ভৌত রাশি কী, রাশি ও এককের পার্থক্য জেনে নিন

পদার্থবিজ্ঞানের সহজপাঠ - ২

পদার্থবিজ্ঞানে মাপজোক খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই পদার্থবিজ্ঞান শিখতে হলে রাশি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। যা কিছু পরিমাপ করা যায়, তা-ই রাশি। পরিমাপযোগ্য বলে প্রতিটা রাশি থেকেই মাপজোক শেষে মান পাওয়া যায়। সেই মান প্রকাশ করা হয় নির্দিষ্ট একটি এককের সাহায্যে। পদার্থবিজ্ঞানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাশি হলো গতি, বল, ভর, তাপমাত্রা, সময় ইত্যাদি।

প্রকৃতি যেসব নিয়ম মেনে চলে, সেগুলো খুঁজে বের করাই পদার্থবিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু শুধু নিয়ম বের করলেই তো হবে না। সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। আর কাজে লাগাতে গেলেই মাপজোকের বিষয়টা অবধারিতভাবে চলে আসে।

ধরা যাক, আপনার কাছে একটা গরম পানির পাত্র আছে। পানির অবস্থা সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলো। জবাব দিলেন, পানি খুব গরম। ‘খুব গরম’—এই তথ্য দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের চলবে না। এ তথ্য দিয়ে তাপগতিবিদ্যার নিয়ম মেনে কোনো কাজ করাতে পারবেন না। তাই পানির ‘ঠান্ডা’ বা ‘গরম’ চরিত্রকে একটা রাশিতে পরিণত করতে হবে। যেমন তাপমাত্রা একটা রাশি। এবার আপনি থার্মোমিটার ব্যবহার করে এটাকে পরিমাপ করতে পারবেন। করলেনও সেটা। দেখলেন, পানির তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, এ গরম পানি কতটা গরম, তা ‘তাপমাত্রা’ নামের একটা রাশির সাহায্যে সহজেই বোঝাতে পারবেন। পাওয়া যাবে মানও।

আরও পড়ুন

তাপমাত্রার মতো তাপও একটা রাশি। আপনি চান পানিকে ফুটিয়ে বাষ্পীভূত করতে। কিন্তু ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সেটা সম্ভব নয়। দরকার ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। এ জন্য তাপমাত্রা বাড়াতে হবে। তাপমাত্রা তো এমনি এমনি বাড়বে না। এ জন্য প্রয়োজন শক্তি। শক্তি হিসেবে আপনাকে পানিতে আরও তাপ প্রয়োগ করতে হবে। চুলায় বা আগুনের সাহায্যে আপনি পানির তাপ বাড়াতে পারবেন। পানির আয়তন ও বায়ুচাপের হিসাব থেকে বের করতে পারবেন, পানির তাপমাত্রা বাড়িয়ে ৯০-১০০ ডিগ্রিতে নিতে ঠিক কতটুক তাপ দিতে হবে। ধরা যাক, ৫ জুল পরিমাণ তাপ দিতে হবে।

প্রকৃতি যেসব নিয়ম মেনে চলে, সেগুলো খুঁজে বের করাই পদার্থবিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু শুধু নিয়ম বের করলেই তো হবে না। সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। আর কাজে লাগাতে গেলেই মাপজোকের বিষয়টা অবধারিতভাবে চলে আসে।

এখানে তাপ একটা ভৌত রাশি। কারণ তাপমাত্রার মতো তাপও পরিমাপযোগ্য। আয়তনও একধরনের রাশি। কিন্তু তাপমাত্রার মতো মৌলিক রাশি নয়। মৌলিক রাশি কী, সে কথায় পরে আসছি।

বলতে পারেন, ‘ভৌত’ বলতে কী বোঝায়? ভৌত শব্দটাকে ইংরেজিতে বলে ‘ফিজিক্যাল’। আর বাংলায় ‘বস্তু’ বলতে পারেন। কিন্তু শুধু ‘বস্তু’ বললে ‘ভৌত’ শব্দের মাহত্ম্য বোঝা যাবে না। বস্তু জগৎকেই বলে ভৌতজগৎ। এভাবে বললে সম্ভবত কিছুটা বোঝা যায়। অর্থাৎ যে জগতের সবকিছু বস্তুগত, পরিমাপযোগ্য, সেটাকেই বলে ভৌতজগৎ বা ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড। আর এই জগতের কারবার বাখ্যা করা হয় পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যে।

আরও পড়ুন

২.

পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা গণিত। আর গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করতে হলে পরিমাপযোগ্য রাশি দরকার। তারপর সেই রাশির মান পাবেন। যেকোনো ঘটনার বৈজ্ঞানিক বা প্র্যাকটিক্যাল ফলাফল পেতে হলে যেমন রাশির দরকার হবে, তেমনি ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করতেও রাশি প্রয়োজন।

ধরা যাক, আবদুর রহিম একজন গাড়ি চালক। একটা কোম্পানি তাকে এবং  তার গাড়ি ভাড়া করল। যেতে হবে যশোরের মনিরামপুরে। ভাড়া করা কোম্পানি তাকে অগ্রীম টাকা দেবে। কিলোমিটার প্রতি ৫০ টাকা। তবে শর্ত হলো, ৫ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছুতে হবে।

এখানে দুটো ভবিষ্যতের বিষয় আছে। একটা হলো কোম্পানি অগ্রীম টাকা দেবে, এ জন্য তাদের জানতে হবে ঢাকা থেকে মনিরামপুরের দূরত্ব কত? প্রথমে ঢাকা থেকে যশোরের দূরত্ব, তারপর যশোর থেকে মনিরামপুরের দূরত্ব জানতে পারলেই কিন্তু কোম্পানি জেনে যাচ্ছে কত টাকা দিতে হবে। অন্যদিকে ৫ ঘণ্টায় পৌঁছাতে হলে রহিমকে জানতে হবে, ঘণ্টায় কত কিলোমিটার গতিতে যেতে হবে। এখানে দূরত্ব একটা রাশি। অন্যদিকে গতিও রাশি। কারণ দুটোই পরিমাপযোগ্য।

তেমনি পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন কাজে রাশি ব্যবহার করা যায় ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য। যেমন ধরা যাক, নাসা মঙ্গলে একটা নভোযান পাঠাবে। আজ যদি নভোযানটা লঞ্চ করে, তাহলে ছয় মাস পর মঙ্গলের বুকে অবতরণ করবে। ছয় মাস পর যদি ঠিকঠাক সেখানে ল্যান্ড করতে হয়, লঞ্চ করার আগেই কিছু বিষয় ঠিক করে নিতে হবে। এ জন্য জানতে হবে মঙ্গলের সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব। আবার সব সময় মঙ্গল আর পৃথিবীর দূরত্ব এক থাকে না। বছরের কোনো এক সময় দূরত্ব খুব বেশি হয়, কখনো খুব কম। তাই বর্তমানে মঙ্গলের সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব কত, ছয় মাস পর কত হবে—এসব বিষয় হিসাব করে সেই গতিতে নভোযানটিকে মঙ্গলে পাঠাতে হবে। এখানে দুটি রাশি হিসাবের মধ্যে এসেছে। সেটা হলো গতি ও দূরত্ব। এ ছাড়া নভোযানটার ভরও হিসেবে রাখতে হয়ছে। কারণ ভর যত বেশি, ওটা গতিশীল করতে শক্তি খরচ হবে তত বেশি। সুতরাং এখানে আরও দুটো রাশি পাচ্ছি—শক্তি ও ভর। শক্তি পেতে জ্বালানি প্রয়োজন। সেই জ্বালানি প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বের করে ফেলা যাবে, তা থেকে কী পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে। সোলার এনার্জি হলে এক রকম, হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম হলে আরেকরকম। এসব জ্বালানির পরিমাণও জানা দরকার। হিলিয়াম বা হাইড্রোজেন হলে এদের পরিমাণ নির্ধারিত হবে আয়তনে বা কেজিতে। অর্থাৎ এখানে আরেকটা রাশি এসে হাজির হচ্ছে, সেটা হলো আয়তন। আর যদি কেজিতে মাপা হয়, তাহলে আবারও ভর নামের রাশিটা চলে আসছে।

আরও পড়ুন

এসব রাশির হিসাব ঠিকমতো বসিয়ে নিউটনের গতির সূত্র ও মহাকর্ষ সূত্রের সাহায্যে সহজেই মঙ্গলে নভোযান পাঠানোর সব হিসাব-নিকাশ বের করে ফেলা যায়। অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো থেকে ৬ মাস পরে কী করবে মহাকাশযান, তার হিসাব আমরা আগেভাগে জেনে যাচ্ছি। আর এ ক্ষেত্রে রাশি একটা বড় ভূমিকা রাখছে।

দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা কাজে সবসময় আমরা কোনো মাপজোক করা মান ব্যবহার করছি। যেমন সকাল আটটায় আপনি ঘুম থেকে ওঠেন। এখানে ওঠার ‘সময়’ হলো একটা পরিমাপযোগ্য রাশি। আপনি ১০টা নাগাদ অফিসে পৌঁছে যান।

পদার্থবিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণী করার এই ব্যাপারটা নিয়ে দারুণ এক মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ফ্রেডরিক উইলকিনসন।  এক গবেষণাপত্রে তিনি বলেন, ‘ভৌত রাশি তত্ত্ব আর পরীক্ষা-নীরিক্ষার মধ্যে সেতুর মতো কাজ করে। কোনো রাশিকে যদি পরিমাপ করা না যায়, বিজ্ঞান সেই রাশি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা হারায়।’

৩.

অনেকে রাশি আর একককে গুলিয়ে ফেলেন। মনে করেন, দুটি বুঝি একই। আসলে তা নয়। রাশিকে পরিমাপ করে যে মান পাওয়া যায়, সেটাকেই এককের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। যেমন মিটার হলো একক। দৈর্ঘের একক। ধরা যাক, একটা লাঠির দৈর্ঘ্য ১০ মিটার। এখানে দৈর্ঘ্য হলো রাশি, মিটার হলো একক। আর যে ১০ মিটারের কথা বললাম, ১০ হলো মান। লাঠির দৈর্ঘ্যকে পরিমাপ করে ১০ মিটার পরিমাণ মান পাওয়া গেছে।

দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা কাজে সবসময় আমরা কোনো মাপজোক করা মান ব্যবহার করছি। যেমন সকাল আটটায় আপনি ঘুম থেকে ওঠেন। এখানে ওঠার ‘সময়’ হলো একটা পরিমাপযোগ্য রাশি। আপনি ১০টা নাগাদ অফিসে পৌঁছে যান। অর্থাৎ ৯-১১ টা পর্যন্ত এই দুই ঘণ্টা সময়ে আপনি ঘুম থেকে ওঠেন, ব্রাশ করেন, প্রাতকৃত সারেন, তারপর গাড়িতে চড়ে অফিসে যান। মোট ২ ঘণ্টা সময় লাগছে। এখানে ‘২’ মান, ‘ঘণ্টা’ হলো একক আর ‘সময়’ হলো ভৌত রাশি।

পদার্থবিজ্ঞানের আরেকটা বড় কাজ হলো রাশিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করা। যেমন বস্তু কীভাবে গতিশীল হয়?

আরও পড়ুন

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমাদের জানতে হয়, স্থির বস্তুকে বল প্রয়োগ করলে গতিশীল হয়। এটা নিউটনের গতির প্রথম সূত্র। এখানে বল ও গতির মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হলো। আবার নিউটনের গতির প্রথম সূত্র থেকেই আমরা জানি, যে বস্তুর ভর যত বেশি, তাকে গতিশীল করতে তত বেশি বল প্রয়োজন।

নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্র বা বলের সূত্রটা হলো F=ma। এখানে F হলো বল, m ভর এবং a ত্বরণ। ত্বরণ হলো প্রতিমূহূর্তে বস্তুর বেগ বাড়া। অর্থৎ ত্বরণের ভেতর বস্তুর বেগ ও সময়ের সম্পর্ক লুকিয়ে আছে। তারমানে  F=ma সূত্রের ভেতর ভর, বল, বেগ ও সময়ের সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে। আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ে বস্তু ঠিক যতটা দূরত্ব পাড়ি দেয়, তাকে বেগ বলে। তাহলে বেগের মধ্যে আরও দুটি রাশি লুকিয়ে আছে। দূরত্ব ও সময়। তাহলে F=ma সূত্রে আসলে ভর, বল, বেগ, দূরত্ব ও সময়—এই পাঁচটি রাশি রয়েছে। অর্থাৎ পাঁচটি রাশির মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করেছে নিউটনের বলের সূত্রটি।

সাধারণ তত্ত্ব বা গাণিতিক ফর্মূলা কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা—পদার্থবিজ্ঞানে ভৌত রাশি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই হয়তো ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও লেখক পল ডেভিস বলেছেন, ‘পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্য কেবল তত্ত্ব কিংবা সূত্রে নয়, এর মূল সৌন্দর্য ভৌত রাশিতে।

এখান থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, সব ভৌত রাশি মৌলিক নয়। কিছু রাশি আবার একাধিক রাশির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে পাওয়া যায়। যে রাশি অন্য কোনো রাশির ওপর নির্ভরশীল নয়, সেগুলোকে বলে মৌলিক রাশি। যেমন, ভর সময়, তাপমাত্রা মৌলিক রাশি। আর যেসব রাশি অন্য রাশির ওপর নির্ভরশীল সেগুলোকে বলে লব্ধ রাশি। বল নামের রাশিটা ভর, ত্বরণ—এই দুই রাশির ওপর নির্ভরশীল। ত্বরণ আবার সময় ও বেগের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ বল মৌলিক রাশি নয়, লব্ধ রাশি। তেমনি বেগও সময় ও দৈর্ঘ্য—এই দুই রাশির ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং বেগ লব্ধ রাশি, ত্বরণও লব্ধ রাশি।

মৌলিক হোক বা লব্ধ—সাধারণ তত্ত্ব বা গাণিতিক ফর্মূলা কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা—পদার্থবিজ্ঞানে ভৌত রাশি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই হয়তো ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও লেখক পল ডেভিস বলেছেন, ‘পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্য কেবল তত্ত্ব কিংবা সূত্রে নয়, এর মূল সৌন্দর্য ভৌত রাশিতে। রাশিগুলোই আসলে মহাবিশ্বকে অর্থপূর্ণ করে তোলে।’

বক্স আইটেম

সংজ্ঞা

ভৌতরাশি

ভৌতজগতে যা কিছু পরিমাপ করা যায়, যারা মান আছে, তাকেই ভৌতরাশি বলে। এর সাহায্যে বিভিন্ন প্রকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। যেমন: গতি, তাপমাত্রা, সময়, দৈর্ঘ্য, বিদ্যুৎ প্রবাহ ইত্যাদি।

 

প্রকারভেদ

ভৌত রাশি দুই প্রকার। মৌলিক রাশি ও লব্ধ রাশি।।

 

মৌলিক রাশি

যেসব রাশি অন্যকোনো রাশির ওপর নির্ভরশীল নয়, তাদেরকে বলে মৌলিক রাশি। পদার্থবিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সাতটি মৌলিক রাশির কথা বলেছেন। সেগুলো হলো, দৈর্ঘ্য, ভর, সময়, তাপমাত্রা, তড়িৎ প্রবাহ, দীপন তীব্রতা ও পদার্থের পরিমাণ (এর এক মোল)।

 

লব্ধ রাশি

যেসব রাশি অন্য রাশির ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোকে হলো লব্ধ রাশি। লব্ধ রাশি দুই বা তার চেয়ে বেশি মৌলিক রাশির ওপর নির্ভরশীল। লব্ধ রাশির উদাহরণ হলো: বেগ, ত্বরণ, বল, ক্ষেত্রফল, আয়তন ইত্যাদি।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন