নামে ডাকা হতো। মেক্সিকো থেকে নিউ মেক্সিকো ও অ্যারিজোনা স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর তারা এই এলাকায় এসেছিল। আমার বিশ্বাস, ওই সময়ে এই টার্ম ব্যবহার করা হয়েছিল। পূর্ব দিকের বাসিন্দারা স্প্যানিশ ও ইন্ডিয়ানদের কাছে অ্যাংলো নামে পরিচিত ছিল।’
টাইম ট্রাভেলার মরিয়া হয়ে বলল, ‘শুনুন, আমরা মনে হয় মূল বিষয় থেকে ক্রমেই দূরে...’
তার কথায় পাত্তা না দিয়ে পথচারী বলে যেতে লাগল, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। ইংরেজি এই ফ্রেজটি উৎপত্তি নিয়ে আর মাত্র দুটি কথা বলার আছে। এই অ্যাংলোরাই বিশ শতকে সম্পদশালী ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিল। ফলে নিজেদের ডলার দিয়ে তারা গোটা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।’
‘ঠিক আছে। বিষয়গুলো আমি জানি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কারও ওপর আধিপত্য বিস্তার করার মতো যথেষ্ট ডলার আমার কাছে নেই। তবে...’
‘বুঝেছি। আসলে মূল ব্যাপারটা হলো, অ্যাংলোরা একসময় গোটা বিশ্বে বাণিজ্যিক জাদুকর হয়ে উঠল। তারাই হয়ে উঠল সবচেয়ে চতুর ডিলার, দর–কষাকষিতে দক্ষ, সবচেয়ে যোগ্য ব্যবসায়ী।’
টাইম ট্রাভেলার ঝট করে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাল। ‘আর মাত্র তিন মিনিট...’
‘৩ নম্বর ফ্যাক্টরটা, মানে “ডাউন” নেওয়া হয়েছে আরও অতীতকাল থেকে। এককালে এক সংখ্যালঘু জাতি ছিল, যাদের অ্যাংলোরা তাচ্ছিল্য করে বলত জু। অনেক বছর ধরে একটা টার্ম চালু ছিল, “টু জু ইউ ডাউন”। এর মানে, দাম কমাও। অ্যাংলোরা মুদ্রাব্যবস্থায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের অনুমান করার পর এই “জু ইউ ডাউন” থেকে “অ্যাংলো মি ডাউন” টার্মটার জন্ম হয়। এভাবেই টার্মটা আমাদের কালে, মানে ত্রিশ শতক থেকে এসেছে। অবশ্য এখন আর অ্যাংলো বা জু বলে আলাদা কিছু নেই।’
টাইম ট্রাভেলার জ্বলন্ত চোখে পথচারীর তাকিয়ে বলল, ‘এই গল্পের কোনো কিছুই আমি স্মৃতি হিসেবে অতীতে বহন করে নিয়ে যেতে পারব না, তাই না? আর আমার নাম লেভি।’ আরেকবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে গুঙিয়ে উঠল টাইম ট্রাভেলার। বলল, ‘তাড়াতাড়ি করুন! চলুন, লেনদেনটা সেরে নেওয়া যাক। আপনার ওই পারমাণবিক ছুরিটার জন্য আমার সবকিছু দিচ্ছি।’
তারপর নিজেদের জিনিস বিনিময় করল টাইম ট্রাভেলার এবং পথচারী। ত্রিশ শতকের নাগরিক মালগুলো হাতে নিয়ে একটু পিছিয়ে গিয়ে বিশ শতকের লোকটাকে দেখতে লাগল। লোকটার গায়ে তখন একটা সুতাও নেই। শুধু হাতের মুঠোয় শক্ত করে একটা ছুরি ধরে রেখেছে টাইম ট্রাভেলার। তবে মুখে খুশির আভাস। একটু পরই তার দেহটা ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগল।
পারমাণবিক ছুরিটা কিছুক্ষণ শূন্যে ভেসে রয়েছে বলে মনে হলো। তারপর টাইম ট্রাভেলার সেখান থেকে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছুরিটা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল।
একটু নিচে ঝুঁকে ছোঁ মেরে ছুরিটা মাটি থেকে তুলে নিল পথচারী। যত্ন করে রেখে দিল নিজের পকেটে। ‘লোকটা আসলে বেশি ভদ্র।’ বিড়বিড় করল সে। ‘সম্ভবত প্রথমবার ভবিষ্যতে এসেছে। টাইম ট্রাভেলের প্যারাডক্সের ব্যাপারেও কিছু জানে না। অবশ্যই জানে না। অতীত থেকে ভবিষ্যতে জিনিসপত্র আনা যায়। কারণ, এটাই হলো মাত্রার স্বাভাবিক প্রবাহ। কিন্তু ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে কোনো কিছুই নেওয়া যায় না। এমনকি স্মৃতিও নয়। সময়ের এই স্রোতের বিপরীতে কোনো কিছু নেওয়া যায় না।’
টাইম ট্রাভেলারের কাছ থেকে পাওয়া জিনিসগুলো হাতে নিয়ে নিজের বাড়ির পথ ধরল লোকটা।
কোমরে হাত দিয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল মারগেট। সেখানে পথচারীর সঙ্গে দেখা হতেই রাগত স্বরে সে বলল, ‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
‘ডার্লিং, বাসায় আসার পথে আজ আরেক টাইম ট্রাভেলারের সঙ্গে দেখা হলো,’ জবাব দিল লোকটা।
‘মিথ্যে বলছ...’
‘সত্যি বলছি। কেন হবে না? আমার সঙ্গে না হলে অন্য কারও সঙ্গে হতো...’
‘কিন্তু আমাদের ক্লজেট তো আগের জিনিসপত্রে ভরে টইটম্বুর হয়ে আছে...,’ রাগী চোখে তাকাল মারগেট।
‘শোনো মারগেট, ওভাবে তাকিয়ো না। কোনো দিন হয়তো একটা মিউজিয়াম কিংবা কোনো সংগ্রাহককে পেয়ে যাব। নিশ্চিত থাকো...’
সন্দেহভরা চোখে একবার লোকটার দিকে তাকাল মারগেট। তারপর ঘুরে ঘরে ঢুকে গেল।