পদার্থবিজ্ঞানে একক কেন গুরুত্বপূর্ণ

পদার্থবিজ্ঞানের সহজপাঠ - ৩

বৃক্ষের পরিচয় যেমন ফলে, তেমনি পদার্থবিজ্ঞানে বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলাফল প্রকাশ করার জন্য এককের প্রয়োজন হয়।

একক না হলে ফলের অর্থ নেই। আগের পর্বগুলোতে বলেছি, পদার্থবিজ্ঞানে মাপজোকের ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর মাপজোখের পর একটা ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই ফলটা কী দিয়ে, কোন স্কেলে মাপছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ।

স্কেল মানে মাপকাঠি। কিন্তু মাপকাঠিতে যদি কোনো দাগ দেওয়া না থাকে, সেটা কোনো কাজে আসবে না। ধরা যাক, আপনার হাতে একটা কাঠের স্কেল ধরিয়ে দেওয়া হলো। এর সাহায্যে আপনি দৈর্ঘ্য মাপতে পারবেন। কিন্তু স্কেলে কোনো দাগ দেওয়া নেই। তাহলে ওই স্কেল দিয়ে আপনি কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য মাপতে পারবেন না। কিন্তু দাগ দেওয়া যদি নাও থাকে, তবু একটা উপায়ে মাপা যায়। আপনাকে বলা হলো, স্কেলটার দৈর্ঘ্য ১ মিটার। এবার কিন্তু আপনি স্কেলটা দিয়ে মাপতে পারবেন। ধরা যাক, একটা লম্বা লোহার রডের দৈর্ঘ্য মাপবেন। স্কেলটা দিয়ে মেপে দেখলেন, সেটা ১০টা স্কেলের সমান। অর্থাৎ ১০ মিটার। ১০ এখানে মান, আর মিটার একক।

১০ মিলিমিটারে ১ সেন্টিমিটার। আবার ১০০ সেন্টিমিটারে ১ মিটার। তাই মিলিমিটারের সাহায্যে খুব সহজেই ছোট থেকে অনেক বড় জিনিসও মাপতে পারবেন। ১ ফুটের ওই স্কেলের একপাশে ১২ ইঞ্চির ঘর কাটা থাকে।

লোহার রডের দৈর্ঘ্য ঠিক ১০ মিটার বলে আপনার সুবিধা হলো মাপতে। কিন্তু রড যদি কাঁটায় কাঁটায় ১০ মিটার না হয়ে কিছুটা কম বা বেশি হয়? তখন ওই স্কেল দিয়ে মাপতে গিয়ে বিপদে পড়বেন। ধরা যাক, রডটার দৈর্ঘ্য ১০ মিটারের চেয়ে খানিকটা বেশি। এবার যদি ওই স্কেল দিয়ে মাপতে যান, তাহলে তীরে এসে তরি ডুববে। কারণ, ১০ মিটারের চেয়ে ঠিক কতটুকু বড়, তা মাপতে পারবেন না। আপনি হয়তো অনুমান করে বলবেন, শোয়া ১০ কিংবা সাড়ে ১০ মিটার। পদার্থবিজ্ঞানে এমন অনুমাননির্ভর মানের কোনো মূল্য নেই। তাই আপনাকে এমন স্কেল নিতে হবে, যাতে আরও বেশি ছোট দৈর্ঘ্য মাপা যায়।

স্কুলের ছেলেমেয়েরা ধাতব, কাঠ কিংবা প্লাস্টিকের যে স্কেল ব্যবহার করে, সেটা মূলত ১ ফুট বা ১২ ইঞ্চি মাপের। মিটারের সঙ্গে আবার ফুটের হিসাবের পার্থক্য আছে। তবে এসব স্কেলে ফুটের পাশাপাশি নিচে সেন্টিমিটার, মিলিমিটারের জন্য দাগ কাটা আছে।

আরও পড়ুন

১০ মিলিমিটারে ১ সেন্টিমিটার। আবার ১০০ সেন্টিমিটারে ১ মিটার। তাই মিলিমিটারের সাহায্যে খুব সহজেই ছোট থেকে অনেক বড় জিনিসও মাপতে পারবেন। ১ ফুটের ওই স্কেলের একপাশে ১২ ইঞ্চির ঘর কাটা থাকে। আবার প্রতি ইঞ্চি ভাগ করা থাকে ১৬টা ছোট ভাগে। আরেক পাশে থাকে সেন্টিমিটারের দাগ। ৩০টা বড় দাগ থাকে ওই স্কেলে। ওই দাগ দিয়ে ৩০ সেন্টিমিটার নির্দেশ করে। প্রতিটা বড় দাগের মাঝে নয়টা ছোট দাগ থাকে। এগুলো সব এক মিলিমিটার পর পর কাটা হয়। অর্থাৎ একটা বড় দাগের পর আরেকটা বড় দাগ পর্যন্ত মোট ১০ মিলিমিটারের জন্য দশটা দাগ থাকে।

পদার্থবিজ্ঞানে ইঞ্চি বা ফুটের চেয়ে মিলিমিটার, সেন্টিমিটার বা মিটারে মাপজোকের প্রবণতা বেশি। তাই দৈর্ঘ্য সংক্রান্ত ছোট থেকে মাঝারি, এমনকি বড় বড় মাপও এই এক ফুটের স্কেল থেকে করা সম্ভব। ১০ মিটারের রডটা যেমন সহজেই এটার সাহায্যে মাপা যাবে, তেমনি ১০ মিটারের পর রডটা কত সেন্টিমিটার বা কত মিলিমিটার বড়, তাও মাপা যাবে।

কিন্তু যদি ছোট কোনো বস্তু নিয়ে কাজ করতে চাই? ধরা যাক, একটা ছোট্ট বাক্সের দৈর্ঘ্য মাপব। সেটার দৈর্ঘ্য, ধরা যাক ১২ সেন্টিমিটার। এ ক্ষেত্রে সেন্টিমিটার একক ব্যবহার করাই ভালো।

এ তো গেল সাধারণ স্কেলের কথা। আরও সূক্ষ্ম জিনিস, যেগুলোর ক্ষেত্রে হয়তো মিলিমিটারের চেয়েও ছোট মাপ নেওয়া দরকার, সে সব পরিমাপের জন্য আছে স্লাইড ক্যালিপার্স, ভার্নিয়ার স্কেল ইত্যাদি। এ যুগে মাইক্রোমিটার, ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের জিনিসও মাপার আধুনিক স্কেল বা যন্ত্র আছে।

২.

এই যে দৈর্ঘ্যের বিভিন্ন একক, সেটা বস্তু বা পরীক্ষার আকার অনুযায়ী ঠিক করা হয়। বড় বড় বিল্ডিং, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি মাপতে একক হিসাবে মিটার ব্যবহার করা হয়। এখন ধরা যাক, আমাদের ওই রড, যেটার দৈর্ঘ্য ১০ মিটারের চেয়ে বেশি, সেটা আমরা ছোট ছোট দাগ কাটা স্কেলে মাপব। ধরা যাক, সেটার দৈর্ঘ্য সোয়া এক মিটার। অর্থাৎ ১ মিটার ২৫ সেন্টিমিটার। এখানে আমরা দুরকম একক পাচ্ছি। যদিও দুটোই দৈর্ঘ্যের একক এবং দুটোই মিটারকে মূল একক ধরে হিসাব করা হচ্ছে। তাই আমরা সেন্টিমিটারের হিসাবটাকে আলাদা করে না লিখে লিখব ১.২৫ মিটার। এক মিটার = ১০০ সেন্টিমিটার বলে ২৫ সেন্টিমিটারকে মিটারে পরিবর্তন করলে হয় ০.২৫ মিটার।

আরও পড়ুন

কিন্তু যদি ছোট কোনো বস্তু নিয়ে কাজ করতে চাই? ধরা যাক, একটা ছোট্ট বাক্সের দৈর্ঘ্য মাপব। সেটার দৈর্ঘ্য, ধরা যাক ১২ সেন্টিমিটার। এ ক্ষেত্রে সেন্টিমিটার একক ব্যবহার করাই ভালো। কিন্তু যদি দেখা যায়, একটা পরীক্ষা সাজানো হয়েছে, সেখানে সবকিছুর একক হিসেবে মিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে ওই বাক্সের দৈর্ঘ্যটা দরকার হবে। কিন্তু সব রাশির একক মিটারে রেখে একটি রাশির একক সেন্টিমিটারে রাখলে হিসাবটা গোলমেলে হয়ে যাবে।

তাই বাক্সের দৈর্ঘ্যটা মিটারে কনভার্ট বা রূপান্তর করে নিতে হবে। তখন বাক্সের দৈর্ঘ্য ১২ সেন্টিমিটারকে ১০০ দিয়ে ভাগ করলে দাঁড়াবে ০.১২ মিটার। কিন্তু সেই পরীক্ষার সব যন্ত্র যদি ছোট হয়, মাপজোক সব সেন্টিমিটারে হয়, তখন বাক্সের দৈর্ঘ্য লেখা উচিত ১২ সেন্টিমিটার।

এবার ধরা যাক, পরীক্ষা ব্যবস্থাটা আরও ছোট যন্ত্রপাতি নিয়ে করা হবে। সেগুলোর সব হিসাব মিলিমিটারে। তখন এই বাক্সের দৈর্ঘ্যটা সেন্টিমিটারে রাখলে হিসাবে গোলমাল লেগে যাবে। তাই একে মিলিমিটারে কনভার্ট করে নিতে হবে। ১ সেন্টিমিটার মানে ১০ মিলিমিটার। তাই বাক্সের দৈর্ঘ্য হবে ১২ × ১০ = ১২০ মিলিমিটার।

আবার অনেক বড় কোনো দৈর্ঘ্য মাপতে গেলে তখন মিলিমিটার, সেন্টিমিটার এমনকি মিটারেও কাজ হবে না। তখন মাপতে হবে কিলোমিটারে। যেমন দুটি শহর বা দুটি দেশের দূরত্ব, এমনকি গতি মাপতে গেলে একক হিসেবে কিলোমিটার ব্যবহার করতে হবে।

পদার্থবিজ্ঞানে ইঞ্চি বা ফুটের চেয়ে মিলিমিটার, সেন্টিমিটার বা মিটারে মাপজোকের প্রবণতা বেশি। তাই দৈর্ঘ্য সংক্রান্ত ছোট থেকে মাঝারি, এমনকি বড় বড় মাপও এই এক ফুটের স্কেল থেকে করা সম্ভব।

শুধু দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রেই নয়, তাপমাত্রা, চাপ, আলোর তীব্রতা, গতি, সময় ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একক এভাবে সূচকীয় হারে ছোট-বড় করে নিতে হয়। একই রাশির একক হলে এভাবে ছোট-বড় করতে সমস্যা হয় না। কিন্তু রাশি যদি ভিন্ন হয়, তখন?

ধরা যাক, একটা পর্যবেক্ষণ সিস্টেমে জড়িয়ে আছে দূরত্ব, তাপমাত্রা, ভর ইত্যাদি। দূরত্বের একক কী নেবেন, সময়ের একক কী হবে আর তাপমাত্রার এককই বা কী হবে। যেমন তাপমাত্রাকে সেলসিয়াস, কেলভিন বা ফারেনহাইট এককে মাপা যায়।

দৈর্ঘ্যকে মিলিমিটার, সেন্টিমিটার, মিটার বা কিলোমিটারে প্রকাশ করা যায়। ভরকেও মিলিগ্রাম, গ্রাম বা কিলোগ্রামে প্রকাশ করতে পারেন। সময়ের ক্ষেত্রে আছে ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ড। আবার সেকেন্ডেরও ভাগ আছে, ন্যানো, মাইক্রো, মিলি ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো, হিসাবের সময় কোন রাশির কোন একক নিলে ঠিকঠাক হিসাবটা মিলবে?

আরও পড়ুন

এর জন্য কিছু পদ্ধতি আছে—এমকেএস (MKS), সিজিএস (CGS) ও এফপিএস (FPS)। এফপিএস পদ্ধতি হলো ফুট-পাউন্ড-সেকেন্ড পদ্ধতি। বোঝাই যাচ্ছে, এই পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একক ফুট, ভরের একক পাউন্ড ও সময়ের একক হিসেবে সেকেন্ড ব্যবহার করা হয়। এটাকে ব্রিটিশ পদ্ধতিও বলে। অন্যদিকে সিজিএস এককে দৈর্ঘ্য, ভর ও সময়ের একক যথাক্রমে সেন্টিমিটার, গ্রাম ও সেকেন্ড।

এমকেএস পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক এসআই বা এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি তৈরি হয়েছে। এখানে দৈর্ঘ্যের একক মিটার, ভরের একক কিলোগ্রাম এবং সময়ের একক সেকেন্ড।

এখানে মজার ব্যাপার হলো, তিন ক্ষেত্রেই সময়ের একক হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেকেন্ড। এখানে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা ভাঙা প্রয়োজন। কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একক, সময়ের একক নয়। এমকেএস বা এসআই পদ্ধতিতে সময়ের মৌলিক একক সবসময় সেকেন্ড। ট্রেন বা গাড়ির গতি বোঝাতে আমরা ‘কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা’ (km/h) ব্যবহার করি, যা দূরত্ব (কিলোমিটার) এবং সময় (ঘণ্টা)—উভয়ের সমন্বিত একটি লব্ধ একক, কেবল সময়ের একক নয়। একে বাংলায় ‘ঘণ্টায় … কিলোমিটার’—এভাবেও লেখা হয়। ‘…’ অংশটায় সংখ্যা বসবে, বলা বাহুল্য।

এই তিন পদ্ধতিতেই তাপমাত্রা, শক্তি, দীপন তীব্রতা ও অন্যান্য রাশির জন্য আলাদা আলাদা একক আছে। আবার রাশির মতো এককেও মৌলিক ও লব্ধ—দুটি ভাগ আছে। আছে বিভিন্ন এককের আলাদা সংজ্ঞা। তবে সেসব আগামী পর্বের জন্য তোলা রইল।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন