নভোচারী পাঠাতে গিয়ে নিজেদের একমাত্র সচল লঞ্চপ্যাডই দুমড়েমুচড়ে ফেলল রাশিয়া
মহাকাশ অভিযানে রাশিয়ার দাপট সেই ১৯৫৭ সাল থেকে। কিন্তু সেই রাশিয়া আজ এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি, যা গত ৬০ বছরেও দেখা যায়নি। ঘটনাটা অনেকটা এমন—নভোচারীদের মহাকাশে পাঠাতে গিয়ে তারা সফল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পেছনের দরজাটা এমনভাবে ভেঙে ফেলেছে যে, এখন আর বের হওয়ার উপায় নেই!
সহজ কথায়, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারী পাঠাতে গিয়ে রাশিয়া ভুলবশত তাদের একমাত্র সচল লঞ্চপ্যাডটি ধ্বংস করে ফেলেছে। ফলে ১৯৬১ সালের পর এই প্রথম দেশটি মহাকাশে মানুষ পাঠানোর সক্ষমতা হারিয়ে ফেলল।
আসলে কী ঘটেছিল
২৭ নভেম্বর ছিল থ্যাঙ্কস গিভিং ডে। কাজাখস্তানের বাইকোনুর কসমোড্রোমের ‘সাইট ৩১/৬’ থেকে রাশিয়ার সয়ুজ এমএস-২৮ রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হয়। স্থানীয় সময় তখন দুপুর আড়াইটা। রকেটে ছিলেন মোট তিন নভোচারী। দুজন রাশিয়ান কসমোনট সের্গেই কুদ-সিভারচকভ ও সের্গেই মিকায়েভ এবং নাসার নভোচারী ক্রিস উইলিয়ামস। সুখবর হলো, তাঁরা তিনজনই নিরাপদে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছেছেন এবং আগামী আট মাস সেখানেই থাকবেন।
কিন্তু বিপত্তিটা বাধল মাটিতে। রকেট আকাশে উড়ার পরপরই রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা রসকসমস জানায়, উৎক্ষেপণের সময় লঞ্চপ্যাডের বড়সড় ক্ষতি হয়েছে। টেলিগ্রামে তারা লিখেছে, ‘লঞ্চপ্যাডের বেশ কিছু যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়া বিস্তারিত কিছু না জানালেও ভেতরের খবর কিন্তু বেশ ভয়ংকর। আর্স টেকনিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, রকেট ওড়ার সময় ইঞ্জিনের কাজ করার জন্য ব্যবহৃত প্রায় ২০ টন ওজনের একটি বিশাল সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম সোজা গিয়ে পড়ে ফ্লেম ট্রেঞ্চে।
ফ্লেম ট্রেঞ্চ হলো লঞ্চপ্যাডের ঠিক নিচের জায়গা, যেখানে রকেটের আগুনের ধোঁয়া আর তাপ বের হয়। ধারণা করা হচ্ছে, উৎক্ষেপণের আগে ওই বিশাল লোহার কাঠামোটি ঠিকমতো আটকানো ছিল না। ফলে রকেটের ধাক্কায় সেটা ধসে পড়ে এবং পুরো লঞ্চপ্যাডটিকেই অকেজো করে দেয়।
বিষয়টা রুশদের জন্য বেশ লজ্জার। কারণ বাইকোনুর কসমোড্রোমের এই ‘সাইট ৩১/৬’ ছিল তাদের হাতে থাকা একমাত্র সচল লঞ্চপ্যাড, যা দিয়ে মানুষ মহাকাশে পাঠানো যেত। এর আগে ২০২০ সালে তারা ঐতিহাসিক ‘গ্যাগারিনস স্টার্ট’ (সাইট ১/৫) প্যাডটি অবসরে পাঠিয়েছিল।
বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কি
না, আপাতত নেই। রাশিয়ার নিজের দেশে ‘ভস্তোচনি’ এবং ‘পলেসেতস্ক’ নামে আরও দুটি কসমোড্রোম আছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই মানুষবাহী সয়ুজ রকেট উৎক্ষেপণের জন্য তৈরি নয়।
বাইকোনুর কসমোড্রোমটি তৈরি হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে, সোভিয়েত আমলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর এটি কাজাখস্তানের ভাগে পড়ে। রাশিয়া এখন বছরে প্রায় ১১৫ মিলিয়ন ডলার ভাড়া দিয়ে এটি ব্যবহার করে। এখন এই ভাঙা প্যাড মেরামত করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।
ভবিষ্যতে রাশিয়া কীভাবে নভোচারী পাঠাবে
রাশিয়ার জন্য এখন বড় পরীক্ষা হলো সময়। কারণ আগামী ২০ ডিসেম্বর, অর্থাৎ তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে এই প্যাড থেকেই একটি কার্গো বা রসদবাহী রকেট ওড়ার কথা ছিল। আর পরবর্তী মানুষবাহী মিশনটি হওয়ার কথা ২০২৬ সালের জুলাই মাসে।
মহাকাশ নীতি বিশেষজ্ঞ জেফ ম্যানবার বলছেন, ‘রাশিয়া তাদের এই ভাঙা লঞ্চপ্যাড কত দ্রুত ঠিক করতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এটা তাদের সক্ষমতার এক বড় পরীক্ষা।’
রাশিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করছে। তারা ২০২৭ সাল থেকে নিজেদের অরবিটাল স্টেশন বানাতে চায় এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের সঙ্গে মিলে চাঁদে বেস বানানোর স্বপ্ন দেখছে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, স্বপ্ন অনেক বড় হলেও মাটির নিচের ভিত্তিটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। শুধু রাশিয়াই নয়, তাদের বন্ধু চীনও সম্প্রতি মহাকাশে বিপদে পড়েছে। নভেম্বরের শুরুতে মহাকাশের আবর্জনার ধাক্কায় চীনের স্পেস স্টেশনের একটি ক্যাপসুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফলে তাদের নভোচারীরা সাময়িকভাবে আটকা পড়েছিলেন।
সব মিলিয়ে, মহাকাশ জয়ে পথিকৃৎ রাশিয়া এখন নিজেদের আঙিনাতেই বড় এক হোঁচট খেল। এখন দেখার বিষয়, তারা কত দ্রুত আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।