সময় নিজেই কি ত্রিমাত্রিক, দাবি নতুন গবেষণায়

সময়েরও নাকি তিনটি মাত্রা আছে। এমনটাই জানা যাচ্ছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ফেয়ারব্যাঙ্কসের বিজ্ঞানী গুন্থার ক্লেটেস্কার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমনটি দাবি করেছেন। চলতি বছরের ২১ এপ্রিল এ সম্পর্কে তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে সিঙ্গাপুরের রিপোর্টস ইন অ্যাডভান্সেস অব ফিজিক্যাল সায়েন্সেস জার্নালে।

কী বলেছেন গুন্থার সেই গবেষণাপত্রে? আমাদের মহাবিশ্ব ত্রিমাত্রিক। এই মাত্রা স্পেস বা স্থানের। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই ধারণায় দৃঢ় আস্থা ছিল বিজ্ঞানীদের। কিন্তু ১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি দেখান, মহাবিশ্ব তিনটি নয়, বরং চার মাত্রার ওপর দাঁড়িয়ে। এর একটি মাত্রা সময়ের, বাকি তিনটি স্থানের। এতকাল এটাই মেনে আসছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু গুন্থার বলছেন অন্য কথা।

তাঁর দাবি, মহাবিশ্বের কাঠামো তৈরি করতে সময়ই মূল ভূমিকা পালন করছে। স্থানের ভূমিকা এখানে গৌণ। তিনি স্থানের মতো সময়েরও তিনটি মাত্রা থাকার দাবি করেছেন। অর্থাৎ, এতদিন যে চার মাত্রার পৃথিবীর কথা আমরা জেনেছি, সেই চার মাত্রার জগৎ এখন ছয় মাত্রায় পরিণত হবে। অবশ্য সে জন্য গুন্থারের তত্ত্ব প্রমাণিত হতে হবে।

আগের তত্ত্বগুলোতে দেখা যেত কোনো ঘটনার ‘ফলাফল’ ‘কারণ’-এর আগেই গাণিতিক তত্ত্বে এসে হাজির হয়ে যেত। অর্থাৎ, কোনো কারণ ছাড়া ঘটনা ঘটে যেত এবং পাওয়া যেত ফলাফল।

এর আগে, স্ট্রিং থিওরিতে মহাবিশ্বের ১১টি মাত্রার কথা বলা হয়েছে। তবে সেখানে স্থানের মাত্রাই ১০টি। বাকি একটি মাত্রা সময়ের। আবার সময়ের তিনটি মাত্রা নিয়েও আগে বেশকিছু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর কোনোটাই এখনো প্রমাণ করা যায়নি।

গুন্থার অবশ্য তাঁর গবেষণা নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, তাঁর গাণিতিক কাঠামো প্রস্তাবিত আগের তত্ত্বগুলোর চেয়ে উন্নত। কারণ, এটা বাস্তব কণার ভর এবং অন্যান্য গুণাগুণ সঠিকভাবে অনুমান করতে পারে। গুন্থার বলেন, ‘আগে যে সব তত্ত্বে ত্রিমাত্রিক সময়ের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর কোনোটাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমার তত্ত্ব পরীক্ষার সাহায্যে যাচাই করা সম্ভব।’

আরও পড়ুন

গুন্থারের মতে, মহাবিশ্ব আসলে তিন মাত্রিক সময়ের একটা ক্যানভাস। আর ‘স্থান’সেই ক্যানভাসের ওপর রঙের প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে ত্রিমাত্রিক সময় দিয়ে। স্পেস বা স্থান তার ওপর রং চড়িয়েছে মাত্র। গুন্থার বলছেন, ‘এমন নয় যে স্থান বলে কিছু নেই। স্থান অবশ্যই আছে। তবে এর গুরুত্ব সময়ের পরে।’

শুধু তাই নয়, গুন্থার দাবি করছেন, স্থান আসলে সময়ের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কী এই ত্রিমাত্রিক সময়? গুন্থারের মতে, স্থানের যেমন তিনটি দিক বা অক্ষ আছে— যেগুলো আমরা X, Y ও Z অক্ষ নামে চিনি—সময়ও তেমন তিনটি পথে তিন দিকে প্রবাহিত হয়। ধরা যাক, একটা সোজা রাস্তা। আপনি সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এবার মনে করুন, আরেকটি পথ আপনার চলার পথে এসে তীর্যকভাবে মিলেছে বা আপনার পথের পাশ দিয়ে চলে গেছে। আপনি এখন মূল পথ ছেড়ে দ্বিতীয় পথে হাঁটতে শুরু করলেন। নতুন এই পথটা আসলে একই সময়ের আরেকটি সম্ভাব্য রূপ। এই দুটি পথকে আপনি সময়ের দুটি মাত্রার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। তাহলে তৃতীয় মাত্রা কোনটি? প্রথম পথ থেকে যে উপায়ে যে পথ ধরে দ্বিতীয় পথে উঠছেন, সেটাই হলো সময়ের সম্ভাব্য তৃতীয় রূপ, অর্থাৎ তৃতীয় মাত্রা।

২.

সময়ের তিন মাত্রা নিয়ে আগেও বেশ কয়েকটি তত্ত্ব ছিল। কিন্তু সেগুলোর প্রত্যেকটিতে ছিল একটি সাধারণ সমস্যা। কোনো ঘটনার ‘কারণ’ ও ‘ফলাফল’ এর মধ্যে বিভ্রান্তিকর একটা পরিস্থিতি তৈরি করে সময়ের বাকি দুই মাত্রা। তাই সেই তত্ত্বগুলো ঠিক অতটা ফলপ্রসূ হয়নি। গুন্থার তাঁর নতুন এই তত্ত্বে সেই সমস্যাগুলো এড়াতে পেরেছেন। অন্তত তিনি এমনটাই দাবি করছেন।

তাঁর মতে, আগের তত্ত্বগুলোতে দেখা যেত কোনো ঘটনার ‘ফলাফল’ ‘কারণ’-এর আগেই গাণিতিক তত্ত্বে এসে হাজির হয়ে যেত। অর্থাৎ, কোনো কারণ ছাড়া ঘটনা ঘটে যেত এবং পাওয়া যেত ফলাফল। গুন্থারের এই তত্ত্বে সময়ের তিন মাত্রার সম্পর্কটা হয়তো জটিল, কিন্তু সবসময় ঘটনার কারণ আগে হাজির হবে, ঘটনা ঘটবে এবং ফলাফল পাওয়া যাবে সবার পরে। অবশ্য এই নতুন তত্ত্বের গাণিতক কাঠামোটা আগের তত্ত্বগুলোর চেয়ে অনেক জটিল। সে কথা গুন্থার নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন।

ব্ল্যাকহোলের ভেতরকার খবর, কিংবা মহাবিশ্বের শুরু বা বিগ ব্যাংয়ের সময়কার খবরাখবর, কৃষ্ণগহ্বরের সিঙ্গুলারিটি, মাল্টিভার্স, প্যারালাল ইউনিভার্সের মতো তাত্ত্বিক বস্তুগুলোর সন্ধান পেতে গেলে এই দুই তত্ত্বের মিলন জরুরি।

ত্রিমাত্রিক এই সময়ের বাকি দুই মাত্রা আপনি চাইলেই যখন-তখন অনুভব করতে পারবেন না। এর উদ্ভব হয় বিশেষ পরিস্থিতিতে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ইৎঝাক বারসে বলেন, সময়ের বাকি দুই মাত্রা বিশেষ কিছু মুহূর্তে উদ্ভব হয়। যেমন, মহাবিশ্বের শুরুতে বিগ ব্যাংয়ের সময়, কিংবা উচ্চগতির কণাদের মিথস্ক্রিয়ার সময় বিশেষ দুটি মাত্রা দৃশ্যপটে হাজির হয়।

আরও পড়ুন

আমাদের বাস্তব জগতে সময় সবসময় সামনের দিকে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ, এর অভিমুখ সবসময় বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে। বিশেষ কিছু কোয়ান্টাম অবস্থা ছাড়া সময় কখনো ভবিষ্যৎ থেকে অতীতের দিকে প্রবাহিত হয় না। সময়ের একমুখী প্রবাহ নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বিব্রত। পদার্থবিজ্ঞানের কোনো ফান্ডামেন্টাল তত্ত্বই সময়কে পেছনের দিকে প্রবাহিত হতে দেয় না। তবু সময় কেন একদিকেই প্রবাহিত হয়, এ বিষয়টা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাননি। গুন্থারের নতুন এই তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের সেই বিব্রতবোধ থেকে বাঁচাতে পারে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। গুন্থারের তত্ত্বের আকর্ষণীয় দিক হলো, এটা সময়কে পেছন দিকে চলতে বাধা দেয় না। আবার শুধু সামনে বা পেছনে নয়, সময়কে পাশের দিকে প্রবাহিত হতেও এই তত্ত্বে কোনো বাধা নেই।

৩.

মোটা দাগে গোটা মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য একক কোনো তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে নেই। বড় বড় বস্তুর গতি-প্রকৃতি, গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচলের ব্যাখ্যা খুঁজতে আমাদের নির্ভর করতে হয় নিউটন-আইনস্টাইনের চিরায়ত বলবিদ্যা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার ওপর। অন্যদিকে খুদে কণাদের গতি-প্রকৃতি, চরিত্র-ধর্ম ব্যাখ্যা করার জন্য দরকার হয় হাইজেনবার্গ-শ্রোডিঙ্গারের কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কিন্তু দুটি তত্ত্বকে একত্রে মিলিয়ে ফেলার মতো কোনো একীভূত তত্ত্ব বা সর্বাত্মক তত্ত্ব (বা থিওরি অব এভরিথিং) এখনো আবিষ্কার হয়নি।

সামনে তাঁকে পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। তাঁর এই তত্ত্বকে এখন একটা প্রাথমিক প্রস্তাবনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক মহলে এখনো এটা নিয়ে তেমন হইচই হয়নি।

এখন প্রশ্ন হলো, একীভূত তত্ত্ব কি আসলেই জরুরি? হ্যাঁ, জরুরি তো বটেই। ব্ল্যাকহোলের ভেতরকার খবর, কিংবা মহাবিশ্বের শুরু বা বিগ ব্যাংয়ের সময়কার খবরাখবর, কৃষ্ণগহ্বরের সিঙ্গুলারিটি, মাল্টিভার্স, প্যারালাল ইউনিভার্সের মতো তাত্ত্বিক বস্তুগুলোর সন্ধান পেতে গেলে এই দুই তত্ত্বের মিলন জরুরি। এককথায়, কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ববিষয়ক গবেষণার আরও ভেতরে ঢুকতে হলে আমাদের একটা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি প্রয়োজন। বেশ কিছু তত্ত্ব এখন খাতা-কলমে কোয়ান্টাম গ্রাভিটিকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। যেমন, স্ট্রিং থিওরি, লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়।

আরও পড়ুন

একীভূত তত্ত্ব হওয়ার দৌড়ে এখন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে সময়ের এই ত্রিমাত্রিক তত্ত্ব। তেমনটাই মনে করছেন ইৎঝাক বারস ও তাঁর সহকর্মীরা। এই তত্ত্বের জনক গুন্থার ক্লেটেস্কাও তাঁদের সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, এই তত্ত্ব ইলেকট্রন, মিউয়ন ও কোয়ার্কের মতো কোয়ান্টাম কণাদের ভর পরিমাপ করতে পারে একবারে নিখুঁতভাবে। তেমনি এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে এসব কণাদের ভর কেন এমন হলো, সেটাও। গুন্থার বলেন, ‘সত্যিকারে একটা একীভূত তত্ত্ব পেতে হলে পদার্থবৈজ্ঞানিক বাস্তবতাকে নতুন করে ভাবতে হবে। সময়কে যদি ত্রিমাত্রিক হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ধাঁধা নতুন এই গাণিতিক কাঠামোর সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

তবে গুন্থার যাই বলুন, সামনে তাঁকে পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। তাঁর এই তত্ত্বকে এখন একটা প্রাথমিক প্রস্তাবনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক মহলে এখনো এটা নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। এমনকি এই তত্ত্ব উন্নতমানের কোনো পদার্থবিজ্ঞান জার্নালেও প্রকাশিত হয়নি। গুন্থার দাবি করছেন, পরীক্ষার মাধ্যমে এই তত্ত্ব যাচাই করা সম্ভব। কিন্তু এখনো কোনো গবেষক সেই পরীক্ষাটা করে দেখেনি। তাই চমক থাকলেও এই তত্ত্বকে এখনো পরিপূর্ণ তত্ত্ব বলার সময় আসেনি।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: ফিজিকস ডট অর্গ

আরও পড়ুন