বিজ্ঞান কল্পগল্প
পোকা
এসির কুলারে নাকি একগাদা ছোট ছোট তেলাপোকা ঢুকে শর্টসার্কিট...লাইনটা কেটে গেল। অনেকবার ট্রাই করেও সাবিলার ফোনের আর লাইন পেল না। সাবিলার বাসায় যাবে?
পৃথিবীর ৯৫ শতাংশ প্রাণী হচ্ছে পোকামাকড়।
তো?
তাদের সবার মস্তিষ্ক আর স্নায়ুতন্ত্র যদি একসঙ্গে হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাহলে বুঝতে পারছিস কী ঘটবে?
কী ঘটবে?
কী ঘটবে, তা আমরা চিন্তাও করতে পারব না। মোটকথা, মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে...এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
উফ্ফফ।
কী হলো?
তুই এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনা কোথায় পাস, বল তো?
দুই বন্ধু বন্ধের দিনে একটা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল পোকার আগ্রাসন নিয়ে সন্দেহবাদী বন্ধু সজল।
মামা, এসব কী চা বানান, মুখে দেওয়া যায় না?
ক্যান মামা, কী হইছে?
কী হইছে জানি না। তবে এইটা চা হয় নাই। ঘোড়ার পেচ্ছাপ এর চেয়ে ভালো।
চা-ওয়ালার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। সে তার চায়ের বদনাম নিতে পারে না, একেবারেই না। তার ইচ্ছা হচ্ছে দু-এক কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু এরা এই এলাকার ছেলেপেলে। থমথমে গলায় বলল, আচ্ছা, আরেক কাপ দিতাছি, এইটার লিকার মনে হয় বেশি হইছে।
থমথমে মুখ হয়েছে আরেকজনের। পোকাদের সম্মিলিত মস্তিষ্ক আর স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে রকিবুজ্জামান রকিব। সে কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে ৯৫ শতাংশ পোকার জগৎ মানবসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কাজে নেমে পড়েছে! সে প্রথম টের পেয়েছে, যখন তার অফিসের সব কটি পেস্ট কন্ট্রোল মেশিন একসঙ্গে অকেজো হয়ে গেল।
কি রে, চা খাবি না?
খাবো, একটু ঠান্ডা হোক।
সজল সিগারেট ধরিয়েছে, কী যেন বলছিলি পোকাদের নিয়ে?
নাহ্, সে রকম কিছু নয়।
তুই তোর এই পেস্ট কন্ট্রোলের অফিস ছাড়। আমার সঙ্গে আয়। আমাদের হেড অফিসে একজন লোক নেবে। তোকে ঢুকিয়ে দিতে পারব। ওই ডিপার্টমেন্টে আমার ভালো হোল্ড আছে। চল, আজই চল আমার সঙ্গে। তোর ফোনে সিভি আছে না? ওতেই চলবে। অফিস থেকে প্রিন্ট করে নেব। চল।
আরে বাবা বল না, পোকাদের ব্যাপারে আমারও ইন্টারেস্ট কম নয়। আচ্ছা, তোর পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবসা কেমন চলছে?
আমার পেস্ট কন্ট্রোলের আটটা মেশিন একসঙ্গে নষ্ট।
বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝতে পেরেছিস?
তোর পেস্ট কন্ট্রোলের আটটা মেশিন নষ্ট দেখে তোর মনে হয়েছে এসব পোকাদের কাজ...ওরা মানবসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেগে পড়েছে, তাই না?
না, আরও ঘটনা আছে।
কী ঘটনা?
আমরা নতুন মেশিন কিনতে গিয়েছিলাম গতকাল, স্টেডিয়াম মার্কেটে। ওরা বলল, ওদের সব মেশিনও একসঙ্গে নষ্ট! শুধু তা–ই নয়, ওরা সিঙ্গাপুরের যে কোম্পানি থেকে মেশিন আনে, তারাও বলেছে, ওদের সব মেশিনে নাকি ম্যালফাংশন হচ্ছে।
বলিস কী! এবার যেন প্রথম বন্ধুকে একটু চিন্তিত মনে হয়।
শোন, একটা কথা বলি।
বল।
তুই তোর এই পেস্ট কন্ট্রোলের অফিস ছাড়। আমার সঙ্গে আয়। আমাদের হেড অফিসে একজন লোক নেবে। তোকে ঢুকিয়ে দিতে পারব। ওই ডিপার্টমেন্টে আমার ভালো হোল্ড আছে। চল, আজই চল আমার সঙ্গে। তোর ফোনে সিভি আছে না? ওতেই চলবে। অফিস থেকে প্রিন্ট করে নেব। চল।
না।
তা যাবি কেন? বসে বসে পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। আমি গেলাম।
বন্ধু উঠে হন হন করে চলে যায়। মুখ ব্যাজার করে বসে থাকে রকিব।
মামা?
চা-ওয়ালার ডাকে সংবিৎ ফেরে রকিবের।
কিছু বলবা?
মামা, আপনার কথা সঠিক!
কোন কথা?
এই যে কইলেন পোকামাকড়ে পিত্থিবি ধ্বংস কইরা ফেলব, কথা কইলাম একদম সঠিক। রাইতে মামা মশার জ্বালায় ঘুমাইতে পারি না। আর তোশকে যে ছারপোকা হইছে...উফ্, এই দেহেন হাতে–পায়ে কামড়ায়া কী করছে...
বদলে ফেলার কারণটাও অদ্ভুত। একটা ফোন কোম্পানিতে ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে। ওই কোম্পানি ঘোষণা দিয়ে অফিস থেকে সব কাগজ, বইপত্র—সব সরিয়ে ফেলে। সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড অফিস।
চায়ের বিল দিয়ে শংকর বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল রকিব। ১০টায় সাবিলার আসার কথা। সাবিলাকে ফোন দিল।
হ্যালো সাবি, আসবা না?
আরে, আমাদের বাসার এসি
বার্স্ট করেছে।
কী বলছ! কীভাবে?
এসির কুলারে নাকি একগাদা ছোট ছোট তেলাপোকা ঢুকে শর্টসার্কিট...লাইনটা কেটে গেল। অনেকবার ট্রাই করেও সাবিলার ফোনের আর লাইন পেল না। সাবিলার বাসায় যাবে? কিন্তু ও কঠিনভাবে নিষেধ করে দিয়েছে, বাসায় তো নয়–ই...ভুলেও যেন ওদের পাড়ায় না যায়।
মন খারাপ করে কিছুক্ষণ ধানমন্ডি পার্কে বসে থাকল রকিব, তারপর বাসায় চলে এল। কয়েক বন্ধু মিলে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে। সাব্বির নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ল। তখনই টুং করে শব্দ হলো ফোনে। নিশ্চয়ই সাবিলা মেসেজ করেছে।
না, সাবিলার মেসেজ নয়। একটা সায়েন্টিফিক নিউজ পাঠিয়েছে কেউ হোয়াটসঅ্যাপে, নাকি মেসেঞ্জারে। ‘একধরনের নতুন উইপোকা বের হয়েছে, এরা লোহা–কংক্রিট সব সেকেন্ডের মধ্যে হজম করতে পারে...খুব সম্ভব ওরা মিউটেশন করে নিজেদের বদলে ফেলেছে! বদলে ফেলার কারণটাও অদ্ভুত। একটা ফোন কোম্পানিতে ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে। ওই কোম্পানি ঘোষণা দিয়ে অফিস থেকে সব কাগজ, বইপত্র—সব সরিয়ে ফেলে। সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড অফিস। সম্ভবত কিছু উইপোকা ছিল আগে থেকে, খাদ্যের অনুপস্থিতি বুঝতে পেরে তারা মিউটেশন করে নিজেদের বদলে ফেলতে শুরু করে ধীরে ধীরে...তারা এখন কংক্রিট–লোহা এসব দিব্যি হজম করতে পারে...ওই কোম্পানির বিল্ডিং এখন ঝুঁকির মুখে; বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনের অনেকখানি নাকি ওরা খেয়ে ফেলেছে!’
*
টুং করে আবার একটা শব্দ হলো। আরেকটা মেসেজ, এটা মেসেঞ্জারে। চীনের একটা মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লেগে সব পুড়ে ছাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই বিশেষ মার্কেটে শুধু পোকামাকড়, ফড়িং, চেল্লা—এসবের কুড়মুড়ে ভাজাভাজির দোকানে সয়লাব ছিল।
‘অ্যালগরিদম’ ফিসফিস করল রকিব! কয়েক দিন ধরে সে পোকামাকড় সম্পর্কে জানতে চাইছে, বুঝতে পেরে এখন তার কাছে র্যান্ডমলি এ ধরনের নিউজ আসা শুরু করেছে।
ফোন বন্ধ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল।
দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ল রকিব। ঘুমিয়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল। যেন কোটি কোটি পোকামাকড় তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে, তারা যেন ফিসফিস করে বলছে, ‘...মানব প্রজাতির সম্মিলিত ভর এখন আমাদের ভরের চেয়ে বেশি। এটা জীববৈচিত্র্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং আমাদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ...তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার...,’ কথাগুলো বলতে বলতে তারা এগিয়ে আসছিল রকিবের দিকে...গা ঘিন ঘিন করে উঠল ওর। প্রবল ঘৃণার একটা অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠল রকিব। বিছানায় বসে টের পেল, সে দরদর করে ঘামছে।
একসময় সত্যিই ঘুম ভাঙে রকিবের। সে অবাক হয়ে দেখে, তার পাশেই প্রায় গা ঘেঁষে সাবিলা। আরেক পাশে সজল...আরও পরিচিত কিছু মুখ, অচেনা অনেক মুখও দেখা যাচ্ছে, সেই চা-ওয়ালা মামাও আছে।
তখনই রকিব খেয়াল করল, তার ঘরের চার দেয়ালে গিজগিজ করছে লক্ষকোটি পোকামাকড়। এটা হতে পারে না! অসম্ভব! নিশ্চয়ই আমার ঘুম ভাঙেনি, আমি এখনো স্বপ্নের ভেতরেই আছি। নইলে এসব দেখছি কেন আমি! নিজেকে চিমটি দেয়। ব্যথা লাগে ঠিকই, কিন্তু ঘুম ভাঙে না। দেয়ালের পোকাগুলো মেঝেতে নেমে আসছে। তারা বিজবিজ শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসছে বিছানার দিকে। রকিব ড্রয়ার খুলে তার ছোট্ট ছুরিটা বের করে। চোখ বন্ধ করে পায়ের ঊরুতে ঢুকিয়ে দেয় ছুরির ছোট্ট, কিন্তু ধারালো ফলাটা! ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে...আমার ঘুমটা এখনই ভেঙে যাবে, এখনই ভেঙে যাবে...আমি এ জঘন্য স্বপ্ন থেকে জেগে উঠব...নিশ্চয়ই জেগে উঠব।’
একসময় সত্যিই ঘুম ভাঙে রকিবের। সে অবাক হয়ে দেখে, তার পাশেই প্রায় গা ঘেঁষে সাবিলা। আরেক পাশে সজল...আরও পরিচিত কিছু মুখ, অচেনা অনেক মুখও দেখা যাচ্ছে, সেই চা-ওয়ালা মামাও আছে। সবাই এ রকম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে কেন, কে জানে। হঠাৎ ওরা সবাই একসঙ্গে দুলে ওঠে। ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? কে জানে...রকিব তার ষোলো জোড়া পা দিয়ে সবুজ পাটাতনটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে!
কী গাছ এটা, কে জানে। গাছের পাতাগুলো বেশ বড় বড়। তার ওপর অনেকগুলো পোকা জড়াজড়ি করে আছে। হঠাৎ বাতাসে গাছের পাতাগুলো দুলতে শুরু করেছে!
