দ্য এলিয়েন মাইন্ড

গভীর ঘুমের ভেতর থেটা চেম্বারের নিস্তব্ধতা ভেদ করে একটা ক্ষীণ সুর আর যান্ত্রিক গলার শব্দ শুনতে পেল—‘পাঁচ মিনিট।’

‘ঠিক আছে।’ সে ঘুম থেকে উঠে চোখ খোলে। শব্দ বের করতেও কষ্ট হলো। নিজের স্পেসশিপের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে সে। হাতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে শিপের কোর্স অ্যাডজাস্ট করার জন্য। মাঝেমধ্যে অটো কন্ট্রোল সিস্টেম বিগড়ে যায়। তার কি কোনো ভুল হয়েছে? হতে পারে না। সে ভুল করেনি। অবশ্যই না। কিন্তু আজ, টলতে টলতে সে কন্ট্রোল মডিউলের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল, নরম্যানও জেগে উঠেছে। বিড়ালকে তার সঙ্গী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। ধীরভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, মজা করে খেলছিল একটা কলম নিয়ে, যা কোনোভাবে আলগা হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত, ভাবল বেডফোর্ড।

‘আমি ভাবছিলাম তুই আমার মতো ঘুমাচ্ছিস।’ শিপের কোর্স পড়তে পড়তে সে বলল। সাইরেসের দিকে প্রায় পাঁচ পারসেক ভুল পথে আছে সে। এর ফলে তার যাত্রাকাল এক সপ্তাহ বেড়ে যাবে। কঠোর মনোযোগ দিয়ে কন্ট্রোলটা রিসেট করল। তারপর গন্তব্য জানিয়ে মেকনোস থ্রিতে অ্যালার্ট সিগন্যাল পাঠাল।

‘সমস্যা?’ মেকনোসিয়ান অপারেটর জানতে চাইল। কণ্ঠটা ছিল শুষ্ক ও ঠান্ডা, এই ক্যালকুলেটিং মেনোটোন সব সময় বেডফোর্ডকে সাপের কথা মনে করিয়ে দেয়।

সে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল। ‘ভ্যাকসিনগুলো আমাদের দরকার,’ মেকনোসিয়ান জানাল। ‘যতটা সম্ভব সঠিক পথে থাকার চেষ্টা করুন।’

আরও পড়ুন

কন্ট্রোল মডিউলের ওপর ভাসছিল বিড়ালটা, নাম নরম্যান। বিড়ালটা একটা থাবা বাড়িয়ে বাটন টিপল। বিপ বিপ দুটো সূক্ষ্ম শব্দ তুলে অ্যাকটিভেট হয়ে গেল। শিপটা গতিপথ পরিবর্তন করল। বদলে গেল গতিপথ।

‘তুই এ কাজ করেছিস!’ চিৎকার করল বেডফোর্ড,

গলায় অবিশ্বাস।

‘এলিয়েনের সামনে আমাকে অপদস্থ করলি! ওর এলিয়েন মনে আমার বোকামি প্রকাশ করে দিলি!’ বিড়ালটাকে খপ করে ধরে ফেলল সে। তারপর চটকাতে থাকল।

‘অদ্ভুত শব্দটা কিসের?’ মেকনোসিয়ান অপারেটর জানতে চাইল। ‘কান্নার শব্দ মনে হচ্ছে।’

‘কান্নার শব্দ নয়। ভুল শুনেছ।’ বেডফোর্ড শান্ত গলায় জবাব দিল। রেডিও বন্ধ করে দিয়ে বিড়ালটাকে নিয়ে শিপের ট্রাস স্ফিঞ্চটারের দিকে এগোল সে। তারপর বিড়ালটাকে বাইরে ফেলে দিল।

একটু পর থেটা চেম্বারে ফিরে সে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল।

এখন আর কেউ নেই, যে তার কন্ট্রোলে হস্তক্ষেপ করবে। শান্তির এক ঘুম দিল সে।

মেকনোস থ্রিতে তার শিপটা যখন ডক করল, এলিয়েন মেডিকেল টিমের প্রধান তাকে এক অদ্ভুত অনুরোধ জানালেন। ‘আমরা আপনার পোষা প্রাণীটিকে দেখতে চাই।’

‘আমার কোনো পোষা প্রাণী নেই।’ বেডফোর্ড বলল। ‘সত্যি বলছি।’

‘কিন্তু আপনার আগের মেনিফেস্ট ফাইলের তথ্যানুযায়ী...’

‘সেটা আপনাদের বিষয় নয়।’ বেডফোর্ড বলল, ‘আপনাদের ভ্যাকসিন বুঝে নিন, আমি আবার উড়াল দিতে চাই।’

মেকনোসিয়ান বলল, ‘আমাদের কাছে সব প্রাণের নিরাপত্তাই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আপনার শিপটা পরীক্ষা

করে দেখব।’

‘একটা বিড়ালের জন্য এটা ঠিক নয়।’ বেডফোর্ড বলল।

আরও পড়ুন

তাদের পরীক্ষা ফলপ্রসূ হলো। অস্থির হয়ে বেডফোর্ডকে দেখছিল এলিয়েনরা। তার শিপের প্রতিটি এবং প্যাসেঞ্জারদের লকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল। দুর্ভাগ্যবশত মেকনোসিয়ানরা ১০ বালতি বিড়ালের খাবার খুঁজে পেল। এরপর তাদের মধ্যে নিজস্ব ভাষায় একটা দীর্ঘ আলোচনা শুরু হলো।

‘আমি কি ফিরে যাওয়ার অনুমতি পেতে পারি?’ বেডফোর্ড কর্কশ গলায় জিজ্ঞাসা করল। ‘পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে। আমার শিডিউল খুব টাইট।’ এলিয়েনরা কী ভাবছে, কী বলছে, তা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়; সে শুধু তার নিঃশব্দ থেটা চেম্বারে ফিরে গিয়ে গভীর একটা ঘুম দিতে চাইছিল।

‘তোমাকে আগে ডিক্লারেশন প্রসিডিউর শেষ করতে হবে।’ মেকনোসিয়ান মেডিকেল অফিসার বলল। ‘যাতে কোনো জীবাণু অথবা ভাইরাস…’

‘বুঝতে পারছি।’ বেডফোর্ড বলল। ‘তাহলে শুরু করা যাক।’

ডিক্লারেশন প্রসিডিউর শেষ হয়ে গেলে সে শিপে ফিরে এল। স্টার্ট দিতে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময় রেডিও সরব হয়ে উঠল। সেই মেকনোসিয়ান অথবা অন্য একজন; বেডফোর্ডের কাছে সবাইকে দেখতে একই রকম লাগে। মেকনোসিয়ান জিজ্ঞাসা করল, ‘বিড়ালটার নাম কী ছিল?’

‘নরম্যান,’ বেডফোর্ড বলল। সঙ্গে সঙ্গে ইগনাইট সুইচে চাপ দিল সে। তার শিপ ঊর্ধ্বাকাশে উড়াল দিল, মুখে ফুটে উঠল হাসি। কিন্তু সেই হাসি মিলিয়ে গেল, যখন দেখল তার থেটা চেম্বারের পাওয়ার সাপ্লাই মিসিং। আরও হাসতে পারল না, যখন দেখল ব্যাকআপ ইউনিটও নেই।

আমি কি এটা আনতে ভুলে গেছি? নিজেকে প্রশ্ন করল। না, তা সম্ভব নয়। আমি এমনটা করব না। নিশ্চয়ই ওরা নিয়ে গেছে।

টেরায় পৌঁছাতে দুই বছর লাগবে। দুই বছর পূর্ণ সচেতন থাকা, ঘুম বাদ দিয়ে; দুই বছর বসে থাকা বা ভাসমান থাকা কিংবা যেমনটা সে সামরিক প্রস্তুতির হোলো ফিল্মে দেখেছিল—এক কোনায় গুটিয়ে থাকা; সম্পূর্ণ উন্মাদ অবস্থা!

মেকনোস থ্রিতে ফিরে যাওয়ার জন্য জরুরি সংকেত পাঠাল। না, কোনো সাড়াশব্দ নেই।

কন্ট্রোল মডিউলে বসে শিপের কম্পিউটারটি চালু করল। ‘আমার থেটা চেম্বার কাজ করছে না। মনে হয় স্যাবোটাজ করা হয়েছে। আগামী দুই বছর কী করব, তোমার পরামর্শ কী?’

‘জরুরি মনোরঞ্জন টেপ আছে।’

আরও পড়ুন

‘ঠিক।’ তার মনে পড়ল। ‘ধন্যবাদ।’ ঠিক বাটনে চাপ দিল, এর ফলে টেপ কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে গেল।

কোনো টেপ নেই। আছে শুধু একটি বিড়ালের খেলনা—একটি ছোট পাঞ্চিং ব্যাগ..., এটা নিশ্চয়ই নরম্যানের জন্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাকে দেওয়ার সুযোগই হয়নি। এ ছাড়া…তাক খালি।

এলিয়েন মন রহস্যময় ও নির্মম, বেডফোর্ড ভাবল।

শিপের অডিও রেকর্ডার চালু করল। শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আগামী দুই বছর আমি নিয়মিত রুটিনের ওপর নির্ভর করে কাটাব। প্রথমত, খাবারের ব্যবস্থা। আমি যথাসম্ভব সময় নিয়ে খাওয়ার পরিকল্পনা করব, রান্না করব, খাব আর সুস্বাদু খাবার উপভোগ করব। এ সময়ে আমি বিভিন্ন ধরনের খাবার খেয়ে দেখব।’

অস্থিরচিত্তে উঠে সে এগিয়ে গেল বিশাল খাবারের স্টোরেজ লকারের দিকে।

টাইট করে আটকানো লকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে চোখ বন্ধ করে ভাবল, সারি সারি একই রকম স্ন্যাকসের প্যাকেটে ঠাসা। কিন্তু দুই বছরের খাবার জমা আছে, এটা ঠিক; তবে সবই বিড়ালের খাবার। ভিন্নতা আছে প্যাকেটে। সবই কি একই স্বাদের?

হ্যাঁ, সবই এক স্বাদের।

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত