আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং আইনস্টাইনের থট এক্সপেরিমেন্ট

আইনস্টাইন প্রায় ১০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৬ সালে প্রকাশ করেন আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব

মানব সভ্যতার বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে সবচেয়ে যুগান্তকারী তত্ত্বের নাম খুব সম্ভবত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। মানুষের অনন্য চিন্তাশক্তির উৎকর্ষতার প্রমাণ মেলে এই তত্ত্বে। এর মাধ্যমে একই সঙ্গে ব্যাখ্যা করা সম্ভব মহাকর্ষ, গতি, পদার্থ, শক্তি, স্থান-কাল, ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর, বিগ ব্যাং এবং এমনকি ডার্ক এনার্জিও। বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে শুরু করে প্রায় এক দশক সময় নিয়ে আইনস্টাইন এই তত্ত্বের অবতারণা করেন।

আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সূচনা হয়েছিল নিউটনের গতিবিষয়ক সূত্রের সঙ্গে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক তত্ত্বের সূত্রের মধ্যকার অসামঞ্জস্যতা থেকে। নিউটন প্রকৃতিকে বর্ণনা করেছিলেন এর উপাদান বস্তুগুলোর গতির মাধ্যমে। আর এই বস্তুগুলোর মধ্যে বিদ্যমান থাকে আপেক্ষিক গতি। আলোর গতিকেও তিনি ব্যতিক্রম ভাবতেন না। উৎস এবং পর্যবেক্ষকের ওপর ভিত্তি করে আলোর বেগের তারতম্য হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। অন্যদিকে, ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক তত্ত্ব অনুসারে আলোর বেগ ধ্রুব। উৎস বা পর্যবেক্ষকের ওপর এটি নির্ভরশীল নয়।

আরও পড়ুন
উনিশ শতকের শেষ দিকে অনেকেই মনে করতেন, মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার মতো প্রয়োজনীয় সমীকরণগুলো বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে চলুন, আলোর বেগ কীভাবে প্রথমবারের মতো মাপা হয়েছিল, তা দেখে আসা যাক। ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ ওলে রোমার ১৬৭৬ সালে বৃহস্পতির উপগ্রহ লো-এর গ্রহণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আলোর বেগ পরিমাপ করতে সক্ষম হন। একবার কক্ষপথ সম্পূর্ণ করতে লো-এর সময় লাগে পৃথিবীর হিসেবে ১.৭২৯ দিন। তাই পৃথিবী থেকে প্রায়ই এটির গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। অনেক বছর ধরে এই ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে রোমার একটি চমকপ্রদ বিষয় লক্ষ্য করেন। পৃথিবী ও বৃহস্পতির মধ্যকার দূরত্ব কম বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে লো উপগ্রহের পরপর দুটি গ্রহণ পর্যবেক্ষণের মধ্যকার সময়কালেও তারতম্য হয়। যখন পৃথিবী ও বৃহস্পতির মধ্যকার দূরত্ব সবচেয়ে কম থাকে, তখন প্রায় ১১ মিনিট আগে পৃথিবী থেকে গ্রহণ দেখা যায়। আর উল্টোটা হলে গ্রহণ দেখা যায় ১১ মিনিট পর। প্রায় ছয় মাস ধরে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রোমার এই তথ্যগুলো নিশ্চিত করেন। এখান থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, আলোর বেগ অসীম নয়। কারণ তেমনটা হলে উপগ্রহের গ্রহণ আগে বা পরে দেখা যেত না। সব সময় একই সময়ে দেখা যেত। রোমারের পরিমাপে আলোর বেগের মান পাওয়া যায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৩১ হাজার মাইল, যা প্রকৃত মানের চেয়ে মাত্র ২৫ শতাংশ কম। ১৮৫০ সালের দিকে আলোর প্রকৃত বেগের মান জানা সম্ভব হয়।

যা-ই হোক, নিউটনের মহাবিশ্বে আলোর বেগ ধ্রুব ছিল না। বরং উৎস এবং পর্যবেক্ষকের মধ্যকার গতির ওপর ভিত্তি করে আলোর বেগের পরিবর্তন হতে পারত। তবে তৎকালীন বিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টা করেও আলোর বেগ কম-বেশি হওয়ার কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি।

আরও পড়ুন

২.

উনিশ শতকের শেষ দিকে অনেকেই মনে করতেন, মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার মতো প্রয়োজনীয় সমীকরণগুলো বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এখন শুধু প্রয়োজন আরও সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করার পদ্ধতি খুঁজে বের করা। তবে আইনস্টাইন এমনটা বিশ্বাস করতেন না। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বিভিন্ন থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষা করা শুরু করেছিলেন। এতে তিনি নিজেই নিজেকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন এবং কল্পনার রাজ্যে সেগুলোর উত্তর খুঁজতেন। এমনই একটি প্রশ্ন ছিল, ‘যদি কেউ একজন একটি আলোকরশ্মির ওপর চেপে বসে ভ্রমণ করা শুরু করে, তাহলে সে কী দেখবে?’ নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে, এর উত্তর ছিল খুব সরল। সেই ব্যক্তি আলোর বেগের সমান বেগ নিয়ে পরিভ্রমণ করবে। এই সময়ে তার সামনের দিক থেকে আসা আলো দ্বিগুণ বেগে তার চোখে এসে পৌঁছাবে। আর পেছন থেকে আসা আলো কখনোই তার কাছে পৌঁছাবে না। অর্থাৎ সেই ব্যক্তি পেছনে শুধু অন্ধকার দেখবে!

এই প্রশ্নটিও আপেক্ষিকতা আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত। তবে এ আবিষ্কারের মূলে ছিল আরেকটি মানস পরীক্ষা। এতে আইনস্টাইন দুজন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করেন। তাদের একজনের অবস্থান ছিল চলন্ত ট্রেনে, অন্যজন স্থির অবস্থায় দাঁড়ানো ছিলেন ট্রেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ধরা যাক, চলন্ত ট্রেনের যাত্রীর নাম বব এবং অন্যজনের নাম প্যাট। এবার নিচের ছবিগুলো লক্ষ্য করুন। 

ছবি ১: আপেক্ষিকতাবিষয়ক আইনস্টাইনের মানস পরীক্ষা

প্রথম ছবিতে ববকে চলন্ত ট্রেনের ভেতরে একটি টর্চ লাইটের সুইচ অন করতে দেখা যাচ্ছে। ঠিক ওপরের আয়নায় সেই টর্চ থেকে নির্গত আলো প্রতিফলিত হয়। একটি ঘড়ির সাহায্যে বব সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া (আলো টর্চ থেকে নির্গত হয়ে, আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে আবারও আগের জায়গায় ফিরে আসা) সম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজনীয় সময় পরিমাপ করে। এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক প্ল্যাটফর্মে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা প্যাটের দিকে। সেও একই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে। কিন্তু সম্পূর্ণ ঘটনাটিকে সে একটু ভিন্নভাবে সংঘটিত হতে দেখবে। বব টর্চের আলো সোজা পথে ওপরে উঠতে এবং নিচে নামতে দেখে (ছবির প্রথম অংশ)। কিন্তু প্যাট আলোর গতিপথ সোজা দেখবে না। ওপরের ছবির দ্বিতীয় অংশের মতো বক্রপথে চলতে দেখবে আলোকে।

প্রসঙ্গ কাঠামোর গতির সঙ্গে সময়ের এই তারতম্যের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে হলে অবশ্যই বস্তুগুলোকে পরস্পরের সাপেক্ষে অত্যন্ত দ্রুত বেগে (আলোর কাছাকাছি বেগে) চলাচল করতে হবে।

স্থির অবস্থায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা প্যাটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আলো বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে। আলোর বেগ উভয় ক্ষেত্রেই একই হওয়ায় প্যাটের গণনায় সম্পূর্ণ ঘটনাটি ঘটার সময়কাল অবধারিতভাবে ববের তুলনায় বেশি হবে। অর্থাৎ, দুটি ভিন্ন অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করলে একই ঘটনা ঘটার সময়কাল ভিন্ন পাওয়া যায়। আশ্চর্য ব্যাপার, তাই না?

মূলত এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই সূচনা হয়েছিল আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের। আইনস্টাইন উপরোক্ত ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এমন একটি বিষয় সামনে এনেছিলেন, যা অন্য কোনো বিজ্ঞানী স্বপ্নেও ভাবেননি। আর সেটি হলো, সময় ধ্রুব নয়, বরং পরিবর্তনশীল!

আরও পড়ুন

আমরা জানি, বেগকে পরিমাপ করা হয় সরণ এবং সময় দিয়ে। একক সময়ে অতিক্রান্ত সরণের নামই বেগ। গাণিতিকভাবে, v =  । এই সমীকরণে বেগ যদি ধ্রুবক হয়, তাহলে সময়কে অবশ্যই পরিবর্তনশীল হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

মানস পরীক্ষায় ট্রেনের ভেতরে অবস্থানরত ববের কাছে তার ঘড়িটি স্বাভাবিকভাবেই চলছে বলে মনে হবে। কিন্তু স্টেশনে দাঁড়ানো প্যাট সেই একই ঘড়িকে ধীরে চলতে দেখবে। সময় পরিমাপের অন্যান্য পদ্ধতি, যেমন পেন্ডুলাম, কোয়ার্টজ ক্রিস্টালের কম্পন ইত্যাদি ব্যবহার করেও ট্রেনে অবস্থানরত বব সময় ধীরে চলার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে পারবে না। অর্থাৎ পর্যবেক্ষকের প্রসঙ্গ কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে সময়। যে ব্যক্তি যত দ্রুত চলবে, তার কাছে সময় তত কম অতিক্রান্ত হয়েছে বলে মনে হবে।

একটি কথা বলে রাখা ভালো। প্রসঙ্গ কাঠামোর গতির সঙ্গে সময়ের এই তারতম্যের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে হলে অবশ্যই বস্তুগুলোকে পরস্পরের সাপেক্ষে অত্যন্ত দ্রুত বেগে (আলোর কাছাকাছি বেগে) চলাচল করতে হবে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতায় এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ অসম্ভব।

৩.

চলুন, আবারও ফেরা যাক মানস পরীক্ষাটায়। এবার বব এবং প্যাট—দুজনের কাছেই আছে একটি করে বল। এগুলোর ভর সমান এবং আকার-আকৃতি সম্পূর্ণ এক। আগের মতো ববের অবস্থান চলন্ত ট্রেনে (আলোর কাছাকাছি বেগে গতিশীল) এবং প্যাট দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। এবার তারা দুজনেই বলগুলোকে অন্যের দিকে ছুড়ে মারে। ঠিক মাঝ দূরত্বে এসে বলগুলো পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং যে দিক থেকে এসেছিল সে দিকেই ফেরত চলে যায়। যদি তারা দুজনেই একই রেফারেন্স ফ্রেমে থাকত (অর্থাৎ, দুজনেই ট্রেনের ভেতরে গতিশীল অবস্থায় বা দুজনেই স্থির অবস্থায় প্ল্যাটফর্মে থাকে), তাহলে কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই বলগুলো মাঝপথে ধাক্কা খেয়ে আগের জায়গায় ফেরত চলে যেত। কিন্তু থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষায় তারা দুজন আলাদা প্রসঙ্গ কাঠামোয় রয়েছে। তাই প্যাটের কাছে মনে হবে, ববের ছোঁড়া বলটি অনেক ধীর গতিতে এসে অন্য বলটিকে ধাক্কা দিচ্ছে। গতিশীল অবস্থায় সময় ধীর হয়ে যাওয়ার জন্যই সে এমনটা দেখবে। আর এই ঘটনা শুধু তখনই ঘটতে পারে, যখন ববের ছোড়া বলটি আগের চেয়ে ভারী হয়ে যায়। অর্থাৎ, এর ভর বেড়ে যায়।

বব ও প্যাটের বল দুটি স্থির অবস্থায় সম্পূর্ণ এক হলেও অনেক বেশি বেগে গতিশীল থাকায় (আলোর কাছাকাছি বেগে) ববের বলটির ভর বৃদ্ধি পাবে। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটা সত্যি। সময়ের মতো করে ভরেরও আপেক্ষিকতা দেখা যায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। অনেকেই নিশ্চয়ই লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের (LHC) নাম শুনেছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত এই পার্টিকেল এক্সিলারেটর বা কণাত্বরক যন্ত্রে প্রোটনের বেগ বাড়িয়ে আলোর বেগের প্রায় ৯৯.৯৯ শতাংশ করা হয়েছিল। এই উচ্চ বেগের প্রোটনগুলোর ভর পরিমাপ করে দেখা গেছে, স্থির প্রোটনের চেয়ে এদের ভর প্রায় ৭,৫০০ গুণ পর্যন্ত বেশি হতে পারে।

একই ব্যক্তিকে এবার একটি রকেটে করে পাঠিয়ে দেয়া হলো মহাশূন্যে, যেখানে মহাকর্ষের লেশমাত্রও নেই। সেখানে রকেটটি স্থির, শূন্যে ভাসমান থাকায় সেই ব্যক্তিও ওজনহীনতা অনুভব করবেন।

বেগ এবং ভরের মধ্যকার নিবিড় সম্পর্ক থেকে প্রকৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। সেটি হলো, কোনো বস্তুর প্রকৃতি যা-ই হোক না কেন, সেটির বেগ কখনোই আলোর চেয়ে বেশি হতে পারে না। এর বেগ যতই আলোর বেগের নিকটবর্তী হতে থাকে, তত ভর বাড়তে থাকে। এক সময় তা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে ছুঁয়ে ফেলে অসীমকে। একই সঙ্গে সময়ও ধীর হতে হতে প্রায় থেমে যায়। তাই আলোর বেগকে অতিক্রম করতে প্রয়োজন অসীম পরিমাণ শক্তি, যা পাওয়া অসম্ভব।  

আরও পড়ুন

৪.

বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এটি শুধু কাজ করে ত্বরণের অনুপস্থিতিতে। অর্থাৎ রেফারেন্স ফ্রেমগুলোকে অবশ্যই পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুব বেগে গতিশীল থাকতে হবে। এতক্ষণ আলোচনা করা মানস পরীক্ষাতেও বব এবং প্যাটের রেফারেন্স ফ্রেম পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুব বেগে গতিশীল ছিল। কোনো ত্বরণের অস্তিত্ব এতে ছিল না। অন্যদিকে মহাবিশ্বের সবখানেই ত্বরণের অস্তিত্ব আছে। তাই একে ব্যাখ্যা করার সামর্থ নেই আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের।

এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে কাজে নেমে পড়েছিলেন আইনস্টাইন। প্রায় ১০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৬ সালে প্রকাশ করেন আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। এর মাধ্যমে তিনি মহাকর্ষকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের চেয়েও নিখুঁতভাবে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করা যায় এর মাধ্যমে। আর এ সবই শুরু হয়েছিল আইনস্টাইনের আরেকটি অনন্য সাধারণ মানস পরীক্ষার মাধ্যমে। পরে তিনি নিজেই এই চিন্তাকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখী চিন্তা (হ্যাপিয়েস্ট থট) হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন! চলুন সহজভাবে জেনে আসি, আইনস্টাইনের জীবনের সবচেয়ে সুখী চিন্তার কথা।

প্রথমেই কল্পনা করে নিন, এক ব্যক্তি লিফট ব্যবহার করে ওপরের দিকে উঠছেন। ধরুন, হঠাৎ করে আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনায় লিফটের কেবল (তার) ছিঁড়ে গেল এবং সেটি নিচের দিকে পড়তে শুরু করল। এ সময়ে লিফট এবং লিফটের মধ্যে থাকা ব্যক্তি উভয়েই মহাকর্ষের প্রভাবে g=9.8 ms-2 ত্বরণে মুক্তভাবে নিচে পড়তে থাকবেন। অবধারিতভাবেই ওই ব্যক্তি তখন নিজেকে ওজনহীন অনুভব করবেন। সে সময়ে তিনি যদি তাঁর হাতে থাকা কোনো বস্তুকে ছেড়ে দেন, তাহলে তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করবেন, বস্তুটি শূন্যে ভেসে আছে, নিচে পড়ছে না। আসলে লিফট, বস্তু এবং ব্যক্তি—সবাই একই সঙ্গে একই ত্বরণে নিচে পড়ে যাচ্ছে। তাই আপাতদৃষ্টিতে ওই বস্তুটিকে স্থির মনে হচ্ছে।

এবারে নতুন আরেকটি ঘটনা কল্পনা করা যাক। সেই একই ব্যক্তিকে এবার একটি রকেটে করে পাঠিয়ে দেয়া হলো মহাশূন্যে, যেখানে মহাকর্ষের লেশমাত্রও নেই। সেখানে রকেটটি স্থির, শূন্যে ভাসমান থাকায় সেই ব্যক্তিও ওজনহীনতা অনুভব করবেন। পাশাপাশি হাত থেকে কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে সেটিও শূন্যে ভেসে থাকবে। নিচের ছবির প্রথম অংশে বিষয়টি সহজভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

 আইনস্টাইনের মতে, ওপরের দুটি ঘটনাই সমতুল্য (Equivalent)। লিফট ছিঁড়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট ওজনহীনতা এবং মহাশূন্যে ওজনহীনতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পদার্থবিজ্ঞানের সব ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করেও এই দুটি ঘটনার মধ্যে বিন্দুমাত্র পার্থক্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

ছবি ২: ক) মুক্তভাবে পড়ন্ত লিফট এবং মহাশূন্যে স্থির রকেটের ওজনহীনতা সমতুল্য খ) ভূপৃষ্ঠে দাঁড়ানো ব্যক্তির অনুভব করা ওজন এবং একই ব্যক্তির g ত্বরণে গতিশীল রকেটে পরিভ্রমণের সময়ে অনুভব করা ওজন একই

এরপর আইনস্টাইন মানস পরীক্ষাটিকে আরেকটু সম্প্রসারিত করলেন। ওপরের ছবির দ্বিতীয় অংশ লক্ষ করুন। বাঁ দিকের অংশে একজন মাটিতে দাঁড়িয়ে। তার ওপর পৃথিবীর মহাকর্ষ বিদ্যমান। এতে তিনি ওজন অনুভব করবেন, যার মান mg পরিমাণ (m ব্যক্তির ভর)। এবার আবারও তাকে রকেটে করে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেওয়া যাক। তবে এবার তাকে বহনকারী রকেটটি স্থির নয়, বরং সেটি g ত্বরণে চলমান। তাই মহাশূন্যে মহাকর্ষ না থাকা সত্ত্বেও এবার তিনি আর নিজেকে ওজনহীন মনে করবেন না। আইনস্টাইনের মতে, এ ঘটনা দুটিও সমতুল্য। ভূপৃষ্ঠে অবস্থান কালে এবং মহাশূন্যে চলমান রকেটে থাকা অবস্থায় সেই ব্যক্তি সমান mg ওজন অনুভব করবেন। সব ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করার পরও এই দুই ঘটনার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আমাদের মহাবিশ্ব ত্রিমাত্রিক। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা—এই তিন মাত্রার সমন্বয়ে এটি গঠিত। তবে আইনস্টাইনের মতে, মহাবিশ্বের মাত্রা চারটি।

এবার একটি প্রশ্ন করা যাক। ভূপৃষ্ঠে অবস্থান করা ব্যক্তি যদি হাত থেকে একটি বল মাটিতে ফেলে দেন, তাহলে সেটি মাটিতে পড়ে যাবে। একই ঘটনা যদি g ত্বরণে চলমান রকেটে ঘটানো হয়, তাহলে ফলাফল কী হবে? রকেটের মধ্যে তো কোনো নেই। তাই হাত থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর বলটি শূন্যে এক জায়গায় ভেসে থাকবে। কিন্তু গতিশীল রকেট এবং রকেটের মেঝেতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি উভয়ই সামনের দিকে অগ্রসর হবে g ত্বরণে। তাই বলটি রকেটের মেঝেতে এসে ধাক্কা খাবে। অর্থাৎ, মহাকর্ষ না থাকার পরও বলটি নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে বলে মনে হবে। পরের ছবিটি দেখলে বিষয়টি আরও সহজে বোঝা যাবে। 

ছবি ৩: রকেটের গতিশীলতার কারণে বল শূন্যে স্থির থাকার পরেও মেঝেতে পৌঁছে যাচ্ছে

অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে দাঁড়ানো অবস্থায় এবং মহাশূন্যে চলমান রকেটে থাকার সময় একই ফলাফল পাওয়া যায়। ফলাফল পাওয়ার রাস্তাটি কেবল ভিন্ন। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এই তত্ত্বকে ডাকা হয় ‘ইকুইভেলেন্স প্রিন্সিপল’ নামে। অত্যন্ত সরল এই তত্ত্ব ব্যবহার করে আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ আরেকবার বদলে দেন, নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন মহাকর্ষকে। চলুন দেখে আসি, কীভাবে।

ধরে নেওয়া যাক, ওপরের মানস পরীক্ষায় g ত্বরণে চলমান রকেটে অবস্থিত ব্যক্তির হাতে বলের পরিবর্তে একটি টর্চ লাইট রয়েছে। রকেটটি যদি স্থির অবস্থায় থাকত, তাহলে টর্চ থেকে আসা আলো সোজা পথে পরিভ্রমণ করে রকেটের দেয়ালে এসে পড়ত। কিন্তু রকেটটি g ত্বরণে গতিশীল থাকায় টর্চ থেকে আলো বের হওয়ার পরের মুহূর্তেই রকেটটি একটু সামনের দিকে অগ্রসর হবে। এতে রকেটটি স্থির অবস্থায় থাকলে আলো দেয়ালের যে অংশে পৌঁছানোর কথা ছিল, তার চেয়ে কিছুটা নিচে এসে পৌঁছাবে। রকেটটি ত্বরণসহ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে টর্চ থেকে নির্গত আলো ক্রমান্বয়ে রকেটের দেয়াল সংলগ্ন মেঝেতে এসে পৌঁছাবে, ঠিক আগের উদাহরণে বর্ণনা করা বলের মতোই। পরের ছবিতে সে কথাই বলা আছে।    

এ ঘটনার অর্থ হলো, রকেটের মধ্যে থাকা ব্যক্তির মনে হবে, আলো সোজা পথে পরিভ্রমণ না করে বক্র পথে পরিভ্রমণ করছে। ইকুইভেলেন্স প্রিন্সিপল অনুসারে, এ ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষা অনুসারে, g ত্বরণে গতিশীল রকেটে থাকা ব্যক্তি এবং ভূপৃষ্ঠে অভিকর্ষ বলের মধ্যে অবস্থানরত ব্যক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পরস্পর সমতুল্য। তাই গতিশীল রকেটে আলোর বেঁকে যাওয়ার ঘটনাটি ভূপৃষ্ঠেও ঘটবে।

ছবি ৪: গতিশীল রকেটে আলোর গতিপথ বেঁকে যাওয়া

কথাটি শুনতে বেশ বেখাপ্পা মনে হচ্ছে না? আলো কীভাবে বেঁকে যাবে? নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুসারে, মহাকর্ষ কাজ করে মহাবিশ্বের যেকোনো ভরের বস্তুর ওপরে। কিন্তু আলোর কণা ফোটনের কোনো ভর নেই। ভর না থাকলে এরা মহাকর্ষ দিয়ে প্রভাবিত হবে কীভাবে?

৫.

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আইনস্টাইন অবতারণা করেন আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বে মহাকর্ষকে শুধু বল (শক্তি) হিসেবে বিবেচনা করে হয় না, বরং ভরের উপস্থিতে স্থান-কালের বক্রতার ফলাফল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। 

আমাদের মহাবিশ্ব ত্রিমাত্রিক। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা—এই তিন মাত্রার সমন্বয়ে এটি গঠিত। তবে আইনস্টাইনের মতে, মহাবিশ্বের মাত্রা চারটি। আগের তিনটির সঙ্গে নতুন করে সময়কে মাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। এভাবেই উৎপন্ন হয় স্থান-কালের ধারণা। চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্বের প্রতিটি অংশই স্থান-কাল। ভর বিশিষ্ট সব বস্তুই এদের বাঁকিয়ে ফেলতে পারে। বস্তুর ভর যত বেশি হয়, স্থান-কালের বক্রতার পরিমাণও হয় তত বেশি।

ধরা যাক, গোটা মহাবিশ্বজুড়ে একটি পাতলা চাদর বিছানো আছে, যেটি কিনা টান টান অবস্থায় আছে। ভারী কোনো বস্তুকে যখন সেই চাদরের ওপরে রাখা হয়, তখন চাদরের সেই অংশটি নিচের দিকে ডেবে যায়। এই ঘটনার নাম স্থান-কালের বক্রতা। এতে ওই বস্তুর আশপাশে যদি অন্য কোনো কম ভরের বস্তু আসে, তাহলে সেটি ক্রমান্বয়ে ভারী বস্তুর দিকে অগ্রসর হবে, যা আকর্ষণ বলেরই নামান্তর। এভাবেই উৎপত্তি হয় মহাকর্ষের। এভাবে স্থান-কালের বক্রতার জন্য মহাকর্ষের উৎপত্তি হওয়ার অর্থ, এটির প্রভাব অনুভবের জন্য ভরের প্রয়োজন নেই। তাই আলো বা বিকিরণও মহাকর্ষ দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে। 

প্রভাবের মাত্রা বেশি হলে আলোর গতিপথ বেঁকে যেতে পারে। আবার, অনেক সময় মহাকর্ষ এত বেশি হয়, আলো এর প্রভাব কাটিয়ে বাইরে যেতে পারে না। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরে ঠিক এ ঘটনাই ঘটে।

ছবি ৫: বিভিন্ন ভরের দরুন স্থান-কালের বক্রতার তুলনা
আরও পড়ুন

সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সিদ্ধান্তগুলো বিজ্ঞানীদের হতবাক করে দেয়। তাঁরা এ তত্ত্বের সঠিকতা যাচাই করতে উদ্যোগী হন। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের সমর্থনে প্রমাণ যোগাড় করতে সক্ষম হন। তিনি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করতে আটলান্টিক দ্বীপে ভ্রমণ করেন। তবে তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল গ্রহণের সময় সূর্যের পটভূমিতে (Background) থাকা নক্ষত্রগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা। সূর্যের উজ্জলতার কারণে অন্য সময়ে এগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়।

দুটি ছবির তুলনা করে তিনি নক্ষত্রের অবস্থানের তারতম্যের বিষয়টি নিশ্চিত হন। গ্রহণের সময়ে তোলা ছবিতে নক্ষত্রের যে অবস্থান দেখা যায়, সেটি এদের প্রকৃত অবস্থান নয়।

নিউটনের তত্ত্ব অনুসারে, নক্ষত্র থেকে পৃথিবীতে আসা আলো সব সময়ে সরলরেখা ধরে পথ পরিভ্রমণ করে। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে, স্থান-কালের বক্রতার কারণে বিশাল ভরের বস্তুর (যেমন সূর্য) পাশ দিয়ে আসার সময়ে নক্ষত্রের আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। এতে নক্ষত্রগুলোকে প্রকৃত অবস্থান থেকে দূরে দেখা যায়। নিচের ছবিটি দেখুন। 

ছবি ৬: সূর্যের ভর স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেওয়ায় এর ব্যাকগ্রাউন্ডে অবস্থিত নক্ষত্রগুলোকে প্রকৃত অবস্থান থেকে দূরে দেখা যায়।

আর্থার এডিংটন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়ে সূর্যের পটভূমিতে থাকা নক্ষত্রগুলোর ছবি তোলেন। এর ৬ মাস পরে যখন আকাশে সূর্যের অবস্থান সম্পূর্ণ উল্টো দিকে, তখন তিনি আকাশের ওই একই স্থানের ছবি তোলেন। দুটি ছবির তুলনা করে তিনি নক্ষত্রের অবস্থানের তারতম্যের বিষয়টি নিশ্চিত হন। গ্রহণের সময়ে তোলা ছবিতে নক্ষত্রের যে অবস্থান দেখা যায়, সেটি এদের প্রকৃত অবস্থান নয়। সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময়ে মহাকর্ষের প্রভাবে আলো বেঁকে যাওয়ার ফলেই এমনটা হয়। এভাবে আর্থার এডিংটনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রমাণিত হয়।

একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন। আইনস্টাইনের তত্ত্বের মাধ্যমে মহাকর্ষকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মানে এই নয়, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব ভুল। আসলে একটি বিশেষ সীমার মধ্যে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বই হলো নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব।  

লেখক: সহকারি ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড

সূত্র: দ্য অ্যাস্ট্রোনমি বুক: বিগ আইডিয়াস সিম্পলি এক্সপ্লেইন্ড

 আরও পড়ুন