সরলরৈখিক গতি ও চলন গতির মধ্যে পার্থক্য

সরলরৈখিক গতি চলন গতিরই এক রূপমিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

পদার্থবিজ্ঞানের সহজপাঠ - ১০

আমাদের চারপাশে নানা রকম গতি রয়েছে। মোটাদাগে এগুলোকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, সরলরৈখিক গতি, চলন গতি, কৌণিক গতি, পর্যাবৃত্ত গতি ও সরল ছন্দিত গতি। নবম-দশম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে এই পাঁচ প্রকার গতির কথা বলা আছে। কিন্তু বইয়ে চলন গতির সংজ্ঞার সঙ্গে সরলরৈখিক গতির পার্থক্য স্পষ্টভাবে বোঝানো নেই। পার্থক্যটা আমরা পরে খুঁজি, তার আগে দেখি সরলরৈখিক গতি কী।

কোনো বস্তু যদি একেবারে সোজা পথে বা সরলরেখা বরাবর চলে, তবে তার গতিকে সরলরৈখিক গতি বলে। যেমন, একটি সোজা রাস্তায় কোনো গাড়ির গতি হলো সরলরৈখিক গতি। গাড়ি ছোট হোক বা বড়, সব গাড়ির গতিই সরলরৈখিক। মূলকথা হলো, যে গতি প্রতি মুহূর্তে দিক পরিবর্তন করে না, সেটিই সরলরৈখিক গতি।

এখন একটি প্রশ্ন আসতে পারে—গাড়ি, বাস বা ট্রেনের পথ তো সব সময় পুরোপুরি সোজা হয় না। তাহলে এদের গতিকে সরলরৈখিক গতি কেন বলা হচ্ছে? কারণ, এদের চলার পথের বড় অংশই সরলরৈখিক। মাঝেমধ্যে কিছুটা বাঁক থাকলেও এদের গতি সব সময় বাঁকা পথে থাকে না। আবার পথগুলো একেবারে বৃত্তাকার বা উঁচু-নীচুও নয়।

ধরা যাক, একটা রাস্তা ২০ মিটার সোজা পূর্ব দিকে গেছে। একটা ছোট বাঁক নিয়ে আবার গেছে দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণ দিকে সোজা ৪০ মিটার গেল। তারপর আবার একটা ছোট বাঁক নিয়ে পূর্ব দিকে চলতে থাকল। ৬০ মিটার সোজা চলার পর আবার একটা বাঁক। এবার উত্তর দিকে। সেদিকে সোজা ২০ মিটার চলার পর আবার বাঁক নিল পূর্ব দিকে।

এখন একটি প্রশ্ন আসতে পারে—গাড়ি, বাস বা ট্রেনের পথ তো সব সময় পুরোপুরি সোজা হয় না। তাহলে এদের গতিকে সরলরৈখিক গতি কেন বলা হচ্ছে? কারণ, এদের চলার পথের বড় অংশই সরলরৈখিক।

এখানে গাড়িটি ঘন ঘন নিলেও প্রতিটি বাঁকের আগে এটি সরলরেখা বরাবরই চলছে। মানে প্রথমে ২০ মিটার, তারপর ৪০ মিটার এবং তারপর আবার ৬০ মিটার সোজা পথে চলেছে। বেশিরভাগ রাস্তা কয়েক কিলোমিটার পরপর বাঁক নেয়। এই কয়েক কিলোমিটার পথে গাড়ির গতিই হলো সরলরৈখিক গতি।

চীন বা রাশিয়ার মতো বড় দেশে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যেতে দীর্ঘ সোজা পথ দেখা যায়। আমাদের দেশের ট্রেন লাইনগুলোতেও বাঁক থাকে বহুদূর পর পর। তাই ট্রেনের গতি বেশির ভাগ সময় সরলরৈখিক গতি।

তবে আকাশে সাধারণত এঁকেবেঁকে চলার প্রয়োজন হয় না। ধরুন, আপনি ঢাকা থেকে যশোর যাবেন। বাস বা ট্রেনে গেলে আপনাকে কয়েকবার বাঁক নিতে হবে। কারণ, মাটির ওপর রাস্তা সব সময় সোজা বানানোর উপায় নেই।

প্রশ্ন করতে পারেন, ঢাকা থেকে যশোর সোজা রাস্তা করলে কী হত? আগে থেকেই যদি এখানে জনপদ থাকত, তাহলে সোজা পথ করা কিছুটা সহজ হতো। মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে তো রাস্তা করা যায় না। তাই বাঁক নিতে হয় মাঝেমধ্যে। এছাড়া চলতি পথে খানা-খন্দ, রাস্তার অনুপযোগী জমি, কৃষিজমি কিংবা ঘরবাড়ি পড়তে পারে। তাই রাস্তা করার সময় সবদিক বিবেচনা করেই মাঝেমধ্যে বাঁক রাখতে হয়। তবে আকাশপথে এ ঝামেলা নেই। তাই ঢাকা থেকে বিমান উড়াল দিয়ে সরলরেখা বরাবর যশোর গিয়ে পৌঁছায়। বিমানের গতিই সরলরৈখিক গতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

যেখানে মহাকর্ষ বল নেই, যেখানে বাতাসে ঘর্ষণ নেই। সেখানে যে বস্তুকেই গতিশীল করুন না কেন, একই গতিতে তা সোজা পথে চলতে থাকবে চিরকাল।

২.

সরলরৈখিক গতিকে মৌলিক গতি বলা যেতে পারে। বাকি সব গতি সরলরৈখিক গতিরই রূপান্তর মাত্র। অষ্টম পর্বে আমরা অ্যারিস্টটলের গতির ধারণা দেখেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বল প্রয়োগ করলে বস্তু গতিশীল হয়, বল প্রয়োগ না করলে বস্তু থেমে যায়। গ্যালিলিও বলেছেন অ্যারিস্টটলের গতির ধারণার ঠিক উল্টো কথা। আসলে নানারকম ঘর্ষণের কারণেই গতিশীল বস্তু থেমে যায়। গ্যালিলিওর পরীক্ষার ওপর ভর করে আইজ্যাক নিউটন তাঁর বিখ্যাত তিনটি গতিসূত্র দেন। এর প্রথম সূত্রেই সরলরৈখিক গতির মহিমা লুকিয়ে আছে। নিউটন গতির প্রথম সূত্রে বলেছিলেন, বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির থাকবে। আর গতিশীল বস্তু সোজা পথে চিরকাল চলতে থাকবে।

খেয়াল করুন, নিউটন কিন্তু ‘সোজা পথে’ চলার কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে কোনো কিছুই সোজা পথে চিরকাল চলে না। এর জন্য দায়ী ঘর্ষণ বল ও মহাকর্ষ বল। এই বলগুলো গতিশীল বস্তুকে বাধা দেয়। তাই জ্বালানি ছাড়া গাড়ি বা বিমানকে চিরকাল গতিশীল করা সম্ভব নয়। কিন্তু যেখানে মহাকর্ষ বল নেই, যেখানে বাতাসে ঘর্ষণ নেই। সেখানে যে বস্তুকেই গতিশীল করুন না কেন, একই গতিতে তা সোজা পথে চলতে থাকবে চিরকাল। কিন্তু এমন জায়গা কী কোথাও পাবেন?

সরলরৈখিক গতি আসলে চলন গতিরই একটা রূপ। তবে বলে রাখা ভালো, সব সরলরৈখিক গতিই চলন গতি, কিন্তু সব চলন গতি সরলরৈখিক গতি নয়।

বাতাস বা ভূপৃষ্ঠের ঘর্ষণহীন জায়গা আপনি অনেক পাবেন। কিন্তু এমন জায়গা পাবেন না যেখানে মহাকর্ষ বল পুরোপুরি শূন্য। মহাকাশের অনেক গভীরে এমন জায়গা আছে, যেখানে আশপাশে বড় কোনো গ্রহ-নক্ষত্র নেই। মনে হতে পারে সেখানে মহাকর্ষ বল শূন্য। আসলে একেবারে শূন্য নয়। মহাকর্ষ বলের পাল্লা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই গ্রহ-নক্ষত্র যত দূরেই থাক, খুব সামান্য হলেও সেখানে মহাকর্ষ বল ক্রিয়া করবে। তাই বস্তুকে গতিশীল করে ছেড়ে দিলে একসময় তা থেমে যাবে। কিন্তু থামার আগে সেটা লাখ লাখ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে। এর মাঝে অন্য কোনো বস্তু যদি না এসে পড়ে, সেই লাখ লাখ কিলোমিটার পথ সরলরেখায় চলবে। তাই নিউটনের সরলরৈখিক গতির এটাই আদর্শ উদাহরণ।

৩.

এবার চলন গতির কথায় আসা যাক। চলন গতি কী? কোনো বস্তুর সব কণা যদি একই সময়ে একই দিকে সমান দূরত্ব অতিক্রম করে, তবে সেই গতিকে চলন গতি বলে। অর্থাৎ, বস্তুটি ঘোরার সুযোগ পায় না, সোজা বা বাঁকা পথে এগিয়ে যায়।ধরা যাক, একটা গাড়ি বা বিমান চলছে। গাড়ি বা বিমানটা যেদিকেই চলুক, এর প্রতিটা কণা একই গতিতে একই দিকে চলে। সরলরৈখিক গতি আসলে চলন গতিরই একটা রূপ। তবে বলে রাখা ভালো, সব সরলরৈখিক গতিই চলন গতি, কিন্তু সব চলন গতি সরলরৈখিক গতি নয়। চলন গতি দুই প্রকার। সরলরৈখিক চলন গতি, মানে যখন বস্তুটি সোজা পথে চলে। আর বক্র চলন গতি মানে যখন বস্তুটি বাঁকা পথে চলে, কিন্তু ঘোরে না। যেমন, শূন্যে ছুড়ে দেওয়া একটি ঢিল বাঁকাপথে চললেও এর সব কণা একই দিকে এগোতে থাকে। তাই এটি বক্র চলন গতির উদাহরণ। অন্যদিকে, কৌণিক গতি বা ঘূর্ণন গতি কোনোভাবেই চলন গতি নয়। কারণ, ঘূর্ণনরত বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন কণা ভিন্ন ভিন্ন দিকে ঘুরতে থাকে।