একটা বৃষ্টি ভেজা রাতের কথা কল্পনা করুন। প্রায় অন্ধকার একটা ঘর। বাইরে থেকে আবছা আলো আসছে জানালার কাচ ভেদ করে। সে আলোয় জানালার কাচের দিকে তাকালে কেমন যেন একটা ঘোর লাগে। কাচ ভেদ করে ওপাশে চোখে পড়বে শহুরে ঝলমলে আলো, ঝুম বৃষ্টিতে রাস্তা ধরে ছুটে চলা ঝাঁকবাধা গাড়ির আলো। আর এসবের মাঝখানে ঠিক ভূতের মতো ভেসে উঠতে দেখা যাবে একটা মুখ। বলা ভালো, একটা মুখের অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। ভূত, ভূত!—বলে চিৎকার করতে যাবেন না। কারণ ওটা আর কারো নয়, আপনার নিজেরই মুখ। রাতের বেলা এমন অভিজ্ঞতা আপনার নিশ্চয়ই হয়েছে।
এই অতি সাধারণ দৃশ্যটির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর রহস্য। বলা ভালো, মহাবিশ্বের গভীর এক রহস্য। আমাদের মহাবিশ্বের একেবারে গভীরের এক চমকপ্রদ সত্য উন্মোচন করে সেটা। বিশ্বাস করুন বা না করুন, এই নিরীহ দৃশ্য বলছে যে আমাদের জগৎ সবচেয়ে মৌলিক স্তরে একদম এলোমেলো—অনিশ্চিত। সেখানে কী ঘটবে, তা আগাম বলার উপায় নেই। ঠিক লুডো বা পাশার ছক্কা চালার মতো। ছক্কা চলার পর যেমন কোন সংখ্যা উঠবে, তা আগে থেকে কেউ জানে না, এই দৃশ্যের গভীরেও আছে এমন অনিশ্চয়তা।
জানালার কাচ ভেদ করে বাইরের আলো যেমন আমাদের চোখে ধরা দেয়, তেমনই ভেসে ওঠে নিজের মুখের আবছা প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এর কারণ কী?
জানালায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখার এই ব্যাখ্যা বেশ সরল। আপাতদৃষ্টিতে এর কোনো গভীর দার্শনিক তাৎপর্য নেই বলেই মনে হয়। কিন্তু এখানেই লুকিয়ে আছে এক বিশাল ধাঁধা! আলোকে আমাদের কাছে আসলে যা মনে হয়, বাস্তবে ব্যাপারটা তা নয়।
নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর চিন্তাভাবনার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এর কারণ বুঝতে চেষ্টা করেছেন। তাঁরা হিসেব কষে দেখেছেন, জানালার কাচে পড়া আলোর প্রায় ৯৫ শতাংশ সরাসরি কাচ ভেদ করে চলে যায়। আর বাকি মাত্র ৫ শতাংশ প্রতিফলিত হয়। ফলে আমরা বাইরের দৃশ্য এবং নিজের প্রতিচ্ছবি একই সঙ্গে দেখি। আবার একই কারণে ঘরে আলো জ্বালানো অবস্থায় কাচের জানালার ভেতর দিয়ে বাইরে তাকালে বাইরের দৃশ্য ভালোভাবে দেখা যায় না। তার কারণ বাইরে থেকে পুরো আলোটা কাচের ভেতর দিয়ে প্রতিসরিত হচ্ছে না। কিছু প্রতিফলিত হচ্ছে। আবার ভেতরের আলোরও প্রতিসরণ ও প্রতিফলন দুটোই ঘটছে। এই প্রতিফলনটা খুব বেশি না হলেও যথেষ্ট। হিসেবে দেখা গেছে, জানালার কাচে প্রায় ৫ ভাগ আলো প্রতিফলিত হয়। সে কারণেই বাইরের দৃশ্যের মাঝখানে ঝাপসা ছায়ার মতো নিজেকেও দেখা যায়।
আলোকে যদি পুকুরের পানিতে ঢেউয়ের মতো তরঙ্গের মতো ধরে নেওয়া হয়, তাহলে এই ঘটনা ব্যাখ্যা করা সহজ। কল্পনা করুন, একটা শান্ত হ্রদের ওপর দিয়ে পানি কেটে নৌকা ভেসে যাচ্ছে। তরতর করে। নৌকার সামনে থেকে ঢেউ উঠে ক্রমেই দুপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। হ্রদের পানিতে ছোট্ট এক টুকরো কাঠ ভাসছে। একসময় কাঠের টুকরোতে ধাক্কা খেল ঢেউটা। তাহলে দেখা যাবে, ঢেউয়ের বেশিরভাগ অংশই কাঠকে যেনো গ্রাহ্যই করছে না। সেটা ডিঙিয়ে সোজা চলে যাচ্ছে অন্যপাশে। স্রেফ ঢেউয়ের ছোট্ট একটা অংশ কাঠে ধাক্কা খেয়ে উল্টো দিকে ফিরে আসবে। জানালার কাচেও ঘটে ঠিক এ ব্যাপারটাই। এ ক্ষেত্রেও সিংহভাগ আলোর তরঙ্গ জানালার কাচ ভেদ করে চলে যায়, স্রেফ ৫ ভাগ আলো প্রতিফলিত হয়। কিন্তু গোলমালটা বাধে এখানে এসেই!
জানালায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখার এই ব্যাখ্যা বেশ সরল। আপাতদৃষ্টিতে এর কোনো গভীর দার্শনিক তাৎপর্য নেই বলেই মনে হয়। কিন্তু এখানেই লুকিয়ে আছে এক বিশাল ধাঁধা! আলোকে আমাদের কাছে আসলে যা মনে হয়, বাস্তবে ব্যাপারটা তা নয়। কারণ এর মধ্যে এমন এক রহস্য লুকিয়ে আছে, যা এই সরল ছবিকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। পাল্টে দেয় সবকিছু। বিংশ শতাব্দীতে এমন কিছু ঘটনা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে আলো শুধু পুকুরে ছড়িয়ে পড়া ঢেউয়ের মতো তরঙ্গ নয়, বরং এটি বুলেটের মতো কণার একটি স্রোতও বটে।
যেমন কম্পটন প্রভাবের কথা বলা যাক। পরমাণুর অন্যতম কণা ইলেকট্রন সম্পর্কে সবারই জানা আছে। ১৮৯৭ সালে এ কণাটি আবিষ্কার করেছিলেন কেমব্রিজের পদার্থবিদ জে. জে. টমসন। এর প্রায় দুই দশক পর মার্কিন পদার্থবিদ আর্থার কম্পটন এক অদ্ভুত চিন্তা করলেন। ১৯২০ সালের দিকে তিনি ভাবলেন, ইলেকট্রনের উপর আলো ফেললে কী ঘটবে? ব্যাপারটা শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ রাখলেন না তিনি, সেটা পরীক্ষা করে দেখতে আঁটঘাট বেধে নামলেন। সে জন্য একটি বিশেষ পরীক্ষায় পরমাণুর ইলেকট্রনের ওপর এক্স-রে ছুড়ে দিলেন কম্পটন।
তাঁর ধারণা ছিল, আলোর তরঙ্গ পানির ঢেউয়ের মতো। তাই পানিতে ভাসমান কোনো বয়ার ওপর থেকে পানির ঢেউ যেভাবে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, আলোও ফিরে আসবে সেভাবে। এ ক্ষেত্রে ঢেউয়ের আকার বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য একই থাকে। অর্থাৎ একটি ঢেউয়ের দুটি চূড়ার মধ্যে দূরত্ব যেমন থাকে, ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা ঢেউয়ের ক্ষেত্রেও থাকে তেমনটাই।
কিন্তু কম্পটনের পরীক্ষায় ঘটল সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার! ফলাফল দেখে মাথায় হাত কম্পটনের। দেখা গেল, ইলেকট্রনের ওপর থেকে আলোর তরঙ্গ ধাক্কা খাওয়ার পর তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আলোর দিক সংঘর্ষের ফলে যত বেশি পরিবর্তিত হলো, তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তনটাও হলো তত বেশি।
ইলেকট্রনগুলো ছোট ছোট বিলিয়ার্ড বলের মতোই, এটা জানাই ছিল। অন্যদিকে আলো স্থানের ভেতর দিয়ে তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হয়, এটাই ছিল এতদিনের ধারণা। কিন্তু কম্পটনের পরীক্ষাগুলো ছিল একেবারে দ্ব্যর্থহীন।
কম্পটন আরও অবাক হয়ে দেখলেন, এক্স-রে আলো একটি ইলেকট্রনের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সময় সেই আলো তার কিছু শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া মানে আলোর রং বদলে যাওয়া। যেমন নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে তা লাল রঙের মতো দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যে পরিণত হয়। মজার ব্যাপার হলো, একটি দীর্ঘ ও ধীরগতির তরঙ্গ একটি ছোট ও দ্রুতগতির তরঙ্গের চেয়ে কম শক্তিশালী হয়। কম্পটনের পরীক্ষাগুলো থেকে দেখা গেল, কোনো এক রহস্যময় উপায়ে আলো নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলছে।
এ পরীক্ষার কারণে কম্পটনের এতদিনের ধারণা একেবারে ভুল প্রমাণিত হলো। আলো কোনোভাবেই পানির ঢেউয়ের মতো আচরণ করল না। বরং আলোর এই আচরণ কণার সঙ্গেই বেশি মেলে। ধরা যাক, একটি বল ছুড়ে মারা হলো আরেকটা ছোট বলের দিকে। বড় বলটা ধাক্কা দিয়ে ছোট বলটিকে সরিয়ে দেয়, এবং নিজেও থেমে যায় বা গতিপথ বদলে ফেলে। আর এভাবে প্রথম বলটার শক্তি কমে যায় এবং দ্বিতীয় বল কিছু শক্তি নিয়ে নেয়। আলোও যেন ঠিক এভাবেই আচরণ করছে ইলেকট্রনের সঙ্গে সংঘর্ষের বেলায়।
ইলেকট্রনগুলো ছোট ছোট বিলিয়ার্ড বলের মতোই, এটা জানাই ছিল। অন্যদিকে আলো স্থানের ভেতর দিয়ে তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হয়, এটাই ছিল এতদিনের ধারণা। কিন্তু কম্পটনের পরীক্ষাগুলো ছিল একেবারে দ্ব্যর্থহীন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রচলিত সেই ধারণায় আঘাত করল তাঁর পরীক্ষাটা। ১৯২৩ সালের এপ্রিল মাসে এই গবেষণা যুক্তরাষ্ট্রের ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে প্রকাশ করেন কম্পটন।
এর আগে, ১৯০৫ সালে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যা করতে আলোকে কণা হিসেবে ধরে নেন আলবার্ট আইনস্টাইন। সে জন্য তিনি হাত পাতেন জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের সদ্য আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকে। এ তত্ত্ব অনুসারে আলোকে কণাকে হিসেবে বিবেচনা করে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের সঠিক ব্যাখ্যা দেন আইনস্টাইন। আলোর কণাকে তিনি বললেন আলোর কোয়ান্টা। প্রায় দুই দশক পরে সেটি ফোটন হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই ব্যাখ্যার জন্য ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান আইনস্টাইন। তাঁর আলোর কণাধর্মী প্রকৃতিকে আরও শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিল কম্পটনের এই পরীক্ষা। আলোর কণা প্রকৃতির পরীক্ষামূলক প্রমাণে যুগান্তকারী কাজের জন্য ১৯২৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান আর্থার কম্পটন।
আলো যে কণার স্রোতের মতো আচরণ করে, তার প্রমাণ মেলে সুপারমার্কেটের দরজার দিকে হেঁটে যাওয়ার সময়। দেখা যায়, কেউ দরজার কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়। আলীবাবার গুহার মতো চিচিংফাঁক। কিন্তু দরজার দ্রুত সরে যাওয়ার কারণ কী?
আসলে এ ক্ষেত্রেও জিতে যায় আলোর কণাধর্ম। আসলে দরজার সঙ্গে একটা ফটোসেল নামের একটি ধাতব ডিভাইস সংযুক্ত থাকে। এর উপর আলোক রশ্মি পড়লেই সেখান থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। সেটা ঘটে কারণ ইলেকট্রনগুলি নিজ নিজ পরমাণুর সঙ্গে আলগাভাবে আবদ্ধ থাকে। তাই স্রেফ আলোর শক্তি দিয়ে ইলেকট্রনগুলোকে মুক্ত করা যায়। দরজার দিকে এগিয়ে গেলে পায়ের কারণে ওই আলোর রশ্মি ফটোসেলে পড়তে বাধা পায়। ফলে ইলেকট্রনের নিঃসরণও বন্ধ হয়ে যায়। আর ইলেকট্রনের প্রবাহ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আরও কিছু কারিকুরির মাধ্যমে দরজা খুলে যায়।
শুরুতে বৃষ্টিভেজা রাতের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? রাতের জানালায় আলোর প্রতিফলন আর প্রতিসরণের খেলা আসলে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে মহাবিশ্বের এক গভীর সত্য। যে আলোকে এতক্ষণ আমরা কেবল তরঙ্গ হিসেবেই জেনে এসেছি, দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে কণার স্রোত।
প্রশ্ন আসতে পারে, ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের সঙ্গে আলোর কণা প্রকৃতির সম্পর্ক কী? এক্ষেত্রে আলো যদি তরঙ্গ হতো, তাহলে সেটা ওই ফটোসেল থেকে কীভাবে এত দ্রুত ইলেকট্রন ছিটকে ওঠে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তরঙ্গ তো ছড়িয়ে থাকে, তাই একটি সাধারণ আলোর তরঙ্গ ধাতুর পৃষ্ঠের উপর ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক ইলেকট্রনের সাথে মিথস্ক্রিয়া করবে। ফলে কিছু ইলেকট্রন অন্যদের পরে ছিটকে বের হওয়ার কথা। হিসেব করে দেখা গেছে, আলো তরঙ্গ হলে কিছু ইলেকট্রন অন্যদের দশ মিনিট পর্যন্ত পরে বের হতে পারে। একবার শুধু কল্পনা করুন, আপনি একটি স্বয়ংক্রিয় দরজার কাছে আসার দশ মিনিট পর ফটোসেলে ইলেকট্রনের প্রবাহ তৈরি হচ্ছে। তাহলে দরজাটা খোলার জন্য আপনাকে পাক্কা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
কিন্তু এখানে আলো যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি হয় এবং প্রতিটি কণা ধাতুর একটি একক ইলেকট্রনের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে, তাহলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে না পড়ে, এই ফোটন নামক আলোর কণাগুলো ইলেকট্রনগুলোতে শক্তিশালী আঘাত হানে। প্রতিটি ফোটন শুধু একটি ইলেকট্রনকেই নির্গত করে না, বরং তা করে সঙ্গে সঙ্গে। তাই স্বয়ংক্রিয় দরজাটা খুলে যায় ঝট করে। অন্তত এ কারণে হলেও আলোর কণাধর্মী প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিতে পারেন।
যাই হোক, শুরুতে বৃষ্টিভেজা রাতের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? রাতের জানালায় আলোর প্রতিফলন আর প্রতিসরণের খেলা আসলে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে মহাবিশ্বের এক গভীর সত্য। যে আলোকে এতক্ষণ আমরা কেবল তরঙ্গ হিসেবেই জেনে এসেছি, দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে কণার স্রোত। আর এই কণাগুলো এলোমেলোভাবে আচরণ করে, কোনো নির্দিষ্ট নিয়মের তোয়াক্কা না করে। এই এলোমেলো আচরণই আমাদের চারপাশের অনেক ঘটনার মূলে লুকিয়ে আছে। এতটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু আরও গোলমাল শুরু হয় এখান থেকে।
২.
দেখতেই পাচ্ছেন, আলো শুধু তরঙ্গ নয়, কণাও বটে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভাষায় একে বলা হয়, ওয়েভ-পার্টিকেল ডুয়ালিটি। বাংলায় বলা হয়, কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা। তাই আলো আসলে ছোট ছোট কণার স্রোতও বটে—অনেকটা বুলেট বৃষ্টির মতো। এ কণাগুলোকে বলে ফোটন। প্রশ্ন হলো, যদি সব ফোটন একই রকম হয়, তাহলে কাচের পাতের ওপর তাদের আচরণও তো একই হওয়ার কথা। হয় সবগুলোই কাচ ভেদ করে চলে যাবে, নয়তো সবগুলোই কাচে প্রতিফলিত হবে। তাহলে কেন ৯৫ শতাংশ কাচ ভেদ করে চলে যায় আর ৫ শতাংশ ফিরে আসে?
এইখানেই তৈরি হয় এক ধ্রুপদী ধাঁধা। আলোর কণা তত্ত্ব এক কথা বলে, আর আমাদের চোখের দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা পুরোপুরি বিপরীত। আমরা তো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, জানালা ভেদ করে বাইরের জগত এবং নিজের আবছা মুখ। তার মানে কি ফোটন সম্পর্কে আমাদের ধারণায় কোথাও একটা বড় ভুল হচ্ছে?
আসলে, এর একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা হলো, প্রতিটি ফোটনের ৯৫ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে কাচ ভেদ করে চলে যাওয়ার, আর মাত্র ৫ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে প্রতিফলিত হওয়ার। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও, এই ছোট্ট তথ্যটি পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে কেন্দ্রে আঘাত হানে বোমার মতো। কারণ যদি আমরা কেবল একটি ফোটনের কাচ ভেদ করে যাওয়া বা ফিরে আসার সম্ভাবনা জানতে পারি, তাহলে একটি নির্দিষ্ট ফোটন আসলে কী করবে, তা নিশ্চিতভাবে জানার আশা বাদ দিতে হবে।
শুধু তাই নয়, এখান থেকে চমকে দেওয়ার মতো একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয়। ১০০টি ফোটনের মধ্যে কোন ফোটনগুলো প্রতিসরিত হবে আর কোনগুলো প্রতিফলিত হবে, সেটা নির্ধারিত হয় কীভাবে? তাহলে কি ধরে নিতে হবে, ফোটন চিন্তা করতে পারে? ফোটনদের চিন্তা করার মতো কোনো মস্তিষ্ক আছে? তারা কি নিজেরা যুক্তি পরামর্শ করে ঠিক করে, কে প্রতিসরিত হবে আর কে প্রতিফলিত হবে? নাকি এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে? এখানে জন্ম নেয় একটা গোলমেলে প্যারাডক্স।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের আগে এই ক্ষুদ্র জগতের অপ্রত্যাশিত ব্যাপারের সঙ্গে আমরা আগে পরিচিত ছিলাম না। আমাদের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন এক বিস্ময়। আক্ষরিত অর্থে বলা চলে, এক বিপন্ন বিস্ময়। কোয়ান্টাম জগতের এই ধারণায় খুবই বিপন্ন বোধ করেছিলেন আইনস্টাইন।
ফোটনের এই আচরণের ভয়াবহ ব্যাপারটা প্রথম উপলব্ধি করেন আইনস্টাইন। অথচ আলো সম্পর্কে চিরায়ত তরঙ্গ ধারণার উল্টো পথে হেঁটে তিনিই প্রথম ফোটনের ধারণা দেন। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে আমরা বস্তুর গতিপ্রকৃতির নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। যেমন আজ রাতে আকাশে চাঁদ যে জায়গায় আছে, সেটা দেখে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ব্যবহার করে ১০০ ভাগ নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব পরের রাতে চাঁদটা কোথায় থাকবে। কিন্তু একটি ফোটনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি ফোটন যখন জানালার কাচের ওপর পড়ে, তখন আমরা কখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, সেটি ভেদ করে চলে যাবে, নাকি প্রতিফলিত হবে। এর ভাগ্য সম্পূর্ণ এলোমেলো, কেবল সুযোগের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল। কোয়ান্টাম তত্ত্ব মতে, একটি ফোটন কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই, কেবল যেন খেয়ালখুশির বশেই জানালা ভেদ করে চলে যায় অথবা ফিরে আসে।
ব্যাপারটা শুধু জানালার কাচের ওপর ফোটনের এই অপ্রত্যাশিত আচরণেই সীমাবদ্ধ নয়। আসলে ফোটনের সম্ভাব্য সব পরিস্থিতিতেই একই ব্যাপার ঘটতে দেখা যায়। শুধু ফোটন নয়, পরমাণু এবং তাদের ক্ষুদ্র কণা জগতের সব বাসিন্দাদের আচরণও একই রকম। এই ক্ষুদ্র কণা জগৎ নিয়ন্ত্রিত হয় এলোমেলোভাবে, সম্ভাবনার ভিত্তিতে। আর এরাই আমাদের বাস্তবতার চূড়ান্ত ভিত্তি। রেডিয়ামের একটি পরমাণু ভেঙে যেতে পারে, তার কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস একটি ছোট গ্রেনেডের মতো বিস্ফোরিত হতে পারে। কিন্তু কখন একটি নির্দিষ্ট রেডিয়াম নিউক্লিয়াস নিজে থেকে ধ্বংস হবে, তা সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করার কোনো উপায় নেই, কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ঘটার সম্ভাবনা নির্ণয় করা যায়।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের আগে এই ক্ষুদ্র জগতের অপ্রত্যাশিত ব্যাপারের সঙ্গে আমরা আগে পরিচিত ছিলাম না। আমাদের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন এক বিস্ময়। আক্ষরিত অর্থে বলা চলে, এক বিপন্ন বিস্ময়। কোয়ান্টাম জগতের এই ধারণায় খুবই বিপন্ন বোধ করেছিলেন আইনস্টাইন। তাই ভীষণ হতাশ হয়ে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না।’
জবাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ডাকসাইটে বিজ্ঞানী নীলস বোর ধমকে উঠেছিলেন, ‘ঈশ্বরকে তাঁর পাশা নিয়ে কী করতে হবে তা বলা বন্ধ করুন।’
ফোটনের এই আচরণের ভয়াবহ ব্যাপারটা প্রথম উপলব্ধি করেন আইনস্টাইন। অথচ আলো সম্পর্কে চিরায়ত তরঙ্গ ধারণার উল্টো পথে হেঁটে তিনিই প্রথম ফোটনের ধারণা দেন। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে আমরা বস্তুর গতিপ্রকৃতির নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি।
আসলে আইনস্টাইন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি, মহাবিশ্বের মৌলিক স্তরে জিনিসগুলি কোনো কারণ ছাড়াই এলোমেলোভাবে ঘটতে পারে। তবে ১৯২০-এর দশকের অন্যান্য পদার্থবিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম ধারণাকে স্বাগত জানাতে শুরু করেন। তাঁরা মেনে নিলেন, কোয়ান্টাম জগতে কোনো কারণ ছাড়াই ঘটনা ঘটতে পারে।
অবশ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি ঘটনার একটি আগের কারণ থাকে। সেখানে কারণ ছাড়া কোনো কার্য ঘটে না। কিন্তু একটি ফোটন যখন জানালার কাচের মুখোমুখি হয়, তখন তার আচরণের কোনো সুর্নিদিষ্ট কারণ নেই। এটি একটি কারণবিহীন কার্য। এটিই প্রকৃতির একেবারে ভিত্তি—এটাই শেষ কথা। এক রহস্যময় কারণে, মহাবিশ্ব কেবল এভাবেই গড়ে উঠেছে।
এর পরের বার বৃষ্টি ভেজা রাতে জানালার দিকে যখন তাকাবেন, তখন শুধু শহরের আলো নয়, কোয়ান্টামের ক্ষুদ্র জগতের কথাটাও একবার ভাববেন। কারণ তাদের এলোমেলো নাচ আর রহস্যময় আচরণের কারণেই আমাদের সামনে গড়ে উঠছে বাস্তবতার ভিত্তি।
