জাতিস্মর
লোকনাথপুর হাটে মাছ বিক্রি করে মজিরদ্দি। অবস্থাটা ওর ভালো যাচ্ছে না ইদানীং। পুঁজি কম, বিক্রিবাট্টাও তাই কম। হাজারখানেক টাকা নিয়ে ফিরছে সে। অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে অবশ্য। রাতবিরেতে কী হয় না–হয়! কী আর হবে! নিজেকে প্রবোধ দিয়ে সাইকেলের পেডেলে দ্রুত পা চালায়। সামনে আরেকটা সাইকেল। একটু ধীরে চলছে।
‘আজিজ মিয়া নাকি?’ পরিচিত কেউ ভেবে স্বস্তির খোঁজে নেমে পড়ে মজিরদ্দি।
‘না ভাই। আমি ভিনগাঁর লোক।’
‘কোন গাঁর?’
‘একটু দূরে, কড়ইতলার।’
‘ওমা, সে তো বেশ দূর! তা কোন গাঁয় যাবা?’
‘জয়রামপুর।’
‘কার বাড়ি?’
‘মজিদ মিয়া। আমার দুলাভাই।’
‘কোন মজিদ, বটতলার মজিদ, নাকি ধলা মজিদ?’
‘বটতলার মজিদ।’
‘এই এলাকা ভালো না। রাস্তাঘাটে চোর-ডাকাতের উৎপাত। ভিনগাঁ থেকে এসেছ, কখন কী হয়, বলা যায়!’
‘জি, আপনি যদি একটু সঙ্গে নিতেন।’
‘সে তো নেবই। তবে এ রকম রাতবিরেতে এ এলাকায় এসো না।’
‘জি আচ্ছা…’ লোকটার সাইকেলের গতি আরও ধীর হয়। মজিরদ্দিও এগিয়ে যায়। তার মতো হতদরিদ্র লোকের জন্য অন্যের উপকার করার সুযোগ চট করে আসে না। অন্য গাঁয়ের বোকা একটা লোককে সাহায্য করতে পারছে, এটা ভেবেই পুলক অনুভব করে সে।
গল্প করতে করতে এগোচ্ছে দুজন। পারিবারিক কথা। বাঁশঝাড়ের কাছটায় জমাট অন্ধকার। হঠাৎ মজিরদ্দি গলায় হ্যাঁচকা একটা টান অনুভব করে। সাইকেল হাতছাড়া হয়। উল্টে ধড়াম করে পড়ে পেছনের দিকে। অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করে ফুসফুস। শব্দ করে চেঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কণ্ঠনালি আটকে গেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে থেমে যায় মজিরদ্দির শেষ স্পন্দনটুকুও।
দুই
আশ্চর্য, প্রডিজি! সত্যি নাকি! খবরটা হজম করতে জামিলের সময় লাগে। কিন্তু নাকচও করে দিতে পারে না। কারণ, লেখাটা ছাপা হয়েছে নেচার-এ। বাংলাদেশি বিস্ময়–বালক প্রমিত হাসান করেছে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার নতুন সমাধান। সমাধানটা এসেছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে। অর্থাৎ আইনস্টাইনের অধরা স্বপ্ন থিওরি অব এভরিথিংয়ের খুব কাছে পৌঁছে গেছে সে। এর জন্য স্ট্রিং থিওরির সাহায্য নেয়নি প্রমিত। মাত্র ১২ বছর বয়স ছেলেটার। যশোরের বেজপাড়ায় বাড়ি।
প্রমিত হাসানকে নিয়ে ফিচারটা লিখেছেন আশরাফ মাহমুদ। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। প্রমিত হাসানের গবেষণাপত্রটার পরই ছাপা হয়েছে তাঁর লেখাটা। প্রডিজি নিয়ে অনেক গবেষণামূলক তথ্য, তত্ত্ব ও ইতিহাসের মিশেলে উপাদেয় এক ফিচার লিখেছেন আশরাফ।
লোকটা কে? এমন পণ্ডিত একজন মানুষ, এত কাছে থাকেন, জামিল তাঁকে চেনে না! প্রমিত হাসান কি তাঁর হাতেই গড়া? দেখা করতে হচ্ছে। তবে প্রডিজি নিয়ে জামিলের মনে ধন্দ আছে। প্রডিজির খবর প্রায়ই আসে সংবাদমাধ্যমে। বেশির ভাগই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মেধাবী বাচ্চাদের অতি মেধাবী দাবি করা হয়। আবার কিছু মা–বাবা আছেন সাইকোপ্যাথ টাইপের। নিজের সন্তানদের জোর করে প্রডিজি বানানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। এতে আখেরে কোনো লাভ তো হয়ই না, বরং বাচ্চাটার শৈশবই ধ্বংস হয়।
‘সফু,’ নিজের স্মার্টফোনে বাস করা এআই রোবটকে নির্দেশ দেন জামিল, ‘গত পাঁচ-দশ বছরে প্রডিজি নিয়ে যত সংবাদ প্রচারিত হয়েছে সারা দুনিয়ায়, সব চেক করো। এর মধ্যে সত্যিকারে প্রডিজি বলে মনে হয় কয়টাকে জানাও। সম্ভব হলে আজ সন্ধ্যার মধ্যেই।’
‘ঠিক আছে, স্যার।’
তিন
‘সর্বনাশ!’
‘কী হলো, স্যার?’ সফু কথা বলে ওঠে।
‘নিউজটা দেখছ?’
‘ঠগির নিউজ?’
‘হুম! এই একবিংশ শতাব্দীতে মধ্যযুগীয় বর্বরতা!’
‘স্যার, আপনি কী অন্য কিছু ভাবছেন? নাকি এটা স্রেফ একটা অপরাধ, যার ধরনটা কেবল মধ্যযুগীয়? নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে?’
‘কোনো সম্ভাবনাই বাতিল করা যায় না, সফু। অন্তত আমি কোনো বিষয়কে সরলীকরণ করি না, সেটা তোমার অজানা নয়।’
‘জি, স্যার।’
‘ব্যাপারটার ওপর নজর রাখো।’
‘ওকে, স্যার।’
খবরটাতে নতুনত্ব আছে। কিন্তু পুলিশের মাথাব্যথা আছে বলে জামিলের মনে হয় না। একটা খুন। গাঁয়ের হাটের খুব সাধারণ এক মাছ ব্যবসায়ী, তার কাছে টাকাকড়িও তেমন ছিল না। সাইকেল ছিল, সেটা ছোঁয়নি হত্যাকারী। হাজারখানেক টাকা, একটা মুঠোফোন। ৯০০ টাকা দামের বাটন ফোন। সব মিলিয়ে দুই হাজার টাকার কম তার পকেটে।
‘খুনি সম্পর্কে তোমার ধারণা কী, সফু?’
‘স্যার, লোকটা শিক্ষিত, বইটই পড়ে। নইলে ঠগিদের কথা একালের সাধারণ মানুষ জানে না। সাধারণ ছিনতাইকারীর পক্ষে সম্ভব নয়, এ পদ্ধতিতে নরহত্যা করা।’
‘মোটিভ?’
‘শুধু টাকার জন্য খুন করেনি, স্যার। পুরোনো কোনো শত্রুতার জেরে খুন করেছে।’
‘হতে পারে। কিন্তু আমি অন্য একটা আশঙ্কা করছি। খুনি হয়তো সাইকোপ্যাথ। প্রাচীন একটা পদ্ধতি বেছে নিয়েছে খুনের জন্য। আরও খুন হতে পারে?’
‘সিরিয়াল কিলার?’
‘হুম, হয়তো মজিরদ্দি তার প্রথম শিকার। আরও খুন হওয়ার আগে থামাতে হবে ডেভিলটাকে?’
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন জামিল। গাড়িতে বসেই ড্রাইভারকে বললেন, ‘জয়রামপুর।’
চার
‘জামিল ভাই নাকি? কেমন আছেন? কত দিন পর?’ জামিলের ফোন পেয়ে উল্লসিত পুলিশের ডিআইজি।
‘গতকাল একটা খুন হয়েছে আমাদের এলাকায়। বাজারের এক মাছওয়ালা। কেস হয়েছে থানায়। কেসটা পুলিশ তদন্ত করছে। কিন্তু আমিও এটাতে যুক্ত হতে চাই। মানে আমি ইনভেস্টিগেট করব। থানার একজন এএসআই যদি আমাকে হেল্প করে, খুবই ভালো হয়।’
‘নিশ্চয়ই, আমি লোকাল থানায় ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সাধারণ ছিনতাই-খুনে আপনি নাক গলানোর মানুষ নন। নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে! সেটা কী, জামিল ভাই?’
‘যথাসময়ে বলব। তুমি সাহায্য করছ, এ জন্য ধন্যবাদ।’
পাঁচ
‘জামিল স্যার, আপনি? আমার বাড়িতে! কী সৌভাগ্য আমার!’
‘সৌভাগ্য বরং আমার। এত দারুণ কাজ করেছেন। ছেলেটাকে আবিষ্কার করলেন কীভাবে?’
‘প্রমিতের কথা বলছেন? আমার বোনের ননদের ছেলে। ওর বাবা পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মা গণিতের। ওর দাদা বিখ্যাত গণিতজ্ঞ কামরুল হাসান। আগের দুই পুরুষও কেউ গণিতে, কেউ পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। মায়ের গোষ্ঠীর অতীত ইতিহাসও একই রকম। সুতরাং ওই ফ্যামিলি থেকে একজন বাচ্চা গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানে এতটা মেধাবী হবে, সেটা আসলে অতটা আশ্চর্যের কিছু নয়। আমি শুধু ওর প্রতিভাটা বুঝতে পেরে নিজের কাছে এনে রেখেছিলাম।’
‘আপনি সহজাত প্রতিভায় বিশ্বাস করেন, মিস্টার আশরাফ।’
‘করি, আপনি করেন না?’
‘না।’
‘একজন বিজ্ঞানীর মুখে এ কথা শুনে আশ্চর্য হলাম। আপনার নিজের প্রতিভা কি পুরোটাই জন্মের পরে নিজের চেষ্টায় বিকশিত হয়েছে। জিনগত কোনো উত্তরাধিকারই পাননি?’
ঠিক আছে, স্যার।’ দরজা থেকে হাসেমের মুখ আড়াল হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত-সৌম্য এক বালক এসে হাজির। ফরসা, একহারা গড়ন। গলায় একটা রুপার চেন।
‘বংশগত কোনো প্রতিভা যদি বিকশিত হতো, তাহলে আমি হতাম অত্যাচারী চেয়ারম্যান কিংবা এমপি। অথবা দুর্ধর্ষ ডাকাত। কারণ, আমার পূর্বপুরুষদের কেউ ছিলেন অত্যাচারী জমিদার, তারও আগের জেনারেশন কুখ্যাত ডাকাত। বুঝতেই পারছেন…’
‘কিন্তু বংশগতিবিদ্যা কি মিথ্যে তাহলে? মেন্ডেল, ওয়াটসন, ক্রিক…?’
‘না, তবে তাঁদের কেউই কিন্তু প্রডিজি নিয়ে কোনো তত্ত্ব দাঁড় করাননি?’
‘তাহলে প্রমিতের উদাহরণটা কি মিথ্যে?’
‘ওর ব্যাপারটা সত্যিই আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে। অবিশ্বাস্য!’
‘কথা বলে দেখতে পারেন কিন্তু।’ বলে বেল চাপলেন। দরজায় একটা মুখ দেখা গেল। ‘হাসেম, প্রমিত আছে ল্যাবে, নাকি ঘুমাচ্ছে?’
‘আছে স্যার।’
‘ওকে ডাকো, বলো যে ডক্টর জামিল এসেছেন, ওর সঙ্গে কথা বলতে চান। ও তো আবার জামিল স্যারের মহাভক্ত।’
‘ঠিক আছে, স্যার।’ দরজা থেকে হাসেমের মুখ আড়াল হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত-সৌম্য এক বালক এসে হাজির। ফরসা, একহারা গড়ন। গলায় একটা রুপার চেন। একটা লকেট ঝুলছে, একটা পাখির মূর্তি, নিজের বাসার সঙ্গে যুক্ত। ঠিক লকেটের মতো হুবহু একটা শোপিস বসানো রয়েছে আশরাফ মাহমুদের টেবিলে।
প্রমিতের সঙ্গে জামিলের কথা হলো মিনিট দশেক। তৈরি ছেলে, কোথাও খুঁত নেই। সত্যিকারের প্রডিজি। জামিল ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, ‘কথা বলে ভালো লাগল। তুমি এখন আসতে পারো?’
‘কী মনে হলো, স্যার?’ আশরাফ মাহমুদের চোখে বিজয়ের দ্যুতি।
‘সত্যিকারের প্রডিজি। ধন্যবাদ, আপনাকে। এখন উঠি…’ বলে আবার পেছনে ঘোরেন জামিল। ততক্ষণে আশরাফ মাহমুদ উঠে দাঁড়িয়েছেন জামিলকে বিদায় দেওয়ার জন্য। জামিল টেবিল থেকে শোপিসটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘বাহ, এটা তো সুন্দর এবং আনকমন। একপাশের মেনডেলের ছবি।’
‘জি, এটা আনকমন, ভেনিস থেকে আনা।’
‘একটা ছবি তুলতে পারি এর। নিজের জন্য একটা আনাব।’
‘শিওর…’ বললেন বটে, কিন্তু আশরাফ মাহমুদের চোখে স্পষ্ট অসন্তোষ।
‘ধন্যবাদ।’ বলে বিদায় নিলেন জামিল।
‘পুরোনো কোনো শত্রু। আপনার স্বামী অনেক আগে এমন কিছু করেছিলেন, যে কারণে এত দিন পর হয়তো প্রতিশোধ নিয়েছে খুনি।’
ছয়
‘স্যার, আমি শাহরিয়ার শরীফ।’ বছর ত্রিশের আগন্তুক নিজের পরিচয় দেয়, ‘আমি মজিরদ্দি মার্ডার কেসের ইনভেস্টিগেটর। ওসি সাহেব আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন। ডিআইজি স্যার…’
‘বসুন, চা খান…’
‘স্যার, সত্যি বলতে কি, কেসটাকে আমরা অতটা গুরুত্ব দিইনি। সাধারণ ছিনতাই বলেই মনে হয়েছিল।’
‘আমারও তা-ই মনে হয়...চা এসে গেছে, নিন।’
শাহরিয়ার শরীফ নীরবে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। অপেক্ষা করে জামিলের পরবর্তী মন্তব্যের জন্য। ‘সাধারণ ছিনতাই এটা, কিন্তু আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে খুনের ধরনটা। এই যুগে কেউ ঠগির গামছা দিয়ে খুন…!’
‘সত্যি বলতে স্যার, এটাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবিনি।’
‘সমস্যা নেই, এ নিয়ে ভাবনা আমার। আপনি তদন্ত চালিয়ে যান। শুধু আমি যেভাবে বলব, সেভাবে করবেন। আমি নিজেও হয়তো স্পটে যাব।’
‘ঠিক আছে, স্যার। আপনার সঙ্গে কাজ করতে পারা তো আমার পরম সৌভাগ্য।’
‘আপনার স্বামীর কোনো শত্রু ছিল?’ মজিরদ্দির বউকে জিজ্ঞেস করে শাহরিয়ার শরীফ।
‘গরিব মানুষ, লোকের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ হয়তো হতে পারে। তাই বলে মেরে ফেলবে!’
‘পুরোনো কোনো শত্রু। আপনার স্বামী অনেক আগে এমন কিছু করেছিলেন, যে কারণে এত দিন পর হয়তো প্রতিশোধ নিয়েছে খুনি।’
‘এমন কিছুও তো শুনিনি।’
এ কথা গ্রামের কেউই বলতে পারে না। মজিরদ্দির বৃদ্ধা মা–ও মনে করতে পারেন না, ছেলের কোনো পুরোনো শত্রুর কথা। সুতরাং প্রতিশোধ থিওরি আপাতত বাদ দিয়ে খুনিকে খোঁজার কথা ভাবেন শাহরিয়ার শরীফ।
‘আপনার স্বামী মুঠোফোনটা কবে কিনেছিলেন?’ এবার জামিল প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
‘বছর দু–এক হবে?’
‘ফোনের সঙ্গে একটা বাক্স দেয়, ওটা আছে?’
‘না স্যার। আমার মেয়ে ওটা নিয়ে খেলত। কোথায় হারিয়ে ফেলেছে?’
‘কোন দোকান থেকে কিনেছিল জানেন?’
‘দামুড়হুদা থেকে। কিন্তু কোন দোকান থেকে, জানি না।’
‘রসিদ আছে।’
‘খুঁজে দেখতে হবে।’
ছোট্ট ঝুপড়িঘর, কাগজপত্র থাকার মতো একটাই জায়গা। চৌকির ওপর যে বিছানা পাতা, তার নিচে। কিন্তু কোনো রসিদ সেখান থেকে পাওয়া গেল না। মেয়ের বইপত্রের ভেতরও খোঁজা হলো। ফল একই।
‘ঠিক আছে, ওনার মুঠোফোন নম্বরটা দিন।’
‘আমি তো জানি নে, রফিকের নম্বরে সেভ করা আছে।’ বলে মজিরদ্দির স্ত্রী ভাসুরের ছেলেকে ডাকলেন। তার কাছ থেকে পাওয়া গেল নম্বরটা।
সাত
সফু ছয় প্রডিজির সন্ধান দিয়েছে। জার্মানি, মিসর, জাপান, ফ্রান্স, চীন, ইরানের ছয় কিশোর। এর মধ্যে দুজন বীজগণিতে, একজন টপোলজিতে, দুজন নিউক্লিয়ার ফিজিকস আর একজন চিত্রকলায় অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছে। সব কটিই এসেছে ২০১৮-এর পরে। বাংলাদেশি প্রডিজি প্রমিত তাদের সবার চেয়ে এগিয়ে। জামিল নির্দেশ দেন এদের সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নিতে। তারপর মুঠোফোনে তোলা শোপিসের ছবিটা ইনপুট দিলেন সফুকে। বললেন, ‘ছবিটা চেনা চেনা লাগছে, ইন্টারনেটে সার্চ দাও। যেখান থেকে পারো বিস্তারিত জানাও। প্রয়োজনে ডার্ক ওয়েবেও খোঁজ নিয়ো।’
একসঙ্গে দুটো রহস্যের পেছনে ঘুরছেন জামিল। সম্ভবত দুটোতে কোনো সম্পর্ক আছে। আপাতত ভাবছেন বিশপ হাউসের লোগোটা নিয়ে। এর সঙ্গেই–বা বিজ্ঞানের সম্পর্ক কী? যাজকদেরই–বা সম্পর্ক কোথায়? লোগোর একটা অর্থ থাকতে হয়। বাসা মানে হাউস, ঠিক আছে। তাহলে বাবুই মানে কি যাজক? বাবুইয়ের ইংরেজি নাম ওয়েভার বার্ড। বিশপ, যাজক…! ফোনটা তুলে নিলেন। গুগলে সার্চ দিয়েই পেয়ে গেলেন উত্তর। বাবুই পাখির ইংরেজি ওয়েভার বার্ড। কিন্তু বিকল্প নাম বিশপ! মানে বিশপ হাউস মানে বাবুইয়ের বাসা!
তার মানে যাজক সংগঠন না–ও হতে পারে। হতে পারে স্রেফ এমন একটা সংগঠন, যার সদস্যরা নিজেদের বাবুই পাখি মনে করে। বা বাবুই পাখি হতে চায়। যারা আবার মেন্ডেলকে আদর্শ মানে। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় জামিলের কাছে। সর্বনাশ! এক্ষুনি থামাতে হবে দানবগুলোকে, নইলে প্রমিতের মতো মেধার জন্ম হবে ঠিকই, কিন্তু আস্তাকুঁড় থেকে বেরিয়ে আসবে ঠগির মতো কুখ্যাত পেশাগুলোও।
জামিলের কপালে ভাঁজ। কী যেন চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। নামটা শুনলে মনে হয় পাদরি সংগঠন। কিন্তু লোগোটা মোটেও পাদরিদের সঙ্গে যায় না। আবার মেন্ডেলের ছবি।
আট
‘স্যার, একটা সংগঠনের লোগো, স্যার।’ ঘণ্টা ছয়েক পর জানায়, ‘বিশপ হাউস নাম। যাজকদের কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পারে। একটা কয়েন পেয়েছি, দেখুন স্যার।’
একটা কয়েনের ছবি ভেসে ওঠে মুঠোফোনের পর্দায়। বাবুই পাখির লোগোটা খোদাই করা। জামিল ডানে স্ক্রল করলেন। আরেকটা ছবি ভেসে ওঠে পর্দায়। কয়েনের উল্টো পিঠ, জোহান মেন্ডেলের ছবি খোদাই করা সেখানে।
‘যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে,’ সফু বলে, ‘২০১৫ ব্রিটেন আর অস্ট্রেলিয়াতেও নিষিদ্ধ হয়। আরও খোঁজ নিচ্ছি, স্যার।’
জামিলের কপালে ভাঁজ। কী যেন চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। নামটা শুনলে মনে হয় পাদরি সংগঠন। কিন্তু লোগোটা মোটেও পাদরিদের সঙ্গে যায় না। আবার মেন্ডেলের ছবি। মেন্ডেল নিজেই একাধারে যাজক, আবার বিজ্ঞানী। বংশগতিবিদ্যার জনক। অর্থাৎ পাদরিদের কোনো সংগঠন, যারা বিজ্ঞানচর্চা করে। কোন ধরনের বিজ্ঞান, যার জন্য নিষিদ্ধ হতে হয়? মানব ক্লোনিং অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। কিন্তু একটা যাজক সংঘ মানব ক্লোনিং করবে? জামিল দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। তখন শাহরিয়ার শরীফ হাজির।
‘স্যার, মজিরদ্দির ফোনটা ট্রেস করতে পেরেছি। বাস্তুপুরের এক লোক কিনেছে। তবে সাসপেক্টের কাছ থেকে নয়, দামুড়হুদার মায়ের দোয়া ইলেকট্রনিকস থেকে। দোকানের মালিক ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র ঠিক করে। নতুন-পুরোনো মুঠোফোনও বিক্রি করে। গত পরশু কেনে ফোনটা। লম্বা, হালকাপাতলা গড়নের এক লোক ফোনটা বিক্রি করতে এসেছিল। লোকটার বাড়ি নাকি কড়ইতলায়। জয়রামপুরে এসেছিল কী একটা কাজে। ফেরার পথে নাকি পকেটমার টাকাপয়সা সব নিয়ে পালিয়েছে। বাড়ি ফেরার জন্য টাকা দরকার। চার শ টাকা দিয়েছে দোকানদার। আরও কম দিতে চেয়েছিল চোরাই ফোন বলে। কিন্তু লোকটা কিছুতেই এর চেয়ে কমে বিক্রি করতে রাজি হয়নি। দোকানদার তখন নিশ্চিত হয়, চোরাই ফোন নয়, আসলেই বিপদে পড়ে বিক্রি করছে।’
‘চলুন,’ বলে জামিল হঠাৎ উঠে দাঁড়ান।
ইন্সপেক্টর শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করেন, ‘দামুড়হুদায়?’
‘মায়ের দোয়া ইলেকট্রনিকসে...রশিদ, গাড়ি বের করো।’
মোটরবাইকের স্টার্টারে চাপ দেয় শাহরিয়ার শরীফ। পাঁচ মিনিটও সময় নেয়নি জামিলের ড্রাইভার রশিদ। জামিল গাড়িতে উঠে বসেন। ফোনটা হাতে নিয়ে সফুকে তলব করেন, ‘সফু, মাস ছয়েক আগে তোমাকে বলেছিলাম, ফরেনসিক আর্টটা শিখে নিতে। সেটার অগ্রগতি কেমন?’
‘স্যার, আমি কিছু টুল নামিয়ে চেষ্টা করেছি। একটা অ্যাপও বানিয়েছিলাম। আমার ধারণা, যেকোনো ফরেনসিক আর্টিস্টের চেয়ে এখন আমার দক্ষতা অনেকটাই বেশি।’
‘ঠিক আছে, একটা পরীক্ষা হয়ে যাক।’
দামুড়হুদার মায়ের দোয়া ইলেকট্রনিকসে
‘আপনি কিনেছিলেন ফোনটা?’
‘জি স্যার।’
‘সিসি ক্যামেরা আছে আপনার দোকানে?’
‘না স্যার।’
‘আশপাশের কোনো দোকানে?’
‘এই এলাকায় সব ছোট দোকান। কারও সিসি ক্যামেরা নেই।’
‘চেহারাটা কেমন বলুন, যতটা সম্ভব বিস্তারিত বলবেন?’
লোকটার বর্ণনা রেকর্ড করে সফু।
‘আর কেউ ছিল তখন আপনার দোকানে?’
‘এই যে, ও ছিল। দোকানের একজন কর্মচারীকে দেখিয়ে বলে লোকটা।’
‘আর কেউ?’
‘মনে করে দেখি…’ বলে কিছুক্ষণ ভাবে। আরও দুজনের নাম মনে করে। জামিল বলেন, ওই দুজনের নাম–ঠিকানা দিতে। আর সফুকে বলেন তাদের প্রত্যেকের বর্ণনা রেকর্ড করতে। সব বর্ণনা মিলিয়ে একটা ছবি যেন দাঁড় করায়। ঘণ্টা তিনেক সময় চেয়ে নেয় সফু।
‘শিখল কীভাবে ওরা বাসা বানানো? সাধারণ মানুষ মনে করে মায়েদের কাছ থেকে দেখে শেখে। আসলে কিন্তু তা নয়। শুধু বাবুই নয়, যেকোনো পাখির ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি।
নয়
মজিরদ্দির ঘাতকের একটা ডিটেইল স্কেচ তৈরি করেছে সফু। ঢ্যাঙা কালো একটা লোক। তবে চেহারা আর চোখ দেখেই বোঝা যায়, গায়ে শক্তি ধরে।
ডিআইজিকে একটা ফোন দিলেন জামিল। খুলে বললেন সব ঘটনা। ঘাতকের স্কেচটা পাঠালেন ই–মেইলে। বললেন, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া—এই চার জেলার সব কটি লোকাল থানাকে যেন অ্যালার্ট করেন। এই লোকটাকে ধরা চাই।
আরেকটা সাহায্য চাই তাঁর। সিসিটিভির ছবি দরকার। যশোরের। বিজ্ঞানী আশরাফ মাহমুদের বাড়ির। ব্যাপারটা রিস্কি। সারা দুনিয়ায়, সারা দেশে লোকটা রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছেন। পুলিশ চাইলেই গিয়ে তাঁর কাছে সিসিটিভির ফুটেজ চাইতে পারে না। সুতরাং ছলনার আশ্রয় নিতে হলো পুলিশকে। বলতে হলো, কুখ্যাত এক লোক তাঁর পিছু নিয়েছে। তাঁর বাড়ির ওপর নজর রাখছে। লোকটাকে ট্রেস করতে না পারলে বিপদে পড়তে পারেন আশরাফ মাহমুদ। নিজের স্বার্থেই তাই সিসিটিভির ফুটেজ দিতে বাধ্য হলেন। গত এক মাসের আগের কোনো ভিডিও সার্ভারে নেই।
এত রাত সাধারণত জামিল জাগেন না। কিন্তু জাগতে বাধ্য হয়েছেন আজ। ডিআইজি এক মাসের কয়েক শ ভিডিও ফাইল পাঠিয়েছেন। জামিল সেগুলো ঘাঁটতে লাগিয়ে দিয়েছেন সফুকে। সফু বেশি সময় নেয়নি। ফেস রিকনিগেশন টুল ব্যবহার করে আধঘণ্টার মধ্যে ভিডিও থেকে বের করে দিয়েছে মজিরদ্দির ঘাতকের ছবি। স্কেচের সেই ছবির সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। ১১ জুলাই শেষবার আশরাফ মাহমুদের বাড়িতে দেখা গেছে ঘাতককে। বিকেল তিনটা তেইশে। লোকটা বেরিয়ে যাচ্ছে ধীর পায়ে। পরনে পুরোনো একটা লুঙ্গি আর জড়ানো একটা জামা গায়ে। কোনো তাড়াহুড়া বা উত্তেজনা নেই। পরদিন রাতেই সে ৮০ কিলোমিটার দূরের এক মাছ ব্যবসায়ীকে খুন করছে। অর্থাৎ জামিলের অনুমানই ঠিক। বিশপ হাউস নামে গুপ্ত সংগঠনের হয়ে কাজ করছেন আশরাফ মাহমুদ। এরাই বিশ্বব্যাপী প্রডিজিদের তৈরি করছে। জানালেন সে কথা সফুকে।
‘কিন্তু স্যার, বাবুই পাখির ব্যাপারটা বুঝলাম না।’
‘দ্যাখো সফু, বাবুই পাখি বিখ্যাত কেন?’
‘ওদের বাসার জন্য। শিল্পী পাখি ওরা।’
‘শিখল কীভাবে ওরা বাসা বানানো? সাধারণ মানুষ মনে করে মায়েদের কাছ থেকে দেখে শেখে। আসলে কিন্তু তা নয়। শুধু বাবুই নয়, যেকোনো পাখির ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। ছানা বড় হলে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে না। কিন্তু নিজেদের ডিম পাড়ার সময় হলে ঠিকই বানিয়ে ফেলে বাসা। যে পাখি যে রকম বাসা বানায়, তার ছানারাও বড় হয়ে একই রকম বাসা বানায়। না দেখেই বানায়। কারণ, বাসা কীভাবে তৈরি করতে হবে, সে কৌশলটা থাকে ওদের জিনের ভেতরে।’
‘মানুষই শুধু ব্যতিক্রম, তা–ই তো স্যার।’
‘হ্যাঁ, মানুষের জিনে পূর্বপুরুষদের বিশেষ দক্ষতার এই তথ্য থাকে না বা থাকলেও সেটা জাগ্রত নয়। কিন্তু সব প্রাণীর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেটা জাতিস্মর দাবি করা মানুষের পূর্বজন্মের স্মৃতির মতো।’
‘এই প্রডিজিরা কি জন্মেছেই পূর্বপূরুষদের গাণিতিক ও শৈল্পিক দক্ষতা নিয়ে।’
‘বুঝতে পারছি না। জন্মের পরও ওদের জিন পাল্টে দেওয়া হতে পারে। তবে বুঝতে পারছি, বিশপ হাউস সংঘটা কোনো ভয়াবহ মিশনে নেমেছে। নতুন নতুন প্রডিজির জন্ম দিচ্ছে, কিন্তু এটা করতে গিয়ে কতগুলো ঠগি, ডাকাত বা ভয়ংকর মানুষের জন্ম হচ্ছে, কে জানে?’
জামিল ডিআইজিকে আবার ফোন দিলেন। সবকিছু খুলে বলতে হবে তাঁকে।