হৈটি টৈটি - তৃতীয় পর্ব

(পূর্ব প্রকাশের পর)

৫. রিং কখনো মানুষ হয়ে উঠবে না...

২৭ মার্চ। মনে হচ্ছে যেন ফাউস্টের কাজের ঘরে এসে পড়েছি। প্রফেসর ভাগনারের গবেষণাগারটি এক আশ্চর্য জায়গা। কী নেই এখানে! পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, ইলেকট্রো টেকনোলজি, অণুজীববিদ্যা, শারীরস্থান, শারীরবৃত্ত...বোঝা যায়, জ্ঞানের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যাতে ভাগনার বা তার অভিধা অনুসারে ভাগের আগ্রহ নেই। মাইক্রোস্কোপ, স্পেকট্রোস্কোপ, ইলেকট্রোস্কোপ—সাদাচোখে যা দেখা যায় না, তা দেখার জন্য যত রকমের স্কোপে ভরা। শোনার জন্য একরাশ যন্ত্রপাতি: কর্ণাণুবীক্ষণ দিয়ে হাজার রকমের নতুন শব্দ শুনতে পারেন ভাগনার, ধরতে পারেন পুশকিনের ভাষায় সামুদ্রিক সরীসৃপের জলাভ্যন্তরের গতি, দূর তৃণের জীবনছন্দ। কাচ, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, রাবার, চীনামাটি, এবনি, প্লাটিনাম, সোনা, ইস্পাত এই নিয়ে নানা আকারের নানা ধরনের সমাহার। বকযন্ত্র, ফ্লাস্ক, কয়েল, টেস্টটিউব বাতি, স্পাইরাল, ফিউজ, সুইচ, বোতাম...এসবের মধ্য দিয়ে ভাগনারের মানস জটিলতারই প্রতিফলন হচ্ছে নাকি? পাশের ঘর তো এক মূর্তিশালাবিশেষ। সেখানে নরদেহের ‘চাষ’ করেন ভাগনার, দেহবিচ্ছিন্ন একটা জ্যান্ত আঙুল, খরগোশের কান, কুকুরের হার্ট, ভেড়ার মাথা আর...মানুষের মস্তিষ্ক বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। জ্যান্ত মস্তিষ্ক, তখনো তা ভাবছে! এর যত্ন করার ভার আমার ওপর। সে মস্তিষ্কের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রফেসর তার উপরিতলের ওপর তার আঙুল রাখেন। বিশেষ একধরনের শারীরদ্রবণ দিয়ে পুষ্ট রাখা হয় তাকে, আমার কাজ হলো জিনিসটা তাজা রাখা। কিছুকাল আগে ভাগনার এই দ্রবণের উপাদানে অদলবদল করে মস্তিষ্কে ‘প্রখরীভূত’ পুষ্টিদান শুরু করেন। ফল হয় আশ্চর্য। দ্রুত বাড়তে থাকে মস্তিষ্ক, শেষ পর্যন্ত একটা মস্ত তরমুজের মতো হয়ে উঠল, খুব যে সুন্দর দেখাচ্ছিল, তা অবশ্যই নয়।

২৯ মার্চ। কী নিয়ে যেন ভাগ মস্তিষ্কের সঙ্গে খুব জোর কথাবার্তা চালাচ্ছেন।

৩০ মার্চ। সন্ধ্যায় ভাগ আমাকে বললেন, ‘মস্তিষ্কটা একজন তরুণ জার্মান বৈজ্ঞানিক রিংেয়র মস্তিষ্ক। আবিসিনিয়ায় মারা পড়ে লোকটি কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন, মস্তিষ্কটা এখনো বেঁচে আছে, চিন্তা করছে। কিন্তু কিছুকাল থেকে মস্তিষ্কটা বিষণ্ন হয়ে উঠেছে। মস্তিষ্কের জন্য যে চোখটা আমি করে দিয়েছিলাম, সেটায় ও খুশি নয়। শুধু দেখে তৃপ্তি হচ্ছে না ওর, শুনতেও চায়, শুধু এক জায়গায় পড়ে থাকতে ভালো লাগছে না, নড়েচড়ে বেড়াতে চায়। দুর্ভাগ্যবশত এ ইচ্ছা সে জানাল বড় দেরি করে। কিছু আগে বললে এ ইচ্ছা পূরণ করা যেত। অ্যানাটমি থিয়েটারে একটা সুবিধামতো লাশ জোগাড় করে রিংেয়র মস্তিষ্ক তার মাথায় বসিয়ে দেওয়া যেত। লোকটা যদি মস্তিষ্কের রোগে প্রাণ হারিয়ে থাকে, তাহলে মাথায় একটা নতুন সুস্থ মস্তিষ্ক বসালেই সে প্রাণ ফিরে পেত। রিংয়ের মস্তিষ্ক তখন পেত একটা নতুন দেহ ও পূর্ণ জীবন। কিন্তু এই দেহ বিকাশের পরীক্ষাটা নিয়ে আমি ভারি মেতে উঠেছিলাম। এখন দেখতেই পাচ্ছেন, রিংয়ের মস্তিষ্ক এত বড় হয়ে উঠেছে যে কোনো মানুষের মাথায় তা আঁটবে না। কখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না রিং।

‘আপনি কি বলতে চান, মানুষ ছাড়া অন্য কিছু সে হয়ে উঠতে পারবে?’

‘ঠিক তা–ই। যেমন হাতি হতে সে পারে। অবশ্য হাতির মাথার মতো অত বড় আকারে মস্তিষ্কটা এখনো পৌঁছায়নি, কিন্তু সেটা সময়ে সম্ভব। শুধু দেখতে হবে প্রয়োজনীয় আকারে মস্তিষ্কটা যাতে পৌঁছায়। শিগগিরই একটা হাতির মাথার খোল নিয়ে আসব আমি। মস্তিষ্কটা তাতে বসিয়ে তার তনু বাড়িয়ে চলব, যত দিন না পুরো খোলটা ভরে যায়।’

‘তার মানে রিংকে আপনি হাতি করে তুলতে চান।’

‘আপত্তি কী? রিংকে সে কথা আগেই বলেছি। দেখা, শোনা, ঘুরে বেড়ানো, নিশ্বাস নেওয়া, এর জন্য রিং এতই উৎসুক যে সে একটা শুয়োর–কুকুর হতেও রাজি। আর হাতি একটা উদার প্রাণী, সবল, দীর্ঘায়ু। ও, মানে রিংয়ের মস্তিষ্কটা আরও ১১০ বছর বাঁচতে পারবে। খুব খারাপ কথা কি? রিং তার সম্মতি দিয়েছে...’

দেনিসভ ডায়েরি ছেড়ে ভাগনারকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তার মানে যে হাতিটায় চেপে আমরা যাচ্ছি...’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার মস্তিষ্কটা মানুষের,’ লেখা না থামিয়েই বললেন ভাগনার, ‘পড়ে যান, আমায় বাধা দেবেন না।’

দেনিসভ চুপ করলেন বটে, কিন্তু তক্ষুনি ফের পড়তে শুরু করল না। যে হাতিটায় তারা বসে আছেন তার মস্তিষ্ক মানুষের, এই কথাটা কেমন বিদ্‌ঘুটে ঠেকল তার। কেমন একটা অপ্রাকৃত কৌতূহল, প্রায় সংস্কারাচ্ছন্ন একটা আতঙ্ক পেয়ে বসল তাকে।

৩১ মার্চ। হাতির করোটিটা আজ এল। প্রফেসর তাকে আড়াআড়ি করে করাতে কেটে ফেললেন।

বললেন, ‘মস্তিষ্কটা ভেতরে বসানোর জন্য এটা দরকার। অন্য একটা মাথার খোলে স্থানান্তর করার সময়েও এতে সুবিধা হবে।’ করোটির ভেতরটা দেখে অবাক লাগল; যে জায়গাটায় মস্তিষ্ক থাকার কথা, সেটা তুলনায় অনেক ছোট। অথচ বাইরে থেকে হাতিকে দেখায় যেন অনেক বেশি ‘মস্তিষ্কওয়ালা’।

ভাগ বললেন, ‘স্থলপ্রাণীদের মধ্যে হাতির কপালের দেয়ালই সবচেয়ে বিকশিত। দেখছেন তো? খুলির পুরো উপরাংশটাই ফাঁকা কক্ষ, সাধারণ লোকে ভাবে, ওটাই বুঝি মস্তিষ্কের জায়গা। আসল মস্তিষ্ক তুলনায় অনেক ছোট, হাতির মাথাটার অনেক পেছনে তা লুকানো, এখানটায়, কানের কাছে। সে জন্যই সামনাসামনি মাথায় গুলি করলে তা প্রায়ই লক্ষ্যে পৌঁছায় না। হাড়ের কতগুলো দেয়াল ভেদ করে যায় বুলেট, কিন্তু মস্তিষ্ক অক্ষত থাকে।’

মস্তিষ্কের খোলের মধ্যে কতগুলো ফুটো করলাম আমরা দুজন মিলে। এই ফুটো দিয়ে টিউব চালিয়ে পুষ্টিদ্রবণ খাওয়ানো হবে মস্তিষ্ককে; তারপর সাবধানে রিংয়ের মস্তিষ্কটা বসানো হলো আধখানা খোলে; ফাঁকটা অবশ্য তাতে পুরো ভরল না।

‘ভাবনা নেই, যেতে যেতে ওটা বেড়ে উঠবে।’ বাকি আধখানা খুলি জুড়তে জুড়তে বললেন ভাগ।

আরও পড়ুন

সত্যি বলতে কি, ভাগনারের পরীক্ষা সফল হবে, এ ভরসা আমার বিশেষ ছিল না, যদিও তাঁর অদ্ভুত সব আবিষ্কারের কথা আমি জানতাম। কিন্তু এটা একটা ভয়ানক রকমের জটিল ব্যাপার। বাধা অনেক। প্রথমত একটা জ্যান্ত হাতি চাই। আফ্রিকা বা ভারতবর্ষ থেকে একটা হাতি নিয়ে আসতে অনেক খরচ। তার ওপর, কোনো কারণে হয়তো সে হাতি তেমন জুতসই না–ও হতে পারে। তাই ভাগ ঠিক করলেন রিংয়ের মস্তিষ্ক নিয়ে নিজেই যাবেন আফ্রিকার কঙ্গো দেশে। সেখানে একটা হাতি ধরে অকুস্থলেই মস্তিষ্ক স্থানান্তরের অপারেশন চালাবেন। মস্তিষ্ক স্থানান্তর! বলতে তো খুবই সোজা! কিন্তু এ তো আর এক পকেট থেকে আরেক পকেটে দস্তানা চালানো নয়। সব স্নায়ুমুখ, শিরা, ধমনি এক–এক করে বেছে সেলাই করতে হবে। জন্তুর দেহক্রিয়া মানুষের মতো হলেও অনেক তফাত আছে। এই দুই পৃথক ব্যবস্থাকে মিলিয়ে ভাগনার এক করবেন কী করে? আর এই জটিল অপারেশন করতে হবে আবার একটা জ্যান্ত হাতির ওপর...

৬. বাঁদরে ফুটবল

২৭ জুন। এবার গত কয়েক দিনের ঘটনা এক দফাতেই লিখতে হবে। এ–যাত্রায় অভিজ্ঞতা হলো প্রচুর, আর সবই যে প্রীতিকর তা নয়। জাহাজে থাকতেই, বিশেষ করে গাদাবোটটায় মশা ছেঁকে ধরেছিল। নদীটা অবশ্য হ্রদের মতো চওড়া, তার মাঝামাঝি ধরে গেলে মশা কম। কিন্তু তীরের কাছাকাছি আসামাত্রই মশার মেঘে ছেয়ে যেত। চান করতে গেলেই কালো কালো মাছি এসে গায়ে বসত, রক্ত চুষে খেত। তীরে নেমে যখন পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম, তখন নতুন এক উপদ্রব শুরু হলো, ছোট ছোট পিঁপড়া আর বালুকা-পিসু। প্রতি রাতে তন্নতন্ন করে পা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হতো পিসুগুলোকে। সাপ, বিছা, মৌমাছি, বোলতা—সবাই মিলে কম জ্বালাতন শুরু করেনি।

বন ভেদ করে এগোনো ভারি দুষ্কর, আবার খোলা জায়গা দিয়ে হাঁটাও কম দুরূহ নয়। ঘন ঘাস, মোটা মোটা ডাঁটা, লম্বায় ৪ মিটার। হাঁটতাম যেন দুই সবুজ দেয়ালের মাঝখান দিয়ে—চারপাশের কিছুই দেখা যায় না। ভয়ই লাগে! ঘাসের ধারালো পাতে ছড়ে যায় হাত–মুখ। পা ফেললে একেবারে পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায়। বৃষ্টির সময় জল জমে থাকে পাতায়, হাঁটতে গেলে হড়হড়িয়ে পড়ে গা ভিজিয়ে দেয়। বন আর তৃণভূমির মধ্য দিয়ে একেকজনের সংকীর্ণ পথে লাইন ধরে এগোতে হচ্ছিল আমাদের। এই হাঁটাপথই এসব এলাকার একমাত্র যোগাযোগব্যবস্থা। দলে আমরা ছিলাম ২০ জন, তাদের মধ্যে ১৮ জনই হলো আফ্রিকান ফান উপজাতির লোক, আমাদের মোটঘাট বইছিল, পথ দেখাচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো গেল। তুম্বা হ্রদের তীরে ছাউনি ফেললাম আমরা। আমাদের গাইডরা এখন বিশ্রাম নিচ্ছে, মাছ ধরায় তন্ময় হয়ে আছে।

ভয় পেয়েছে স্থানীয় লোকজন। রাত হতেই তারা এসে জোটে আমাদের তাঁবুর কাছে, সারা রাত ধরে আগুন জ্বালিয়ে রাখে।

এ কাজ থেকে তাদের সরিয়ে আমাদের আস্তানা গাড়ায় সাহায্য করার জন্য টেনে আনা খুব সহজ নয়। দুটি বড় বড় তাঁবু ফেলেছি আমরা। জায়গাটা ভালোই, একটা শুকনা টিলার ওপর। ঘাসগুলো খুব লম্বা নয়। চারপাশের অনেকটা দূর পর্যন্ত বেশ দেখা যায়। রিংয়ের মস্তিষ্ক নিরাপদেই এসেছে, বেশ ভালোই বোধ করছে। শব্দ, বর্ণ, ঘ্রাণ ও অন্যান্য অনুভূতির রাজ্যে ফেরার জন্য তা উদ্‌গ্রীব। ভাগ তাকে এই বলে প্রবোধ দিচ্ছেন যে আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। কী একটা রহস্যময় জিনিস তৈরি করছেন তিনি।

২৯ জুন৷ খুব হইচই শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ছাউনির খুব কাছেই সিংহের টাটকা পায়ের ছাপ দেখেছে দেশীয় লোকেরা। রাইফেলের বাক্স খুলে একটি করে রাইফেল দিয়েছি তাদের, অবশ্য যারা গুলি করতে পারে বলে জানিয়েছে, তাদের। খাওয়ার পর গুলি ছোড়ার মহড়া হলো! সে এক ভয়ানক ব্যাপার! রাইফেলের কুঁদো ওরা পেট বা হাঁটুর সঙ্গে লাগিয়ে গুলি ছোড়ে, আর ধাক্কায় ডিগবাজি খেয়ে উল্টে পড়ে, লক্ষ্যের ১৮০ ডিগ্রি দূর দিয়ে ছুটে যায় বুলেট। তাহলেও আনন্দ তাদের আর ধরে না। অবিশ্বাস্য রকমের চেঁচামেচি লাগিয়েছে তারা। তাদের ওই চিৎকারেই সম্ভবত কঙ্গো অববাহিকার সব বুভুক্ষু জানোয়ার ছুটে আসবে বলে আমার ধারণা।

৩০ জুন। কাল রাতে সিংহটা ছাউনির বেশ কাছেই এসে হাজির হয়েছিল। তার বাস্তব প্রমাণ রেখে গেছে: একটা ঝুনা শুয়োরকে টুকরা টুকরা করে খেয়ে শেষ করেছে। শুয়োরটার মাথার খুলি বাদামের মতো ফেটে চৌচির, পাঁজরার হাড়গুলো একদম ছিবড়া করে দিয়েছে। এমন হাড়খেকোর কবলে পড়ার কোনো বাসনাই আমার নেই!

ভয় পেয়েছে স্থানীয় লোকজন। রাত হতেই তারা এসে জোটে আমাদের তাঁবুর কাছে, সারা রাত ধরে আগুন জ্বালিয়ে রাখে। ভয়ংকর সব জন্তু সম্পর্কে আদিম মানুষের যে ভীতি, সেটা আমি অনুভব করতে শুরু করেছি। সিংহ যখন ডাকে, ইতিমধ্যেই কয়েকবার সে ডাক শুনেছি, তখন বেশ একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়, আমার রক্তের মধ্যে জেগে ওঠে আমার দূর পূর্বপুরুষদের আতঙ্ক, বুকের স্পন্দন থেমে যায়। মনে হয়, কোথাও ছুটে না গিয়ে কুঁকড়িসুকড়ি বসে থাকি, পারলে ছুঁচোর মতো লুকাই মাটির নিচে। তবে সিংহের গর্জন যেন ভাগের কানেই ঢোকে না। এখনো সে তার নিজের ছাউনিতেই, কী একটা জিনিস বানাচ্ছে। আজ সকালে প্রাতরাশের পর আমার কাছে এসেছিলেন। বললেন, ‘কাল সকালে বনের ভেতরে যাব। লোকেরা বলছে, একটা পুরোনো হাতি-চলাপথ আছে হ্রদ পর্যন্ত। আমাদের ছাউনি থেকে অল্প দূরে জল খায় হাতিগুলো। কিন্তু চারণভূমি প্রায়ই বদলায় হাতিগুলো। বনের মধ্যে সেগুলো যে পথ করেছিল, সেটা আবার বুজে যেতে শুরু করেছে। তার মানে, আরও দূরে কোথাও চলে গেছে সেগুলো। খুঁজে বের করতে হবে।’

‘কিন্তু জানেন নিশ্চয়, একটা সিংহ ঘোরাঘুরি করছে এখানে। রাইফেল না নিয়ে একা যাওয়ার ঝুঁকি নেবেন না যেন,’ সাবধান করে দিলাম আমি। ‘জানোয়ারে আমার ভয় নেই। ওঝার মন্ত্র জানি আমি,’ হাসি লুকানোর চেষ্টায় তার ঘন গোঁফ জোড়া কেঁপে উঠল।

‘রাইফেল না নিয়েই যাবেন?’ ভাগ কেবল মাথা নাড়লেন।

আরও পড়ুন

২ জুলাই। ইতিমধ্যে কতগুলো অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। রাতে ফের গর্জন শোনা গেল সিংহের। আমার এমন ভয় লেগেছিল যে নাড়ি উল্টে এসে বুক হিম হয়ে যায়। পরদিন সকালে তাঁবুর বাইরে গা ধুচ্ছিলাম, এমন সময় অন্য তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন ভাগ। পরনে তার একটা সাদা ফ্ল্যানেল স্যুট, মাথায় শোলার টুপি, পায়ে মোটা সোলের বুট—অভিযানে বের হওয়ার জন্য তৈরি, কিন্তু কাঁধে ঝোলাও নেই, রাইফেলও নেই। সুপ্রভাত জানালাম। প্রত্যভিনন্দনে মাথা নেড়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। আমার মনে হলো যেন তিনি পা ফেলছিলেন কেমন সাবধানে। ক্রমশ তার পদক্ষেপ স্বচ্ছন্দ হয়ে এল, স্বাভাবিক দ্রুত তালে হাঁটতে লাগলেন। পাহাড় থেকে যে পথটা নেমে এসেছে, সেই জায়গায় এসে পড়লেন তিনি। যখন বেশ ঢালুতে নেমেছেন, তখন হাত তুললেন। আর এমন একটা আশ্চর্য ব্যাপার তখন ঘটল যে আমি আর দেশীয় লোকেরা সবাই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলাম।

প্রথমটা তার টান টান শরীরটা সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো শূন্যে ধীরে ধীরে ডিগবাজি খেতে শুরু করল। তারপর ক্রমশই ডিগবাজির গতি হয়ে উঠল দ্রুত। এই দাঁড়িয়ে আছেন খাড়া হয়ে, পরমুহূর্তেই মাথা নিচে, পা দুটি শূন্যে। এভাবে অবিরাম পা আর মাথার স্থান বদলাবদলি করে শেষ পর্যন্ত এত জোরে ঘুরতে লাগলেন যে সবকিছু একটা ঝাপসা বৃত্তের মতো হয়ে উঠল আর তার মূল দেহটাকে দেখাতে লাগল একটা গাঢ় কেন্দ্রের মতো। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে ভাগ পাহাড়ের নিচে নেমে এলেন, তারপর সমান মাটিতে কয়েকবার ডিগবাজি খেয়ে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক চলনে এগিয়ে গেলেন বনের দিকে।

কিছুই মাথায় ঢুকল না আমার। দেশীয়রা তো আরও হতভম্ব। তারা শুধু অবাক নয়, রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। যা তারা দেখল, সেটা তাদের কাছে নিঃসন্দেহেই এক অপ্রাকৃত ব্যাপার। আর আমার কাছে, ভাগ আমাকে প্রায়ই যেসব হেঁয়ালির মধ্যে ফেলেন, এই ডিগবাজি খাওয়াও তারই একটা বলে মনে হলো।

কিন্তু হেঁয়ালি হেঁয়ালি ছাড়া কিছু নয়, আর সিংহ যে সিংহই। নিজের ওপর একটু বেশি রকম ভরসাই কি ভাগ করছেন না? আমি জানতাম, অপ্রাকৃত জিনিসে কুকুর ভয় পেয়ে যায়, একটা সুতায় বা ঘোড়ার লোমে বেঁধে এক টুকরা হাড় ছুড়ে দিয়ে তা দেখা যায়। কুকুর যেই খেতে যাবে, অমনি একটু টানতে হবে হাড়টাকে। হাড় যখন মাটির ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকবে যেন কুকুরের গ্রাস থেকে পালাতে চাইছে, তখন এই ‘জ্যান্ত’ হাড়ের কাছ থেকে লেজ গুটিয়ে চম্পট দেবে কুকুর। কিন্তু শূন্যে ভাগকে ডিগবাজি খেতে দেখলে সিংহও কি তা–ই করবে? এই হলো প্রশ্ন। মনে হলো অরক্ষিত অবস্থায় ভাগকে ছেড়ে দেওয়া চলে না।

বনের ছায়া ছেড়ে রোদভরা ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে যাচ্ছিলেন ভাগ, এমন সময় একটা অদ্ভুত চাপা গর্জনের মতো শোনা গেল; নিশ্চয় খেপে ওঠা অথবা ভয় পাওয়া কোনো বড় জন্তুর ডাক।

রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভাগের পিছু পিছু। সঙ্গে রইল দেশীয় লোকদের মধ্য থেকে সাহসী ও বুদ্ধিমান চারজন লোক। আমরাও আসছি, এটা তার জানা ছিল না, বনের মধ্যে হাতিগুলো যে একটা চওড়ামতো পথ করে নিয়েছিল, তা–ই দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ভাগ। হাজার হাজার জন্তু গিয়ে এ পথ সমান করে দিয়েছে। কেবল একটি কি দুটি জায়গায় ছোট ছোট উল্টে পড়া গাছের গুঁড়ি বা শুকনা ডাল চোখে পড়ল আমাদের। ভাগ যখন এগুলোর কাছে আসছিলেন, তখন তিনি থেমে গিয়ে একটু অদ্ভুতভাবেই যতটা দরকার তার চেয়ে অনেক উঁচুতে পা তুলছিলেন। তারপর লম্বা পায়ে ডিঙিয়ে যাচ্ছিলেন সেগুলো। কখনো কখনো তার গোটা দেহ একটুও না বেঁকে সামনের দিকে একেবারে সোজা হয়ে যাচ্ছিল, আবার পরমুহূর্তেই আগের মতোই সিধা হয়ে হাঁটছিলেন। আমরা তাকে অনুসরণ করছিলাম একটু দূরে থেকে। শেষ পর্যন্ত সামনে দেখা গেল একটা উজ্জ্বল আলো, পথটা চওড়া হয়ে এসে মিশেছে একটা ফাঁকা জায়গায়।

বনের ছায়া ছেড়ে রোদভরা ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে যাচ্ছিলেন ভাগ, এমন সময় একটা অদ্ভুত চাপা গর্জনের মতো শোনা গেল; নিশ্চয় খেপে ওঠা অথবা ভয় পাওয়া কোনো বড় জন্তুর ডাক। কিন্তু সিংহের ডাকের মতো নয়। জন্তুর নামটা দেশীয় লোকেরা কানাকানি করে বলছিল, কিন্তু স্থানীয় ভাষার নামগুলো আমার জানা ছিল না। আমার সঙ্গীদের আচরণ ও মুখের ভাব দেখে বোঝা গেল, সিংহকে তারা যেমন ভয় পেত, এ জন্তুর গর্জনেও তাদের তেমনি আতঙ্ক। তাহলেও আমার সঙ্গে সঙ্গেই রইল তারা; বিপদ দেখে গতি আমি বাড়িয়েছিলাম। ফাঁকা জায়গাটায় আসতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল।

বন থেকে মিটার দশেক দূরে আমার ডান দিকে বসে আছে একটি শিশু গরিলা, দেখতে বছর ১০ বয়সের একটা ছেলের মতো। তার একটু দূরেই ধূসর বাদামি একটি মা গরিলা, আর অতিকায় একটা পুরুষ। ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে বেশ জোরেই হেঁটে যাচ্ছিলেন ভাগ, শিশু গরিলা আর তার বাপ–মায়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌঁছানোর পরেই সেদিকে তার দৃষ্টি গেছে বলে মনে হয়। পুরুষ গরিলাটা মানুষ দেখেই সেই ভাঙা ভাঙা গর্জন ছাড়ল, বনের মধ্যে যেটা আমি শুনেছিলাম। ততক্ষণে জানোয়ারগুলোর ওপর চোখে পড়েছে ভাগের; সোজাসুজি পুরুষ গরিলাটার চোখের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক পায়ে এগোতে লাগলেন তিনি। বাচ্চা গরিলাটা মানুষ দেখে কিচমিচ হাউমাউ করে দ্রুত উঠে পড়ল কাছের একটা ছোট গাছের ওপর।

মর্দাটা ফের একটা হুঁশিয়ারি গর্জন ছাড়ল। সাধারণত গরিলা মানুষকে এড়িয়ে যায়, কিন্তু লড়তে বাধ্য হলে অতি বেপরোয়া ও অসাধারণ হিংস্র হয়ে ওঠে। পুরুষটা দেখল, মানুষটা হেঁটে যাচ্ছে না, নিজের বাচ্চাটার জন্য ভয় পেয়ে সে হঠাৎ খাড়া হয়ে লড়াইয়ের পাঁয়তারা কষল। মানুষের এক বিকট প্রতিরূপের মতো এই যে জন্তু, এর চেয়ে ভয়াবহ জীব আর আছে কি না সন্দেহ। বানরজাতীয় প্রাণী হিসেবে পুরুষটার দেহ প্রকাণ্ড, লম্বায় মাঝারি গোছের একটা মানুষের সমান, কিন্তু বুকের ছাতি মানুষের দ্বিগুণ মনে হলো। মূল দেহকাণ্ডটা অস্বাভাবিক বড়, লম্বা লম্বা বাহু, একেকটা শালগাছের মতো। হাত আর পায়ের চেটো অসম্ভব লম্বা। ভুরুর জায়গাটা খাড়া হয়ে বেরিয়ে এসেছে, হিংস্র চোখ; খিঁচনো মুখভরে অবারিত হয়ে উঠেছে বড় বড় ঝকঝকে দাঁত।

লোমশ মুঠো পাকিয়ে বুকের ওপর এমন জোরে বাড়ি মারতে শুরু করল জন্তুটা যে একটা ফাঁকা পিপের মতো ঢপ ঢপ শব্দ বেরোতে লাগল। তারপর ডাক ছেড়ে গর্জন করে ডান হাতে মাটির ওপর ভর দিয়ে ছুটে গেল ভাগের দিকে।

সত্যি বলতে কি, এত নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম যে কাঁধ থেকে রাইফেল নামানোর অবকাশ পাইনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গরিলাটা গিয়ে পৌঁছাল একেবারে ভাগের কাছে আর...ফের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল!

অবস্থা গুরুতর। আর দর্শক হয়ে থাকা চলে না। লোকগুলোকে হাঁক দিয়ে বললাম রাইফেল তুলে ধরতে। একসঙ্গে এগোলাম গোলকটার দিকে।

কোনো একটা অদৃশ্য বাধায় ধাক্কা খেয়ে চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল গরিলাটা। অন্যদিকে ভাগ কিন্তু মাটিতে উল্টে না পড়ে বাতাসে ডিগবাজি খেতে লাগলেন সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো, দুই হাত তার ওপরে তোলা, শরীরটা সিধা। ব্যর্থতায় আরও খেপে উঠল জানোয়ারটা। ফের উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার ভাগের ওপর লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু এবার তাকে ডিঙিয়ে সে পড়ল মাটিতে। একেবারে উন্মাদ হয়ে উঠল গরিলাটা। গর্জন করে, গুঙিয়ে উঠে, মুখে ফেনা তুলে গরিলাটা তার বিটকেলে লম্বা লম্বা হাতে এবার ভাগকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু অদৃশ্য আর অটুট কিছু একটা বাধা যেন আড়াল করে রাখল ভাগকে। গরিলার হাতের ভঙ্গি দেখে অনুমান করলাম, জিনিসটা গোলাকার। অদৃশ্য, কাচের মতো স্বচ্ছ, কোনো রকম আলো ঠিকরে পড়ছে না, অথচ ইস্পাতের মতো মজবুত। এইটাই তাহলে ভাগের সাম্প্রতিক আবিষ্কার!

ভাগ যে একান্তই নিরাপদ, তাতে আমার আর সন্দেহ রইল না। তাই অসীম কৌতূহলে এই অসাধারণ খেলা দেখতে লাগলাম। এ খেলা যত উদ্দাম হয়ে উঠল, দেশীয়রাও ততই আহ্লাদে নাচতে শুরু করে দিল, রাইফেল পর্যন্ত ফেলে দিল মাটিতে।

স্ত্রী গরিলাটাও ক্ষিপ্ত পুরুষ গরিলাটার দিকে কম কৌতূহলে লক্ষ করছিল না। কিন্তু তারপর সে একটা যুদ্ধংদেহী গর্জন করে ছুটে গেল তার সাহায্যে। খেলাটাও তখন থেকে একটু অন্য রকম হয়ে দাঁড়াল। উত্তেজনায় অদৃশ্য গোলকটার ওপর ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল গরিলা দুটি, আর গোলকটা ঠিক একটা ফুটবলের মতো এখানে–ওখানে ড্রপ খেতে লাগল। গরিলাগুলো যেখানে ক্ষিপ্তের মতো ফুটবল খেলছে, সেখানে সেই ফুটবলের মধ্যে বসে থাকা তামাশার ব্যাপার নয়! চরকি পাক ঘুরতে লাগলেন ভাগ, শরীরটা তার তারের মতো একেবারে সিধে। এতক্ষণে বোঝা গেল, দুই হাত ওপরে তুলে শরীরটা তিনি অমন সিধা করে রাখছেন কেন। গোলকটার গায়ে হাত–পা দিয়ে চাপ দিয়ে আছেন তিনি, যাতে নিজের কোনো ক্ষতি না হয়। অসম্ভব শক্ত পাত দিয়ে গোলকটা গড়া নিশ্চয়। কারণ, দুই দিক থেকে একই সঙ্গে আক্রমণ করে গরিলা দুটি যখন গোলকটাকে শূন্যে পাঠাচ্ছিল, তখন মাটি থেকে মিটার তিনেক পর্যন্ত লাফিয়ে উঠছিল গোলকটা, কিন্তু ভাঙল না। তবে ভাগ ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন বোঝা গেল। পেশিগুলোকে অমন টান টান করে রাখা বেশিক্ষণ চলে না। হঠাৎ দেখলাম, ভাগ হাত–পা ছেড়ে গোলকটার নিচে গিয়ে পড়েছেন।

অবস্থা গুরুতর। আর দর্শক হয়ে থাকা চলে না। লোকগুলোকে হাঁক দিয়ে বললাম রাইফেল তুলে ধরতে। একসঙ্গে এগোলাম গোলকটার দিকে। ভয় ছিল গুলি করতে গিয়ে তারা হয়তো ভাগের গায়েই গুলি করে বসবে, তাই হুঁশিয়ার করে দিলাম, আমি হুকুম না দেওয়া পর্যন্ত কেউ যেন গুলি না ছোড়ে। কে জানে অদৃশ্য গোলকটা বুলেটপ্রুফ কি না। তা ছাড়া গোলকটার কোথাও একটা ফাঁক অবশ্যই আছে, নইলে নিশ্বাস নিতে পারতেন না ভাগ। দৈবাৎ সেই ফাঁকের মধ্য দিয়ে গুলি চলে যেতে পারে।

ভয়ানক হইচই, চেঁচামেচি করে গরিলাদের দৃষ্টি ফেরানো গেল আমাদের দিকে। আমাদের দিকে প্রথম মুখ ফেরাল পুরুষ গরিলাটা, ভয়ংকর গর্জন করে উঠল সেটা। তাতে আমাদের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে এগোতে লাগল আমাদের দিকে। যেই সেটি গোলক থেকে বেশ খানিকটা তফাত হয়েছে, অমনি গুলি ছুড়লাম আমি। বুলেট গিয়ে বিঁধল ওর বুকে, তার ধূসর বাদামি লোম বেয়ে রক্ত গড়িয়ে আসতে দেখলাম। ডাক ছেড়ে হাত দিয়ে ক্ষতমুখটা চেপে ধরল গরিলাটা কিন্তু পড়ে গেল না। পরক্ষণেই আরও বেগে ছুটে আসতে লাগল আমার দিকে। দ্বিতীয় গুলিটা লাগল তার কাঁধে কিন্তু ততক্ষণে ও একেবারে আমার কাছে এসে আঁকড়ে ধরল রাইফেলের নলটা। একঝটকায় রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে অসম্ভব শক্তিতে মুচড়ে আমার চোখের সামনেই ভেঙে ফেলল নলটা। তাতেও তুষ্ট না হয়ে কামড়ে হাড় চাবানোর মতো করে চাবাতে শুরু করে দিল। তারপর হঠাৎ টলে পড়ে গেল মাটিতে, খিঁচুনি খেতে লাগল সারা দেহ, ভাঙা রাইফেলটা কিন্তু তখনো ছাড়েনি। স্ত্রী গরিলাটা ইতিমধ্যে পালাল।

‘খুব লেগেছে কি?’ ভাগ জিজ্ঞাসা করলেন, মনে হলো তার স্বর যেন আসছে অনেক দূর থেকে। একটা গরিলা আমার পাশে ধাক্কা দিয়ে গেছে বলেই কি আমার শ্রুতিশক্তিও ঘা খেয়েছে?

তাকিয়ে দেখলাম, ভাগ আমার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। অত কাছে বলেই চোখে পড়ল তার দেহ ঘিরে একটা মেঘলামতো আবরণ। ভালো করে দেখে বোঝা গেল, আসল আবরণ ওটা নয়, সেটা একেবারেই স্বচ্ছ, সেই স্বচ্ছ গোলকটার ওপর গরিলার হাতের ছাপ আর ধুলাবালুর যে দাগ লেগে আছে, সেটাই চোখে পড়ছে কেবল।

‘নিতান্ত সোজা, দেখছেন না গোলকের দেয়ালে একটা পায়ে চাপ দিই। ফলে গোলকটা সামনে গড়িয়ে যায়। নিশ্বাস নেওয়ার ফুটো আছে দেয়ালের গায়ে;

অদৃশ্যে গোলকটার ওই দাগদাগালির দিকে যে চেয়ে আছি, সেটা নিশ্চয় ভাগের চোখে পড়েছিল।

একটু হেসে তিনি বুঝিয়ে বললেন, ‘মাটি যদি কাদাটে বা ভেজা থাকে, তাহলে ওপরে দাগ পড়ে যায়, গোলকটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কিন্তু ধুলাবালু কি শুকনা পাতায় কিছু হয় না। খুব দুর্বল বোধ না করলে উঠে দাঁড়ান, যাওয়া যাক। যেতে যেতে আমার আবিষ্কারটা আপনাকে বুঝিয়ে বলব।’

খাড়া হয়ে ভাগের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। তাকেও কিছুটা ধকল সইতে হয়েছে; মুখের এখানে–ওখানে কালশিটে।

বললেন, ‘ও কিছু নয়, সেরে যাবে। আমারও খানিক শিক্ষা হলো। বোঝা যাচ্ছে, এ রকম একটা দুর্ভেদ্য গোলকের মধ্যেও আফ্রিকান জঙ্গলের গভীরে ঢোকা চলে না, সঙ্গে বন্দুকও রাখা চাই। ফুটবলের ভেতরে গিয়ে পড়তে হবে, কে ভেবেছিল!’

‘ফুটবলের তুলনাটা আপনারও মনে হয়েছে তাহলে?’

‘অগত্যা। এখন শুনুন। কাচের মতো স্বচ্ছ একটা ধাতু আমেরিকানরা আবিষ্কার করেছে, এ খবর শুনেছেন তো? মানে এমন কাচ, যা ধাতুর মতো শক্ত? শুনেছি, সামরিক বিমান গড়েছে তা দিয়ে। খুবই সুবিধা তাতে। শত্রুর কাছে তা প্রায় অদৃশ্য। প্রায় বলছি, কারণ, পাইলটকে তা সত্ত্বেও দেখা যাবে, যেমন গোলকের মধ্যে থাকলেও আমায় দেখা যাচ্ছে। তা অনেক দিন ধরে আমিও ভেবেছি, এমন একটা দুর্গ বানানো যায় কি না, যার ভেতর থেকে আমি সব দেখতে পাব। প্রাণিজীবন আমি সবই পর্যবেক্ষণ করতে পারব। কিন্তু কোনো হিংস্র পশু আমাকে দেখে আক্রমণ করলে সে দুর্গ আমাকে বাঁচাবে। কয়েকটা পরীক্ষার পর কৃতকার্য হয়েছি। এই গোলকটা তৈরি হয়েছে রাবার থেকে। এই অতি কার্যকরী বস্তুটির যা সব সম্ভাবনা, তার কিছুই এখনো নিঃশেষ হয়নি হে! রাবারকে কাচের মতো স্বচ্ছ আর লোহার মতো শক্ত করে তুলতে পেরেছি আমি। আমার অ্যাডভেঞ্চারটা আজ অবশ্য খুব প্রীতিকর হয়নি, ঠিক সময়ে আপনারা আমার সাহায্যে না এলে পরিণাম আরও অপ্রীতিকরই হতো, তাহলেও আমার আবিষ্কারটা সফল ও উপযোগী বলে আমার ধারণা। আর গরিলা? কে ভেবেছিল যে এখানে গরিলা থাকবে। এ জায়গা বুনো বটে, কিন্তু গরিলারা সাধারণত থাকে একেবারে দুর্ভেদ্য, আরও বুনো জঙ্গলের ভেতরে।’

‘কিন্তু এ গোলকের মধ্যে আপনি হাঁটেন কেমন করে?’

‘নিতান্ত সোজা, দেখছেন না গোলকের দেয়ালে একটা পায়ে চাপ দিই। ফলে গোলকটা সামনে গড়িয়ে যায়। নিশ্বাস নেওয়ার ফুটো আছে দেয়ালের গায়ে; গোলকটা তৈরি দুটো আধা গোলক দিয়ে। ভেতরে ঢুকে স্বচ্ছ রাবারের বিশেষ স্ট্র্যাপ দিয়ে মুখে এঁটে দিয়েছি। তবে অসুবিধা হলো এই যে ঢালু জমিতে গোলকটাকে আটকে রাখা দায়। এমন জোরে গড়াতে থাকে যে ব্যায়ামের কসরত করতে হয় আমাকে। কিন্তু ব্যায়াম একটু করবই–বা না কেন?’