হারিয়ে যাওয়া সুপারনোভার সন্ধান, পথ দেখাল মধ্যযুগের আরবি কবিতা
বর্তমান যুগে আমাদের কাছে জেমস ওয়েবের মতো শক্তিশালী টেলিস্কোপ আছে। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি দেখতে পাই সেই টেলিস্কোপের চোখে। কিন্তু ভাবুন তো, আমাদের গ্যালাক্সিতেই ঘটা কোনো মহাজাগতিক ঘটনার হদিস পেতে যদি বিজ্ঞানীদের টেলিস্কোপ ছেড়ে ধুলোমাখা পুরনো ইতিহাসের বই খুঁজতে হয়, তাহলে কেমন হবে?
সম্প্রতি ঠিক এমনটাই ঘটেছে। জার্মানির জেনা ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা মধ্যযুগের আরবি কবিতা আর ইতিহাস ঘেঁটে খুঁজে পেয়েছেন হারিয়ে যাওয়া এক সুপারনোভার ঠিকানা!
সুপারনোভা হলো বিশাল কোনো নক্ষত্রের মৃত্যুর সময়কার এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। সূর্যের চেয়ে অন্তত পাঁচ থেকে আট গুণ বা তার বেশি ভরের নক্ষত্র জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে সুপারনোভায় পরিণত হয়। মূলত মহাকর্ষের প্রচণ্ড চাপের কারণে ঘটে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণের আলো এতই তীব্র হয় যে, দিনের আলোতেও তা দেখা যেতে পারে।
বিষয়টা একটু ভেঙে বলি। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ঘটে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। মহাকর্ষের প্রচণ্ড চাপে হাইড্রোজেন বা হিলিয়ামের মতো মৌলের হালকা নিউক্লিয়াসগুলো একত্র হয়ে তৈরি হয় অপেক্ষাকৃত ভারী মৌল এবং প্রচণ্ড শক্তি। এরই বহিঃপ্রকাশ নক্ষত্রের বিপুল পরিমাণ তাপ ও আলো। আর তাপ যেখানে থাকবে, সেখানে তো চাপও থাকবে। এই চাপই বাইরের মহাকর্ষের চাপের মোকাবিলা করতে থাকে। তাই নক্ষত্র একটি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে পারে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন হিলিয়াম বা হাইড্রোজেনের মতো নক্ষত্রের জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। নক্ষত্রের কেন্দ্রের তাপ কমে যায় জ্বালানির অভাবে। কমে যায় অভ্যন্তরীণ চাপও। এই সুযোগেই মহাকর্ষের প্রচণ্ড চাপ বাইরে থেকে নিমেষের মধ্যে পুরো নক্ষত্রকে অস্বাভাবিক রকম সংকুচিত করে ফেলার চেষ্টা করে। ফলাফল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, সুপারনোভা।
সুপারনোভা হলো বিশাল কোনো নক্ষত্রের মৃত্যুর সময়কার এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। সূর্যের চেয়ে অন্তত পাঁচ থেকে আট গুণ বা তার বেশি ভরের নক্ষত্র জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে সুপারনোভায় পরিণত হয়।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে শেষবার এমন ঘটনা দেখা গিয়েছিল ১৬০৪ সালে। তখনো টেলিস্কোপ সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি। তাই আমাদের গ্যালাক্সির কাছের সুপারনোভাগুলো সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞানীদের নির্ভর করতে হয় প্রাচীন মানুষদের ওপর। তাদের চোখে দেখা বর্ণনার ওপর।
জার্মান গবেষক রালফ নিউহাউজার সম্প্রতি মিশরের কায়রো থেকে পাওয়া দুটি মধ্যযুগের আরবি টেক্সট নিয়ে গবেষণা করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো ১১৮১-১১৮২ সালের দিকে লেখা একটি কবিতা। কবি ইবনে সানা আল-মুলক এই কবিতাটি লিখেছিলেন বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি সুলতান সালাউদ্দিনের প্রশংসায়।
কবিতাটি পড়তে গিয়ে গবেষকেরা চমকে ওঠেন। কবি সেখানে আকাশের এক নতুন নক্ষত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নক্ষত্রটি দেখা গিয়েছিল মেহেদি রাঙানো হাতের মতো নক্ষত্রমণ্ডলীতে।’ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে একে আমরা চিনি ক্যাসিওপিয়া নামে।
কবিতাটি পড়তে গিয়ে গবেষকেরা চমকে ওঠেন। কবি সেখানে আকাশের এক নতুন নক্ষত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নক্ষত্রটি দেখা গিয়েছিল মেহেদি রাঙানো হাতের মতো নক্ষত্রমণ্ডলীতে।’ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে একে আমরা চিনি ক্যাসিওপিয়া নামে।
চীন এবং জাপানের ইতিহাসেও ১১৮১ সালের এই সুপারনোভার কথা আছে। কিন্তু তাদের বর্ণনায় এর সঠিক অবস্থান বোঝা যাচ্ছিল না। আরবের এই কবির কবিতাই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীদের নিশ্চিত করল, ঠিক আকাশের কোন কোণায় সেই বিস্ফোরণটি হয়েছিল।
দ্বিতীয় যে টেক্সটটি গবেষকরা দেখেছেন, সেটি লিখেছেন মিশরীয় পণ্ডিত আল-মাকরিজি। তিনি ১০০৬ সালের একটি সুপারনোভার বর্ণনা দিয়েছেন।
আল-মাকরিজির ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, ১০০৬ সালের সেই সুপারনোভাটি ছিল গত ২ হাজার বছরের ইতিহাসে দেখা সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। এটি এতই উজ্জ্বল ছিল যে, রাতের আকাশে চাঁদের মতোই আলো ছড়াত! পৃথিবী থেকে মাত্র ৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে ঘটা এই ঘটনাটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময়।