টানা টানা চোখ, মুখটা ডিমের মতো। চুলগুলো মনে হচ্ছে একপলকা মেঘ। যদি ছুঁই, বৃষ্টি হয়ে যাবে হাতে। মেয়েটির নাম দিয়েছি মেঘা। কিন্তু মনে মনে আমি তাকে বললাম, মেঘবতী কন্যা। মনে মনে বলা কথা মানুষই বোঝে না, মেঘার বোঝা একেবারেই অসম্ভব। তবু আমার ভাবার সময়, আমার চোখের আলোড়ন দেখেই কি না কে জানে, মেঘা হাসল মিষ্টি করে। বলল, ‘খুব মজার কিছু ভাবছ, না?’
এমনই তো চেয়েছিলাম আমি। ঠিক এমন একটা সঙ্গী। যে আমাকে আমার চেয়ে বেশি বুঝবে। আমাকে একটু আদর করবে, একটু চোখে চোখে রাখবে। বাসার গেটের সামনে দাঁড়ালে ভেতর থেকে দরজা খুলে দেবে। চোখ লাল থাকলে জিজ্ঞেস করবে, তোমার চোখ এত লাল কেন?
মেঘা বলল, ‘আবারও তুমি মনে মনেই ভাবছ। তোমার মনের কথা যদি বুঝতে না পারি, তাহলে কি আমার মার্ক কাটা যাবে?’
আমি বললাম, ‘প্রশ্নই আসে না। মনের কথা বোঝার মতো সফটওয়্যার তোমার ভেতর নেই।’
মেঘা বোধ হয় কিছুটা আহত হলো। বলল, ‘এ ধরনের কথা আমাকে কষ্ট দেয়। মনে হয়, আমি একটা যন্ত্রই শুধু।’
—তুমি যন্ত্র। কিন্তু যন্ত্রণা নও। তুমি সুন্দর। পৃথিবীতে সুন্দর কিছু কখনোই যন্ত্রণা হতে পারে না।
লজ্জা পাচ্ছে মেঘা। গালগুলো রক্তিম হয়ে উঠেছে। এতটাই যে আমার ভয় হলো, ভেতর থেকে না রক্ত বেরিয়ে আসে। দ্রুত বলে উঠল, ‘তুমি কি আমার এই বাদামি চোখ পছন্দ করছ? নাকি অন্য রকম কিছু চাও?’
‘আর কী আছে।।
কেবল কলেজে উঠেছি। হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতা। বুঝেই উঠতে পারছি না, কী করা দরকার। আজ লাইব্রেরিতে বসি তো কাল মাঠে ক্রিকেট। কিন্তু কোনোটাই যখন মনঃপূত হচ্ছে না, তখন ভর্তি হয়ে গেলাম কবিতায়।
রহস্যময় হাসি দিল মেঘা। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি কেমন চাও, বলো…আমার কাছে আছে এক লাখ রং!’
সুখেই কি না, কে জানে, আমার পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল। মেয়েটা এত কাছে। তার শ্বাস আমার কানের ওপর। আমার গলায়, মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে তার ঘ্রাণ। দমটাও যেন আটকে এল। মনে হলো, হৃৎপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দেবে।
মেঘা বলল, ‘তুমি কি আমাকে কিনবে না?’
আমি কোনোমতে বললাম, ‘কিনব। তোমাকে আমি অবশ্যই কিনব, মেঘা।’
মেঘা আমাকে জড়িয়ে ধরল হঠাৎ করেই। ঠিক সেভাবে, যেভাবে অনেক বছর আগে নীলা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওই একবারই। অথচ এত বছর পর, চাইলেই আমি নীলার স্পর্শটুকু অনুভব করতে পারি। সেই স্পর্শের শূন্যতাটুকু এত বছর যে বহন করে বেড়িয়েছি আমি…আজ মনে হলো, মেঘা তা পূরণ করে দিল। জড়িয়ে আমিও তাকে ধরলাম। তার চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে বুঝলাম, বৃষ্টির চেয়ে সুন্দর কিছু এই পৃথিবীতে আছে!
২.
প্রথম বা শেষ নয়, নীলা ছিল আমার একমাত্র প্রেম।
কেবল কলেজে উঠেছি। হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতা। বুঝেই উঠতে পারছি না, কী করা দরকার। আজ লাইব্রেরিতে বসি তো কাল মাঠে ক্রিকেট। কিন্তু কোনোটাই যখন মনঃপূত হচ্ছে না, তখন ভর্তি হয়ে গেলাম কবিতায়। মানে কবিতা আবৃত্তির উটকো এক ক্লাসে। ক্লাস করান কলেজের বাংলা শিক্ষক আফজাল জোবায়েদ। কী যে অদ্ভুত লোকটার কণ্ঠ! আবৃত্তি শুরু করলে মনে হয়, গুমগুম করে পানি পড়ছে কোথাও থেকে। মনে হয় মাটি ফুঁড়ে উদ্গত হচ্ছে শব্দরা। আমি প্রথমত লোকটার কণ্ঠের প্রেমে পড়লাম। তারপরই পড়লাম নীলার প্রেমে।
নীলাও আবৃত্তির ক্লাসে। নীলাও পাগলের মতো গিলছে আফজাল স্যারের কণ্ঠ। তাঁর মতো উচ্চারণ করে যাচ্ছে শামসুর রাহমান থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়—আমি তোমার পায়ের কাছে বেড়াল হয়ে বসে থাকি…
আমারও মনে হয়, আমি নীলার পায়ের কাছেই বসে আছি। তার ভেতরের কাঠবিড়ালিটাকে দেখব বলে…কিন্তু নীলা আমার দিকে দেখলে তো!
নীলার আগ্রহ আমার দিকে ফেরাতেই আমি শুরু করলাম কণ্ঠচর্চা। কী যে অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা…সকালে নিয়ম করে সা রে গা মা থেকে শুরু করে আইসক্রিম খাওয়া চিরতরে বন্ধ। কিন্তু গলায় কোনোভাবেই আফজাল স্যারের ভার আসে না। উচ্চারণে আসে না সেই দরাজ ভাব।
বিপদে পড়লে মানুষের খড়কুটো আকড়ে ধরার বিধি আছে। আমিও রফিককে আকড়ে ধরলাম। দিন যায় রাত যায়… আমি বসি শয্যায়… চোখে নিদ নাহি আসে, সখা হে…
অথচ ওদিকে নীলা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। একেকটা কবিতা আবৃত্তি করছে আর কবিতা তার সব মহিমা হারিয়ে নীলার কণ্ঠে ঝরে পড়ছে সংগীতের মতো। এরই মধ্যে দুয়েক দিন কথা বলার চেষ্টা করেছি নীলার সঙ্গে। লাভ হয়নি। গুরুত্বই দেয়নি। আমাকে দেখে বরং উল্টো তার হাঁটা, আমাকে দেখে তার উল্টো অন্য কারও সঙ্গে কথা বলা। যেন আমি বলে কিছু নেই। বা আমার মতো অচ্ছুত আর কিছু নেই।
রফিক বন্ধু ছিল, না শত্রু, জানি না। কিন্তু বুদ্ধিটা এল তার মাথা থেকেই। বলল, ‘আফজাল স্যারের মতো গলায় ভার আনতে দুইটা জিনিস লাগে। এক. অনেক দিনের সাধনা, যা তোর হওয়ার আগেই নীলা অন্য কারও হয়ে যাবে। দুই. রাত জাগা।’
থমকে যেতে হলো আমাকে। রাত জাগা? রাত জাগায় আবার কী হবে? আমি তো রাত জাগিই।
রফিক তড়াক করে বলল, ‘দুয়েকটা রাত জাগা না। রাতের পর রাত, দিনের দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা… একটানা ১০/১২টা রাত জাগলে দেখবি তোর গলা খড়খড়ে হয়ে গেছে। তখন কণ্ঠে পাবি অন্য রকম বেজ। কণ্ঠে যে তোর বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে, সেটা ধুয়েমুছে অন্য একটা ভাব নিয়ে আসবে!’
বিপদে পড়লে মানুষের খড়কুটো আকড়ে ধরার বিধি আছে। আমিও রফিককে আকড়ে ধরলাম। দিন যায় রাত যায়… আমি বসি শয্যায়… চোখে নিদ নাহি আসে, সখা হে…
সপ্তাহ খানেক একটানা রাত জাগার পর কণ্ঠে বেজ এল কিনা জানি না, কিন্তু বুকের ধড়ফড়ানি বাড়ল হাজার গুণ। সাথে একটানা ঝিমঝিমানি, বমি বমি ভাব…আর এসবের ভেতরেই দেখলাম, হেঁটে আসছে নীলা।
কীভাবে কখন নীলার সামনে দাঁড়িয়েছি, মনে নেই। নীলাকে দেখার পর থেকে নীলার সামনে চলে আসা পর্যন্ত আমি টোটাল ব্ল্যাকআউট। এদিকে আমাকে দেখেই নীলার ভ্রু কোঁচকানো। মুখে জিজ্ঞাসা, চোখে হতাশা। এক পাশে রেখে চলেই যাচ্ছিল সে আমাকে; চিৎকারটা আমিই দিলাম। রফিক তাতে দৌড়ে পালাল। নীলা দাঁড়িয়ে গেল থমকে। তাকাল অবিশ্বাসের সঙ্গে। আমি বললাম, তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে যে ভালোবাসি, তুমি জানো না?
অ্যানিমেশন ছবি হলে নীলার চোখ দুটো বেরিয়ে আসত কোটর থেকে। বাংলা সিনেমা হলে নীলা এসে একটা চড় বসিয়ে দিত গালে। কিন্তু যেহেতু এটা আমার জীবনের গল্প, তেমন কিছুই ঘটল না। ব্যাগ থেকে নীলা বরং পানির বোতল বের করে বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘পানিটা খাও। তুমি সম্ভবত কিছু খেয়েছ…তোমার চোখ এত লাল কেন?’
নীলার সঙ্গে সখ্য নয় এরপর, সরাসরি প্রেমই হয়ে গেল বোধ হয়। কিশোরীরা এ সময় ভুল করে। নীলার ভুল হলাম আমি। সে প্রথমে আমাকে মায়া করল। ভাবল, আহা রে ছেলেটা…আমার জন্য কত কিছুই না করছে! এই মায়াই পরে তার জন্য কাল হলো। পড়ল সে আমার ভালোবাসায়। সেই প্রেমকে উথালপাতালই বলা যায়। শহরে আমাদের কোথায় না পাওয়া যেতে লাগল! এই কফি শপ থেকে এই সংসদ ভবন! এই লাইব্রেরি তো এই টিএসসি! এই রমনা তো এই গুলিস্তান!
একটা লিফট আমাকে এরপর নিয়ে গেল নিচে। ওপরের আলোঝলমলে ব্যাপার থেকে ক্রমেই তা মৃদু হয়ে আসছে। যেন পাতালে নামছি। বলা যায়, অনন্তকাল ধরে নামছি। যখন মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে, তখনই থেমে গেল লিফটটা।
পুরো বছরটা কাটল কবিতার মতো। কবিতার সঙ্গে। আমি নীলাকে ডাকলাম মেঘবতী কন্যা। নীলা আমাকে ডাকল ডালিমকুমার। খুবই কাঁচা কাঁচা ব্যাপার। অন্যরা শুনলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাবে। কিন্তু আমাদের মনে তখন যে রং, তার সঙ্গে এসব খুবই মানানসই।
প্রেমটা আমাদের এরপর সারা জীবন থাকল। যদিও নীলা থাকল না। বছরখানেক পরই নীলারা চলে গেল অস্ট্রেলিয়ায়। পুরো পরিবার। তার বড় ভাই ওখানে কী কী সব শুরু করেছে। ফলে আমাদের প্রেমটাকে শেষ করতে হলো। নীলাও কাঁদল না, আমিও কাঁদলাম না। আমরা বিদায় নিলাম। আমরা বললাম, আমাদের যোগাযোগ হবে। কিন্তু নীলাও জানত, আমিও জানতাম—আমাদের আর যোগাযোগ হবে না!
হয়ওনি আমাদের আর যোগাযোগ। কোনো কারণ ছাড়াই ফেসবুকে নীলাকে আমি ব্লক করলাম, নীলা আমার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে মুছে গেল এরপরই। নিঃসীম যোগাযোগহীনতার ভেতর আমি আমার প্রেমটাকে বাঁচিয়ে রাখলাম, মেঘবতী কন্যার নামে।
৩.
বিজ্ঞাপনটা দেখলাম কিছুদিন আগে।
মেসেঞ্জারে একটা লিংক এল। আমি অ্যাকসেপ্ট করব কি না, জানতেও চাইল। লিংকটার ভেতর ঢুকে দেখলাম, দুনিয়া কতটা বদলেছে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই আমার। এআই–নির্ভর সঙ্গী তৈরি হয়ে গেছে এরই মধ্যে। সেই সার্ভিস এখন আমাদের দেশেও।
কৌতূহল মেটাতেই গিয়েছিলাম ওই মলে।
প্রথমে রেজিস্ট্রেশন, তারপর ফরম পূরণ, তারপর একটা টিউবের মতো রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হলো আমাকে। শুরু হলো প্রশ্ন। আমি কী পছন্দ করি, কোন গান শুনি, কোন খেলোয়াড়কে মনে করি সেরা—সব!
ঘণ্টাখানেক সওয়াল-জবাবের পর জ্বলে উঠল মেরুন রঙের এক আলো। জানা গেল, আমার পছন্দসই এক সঙ্গী রয়েছে এখানে। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী কি না?
পুরো বছরটা কাটল কবিতার মতো। কবিতার সঙ্গে। আমি নীলাকে ডাকলাম মেঘবতী কন্যা। নীলা আমাকে ডাকল ডালিমকুমার। খুবই কাঁচা কাঁচা ব্যাপার। অন্যরা শুনলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাবে।
এসবে কারই–বা আগ্রহ নেই? আমিও মাথা নাড়ালাম দ্রুত। এবার আমাকে চুক্তি করতে হলো। প্রথমত, ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হবে। ভাগ্যিস, ব্যাংকে কিছু টাকা ছিল। সে টাকা দিয়েই প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলানো গেল।
একটা লিফট আমাকে এরপর নিয়ে গেল নিচে। ওপরের আলোঝলমলে ব্যাপার থেকে ক্রমেই তা মৃদু হয়ে আসছে। যেন পাতালে নামছি। বলা যায়, অনন্তকাল ধরে নামছি। যখন মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে, তখনই থেমে গেল লিফটটা। খুলে গেল একটা ডিমের মতো দরজা। ওপারে পৌঁছাতেই দেখলাম, সে অপেক্ষা করছে। আমি যার নাম দিয়েছি মেঘা। কিন্তু যাকে আমি মনে মনে ডাকি মেঘবতী কন্যা বলে।
৪.
মেঘা এখন আমার সঙ্গে থাকছে। গল্প করছে, স্মৃতি হাতড়াচ্ছে, কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে। তাকে ট্রায়ালের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে নিয়ে আসা গেছে। যদি তাকে আমার পছন্দ হয়, তাহলে একটা মোটা অঙ্ক দিয়ে আমি কিনে ফেলতে পারি। মেঘা খুব করে চাইছে, তাকে যেন আমি কিনে নিই।
আমি কি মেঘাকে কিনে ফেলব?
মেঘা। যাকে আমি মনে মনে মেঘবতী কন্যা বলে ডাকি। এমন একজনকেই তো চেয়েছিলাম আমি। ঠিক এমন একটা সঙ্গী। যে আমাকে আমার চেয়ে বেশি বুঝবে। আমাকে একটু আদর করবে, একটু চোখে চোখে রাখবে। বাসার গেটের সামনে দাঁড়ালে ভেতর থেকে দরজা খুলে দেবে। চোখ লাল থাকলে জিজ্ঞেস করবে, তোমার চোখ এত লাল কেন?
নাকি আমি এখনো নীলার জন্য অপেক্ষা করব। যে হয়তো আর কখনোই ফিরে আসবে না!