প্রথমবার ডার্ক ম্যাটার ‘দেখার’ দাবি বিজ্ঞানীদের

গ্যালাকটিক কেন্দ্রের প্রায় ১০০ ডিগ্রি এলাকাজুড়ে গামা-রশ্মির তীব্রতার মানচিত্রছবি: তোমোনোরি তোতানি, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়

ধরুন, আপনি একটা অন্ধকার ঘরে বসে আছেন। আপনার সামনের চেয়ারটা হুট করে সরে গেল, কিন্তু আপনি কাউকে দেখতে পেলেন না। ফ্যানটা নিজ থেকেই ঘুরছে, অথচ সুইচ কেউ টেপেনি। অর্থাৎ, ঘরে অন্য কেউ আছে, কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না।

মহাবিশ্বের অবস্থাটাও ঠিক এমনই। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই জানেন, মহাবিশ্বের বেশির ভাগ জায়গাজুড়ে এমন এক ভুতুড়ে বস্তু আছে, যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না; কিন্তু তার মহাকর্ষ বলের টানে গ্যালাক্সিগুলো টিকে আছে। এর নাম ডার্ক ম্যাটার।

শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা এই অদৃশ্য বস্তুর খোঁজ করছেন। অবশেষে নাসার ফার্মি গামা-রে স্পেস টেলিস্কোপ হয়তো সেই ‘ভূতের’ দেখা পেয়েছে! যদি এটা সত্যি হয়, তবে মানব ইতিহাসে এই প্রথম আমরা ডার্ক ম্যাটারের ‘দেখা’ পেলাম!

আরও পড়ুন

এই গল্পের শুরু ১৯৩৩ সালে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ জুইকি খেয়াল করলেন, কোমা ক্লাস্টারের গ্যালাক্সিগুলো এত জোরে ঘুরছে যে সাধারণ ভরের টানে তাদের একসঙ্গে থাকার কথা নয়। ওগুলোর ছিটকে উড়ে যাওয়ার কথা! তিনি বুঝলেন, অদৃশ্য কোনো এক বিশাল ভর ওগুলোকে ধরে রেখেছে।

এরপর সত্তরের দশকে ভেরা রুবিন দেখলেন, সর্পিলাকার বা প্যাঁচানো গ্যালাক্সির বাইরের দিকের নক্ষত্রগুলো কেন্দ্রের নক্ষত্রগুলোর মতোই সমান গতিতে ঘুরছে। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী এটাও অসম্ভব, যদি না সেখানে অদৃশ্য কোনো বিপুল ভর লুকিয়ে থাকে।

আরও পড়ুন
তোতানি দাবি করছেন, তাঁরা গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে আসা একটা বিশেষ গামা রশ্মির সংকেত পেয়েছেন। এর শক্তি প্রায় ২০ গিগাইলেকট্রনভোল্ট বা ২ হাজার কোটি ইলেকট্রনভোল্ট।

বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে দেখলেন, আমরা গ্রহ, নক্ষত্র, চাঁদ, আমি, আপনি, এমনকি পাশের বাসার বিড়ালটাসহ যা কিছু দেখি, তা সব মিলিয়ে মহাবিশ্বের মোট ভরের মাত্র ৫ শতাংশ। আর প্রায় ২৭ শতাংশ হলো এই রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার এবং বাকী প্রায় ৬৮ শতাংশ হলো ডার্ক এনার্জি!

ডার্ক ম্যাটার আলোর সঙ্গে কোনো বিক্রিয়া করে না। অর্থাৎ এটি আলো শুষেও নেয় না, প্রতিফলিতও করে না। তাই একে দেখা অসম্ভব। তাহলে নাসা দেখল কীভাবে? বিজ্ঞানীদের একটা তত্ত্ব আছে। তাঁরা বলেন, ডার্ক ম্যাটারের কণাগুলো যখন একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, তখন সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ডার্ক ম্যাটারের এই কাল্পনিক কণাকে বলা হয় উইম্প (WIMPs)। আর এই ধ্বংসের সময় সেগুলো প্রচুর শক্তি বা গামা রশ্মি নির্গত করে। এই গামা রশ্মি আমাদের চোখে দেখা না গেলেও বিশেষ টেলিস্কোপে ধরা পড়ে।

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী তোমোনোরি তোতানি এবং তাঁর দল নাসার ফার্মি টেলিস্কোপ দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ধারণা করা হয়, সেখানেই ডার্ক ম্যাটারের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।

তোতানি দাবি করছেন, তাঁরা গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে আসা একটা বিশেষ গামা রশ্মির সংকেত পেয়েছেন। এর শক্তি প্রায় ২০ গিগাইলেকট্রনভোল্ট বা ২ হাজার কোটি ইলেকট্রনভোল্ট।

আরও পড়ুন

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এই গামা রশ্মির যে প্যাটার্ন বা নকশা, তা হুবহু ডার্ক ম্যাটার ধ্বংস হলে যেমন হওয়ার কথা, ঠিক তেমনই! অন্য কোনো সাধারণ নক্ষত্র বা মহাজাগতিক ঘটনা দিয়ে এর ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে না। তোতানি বলছেন, ‘আমার জানা মতে, এই প্রথম মানবজাতি ডার্ক ম্যাটার দেখল।’

এই আবিষ্কার যদি নিশ্চিত হয়, তবে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের বই নতুন করে লিখতে হতে পারে। কারণ, ডার্ক ম্যাটার আমাদের জানা প্রোটন বা ইলেকট্রনের মতো কোনো সাধারণ কণা দিয়ে তৈরি নয়। এটি সম্পূর্ণ নতুন এক কণা, যা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরে।

তবে বিজ্ঞানীরা এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসছেন না। তোতানি নিজেও বলছেন, ‘আমরা নিশ্চিত, তবে আরও তথ্য দরকার।’

জার্নাল অব কসমোলজি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোপার্টিক্যাল ফিজিকস-এ প্রকাশিত এই গবেষণা যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তবে এটি হবে এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার!

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

সূত্র: স্পেস ডটকম