ব্যাগ নিয়ে আবার দরজির দোকানে গেলাম। খুব বিরক্তি লাগছিল। কাউন্টারে সেই আগের লোকটা বসে আছে।
‘আপনি আমাকে ভুল ব্যাগ দিয়েছেন,’ বিরক্তি চেপে রেখে বললাম। ব্যাগের দিকে তাকিয়ে লোকটার মুখের ভাব কেমন যেন বদলে গেল। মনে হলো যেন বেটা খানিক ঘাবড়ে গেছে। এমনটা যে হবে, আগেই আন্দাজ করেছিলাম।
‘আমি আসলে খুব দুঃখিত,’ কোনোমতে বলল সে, ‘ভুল হয়ে গেছে।’
কেমন যেন উদ্ভট দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। মেকি একটা হাসি লেগে আছে তার মুখে।
‘তা তো বটেই, আমি ব্যাগটা খুলে দেখেছি।’
লোকটার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল মুহূর্তে। লোকটার বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, চোখে ভারী চশমা। কেমন রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে।
তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আপনি খুলেছেন?’
‘হ্যাঁ, খুলেছি তো।’
‘কী দেখলেন?’ কেমন যেন ঝাঁজালো স্বরে প্রশ্ন করল সে।
‘একটা বেশ বড় সোয়েটার আর তাতে পাঁচটা হাত!’
‘হয়তো কেউ মজা করে এমন সোয়েটার বানাতে দিয়েছিল?’
‘এমন উদ্ভট মজা কে করবে?’
‘আসেনি, না?’ কেমন যেন রহস্যময়ভাবে হেসে উঠল ভদ্রলোক। ‘আমার মনে হয় কেউ বিশেষ উদ্দেশ্যে আপনার দোকানে এমন কাপড় বানাতে দিয়েছে। তারা কারা?’
‘তাহলে হয়তো আমাদের দরজি ভুল করেছে।’
‘প্রথমে আমিও ওটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’
‘শুধু সোয়েটারটাই যে আজব, তা নয়।’
‘আরও কিছু আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ, একটা উদ্ভট আকারের গেঞ্জি, তারপর এক পা–ওয়ালা পায়জামা। এগুলোর অর্থ কী?’
‘হয়তো বিকৃত দেহের কোনো মানুষের জন্য বানানো হয়েছে। এমন কোনো মানুষ, যার পাঁচটা হাত আর একটা পা, হতেই তো পারে এমন!’
‘দেখুন, আমাদের শহরটা ছোট। মোটামুটি সবাইকে চিনি। সে রকম কেউ এলে মোড়ে মোড়ে আলোচনা হতো, খবরের কাগজগুলোও লেখার উপকরণ পেয়ে যেত।’
‘তা–ও কথা…আচ্ছা, সার্কাস দলের কোনো জোকারের কাপড়ও তো হতে পারে?’
‘অসম্ভব, শহরে বা আশপাশে কোনো সার্কাস দল আসেনি। এলে জানতে পারতাম।’
‘আসেনি, না?’ কেমন যেন রহস্যময়ভাবে হেসে উঠল ভদ্রলোক।
‘আমার মনে হয় কেউ বিশেষ উদ্দেশ্যে আপনার দোকানে এমন কাপড় বানাতে দিয়েছে। তারা কারা?’
‘হুম…ঠিক আছে, শুনতে যখন চাইছেন তখন শুনুন।’
চেয়ে রইলাম আমি। কেমন যেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলতে লাগল ভদ্রলোক।
‘অ্যালমার নামে একটা গ্রহ আছে, জানেন? অন্য এক অদ্ভুত সৌরজগতে…’
‘এ আবার কেমন কথা!’ থামিয়ে দিলাম তাকে, ‘এমন গ্রহের নাম জীবনেও শুনিনি!’
‘তার কারণ আছে। মহাকাশের যে অঞ্চলে ওই গ্রহের অবস্থান, সেটা আপনাদের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দুরবিন দিয়েও দেখা যায় না। ওখানকার পুরো সৌরজগতের শাসনকর্তা একজন অত্যাচারী একনায়ক। তার অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ। কারও নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করার ক্ষমতা নেই, প্রতিবাদ তো দূরের কথা…’
‘অসাধারণ!’ হাসতে লাগলাম আমি।
আমার কথায় কান না দিয়ে সে বলে যেতে লাগল, ‘অ্যালমারের পুরুষেরা দেখতে পৃথিবীর মানুষের মতোই। যা একটু পার্থক্য আছে, সেটা আমাদের প্রযুক্তি দিয়ে ঢেকে ফেলা যায়। তবে সমস্যা হলো মেয়েদের নিয়ে, তাদের চেহারা একদমই পৃথিবীর নারীদের মতো নয়। প্রযুক্তি দিয়েও তা ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে না।’
‘আচ্ছা, আপনি ওই গ্রহ থেকেই এসেছেন বুঝি?’
ঠিকই বলেছে লোকটা। আমাদের গুপ্তচর বাহিনী সদা সতর্ক। আমাদের মতো পেশাদারদের সামনে এই দুই দিনের বিপ্লবীরা টিকতে পারে?
‘ওই শয়তান একনায়ককে সবাই ভয় পায়, তবে তারপরও একটা গোপন আন্দোলন হুট করে শুরু হলো। সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষ তাতে যোগ দিল। কিন্তু ওই সৌরজগতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আমরা ঠিক করলাম, বহুদূরের কোনো গ্রহে গিয়ে আন্দোলন শক্তিশালী করে তুলব। দুটি বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আবহাওয়া আর আকৃতি। মানে যে গ্রহে অ্যালমারের লোকেরা যাবে, সেখানকার আবহাওয়া অনুকূল হতে হবে আর ওখানকার সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীদের সঙ্গে যেন অ্যালমারের প্রাণীদের দৈহিক মিল থাকে। অনেক খুঁজে আমরা বের করলাম পৃথিবীকে। কয়েক মাস আগে একদল নারী ও পুরুষ অ্যালমার থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছে পৃথিবীতে। এখানে থেকে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই, আন্দোলনের পুরো প্রস্তুতি শেষ হলেই চলে যাবে, তারপর সরিয়ে দেবে ওই শয়তানকে। পৃথিবীর কোনো মানুষের যেন ক্ষতি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে।’
‘আপনি এত কিছু জানেন কী করে?’
‘আমার মনে হয় না এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দরকার আছে।’
‘বেশ মজার একটা গল্প শোনালেন। ভালোই লাগল।’
‘সে আর বলতে, কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানেন? আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। সেই অত্যাচারী একনায়কের গুপ্তচর বাহিনী খুব ভয়ংকর ও পেশাদার। তাদের ভয়েই আমরা ওখানে কিছু করতে পারতাম না। এ পৃথিবীতেও যে আমরা তাদের নজর থেকে নিরাপদ, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমরা চাচ্ছি না পৃথিবীর কোনো মানুষ আমাদের পরিচয় জানুক। এ গ্রহের মানুষ আবার কথা–চালাচালিতে বেশ ওস্তাদ, কোথাকার কথা কোথায় যায়…’ আমার দিকে তাকাল ভদ্রলোক, তারপর হাত ঢোকাল পকেটে।
‘তাই না?’ আমিও স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম তার দিকে।
পিস্তলের মতো অদ্ভুত একটা জিনিস বের করল সে পকেট থেকে।
‘বুঝলেন ব্যাপারটা? আপনাকে আমি এখান থেকে যেতে দিতে পারি না।’ শব্দ করে হেসে উঠল সে, ‘অ্যালমারের বিদ্রোহীদের তথ্য যাতে গোপন থাকে, সে জন্যই আপনাকে মরতে হবে। এটার গুলিতে অবশ্য তেমন যন্ত্রণা হয় না, কিছু টেরই পাবেন না। আমি খুবই দুঃখিত!’
‘বাপ রে!’
ওই শয়তান একনায়ককে সবাই ভয় পায়, তবে তারপরও একটা গোপন আন্দোলন হুট করে শুরু হলো। সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষ তাতে যোগ দিল। কিন্তু ওই সৌরজগতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
‘বিশ্বাস করুন, অন্য কোনো উপায় থাকলে আমি জীবনেও আপনাকে মারতাম না।’
‘আছে তো…’ বলেই হুট করে নিজের পকেট থেকে রে-গানটা বের করে গুলি করলাম তাকে। কপাল ফুটা হয়ে গেল বেচারার। অবাক হওয়ারও সময় পেল না।
ঠিকই বলেছে লোকটা। আমাদের গুপ্তচর বাহিনী সদা সতর্ক। আমাদের মতো পেশাদারদের সামনে এই দুই দিনের বিপ্লবীরা টিকতে পারে? আমরা আগেই জেনে গিয়েছিলাম যে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তারা আন্দোলনের চেষ্টা করছে।
গোপন দরজা দিয়ে দোকানের ভেতরের ঘরটায় ঢুকে পড়লাম। অনেক কাগজপত্র আর অস্ত্র পড়ে আছে। হুম, এটাই তবে পৃথিবীতে তাদের প্রধান আস্তানা। তারা সবাই এখানে নিয়মিত আসে।
সব কটাকে ধরব, তারপর বুঝিয়ে দেব আমাদের ক্ষতি করতে চাইলে কী হয়। সিগন্যাল পাঠিয়ে দিলাম আমার সহকর্মীদের। তারাও কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।
নিজের আসল রূপে ফিরে এলাম। সব সময় মানুষের ছদ্মবেশ ধরে রাখা খুব বিরক্তিকর ব্যাপার।