নতুন জন্ম নেওয়া যমজ নক্ষত্র। একে অপরকে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে জড়িয়ে পড়েছে সংঘর্ষে। সেই সংঘর্ষের ফলে ঘটা বিস্ফোরণ থেকে আলোকছটা ছড়িয়ে গেছে বিস্তৃত মহাকাশজুড়ে। সম্প্রতি এমনই এক বিরল দৃশ্যের ছবি ধরা পড়েছে জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের যান্ত্রিক চোখে।
এই যমজ নক্ষত্র ও এগুলোর বিস্ফোরণকে বলা হচ্ছে ‘হারবিগ-হারো ৪৬/৪৭’। হারবিগ-হারো একটি মহাজাগতিক ঘটনার নাম। নীহারিকার মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশু নক্ষত্রের চারপাশে উজ্জ্বল গ্যাস ও ধূলিকণার অঞ্চলকে হারবিগ-হারো বলা হয়। অর্থাৎ আলাদাভাবে উজ্জ্বল গ্যাস, নক্ষত্র বা নীহারিকা নয়, পুরো বিষয়টিকেই একসঙ্গে বলা হয় হারবিগ-হারো। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সবচেয়ে দর্শনীয় ঘটনাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এটিকে। তবে শুধু দর্শনীয় হিসাবেই নয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শিশু নক্ষত্রের গঠন প্রক্রিয়া বুঝতে এ ধরনের নক্ষত্র বেশ কাজের বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
হারবিগ-হারো তৈরির জন্য নির্দিষ্ট কিছু উপাদান প্রয়োজন হয়। শুরুটা হয় আদিনক্ষত্র থেকে। আদিনক্ষত্র মানে, সদ্য জন্ম নিচ্ছে, এমন নক্ষত্র। ইংরেজিতে বলে ‘প্রোটোস্টার’। প্রথমে নীহারিকার ঘন গ্যাস ও ধূলিকণা মহাকর্ষের প্রভাবে ঘুরতে ঘুরতে পরস্পরের কাছে আসে। ধূলিকণা ও গ্যাসের স্তুপ বড় হলে সেটার ভর বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে এর মহাকর্ষ বল। ফলে বাড়ে ঘূর্ণন। আরও বড় হয়ে এই স্তুপই পরিণত হয় প্রোটোস্টারে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন, স্তুপের চারপাশে থাকা সব ধূলিকণা ও গ্যাস নক্ষত্রের এই গঠনে যোগ দেয় না। বরং আদিনক্ষত্রের চৌম্বকক্ষেত্রের বাইরে জমে জমে ধীরে ধীরে মেরুর দিকে সরতে থাকে। এরপর চৌম্বকক্ষেত্রের মেরুতে চলে এলে বিপুল বেগে নিক্ষিপ্ত হয় বাইরের দিকে। অনেকটা সক্রিয় ব্ল্যাকহোল জেটের মতো।
আদিনক্ষত্রের মেরু থেকে নিক্ষিপ্ত এই কণাপ্রবাহের প্রবল গতির কারণে তাপমাত্রাও হয় প্রচণ্ড। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় এসব কণা প্লাজমায় পরিণত হয়। ফলে প্রোটোস্টারের দুই মেরুতে দেখা যায় উজ্জ্বল প্লাজমা প্রবাহ বা জেট। জেটের চারপাশে নীহারিকার ঘন ধূলিকণা ও গ্যাস তখন টরাস বা ডোনাটের মতো আকৃতি পায়।
এর অর্থ, দূর থেকে সাধারণ আলোতে দেখলে মনে হয়, অন্ধকার কোনো গোলকের চারপাশ জ্বলজ্বল করছে।
জেমস ওয়েব নভোদুরবিন ইনফ্রারেড আলো শনাক্ত করতে পারে। আর ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো দৃশ্যমান আলোর মতো এত বেশি ছড়িয়ে যায় না। তাই এ নভোদুরবিনের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা উঁকি দিতে পেরেছেন নীহারিকার ধূলিকণা ও গ্যাসের অন্ধকার আবরণ ভেদ করে আদিনক্ষত্রে।
হারবিগ-হারো ৪৬/৪৭-এর বয়স মাত্র কয়েক হাজার বছর। সাধারণত একটা নক্ষত্র জন্ম নিতে কয়েক লাখ বছর সময় লাগে। সেদিক থেকে এই যমজ নক্ষত্রদ্বয় জন্মের সূচনালগ্নে আছে। আসলে, একটি নক্ষত্র জন্ম নিয়েছে ইতিমধ্যেই। আরেকটি কেবল গঠিত হচ্ছে। এই ইতিমধ্যে জন্ম নেওয়া শিশু নক্ষত্রের জেটই দেখা গেছে জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের নতুন এ ছবিতে। সেখানে দুই মেরু থেকে ছড়িয়ে পড়ছে দুটি জেট। সেটাই ছবিতে দেখা যাচ্ছে দুটি কমলা রঙের অংশ হিসাবে। আগের বিস্ফোরণ থেকে এগুলো তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে আছে কমলা-সাদা রঙের উজ্জ্বল গোলক। এখানেই রয়েছে সেই নক্ষত্রটি।
ছবিতে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে প্রায় ৬০ ডিগ্রি কোণে থাকা নীল রঙের স্পাইকের মাধ্যমে। পুরো কাঠামো জুড়ে হালকা নীল অংশটুকুকে বলা হয় ডার্ক নেবুলা। কারণ, সাধারণ আলোয় এ অংশটি দেখা যায় না। ছায়ার মতো মনে হয়। জেমস ওয়েবের ছবিতে অংশটি কিছুটা স্বচ্ছ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে পেছনে দূর মহাকাশের নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলো দেখা যাচ্ছে।
নক্ষত্রের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য শিশু নক্ষত্রের জেট বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এগুলো চারপাশের ধূলিকণা ও গ্যাসের মেঘকে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলে নক্ষত্র বড় থেকে আরও বড় হয়ে দানব নক্ষত্রে পরিণত হতে পারে না। এ ছাড়া নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা মহাকাশে ছড়িয়ে দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এগুলো।
মহাকাশপ্রেমীদের জন্য বরাবরের মতোই ছবিটি উন্মুক্ত করে দিয়েছে জেমস ওয়েব নভোদুরবিন কর্তৃপক্ষ। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ওয়েবসাইট থেকে ছবিটি সরাসরি ডাউনলোড করা যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট, উইকিপিডিয়া