ডার্ক ম্যাটার নাকি পরিবর্তিত নিউটনীয় বলবিদ্যা
বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্বের প্রায় ৯৫ শতাংশ গঠিত হয়েছে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি দিয়ে। এই ডার্ক ম্যাটারকে অনেকে এক ধরনের কণা বলে মনে করেন। কণা হলেও একে ব্যাখ্যা করা যায় না পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড বা প্রতিষ্ঠিত প্রমিত মডেল দিয়ে। তাহলে কি একে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রয়োজন পরিবর্তিত নিউটনীয় ডায়নামিকস? কীভাবে? তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জেনে নিন...
খেয়াল আছে ইয়ান ওর্টের নাম? তাঁর নামে সৌরজগতের একেবারে বাইরের দিকের ধূমকেতুর আবরণ ওর্ট মেঘের নাম দেওয়া হয়েছে। এই ভদ্রলোক আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সি নিয়ে যেসব গবেষণা করেছিলেন, সেটা গ্যালাক্সি জ্যোতির্বিদ্যাকে সুসংহত রূপ দিয়েছিল। ১৯৩২ সালে একটা বেশ বড় পেপারে তিনি দেখালেন, আমাদের গ্যালাক্সি-তলের দুই দিকে তারাদের গতি গ্যালাক্সি–তলের শুধু দৃশ্যমান বস্তু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এখানে এমন কিছু আছে, যা দৃশ্যমান নয়। এটা হয়তো ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থের প্রথম একটি ইঙ্গিত। বর্তমানে আমরা অবশ্য জানি গ্যালাক্সি-তলে তমোপদার্থের বিশেষ অস্তিত্ব নেই। হিপারকোস মহাকাশযান-দুরবিনের তথ্য ব্যবহার করে জ্যোতির্বিদেরা গ্যালাক্সি–তলের ডায়নামিক ঘনত্ব বের করেছেন ৫৬±৬ সৌরীয় ভর প্রতি বর্গ পারসেকে (১ পারসেক = ৩.২৬ আলোকবর্ষ), যেখানে দৃশ্যমান ভর হলো এরই কাছাকাছি একটা সংখ্যা—৫৩ সৌরীয় ভর প্রতি বর্গ পারসেকে। ডায়নামিক ঘনত্ব বলতে একটা মডেল বোঝানো হচ্ছে, যার মধ্যে দৃশ্য ও অদৃশ্য সব বস্তু রয়েছে।
১৯৩৩ সালে ফ্রিৎজ জুইকি কোমা গ্যালাক্সি স্তবকের কয়েকটি গ্যলাক্সির গতিবেগ বিশ্লেষণ করে দেখান, সেই গ্যালাক্সিগুলোর নিজস্ব গতি এত বেশি যে সেই গতি কোমা স্তবকের দৃশ্যমান পদার্থ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। ওই গতি থাকলে কোমা স্তবকের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়, অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলো স্তবক ছেড়ে চলে যেত। জুইকি লিখলেন, ‘উজ্জ্বল (দৃশ্যমান) বস্তুর পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে যে ঘনত্ব আহরণ করা যায়, তার থেকে কোমার গড় ঘনত্বকে ৪০০ গুণ বেশি হতে হবে।’ বর্তমানের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, কোমার সার্বিক ভরের ৮৫ শতাংশই ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তু।
১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে ভেরা রুবিন ও তাঁর গবেষক সঙ্গীরা দুটি পেপার প্রকাশ করলেন সর্পিল আকৃতির গ্যালাক্সির বাহুতে অবস্থিত তারাদের গতিবেগ নিয়ে। এই গতিবেগ তাঁরা নির্ধারণ করেছিলেন দৃশ্যমান হাইড্রোজেন বা নাইট্রোজেনের বর্ণালি রেখার ডপলার সরণ থেকে। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে ঘূর্ণমান তারাদের গতি কেন্দ্র থেকে বহু দূরে কমে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ভেরা রুবিনের দল আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল, সেই গতি না কমে বরং অপরিবর্তনশীল থাকছে। (এ তথ্য অবশ্য বেতার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হাইড্রোজেনের ২১ সেন্টিমিটার রেখাটির পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ১৯৬০-এর দশক থেকে জানতেন।)
চিত্র ১-এ আমরা দেখাচ্ছি, সৌরজগতের গ্রহরা সূর্য থেকে যত দূরে যাচ্ছে, তাদের প্রদক্ষিণ গতিবেগ তত কমছে। এখানে কেন্দ্রাভিমুখী বলকে মাধ্যাকর্ষণ বলের সঙ্গে সমান গণ্য করা হয়েছে। কাজেই কেপলার ও নিউটনের সূত্র অনুযায়ী এ গতিবেগ সূর্য থেকে দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক বর্গমূল হিসেবে কমবে (v~1/√r)। এ গতিবেগ আবার তার কক্ষপথের অভ্যন্তরের সমস্ত ভরের ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ ভর যত বেশি হবে, গতিবেগও তত বাড়বে (v~√M)। কিন্তু ভেরা রুবিনরা দেখলেন, সর্পিল গ্যালাক্সির বেলায় এ তত্ত্ব খাটছে না।
চিত্র ২-তে আমরা দেখছি যে গ্যালাক্সির দৃশ্যমান বস্তুর ভিত্তিতে যদি তারাদের গতিবেগ নির্ধারিত হয়, তবে প্রথমে কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে গেলে সেটা বাড়বে (এর কারণ হলো কক্ষপথের অভ্যন্তরে তারা ও গ্যাসের পরিমাণ বাড়বে), কিন্তু এক বা দুই কিলো পারসেকের পর থেকে গতিবেগ কমতে থাকবে। কারণ, অভ্যন্তরীণ ভর আর দূরত্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না (নীল রেখা)।
বোঝা যাচ্ছে, চিত্র ২-এ কেন্দ্র থেকে দূরে তারাদের গতিবেগ যে শ্লথ হয়ে যাচ্ছে না, মোটামুটি একই থাকছে (সবুজ রেখা) সেটা আলোর ভিত্তিতে নির্ধারিত দৃশ্যমান ভর দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ভেরা রুবিনরা তাঁদের ১৯৮০ সালের পেপারে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘গ্যালাক্সির উজ্জ্বল ভর কি সমগ্র ভরের একটা ছোট অংশ?’ পরবর্তীকালে গ্যালাক্সির ভেতরে, মূলত তলের চারদিকে, গুপ্ত বস্তুর অস্তিত্ব অনুমান করে নিয়ে গ্যালাক্সির বাইরের দিকের তারাদের অতিরিক্ত গতিবেগ ব্যাখ্যা করা হলো। এতে কেপলারীয় গতিবেগ রক্ষা পেল। কারণ, কক্ষপথের অভ্যন্তরীণ ভর বেড়ে গেল। কিন্তু গ্যালাক্সিতে তমোপদার্থের বণ্টন ঠিক কী রূপ নেবে, তা এখনো ঠিক করা যায়নি। আমরা এই লেখা শুরু করেছিলাম ইয়ান ওর্টকে দিয়ে, সেখানে বলেছিলাম, গ্যালাক্সি-তলে কোনো গুপ্ত বস্তুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে ধারণা করা হচ্ছে, মহাবিশ্বের সবকিছুর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ হলো গুপ্তবস্তু ও গুপ্তশক্তি। কিন্তু এই তমোপদার্থ কী দিয়ে তৈরি? মহাকর্ষীয় লেন্সিং এবং মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির মধ্যে তাপমাত্রার যে ওঠানামা দেখা যায়, সেটা ব্যাখ্যা করতে হলেও ডার্ক ম্যাটারের প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা এই ডার্ক ম্যাটারকে একধরনের কণা বলে ভাবছেন। এটি যদি কণা হয়ে থাকে, তা সাধারণ কণা নয়, যা কিনা প্রতিষ্ঠিত প্রমিত মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তু প্রকৃতির চারটি মূল মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে শুধু মাধ্যাকর্ষণ বলের সঙ্গে কাজ করে। এটি আলোর সঙ্গে কোনো ক্রিয়া করে না, অর্থাৎ তড়িৎ-চুম্বকীয় বলকে এটি অগ্রাহ্য করে, অর্থাৎ এমন নয় যে এর ওপর আলো ফেললে একে দেখা যাবে। নিউক্লীয় সবল মিথস্ক্রিয়াও সেটি করবে না। থাকল বাকি নিউক্লীয় দুর্বল মিথস্ক্রিয়া। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, নিউট্রিনো দুর্বল বলে সংবেদী, হয়তো তমোকণারাও কিছুটা। ৪০ বছর ধরে মাটির গভীরে বিশেষ ডিটেক্টর যন্ত্রে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন সেই কণা আবিষ্কারের। এখন পর্যন্ত তাঁরা সফল হননি।
১৯৭৭ সালে ব্রেন্ট টালি ও রিচার্ড ফিশার একটি পেপার প্রকাশ করলেন, যাতে দেখালেন গ্যালাক্সির বাইরের তারাদের প্রদক্ষিণ গতিবেগ গ্যালাক্সির সার্বিক উজ্জ্বলতার ওপর নির্ভর করে। যে গ্যালাক্সি যত বেশি উজ্জ্বল, সেই গ্যালাক্সি তত বেশি জোরে চক্রাকারে ঘুরছে। দেখা গেল, এই উজ্জ্বলতা গতিবেগের চতুর্থ সূচকের ওপর নির্ভর করে (L~v4) । এটি ব্যবহার করে গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ধারণ করা যায়। অন্যদিকে যত বেশি উজ্জ্বলতা তত বেশি ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থ; অথবা তমোপদার্থ না থাকলেও আমরা বলতে পারি সার্বিক ভর (M~v4) ।
কিন্তু গ্যালাক্সির অনুভূমিক প্রদক্ষিণরেখাকে ব্যাখ্যা করতে কি শুধু তমোপদার্থের ওপর নির্ভর করতে হবে? এটি কি কণা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে? ১৯৮২ সালে মর্দেহাই মিলগ্রোম নামের এক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী একটি বিকল্প পদ্ধতি দিলেন। তিনি বললেন, নিউটনীয় মহাকর্ষীয় সূত্র পরিবর্তন করতে হবে। একে নাম দিলেন পরিবর্তিত নিউটনীয় ডায়নামিকস (MOND)। নিউটনীয় মাধ্যাকর্ষণ বিভব হলো ϕ=-GM/R, যেখানে M হলো অভ্যন্তরীণ ভর, G হলো মহাকর্ষীয় ধ্রুবক এবং R হলো M-এর কেন্দ্র থেকে দূরত্ব। এই বিভবকে ব্যবহার করে আমরা দুটি ভরের মধ্যে (M এবং m) মাধ্যাকর্ষণ বল পাই, যা হলো F=GMm/R2। কিন্তু মিলগ্রোম বললেন, মাধ্যাকর্ষণ বিভব হবে ϕ= √(GMa0)ln(R/MG), এখানে a0 হলো ত্বরণ ধ্রুবক। এর থেকে যে মাধ্যাকর্ষণ বল পাওয়া যায়, সেটা হলো F=m√(MGa0)/R। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আমরা যদি এই বলকে কেন্দ্রাভিমুখী বলের সঙ্গে তুলনা করি, তবে M~v4 পাওয়া যাবে, অর্থাৎ MOND-এর একটি স্বাভাবিক অনুসিদ্ধান্ত হলো টালি-ফিশার সম্পর্ক। এখানে দেখা যাচ্ছে, তারাদের গতিবেগ শেষ পর্যন্ত দূরত্বের ওপর নির্ভর করে না, বরং তার ত্বরণের ওপর নির্ভর করে।
তার মানে কি MOND দিয়ে গুপ্ত বস্তু প্রতিস্থাপন করা যাবে? এখন পর্যন্ত এর উত্তর হলো—না। গ্যালাক্সির প্রদক্ষিণ বেগ MOND দিয়ে ব্যাখ্যা করা গেলেও অন্যান্য জায়গায় MOND তেমন কার্যকর হচ্ছে না, বিশেষত মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির যে মানচিত্র, তাতে তাপমাত্রার যে সামান্য হ্রাসবৃদ্ধি আছে, সেটাকে ব্যাখ্যা করতে হলে গুপ্ত বস্তু আনতে হচ্ছে। এ ছাড়া MOND এখন পর্যন্ত একটি অ্যাডহক তত্ত্ব, যার তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমি শক্ত নয়। আপাতত এ বিষয়ে বিস্তারিত না গিয়ে বলি, অনেক তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী গুপ্ত বস্তু ও MOND-এর একটি মেলবন্ধন করতে চাইছেন, যাতে আইনস্টাইনীয় আপেক্ষিকতার সঙ্গে সংঘর্ষ হবে না। তাঁরা তমোপদার্থকে আখ্যায়িত করছেন একধরনের কোয়ান্টাম সুপারফ্লুইড বলে, যা কিনা বিভিন্ন তাপমাত্রায় ভিন্ন ভিন্নভাবে আচরণ করে। মহাবিশ্বের উষালগ্নে তার মধ্যে কণার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যা কিনা প্রতিভাত হয়েছে মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমিতে, আর মহাবিশ্ব শীতল হয়ে এলে এটি ক্ষেত্রসুলভ (ফিল্ড) আচরণ করে, যেমনটি দেখা যায় সর্পিলাকার গ্যালাক্সিগুলোতে। এটি বেশ একটি কৌতূহলোদ্দীপক আইডিয়া, এ নিয়ে পরে লেখার আশা রাখি।
