শব্দকাহন
মৌলের নাম আইনস্টাইনিয়াম
নতুন কিছু আলাদাভাবে চিহ্নিত করাসহ নানা কারণেই নাম দিতে হয়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এসব নামের পেছনেও লুকিয়ে থাকে মজার ইতিহাস। চলুন, আজ জেনে নিই আইনস্টাইনিয়াম শব্দটি কীভাবে এল…
পর্যায় সারণির ৯৯তম মৌলের নাম আইনস্টাইনিয়াম। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নামে নামকরণ করা হয়েছে মৌলটির। এর নাম যখন দেওয়া হয়, তখনও আইনস্টাইন জীবিত। সেই হিসেবে, এটিই প্রথম মৌল, যার নামকরণ করা হয়েছে জীবিত কোনো ব্যক্তির নামে।
আসলে পর্যায় সারণিতে এরকম দুটি মৌল আছে, যাদের নামকরণ করা হয়েছিল সে সময়ের জীবিত ব্যক্তির নামে। প্রথমটির নাম তো জেনেই গেছেন, দ্বিতীয়টির নাম সিবর্গিয়াম। এর নাম দেওয়া হয়েছিল মার্কিন পারমাণবিক রসায়নবিদ গ্লেন সিবর্গের নামানুসারে।
যা-ই হোক, আইনস্টাইনিয়াম খুবই তেজস্ক্রিয় মৌল। ১৯৫২ সালে ১ নভেম্বর দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের এনিওয়েটক উপহ্রদে প্রথমবার চালানো হল হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা। বোমাটির কোড নেম ছিল আইভি মাইক। খুবই গোপনে এই থার্মোনিউক্লিয়ার বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার শক্তির পরিমাণ ছিল ১০ মেগাটনেরও বেশি। অর্থাৎ ১০ মিলিয়ন টন টিএনটির সমতূল্য। আরেকভাবে বলা যায়, জাপানের হিরোশিমায় ফেলা বোমার চেয়েও ৭০০ গুণ বেশি শক্তিশালী।
হিরোশিমা শহরে ফেলা বোমাটি বিস্ফোরিত হয়েছিল ফিশন প্রক্রিয়ায়। এ প্রক্রিয়ায় ভারী মৌলের পরমাণু (যেমন ইউরেনিয়াম) বিভাজিত হয়ে হালকা মৌলে পরিণত হয়, সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসে বিপুল পরিমাণ শক্তি। সেই শক্তিই আশপাশের সবকিছু ছারখার করে দেয়। তবে হাইড্রোজেন বোমায় ঘটে ফিশন নয়, ফিউশন বিক্রিয়া। ফলে হালকা মৌল ফিউজ হয়ে বা জোড়া লেগে তৈরি হয় ভারী কোনো মৌল। এভাবেই তৈরি হয়েছিল আইনস্টাইনিয়াম। তবে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এই মৌলের আবিষ্কার গোপন রাখা হয়েছিল ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত।
শুরুতে রসিকতা করে এর নাম দেওয়া হয়েছিল পান্ডেমোনিয়াম। কারণ আইভি মাইক নামের প্রথম হাইড্রোজেন বোমা তৈরির প্রকল্পের নাম ছিল প্রজেক্ট পান্ডা।
প্রথম হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের পর ধ্বংসাবশেষ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মার্কিন বিজ্ঞানী। এর নেতৃত্বে ছিলেন বিজ্ঞানী আলবার্ট ঘিওরসো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর মধ্যে আগে অজানা একটি মৌল পাওয়া গেল। তাও মাত্র প্রায় ২০০টি পরমাণু। দেখা গেল, এর পরমাণবিক সংখ্যা ৯৯।
শুরুতে রসিকতা করে এর নাম দেওয়া হয়েছিল পান্ডেমোনিয়াম। কারণ আইভি মাইক নামের প্রথম হাইড্রোজেন বোমা তৈরির প্রকল্পের নাম ছিল প্রজেক্ট পান্ডা। এই পান্ডা থেকেই পান্ডেমোনিয়াম। অবশ্য কেউ কেউ লোসালিয়াম নামেরও প্রস্তাব করেন। পরে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সম্মানে নতুন মৌলটির নামকরণ করা হয় আইনস্টাইনিয়াম। আর এর সংকেত দেওয়া হল Es। নামটি প্রস্তাব করেছিলেন মার্কিন রসায়নবিদ গ্লেন সিবর্গ।
অনেকেই এ নামকরণ স্বার্থক বলে মনে করেন। কারণ পারমাণবিক বিস্ফোরণে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া সম্ভব, তা প্রথম বোঝা গিয়েছিল আইনস্টাইন প্রদত্ত বিখ্যাত সূত্র E=mc2 থেকে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আইনস্টাইনের নাম। কয়েকজন বিজ্ঞানীর চাপে বাধ্য হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার আর্জি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। তাতেই টনক নড়ে মার্কিন সরকারের। অচিরেই যুক্তরাষ্ট্রে শুরু করে পারমাণবিক বোমা তৈরির এলাহি কারবার। তারই নাম ম্যানহাটন প্রজেক্ট। এর নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার।
আইনস্টাইনিয়ামের খুব বেশি ব্যবহার এখনো জানা যায়নি। কারণ মৌলটি তৈরিই হয় খুব সামান্য পরিমাণে।
পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে আইনস্টাইনিয়াম উদ্ভুত হয় না। এ মৌল গঠিত হয় পারমাণবিক চুল্লিতে বা পারমাণবিক বিস্ফোরণে। সাধারণত প্লুটোনিয়ামের নিউক্লিয়াসে নিউট্রন কণা প্রচণ্ডভাবে আঘাত করলে এটি তৈরি হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্লুটোনিয়াম কিছু নিউট্রন শোষণ করে এবং নিউক্লিয়াস অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। তাতে বিটা ক্ষয় হয়ে তৈরি হয় আইনস্টাইনিয়াম-২৫৩ আইসোটপ। এ প্রক্রিয়ায় মাত্র কয়েক মিলিগ্রাম আইনস্টাইনিয়াম তৈরি হতে পারে। এটি বিটা ক্ষয় হয়ে বার্কেলিয়াম-২৪৯, এবং তারপর ক্যালিফোর্নিয়াম-২৪৯-এ পরিণত হয়। তাছাড়া এটি তৈরি করা যায় খুবই অল্প পরিমাণে। এসব কারণে আইনস্টাইনিয়াম নিয়ে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই এদের সম্পর্কে এখনও অনেক কিছুই জানা বাকি।
এই রুপালি ধাতব আইনস্টাইনিয়ামের মোট ১৯টি আইসোটপের খোঁজ মিলেছে। এদের পারমাণবিক ভর ২৪০ থেকে ২৫৮। এর মধ্যে আইনস্টাইনিয়াম-২৫২-এর অর্ধায়ু সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪৭০ দিন। তবে সবচেয়ে পরিচিত আইসোটপ আইনস্টাইনিয়াম-২৫৩। এর অর্ধায়ু প্রায় ২০ দিন। এটি এতই তেজস্ক্রিয় যে মাত্র এক গ্রাম আইস্টাইনিয়াম থেকে প্রায় ১০০০ ওয়াট তাপ শক্তি নিঃসৃত হতে পারে। আবার অন্ধকারেও তা আভা ছড়ায়।
আইনস্টাইনিয়ামের খুব বেশি ব্যবহার এখনো জানা যায়নি। কারণ মৌলটি তৈরিই হয় খুব সামান্য পরিমাণে। তবে কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর ব্যবহার আছে। যেমন আইনস্টাইনিয়ামের চেয়ে ভারী মৌল (যেমন মেন্ডেলেভিয়াম) তৈরিতে এই মৌল ব্যবহার করা হয়।
