নতুন পৃথিবী

‘আমি তো এখানে কোনো সমস্যাই দেখছি না,’ বললেন রাষ্ট্রপতি, ‘ওরা নিজেরাই আমাদের কাছে এসে যোগাযোগ করেছে।’

রাষ্ট্রপতির তিন সহকারী একে অপরের দিকে তাকাল। সাম্প্রতিক ঘটনায় তাদের চেহারা একেবারে বিধ্বস্ত। প্রথমজন ধীরে বলল, ‘জি স্যার, ঠিক বলেছেন। কিন্তু ওই এলিয়েনদের কিছু দাবিদাওয়া আছে...’

‘ওরা তো আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি, তাই না?’ রাষ্ট্রপতি প্রশ্ন করলেন।

‘আসলে চাপ নয়, ঠিক করে বলতে গেলে কিছু অনুরোধ করেছে,’ বলল দ্বিতীয় সহকারী। এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগটা সে-ই সামলাচ্ছে। প্রথমজন সারা বিশ্বে মানুষের প্রতিক্রিয়া সামাল দিচ্ছে। আর তৃতীয়জন এলিয়েনদের উপস্থিতি ভবিষ্যতে কেমন প্রভাব ফেলবে, তার বিশ্লেষণের দ্বায়িত্বে আছে। যদিও তাকে কেউ খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না।

‘হ্যাঁ, অনুরোধই বলা চলে,’ দ্বিতীয়জন বলল। ‘আসলে কিছু শর্ত দিয়েছে ওরা।‘

‘কী ধরনের শর্ত?’ জানতে চাইলেন রাষ্ট্রপতি।

‘সমন্বয়ের,’ হঠাৎ বলে উঠল তৃতীয় সহকারী। ‘বাণিজ্যে, প্রযুক্তিতে, সামাজিকতায় আর যোগাযোগে।’

‘ওদের সঙ্গে তো আমাদের যোগাযোগ হয়েছে,’ বলল প্রথমজন।

এছাড়াও আরও দুটি বানর প্রজাতি আছে, যাদের অস্তিত্ব আমরা কখনো টের পাইনি। তবে লোককাহিনিতে আছে—যেমন ইয়েতি আর বিগফুট,’ বলল তৃতীয় সহকারী।

‘শর্ত না মানলে তারা যেকোনো সময় চলেও যেতে পারে।’ তৃতীয়জন কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে রুমজুড়ে টানটান নীরবতা বিরাজ করল। সবাইকে একটু ঘাবড়ে যেতে দেখা গেল। তবে নীরবতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

‘আসলে ওরা একটা বৈশ্বিক সরকার চাইছে,’ বলল প্রথম সহকারী।

‘হ্যাঁ, জাতিসংঘ তো আছেই,’ বললেন রাষ্ট্রপতি।

‘শুধু জাতিসংঘ থাকলেই চলবে না, স্যার। সব দেশের, মানে প্রত্যেকটা মানুষের সম্পৃক্ততা থাকা লাগবে—কেউ যাতে বাদ না যায়, কেউ যেন জাতিসংঘকে অস্বীকার করতে না পারে।’

রাষ্ট্রপতি কিছুক্ষণ ভাবলেন। ‘এটার কতটুকু সম্ভাবনা আছে?’

‘ওরা আসার পর তো ভালোই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তবে...’ প্রথমজন বাক্যটা শেষ করার আগেই বিরক্তিভরা একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

রাষ্ট্রপতি মাথা নাড়লেন। ‘ওদের সহায়তা পেলে আর একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে, কয়েক বছরেই... হয়তো সম্ভব...’

‘এটা সবেমাত্র প্রথম ধাপ,’ বলে ফেলল তৃতীয় সহকারী। অন্যরা তাকালো তার দিকে।

‘আরেকটা বিষয় আছে, স্যার,’ বলল দ্বিতীয়জন। ‘এই বৈশ্বিক সরকার তো ওদের কেবল প্রথম চাওয়া মাত্র। ওরা আরও কিছু চাইছে।’

‘আর কি চাওয়া থাকতে পারে?’ রাষ্ট্রপতির কণ্ঠে বিরক্তি।

আরও পড়ুন

‘সব মানুষ যেন প্রতিনিধিত্ব পায়—এটা ঠিক আছে, কিন্তু... ওরা অনেক গ্রহে বিভিন্ন জাতি ও প্রজাতির সঙ্গে একসঙ্গে বাস করে, তাই তাদের চাওয়াটা আমাদের ধারণার চেয়ে ভিন্ন।’

‘খুলে বলো তো,’ বললেন রাষ্ট্রপতি।

‘ওরা চায় সব বুদ্ধিমান প্রাণী যেন সেখানে প্রতিনিধিত্ব পায়।’

একটু থেমে রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘পৃথিবীতে আমরা ছাড়া আর কোন বুদ্ধিমান প্রাণী আছে?’

‘ডলফিন,’ বলল তৃতীয় সহকারী।

‘কী বললে? ও হ্যাঁ… গতবার কংগ্রেসে ডলফিন নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছিল, তাই না?’

‘হ্যাঁ, ডলফিন শিকার বন্ধে একটা বিল উঠেছিল। কিন্তু সেটা কংগ্রেসে পাশ হয়নি।’

রাষ্ট্রপতি কিছুক্ষণ ভাবলেন। ‘তাহলে কি ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনোই ভালো হবে না?’

তিন সহকারী মাথা নাড়ল।

এবার শান্ত স্বরে বলল তৃতীয়জন, ‘এসব প্রাণী নিয়ে বহু আগে থেকেই নানা তত্ত্ব ছিল। কিছুটা প্রমাণও আছে। আমরা কখনো পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিইনি বলেই তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা এতদিন নিশ্চিতভাবে জানতাম না।

‘ওদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করতে হবে,’ বললেন রাষ্ট্রপতি।

‘ওরাই একমাত্র না,’ যোগ করল দ্বিতীয়জন।

‘আর কারা?’ রাষ্ট্রপতি হতবাক।

‘চার-পাঁচটা প্রজাতির বানর, আর টার্মাইট,’ বলল তৃতীয়জন।

‘টার্মাইট?!’ রাষ্ট্রপতি যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন।

‘এটা ওদের দেওয়া নাম,’ বলল দ্বিতীয়জন।

‘এছাড়াও আরও দুটি বানর প্রজাতি আছে, যাদের অস্তিত্ব আমরা কখনো টের পাইনি। তবে লোককাহিনিতে আছে—যেমন ইয়েতি আর বিগফুট,’ বলল তৃতীয় সহকারী।

রাষ্ট্রপতি ঢোঁক গিললেন।

‘ওরা তিমির কথাও বলেছে,’ বলল প্রথম সহকারী। ‘তিমিকে দিয়েই ডলফিনদের সঙ্গে প্রাথমিক সংযোগ সেরে ফেলতে বলেছে।’

‘আর কেউ?’

‘অতল সমুদ্রের গভীরে থাকা এক ধরনের জলপরি—ওদেরও যুক্ত করতে হবে।’

‘আরে, এ আবার কী! জলপরি বলতে কিছুই নেই।’

‘কিন্তু ওরা ঠিকই তাদের কথা জানে,’ বলল তৃতীয়জন। ‘জলপরিরা মাঝারি আকৃতির সভ্যতা। ওরা চায় জলপরিদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’

‘ওদের কাছে এমন সব প্রযুক্তি আছে, যেগুলো দিয়ে ওরা বুঝতে পারে কোন কোন প্রাণী বুদ্ধিমান,’ বলল দ্বিতীয়জন। ‘ওরা সাহায্য করবে ঠিকই, কিন্তু আসল কাজটা আমাদেরই করতে হবে।’

‘ওজোন স্তরে থাকা আয়ন প্রাণীদেরকেও যোগ করতে হবে,’ বলল তৃতীয়জন।

‘কী? কী বললে?!’ রাষ্ট্রপতি চেঁচিয়ে উঠলেন।

‘এ নিয়ে আগেও গবেষণা হয়েছিল, স্যার। আমাদের একটা সম্ভাব্য তত্ত্ব আছে,’ বলল প্রথম সহকারী।

‘এখন তাদের অস্তিত্ব আর কোনো সম্ভাবনা নয়, বরং বাস্তব।’ বলল দ্বিতীয়জন।

‘আরও আছে, পাতালের প্রাণীরা,’ বলল তৃতীয়জন।

রাষ্ট্রপতির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।

‘এসব আজব প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের কথা কেমন করে ভাবে ওরা?’ তিনি আবার চিৎকার করলেন।

‘দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন…’ বিড়বিড় করতে লাগল দ্বিতীয়জন।

‘স্বর্গের কথা বাদ দাও! এই পৃথিবীতে এত কিছু এলো কখন?’

আরও পড়ুন

‘স্যার,’ এবার শান্ত স্বরে বলল তৃতীয়জন, ‘এসব প্রাণী নিয়ে বহু আগে থেকেই নানা তত্ত্ব ছিল। কিছুটা প্রমাণও আছে। আমরা কখনো পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিইনি বলেই তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা এতদিন নিশ্চিতভাবে জানতাম না। কিন্তু এলিয়েনরা যেমনটা চাইছে, সে অনুযায়ী এসব বুদ্ধিমান প্রাণীদের অন্তর্ভুক্ত জরুরি।’

এই শান্ত বক্তব্য যেন হঠাৎ রুমের অস্থিরতা প্রশমিত করল।

‘আচ্ছা,’ রাষ্ট্রপতি ধীরে বললেন, ‘বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করলে...হয়তো পারা যাবে...’

‘এলিয়েনদের হিসাব অনুযায়ী, পুরো মানবজাতি ও অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীদের নিয়ে একটা সমন্বিত সভ্যতা গড়তে আমাদের প্রায় চার শ বছর লাগবে,’ বলল দ্বিতীয়জন।

রাষ্ট্রপতি যেন থমকে গেল।

ওদের কাছে এমন সব প্রযুক্তি আছে, যেগুলো দিয়ে ওরা বুঝতে পারে কোন কোন প্রাণী বুদ্ধিমান,’ বলল দ্বিতীয়জন। ‘ওরা সাহায্য করবে ঠিকই, কিন্তু আসল কাজটা আমাদেরই করতে হবে।

‘দীর্ঘ এক পথ,’ শেষমেশ তিনি বললেন, ‘মানবজাতি ও অন্যান্য বুদ্ধিমান প্রাণীদের জন্য এক মহৎ যাত্রা। আমাদের এখনই কাজ শুরু করতে হবে।’

‘বেশ,’ বলল তৃতীয় সহকারী। ‘তাহলে এখন আমরা কথা বলতে পারি।’

তিনজন সহকারী রাষ্ট্রপতির দিকে তাকাল।

তারপর তৃতীয় সহকারী নিজের কপাল থেকে আস্তে আস্তে মুখোশ খুলে ফেলল।

তার মাথার খুলি উন্মুক্ত হতেই দেখা দিল তার লম্বা কান আর পিঠ পর্যন্ত ছড়ানো সিল্কের মতো বোনা চুল। চোখের দৃষ্টিতে একধরনের জাদুকরী ঝলকানি, নতুন চেহারার সঙ্গে একেবারে মানানসই।

‘আমি,’ সে বলল, ‘আত্মগোপনে থাকা সকল এলভদের পক্ষ থেকে বলছি...’

মূল: রবার্ট ম্যাটিংলি

অনুবাদক: ফারহান মাহিন, শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন