পদার্থবিজ্ঞান
অতীত ও ভবিষ্যতের পার্থক্য
সময় কেন শুধু সামনে চলে? অতীত আর ভবিষ্যতের পার্থক্যটা কী? কেন আমাদের অতীত মনে থাকে, ভবিষ্যৎ মনে থাকে না? এই প্রশ্নগুলো গভীর, বড় প্রশ্ন। আমরা সবাই এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই। আর সে উত্তর দেওয়ার কাজটা বিশ শতকের অন্যতম মেধাবী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের চেয়ে ভালো কে করতে পারবেন? নিজের দ্য ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল বইয়ে ফাইনম্যান সময় নিয়ে আলোচনা করেছেন, বলেছেন অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংশ্লিষ্ট ভৌত সূত্রগুলোর কথা। ভাষান্তর করেছেন উচ্ছ্বাস তৌসিফ।
সবাই বিষয়টা বোঝেন। বিশ্বের সব ঘটনাই ইরিভার্সিবল। মানে, কোনো ঘটনা একবার ঘটে গেলে সেটাকে আর উল্টোভাবে ঘটানো সম্ভব না। [বাংলায় বলা যায় অপ্রত্যাবর্তী।]১
আপনি একটা কাপ ফেলে দিলেন হাত থেকে। পড়ে ভেঙে গেল। এরপর আপনি অনেক্ষণ বসে থাকতে পারেন, অপেক্ষা করতে পারেন, টুকরোগুলো কখন একসঙ্গে হয়ে জোড়া লেগে আপনার হাতে চলে আসবে। কিংবা ধরুন, সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখছেন। চাইলে ওখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারেন, ফেনাগুলো আবার এক হয়ে জুড়ে যাবে, তৈরি হবে উল্টো ঢেউ, মাথা তুলে ছুটে যাবে উল্টোমুখে সমুদ্রপানে, তারপর বহুদূরে সমুদ্রের মাঝে কোথাও আছড়ে পড়বে। দারুণ হতো সেই মুহূর্ত। মুগ্ধকর সুন্দর!
যেকোনো লেকচারে এই ঘটনার নমুনা দেখাতে হলে সাধারণত বেশ কিছু ছবি রাখা হয়। ছবিগুলো পর্দায় নড়ে চলে, সামনের দিকে নয়, উল্টোদিকে ছোটে, তারপর ফিরে যায় ঘটনার শুরুতে। [বলা চলে, একটা ভিডিও নিয়ে উল্টো করে চালানো হয়। অর্থাৎ রিভার্স প্লে করা হয়। আর ভিডিওটা শেষ থেকে ধীরে ধীরে একদম শুরুতে ফিরে যায়।] আর সবাই হেসে ওঠেন! হাসিটা ওই কারণেই—বাস্তব পৃথিবীতে এমনটা ঘটে না।
কিন্তু এরকম কোনো সূত্র বা নীতির খোঁজ আমরা পাইনি। তার মানে, ইতিমধ্যে আমরা পদার্থবিদ্যার এত এত যেসব সূত্রের খোঁজ পেয়েছি, এর কোনোটাকেই অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে কোনোরকম পার্থক্য করতে দেখা যায় না।
সত্যি বলতে, অতীত ও বর্তমানের পার্থক্যের মতো অবশ্যম্ভাবী, স্বাভাবিক ও গভীর একটা বিষয়কে এভাবে দেখানো আসলে দুর্বল দৃষ্টান্ত। কারণ, এরকম কোনো পরীক্ষা ছাড়াই বলা যায়, অতীত ও ভবিষ্যতের জন্য আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অতীত আমাদের মনে থাকে, ভবিষ্যৎ মনে থাকে না। কী ঘটেছে, সে বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা যেমন, কী ঘটবে, সে ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন একধরনের সচেতনতা কাজ করে। অতীত ও ভবিষ্যৎ মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরো আলাদা। এর সঙ্গে স্মৃতি ও ইচ্ছার স্বাধীনতার মতো কিছু ধারণা জড়িত। আমাদের মনে হয়, কিছু করে আমরা ভবিষ্যত বদলাতে পারি। নিজেদের কাজের মাধ্যমে ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করতে পারি। কিন্তু কেউই, কিংবা অল্প কজন ছাড়া আর কেউই হয়তো ভাবেন না যে আমাদের কাজ অতীতকে কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারে। অনুতাপ, আফসোস এবং আশা—এরকম আরও অনেক শব্দ আছে, যেগুলো খুব ভালোভাবেই অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্য করে দেয়।
এখন কথা হলো, প্রকৃতি পরমাণু দিয়ে গঠিত। আবার আমরাও পরমাণু দিয়ে তৈরি এবং ভৌত সূত্র মেনে চলি। এর সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হতে পারে, অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যকার স্পষ্ট পার্থক্য কিংবা যেকোনো ঘটনার অপ্রত্যাবর্তীতার [অর্থাৎ উল্টোভাবে যে ঘটতে পারে না, তার] কারণ কিছু সূত্র—পরমাণুর গতির কিছু সূত্র একমুখী। অর্থাৎ এসব সূত্র দুই দিকে কাজ করতে পারে না। শুধু একদিকেই এগিয়ে যায়। নিশ্চয়ই কোথাও এমন কোনো সূত্র বা নীতি কাজ করছে, যার ফলে ‘ক’ শুধু ‘খ’-তে পরিণত হতে পারে, উল্টোটা কখনোই ঘটতে পারে না। ফলে বিশ্বে ‘ক’ সবসময়ই ‘খ’-তে পরিণত হচ্ছে কালের আবর্তে। আর, একমুখী এই কর্মকাণ্ড—একদিকে এগোনোর এই বিষয়টাই নিশ্চয়ই গোটা বিশ্বকে একদিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
কিন্তু এরকম কোনো সূত্র বা নীতির খোঁজ আমরা পাইনি। তার মানে, ইতিমধ্যে আমরা পদার্থবিদ্যার এত এত যেসব সূত্রের খোঁজ পেয়েছি, এর কোনোটাকেই অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে কোনোরকম পার্থক্য করতে দেখা যায় না। গতিশীল ছবিগুলোকে তাই সামনে বা পেছনের দিকে—দুভাবেই চালানো সম্ভব, দুই ক্ষেত্রেই সূত্রগুলো এদের জন্য একইভাবে কাজ করবে। আর যে পদার্থবিদ এসব ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন, তাঁর আসলে হাসার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু তড়িৎ-চুম্বক সূত্র? এটাও প্রত্যাবর্তী। নিউক্লিয়ার ইন্টার্যাকশন বা পারমাণবিক মিথস্ক্রিয়া? আমরা যতটুকু জানি, প্রত্যাবর্তী। আগে যে বিটা ক্ষয়ের কথা বললাম? এটাও কি প্রত্যাবর্তী?
আবারও চলুন, স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত উদাহরণ হিসাবে মহাকর্ষ সূত্রের কথা ভাবা যাক। ধরুন, আমার কাছে একটা সূর্য ও একটা গ্রহ আছে। সূর্যকে ঘিরে আমি গ্রহটাকে কোনো একদিকে ঘোরাতে শুরু করলাম। তারপর ভিডিও করলাম সেটা। এরপর ভিডিওটা উল্টো করে চালিয়ে দিলাম। কী ঘটবে? গ্রহটা সূর্যকে ঘিরে ঘুরবে, অবশ্যই উল্টো দিকে। এভাবে উপবৃত্তাকার পথে এটা ঘুরতে থাকবে। এই ঘুরে চলার বেগ কেমন হবে? ঘোরার ফলে গ্রহটির যেকোনো দুই সময়ের অবস্থান ও ব্যাসার্ধ মিলে যে ক্ষেত্রফল গঠিত হবে, দেখা যাবে, তার মান সব সময় সমান। [কেপলারের গ্রহীয় বেগের দ্বিতীয় সূত্র, সমান সময়ে সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করবে।—অনুবাদক] অর্থাৎ দেখা যাবে, গ্রহটার যেভাবে ঘোরা উচিত, সেভাবেই ঘুরছে। তার মানে, ‘দিক’ মহাকর্ষ সূত্রের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। দিক উল্টে গেলেও এতে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। শুধু মহাকর্ষ কাজ করছে, এমন কোনো ঘটনার ভিডিও উল্টো করে চালালেও সেটাকে তাই একদম ঠিকঠাকই মনে হবে। কথাটাকে আরও সঠিক ও সুনির্দিষ্ট করে এভাবে বলা যায়—যদি কোনো জটিল সিস্টেমের সবগুলো কণার গতি হঠাৎ উল্টে দেওয়া হয়, তাহলে কণাগুলো প্রাথমিক অবস্থা থেকে ধাপে ধাপে [গতি উল্টে দেওয়ার আগের মুহূর্তে] যে অবস্থায় এসেছে, উল্টে দেওয়ার ফলে এগুলো আবার ধাপে ধাপে প্রাথমিক বা আগের অবস্থার দিকে ফিরে যেতে থাকবে। ধরুন, অনেকগুলো কণা একসঙ্গে কিছু একটা করছে। আপনি হঠাৎ এগুলোর গতি উল্টে দিলেন। এগুলো যা করছিল, সব উল্টোভাবে করে করে আগের দশায় ফিরে যাবে।
মহাকর্ষ সূত্রে এ কথা বলা আছে। এটা বলে, বল প্রয়োগের ফলাফল হিসেবে বেগের পরিবর্তন হয়। আমি যদি সময় উল্টে দিই, বলের পরিবর্তন হয় না। ফলে সংশ্লিষ্ট দূরত্বে বেগ পরিবর্তনে কোনো পরিবর্তন আসে না। তাই প্রতিবার বেগ পরিবর্তনের ফলে আগের সংশ্লিষ্ট বিপরীত দশা দেখা যাবে। অর্থাৎ আগে যেভাবে ধাপে ধাপে বেগ বেড়ে উল্টে দেওয়ার আগ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছিল, প্রতিবার বেগের উল্টো পরিবর্তনের ফলে সংশ্লিষ্ট ধাপের উল্টো দশা দেখা যাবে এ ক্ষেত্রে। [অর্থাৎ সময় উল্টে দিলে ঘটনাটা উল্টোভাবে ঘটবে। তবে মূল ঘটনায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। যেমন সূর্যের চারদিকে পৃথিবী উল্টোভাবে ঘুরতে থাকবে, তবে এর ঘোরার পথ বা অবস্থা বদলে যাবে না।] এভাবে মহাকর্ষ সূত্র যে প্রত্যাবর্তী, অর্থাৎ সময় উল্টে দিলে মহাকর্ষ যে যথাযথভাবেই কাজ করে, তা প্রমাণ করা সহজ।
কিন্তু তড়িৎ-চুম্বক সূত্র? এটাও প্রত্যাবর্তী। নিউক্লিয়ার ইন্টার্যাকশন বা পারমাণবিক মিথস্ক্রিয়া? আমরা যতটুকু জানি, প্রত্যাবর্তী। আগে যে বিটা ক্ষয়ের কথা বললাম? এটাও কি প্রত্যাবর্তী?
কয়েক মাস আগে কিছু এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষণে কিছু জটিলতা দেখা গেছে। এটা ইঙ্গিত করে, এতে কিছু একটা ব্যাপার আছে। সূত্রটায় এমন অজানা কিছু আছে, যেটা বলে, বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়া হয়তো প্রত্যাবর্তী নয়। এখন আরও কিছু পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সে জন্য আমাদের কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এ কথা সত্যি যে বিটা ক্ষয় (প্রত্যাবর্তী হোক বা অপ্রত্যাবর্তী) বেশির ভাগ দৈনন্দিন ঘটনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বহীন একটি ব্যাপার। আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলব কি না, তা বিটা ক্ষয়ের ওপর নির্ভর করে না। এটা নির্ভর করে রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়ার ওপর, বৈদ্যুতিক বলের ওপর, মহাকর্ষের ওপর। এই মুহূর্তে পারমাণবিক বলের ওপরও খুব একটা নির্ভর করছে না বিষয়টা। তবে আমি তো একমুখী কাজ করছি—শুধু আমি বলছি, আর একটা স্বর ভেসে যাচ্ছে বাতাসে। আমি আবার মুখ খুললে সেই স্বর কিন্তু ছুটে এসে আমার মুখে ঢুকে পড়ছে না। আর এই অপ্রত্যাবর্তী বিষয়টার সঙ্গে বিটা ক্ষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্য কথায়, আমাদের ধারণা, পারমাণবিক গতির ফলে সৃষ্ট মহাবিশ্বের বেশির ভাগ সাধারণ ঘটনা যেসব সূত্র মেনে চলে, সেগুলো প্রত্যাবর্তী। তাই অপ্রত্যাবর্তীতার ব্যাখ্যা বের করার জন্য আমাদের আরও খুঁজতে হবে।
ধীরে ধীরে নীল মিশে যেতে থাকবে স্বচ্ছ পানির সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে, হালকা নীলচে হয়ে গেছে। এই রংটার নাম ‘লুক ব্লু’ [হালকা আকাশী মতোন]। অর্থাৎ এখন ৫০-৫০ অবস্থা, রংটা সুষমভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সবটাজুড়ে।
সূর্যের চারদিকে আমাদের গ্রহগুলো যে ঘুরছে, এগুলোর দিকে আরও মনযোগ দিয়ে তাকালে শিগগিরই দেখতে পাব, সব ঠিক নেই। যেমন নিজ অক্ষের ওপর পৃথিবীর ঘূর্ণন খুব সামান্য পরিমাণ ধীর হয়ে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে টাইডাল ফ্রিকশন, অর্থাৎ পৃথিবী ও চাঁদের পারস্পরিক আকর্ষণের কারণে সৃষ্ট ঘর্ষণের জন্য। আর আপনি দেখবেন, এই ঘর্ষণ অপ্রত্যাবর্তী। আমি যদি ভারী কিছু নিয়ে মেঝের ওপর রাখি এবং ওটাকে ধাক্কা দিই, জিনিসটা কিছুটা পিছলে এগোবে। তারপর থেমে যাবে। এখন, আমি যদি অপেক্ষা করি, এটা কিন্তু হঠাৎ করে নিজে নিজে চলতে শুরু করবে না। গতিশীল হয়ে উল্টোভাবে ফিরে আসবে না আমার হাতে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, ঘর্ষণের প্রভাব অপ্রত্যাবর্তী। কিন্তু আমরা আগে আলোচনা করেছিলাম, ঘর্ষণের প্রভাব মূলত ওই ভারী জিনিসটার সঙ্গে মেঝের কাঠের জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল। এর ভেতরের পরমাণুদের ছোটাছুটি, লাফালাফি এর জন্য দায়ী। ভারী জিনিসটার ভেতরের পরমাণুদের সুবিন্যস্ত গতিতে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। মেঝের কাঠের ভেতরের পরমাণুরা অনিয়তভাবে লাফালাফি শুরু করে। [এ জন্যই ঘর্ষণ দেখা যায়।] যেকোনো কিছুর দিকে আমাদের তাই মনযোগ দিয়ে তাকাতে হবে।
সত্যি বলতে, আপাত এই অপ্রত্যাবর্তীতার পেছনের ক্লু বা সূত্র আছে আমাদের কাছে। একটা সহজ উদাহরণ দিই। ধরুন, আমাদের কাছে একটা টাংকিতে নীলচে পানি আছে, কালি মেশানো। আর স্বচ্ছ পানি আছে, কালি ছাড়া। দুটোর মধ্যে একটা বাধা বা দেয়াল আছে। আমরা এই দেয়ালটাকে খুব সূক্ষ্মভাবে, যত্ন করে সরিয়ে নিলাম। শুরুতে পানিটা আলাদা। একপাশে নীলচে পানি, একপাশে স্বচ্ছ। একটু অপেক্ষা করুন। ধীরে ধীরে নীল মিশে যেতে থাকবে স্বচ্ছ পানির সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে, হালকা নীলচে হয়ে গেছে। এই রংটার নাম ‘লুক ব্লু’ [হালকা আকাশী মতোন]। অর্থাৎ এখন ৫০-৫০ অবস্থা, রংটা সুষমভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সবটাজুড়ে। এখন যদি আমরা অপেক্ষা করি এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থাকি, এটা নিজে নিজে আলাদা হয়ে যাবে না। (আপনি চাইলে কিছু করে এই নীলটাকে আলাদা করতে পারেন। চাইলে পানিকে বাষ্পীভূত করে, ঘনীভবন করে নিয়ে নীল ডাই, মানে রঙের গুঁড়োগুলো আলাদা করে ফেলতে পারেন এবং সেটাকে টাংকির অর্ধেক পানিতে আবার গুলতে পারেন। তারপর আবার আগের মতো অর্ধেক স্বচ্ছ, অর্ধেক নীলচে পানিকে আলাদা করে রাখতে পারেন। কিন্তু এই যে এত কিছু করছেন, এগুলো করতে গিয়ে আপনি ঠিকই আবার অন্য কোথাও অপ্রত্যাবর্তী বেশ কিছু ঘটনা ঘটাবেন।) মানে, নিজে নিজে এটা উল্টোভাবে ঘটবে না।
এই বিষয়টাই আমাদের কিছু সূত্র দেয়। আমাদের সে জন্য অণুগুলোর দিকে তাকাতে হবে। ধরুন, আমরা নীলচে পানি ও স্বচ্ছ পানি মিশছে—এমন একটা চলমান ছবি [ভিডিও] নিলাম। এটাকে উল্টোভাবে চালালে জিনিসটা হাস্যকর দেখাবে। কারণ আমরা তখন [উল্টোভাবে] শুরুতেই পাব মিশ্রিত পানি। তারপর নীলচে পানি ও স্বচ্ছ পানি ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যেতে থাকবে। জিনিসটা দেখে মনে হবে অদ্ভুতুড়ে।
সূর্যের চারদিকে আমাদের গ্রহগুলো যে ঘুরছে, এগুলোর দিকে আরও মনযোগ দিয়ে তাকালে শিগগিরই দেখতে পাব, সব ঠিক নেই। যেমন নিজ অক্ষের ওপর পৃথিবীর ঘূর্ণন খুব সামান্য পরিমাণ ধীর হয়ে যাচ্ছে।
এবারে আমরা ছবিটাকে বিবর্ধিত বা জুম করলাম যেন উপস্থিত সব পদার্থবিদ প্রত্যেকটা পরমাণুকে আলাদাভাবে দেখতে পান। যেন বুঝতে পারেন, অপ্রত্যাবর্তীভাবে ঠিক কী ঘটে। কোথায় [নীল রং মিশে যাওয়ার এ ঘটনায়] সামনে এগোনো আর পিছিয়ে যাওয়ার ভারসাম্যটা ভেঙে পড়ে। তো, আমরা শুরু করলাম। ছবিটার দিকে তাকালাম। এখানে আমাদের কাছে দুই ধরনের পরমাণু আছে। (বিষয়টা হাস্যকর, তবু চলুন এগুলোকে নীল ও সাদা পরমাণু বলে ডাকা যাক।) পরমাণুগুলো তাপীয় গতির ফলে সদা লাফালাফি, ছোটাছুটি করছে। আমরা যদি একদম শুরু থেকে শুরু করি, তাহলে শুধু এক ধরনের পরমাণুর একপাশে থাকার কথা। অন্যপাশে থাকবে অন্য ধরনের অণু। [অর্থাৎ একপাশে শুধু নীল অণু, অন্যপাশে শুধু সাদা অণু।] এখন, এই অণুগুলো—বিলিয়ন বিলিয়ন অণু, লাফালাফি-ছোটাছুটি করছে। আর আমরা যদি শুরুতে একপাশে শুধু এক ধরনের অণু রাখি, অন্য পাশে অন্য ধরনের অণু, তাহলে দেখব এগুলো অবিরাম অনিয়ত গতিতে মিশে যাচ্ছে। এ কারণেই পানি ধীরে ধীরে আরও, আরও সুষম নীল হয়ে যাচ্ছে।
এবারে চলুন, এই ছবি থেকে যেকোনো একটা সুনির্দিষ্ট সংঘর্ষ খুঁটিয়ে দেখি। চলমান ছবিতে দেখা যাবে, দুটো অণু এই পথ ধরে এল, আর সংঘর্ষের পর বাউন্স করে ওই পথ ধরে ছুটে গেল। এবারে ভিডিওর এই অংশটা আলাদা করে উল্টোভাবে চালিয়ে দেখা যাক। তাহলে দেখব, অণুগুলো ওই পথ ধরে এল, তাদের সংঘর্ষ হলো এবং এই পথ ধরে ছুটে গেল। পদার্থবিজ্ঞানী কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকেন, সবকিছু পরীক্ষা করে, মেপে দেখেন। তারপর বলেন, ‘এটা ঠিকই আছে। সব পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনেই ঘটেছে। দুটো অণু ওই পথ ধরে ছুটে এলে সংঘর্ষের পর এই পথ ধরেই ছুটে যাবে।’ অর্থাৎ ঘটনাটা প্রত্যাবর্তী। আণবিক সংঘর্ষের সূত্রগুলো প্রত্যাবর্তী।
তার মানে, আপনি যতই খুঁটিয়ে দেখেন না কেন, দেখে কিছু বুঝবেন না। কারণ প্রতিটা সংঘর্ষই পুরোপুরি প্রত্যাবর্তী। অথচ গোটা ছবিটা খুব উদ্ভট একটা জিনিস দেখায়। উল্টো করে চালালে দেখা যায়, অণুগুলো মিশ্রিত অবস্থায় ভিডিওটা শুরু হয়েছে। নীল, সাদা, নীল, সাদা, নীল, সাদা। অথচ যত সময় যায়, সংঘর্ষ ঘটে, তত নীল অণুগুলো সাদাগুলো থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে তারা এটা করতে পারে না। জীবনের দুর্ঘটনাগুলো এমন না যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নীল অণুগুলো সাদাগুলো থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এটা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক না। অথচ আপনি যদি উল্টো করে চালিয়ে ভিডিওটা খুঁটিয়েও দেখেন, তবু দেখবেন, সবগুলো সংঘর্ষই ঠিক আছে [মানে, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ীই সব হচ্ছে]।
বিষয় হলো, এর মধ্যে শুধু একটা ঘটনাই ঘটতে পারে। অপ্রত্যাবর্তীতার বিষয়টার পেছনে দায়ী শুধু জীবনের সার্বিক দুর্ঘটনা। এ ছাড়া আর কিছু না। আপনি যদি আলাদা কিছু জিনিস নিয়ে শুরু করেন এবং এগুলো এলোমেলো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, তবে শেষে এসে এগুলো সুষমভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যদি সুষমভাবে [যেমন নীল ও সাদা অণুর মিশ্রণ নিয়ে] শুরু করেন এবং এলোমেলো পরিবর্তন করেন, তবে এগুলো আলাদা হয়ে যায় না বাস্তবে।
এগুলো আলাদা হয়ে যেতে পারে। আলাদা হয়ে যাওয়াটা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের পরিপন্থী না। অণুগুলো ধাক্কা খাবে এবং এক ধরনের অণু একপাশে, অন্য ধরনেরগুলো অন্যপাশে চলে যাবে আলাদা হয়ে—এমনটা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মতে ঘটতে পারে। তবে এমনটা ঘটার সম্ভাবনা কম। দশ লাখ বা এক মিলিয়ন বছরেও এমনটা ঘটে না। এটাই আমাদের উত্তর। সব কিছু প্রত্যাবর্তী এই অর্থে যে কোনো ঘটনা একদিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু অন্যদিকে, উল্টোদিকে যাওয়া সম্ভব—পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, উল্টোদিকে যাওয়াটা ঠিকও আছে—তবে মিলিয়ন বছরেও এমনটা ঘটে না। আপনি দীর্ঘসময় এখানে বসে থাকলে অণুগুলোর লাফালাফি, ছোটাছুটির ফলে নীলচে পানি ও স্বচ্ছ পানি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলাদা হয়ে যাবে—এরকম আশা করা হাস্যকর।
এখন তাহলে পরের প্রশ্নটা হলো—এগুলো শুরুতে সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত হয় কীভাবে? প্রশ্নটা এভাবেও করা যায়—সুবিন্যস্ত কিছু নিয়ে যে শুরু করছি, শুরুর এই সুবিন্যস্ত অবস্থা কোত্থেকে এল?
এখন, আমি যদি এই এক্সপেরিমেন্টের চারপাশে একটা বাক্স বসিয়ে দিই, যেন বাক্সের ভেতরে শুরুতে প্রতি ধরনের অণু চার-পাঁচটা করে থাকে, তাহলে সময়ের আবর্তে এগুলো ধীরে ধীরে মিশে যাবে। কিন্তু আমার ধারণা, আপনি চাইলে এটা বিশ্বাস করতে পারেন যে দীর্ঘকাল ধরে এগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে আর অণুগুলোর মধ্যে অবিরাম অনিয়ত সংঘর্ষ হতে থাকলে একটা সময় পর—এটা যে এক মিলিয়ন বছর হতে হবে, তা নয়; এক বছরও হতে পারে—দেখা যাবে, দুর্ঘটনাক্রমে অণুগুলো কম-বেশি আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। অন্তত এই অর্থে যে এগুলোর মাঝখানে আমি যদি একটা দেয়াল বা বাধা বসিয়ে দিই, তাহলে সব সাদা অণু একপাশে থাকবে, আর সবগুলো নীল থাকবে অন্যপাশে। এটা অসম্ভব না। কিন্তু আমরা বাস্তবে যেসব জিনিস নিয়ে কাজ করি, তাতে শুধু চার-পাঁচটা করে নীল বা সাদা অণু থাকে না। থাকে চার বা পাঁচ মিলিয়ন, মিলিয়ন, মিলিয়ন। আর সে ক্ষেত্রে আলাদা হতে হলে এই সবগুলোকে আলাদা হতে হবে। তাই আপাত অপ্রত্যাবর্তীতার বিষয়টা মৌলিক ভৌত সূত্রগুলোর অপ্রত্যাবর্তীতা থেকে আসে না। বরং এটা সুবিন্যস্ত সিস্টেম বা ব্যবস্থার এই স্বভাব থেকে আসে যে আপনি যদি সুবিন্যস্ত, সুশৃঙ্খল কোনো ব্যবস্থা নিয়ে শুরু করেন, আর এর যদি এলোমেলো প্রকৃতি থাকে; অণুগুলো যদি ছোটাছুটি করে, তবে এগুলো সংঘর্ষের পর বাউন্স করে শুধু একদিকে যাবে [মিশ্রিত হওয়ার দিকে, আলাদা হয়ে যাওয়ার দিকে না]।
এখন তাহলে পরের প্রশ্নটা হলো—এগুলো শুরুতে সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত হয় কীভাবে? প্রশ্নটা এভাবেও করা যায়—সুবিন্যস্ত কিছু নিয়ে যে শুরু করছি, শুরুর এই সুবিন্যস্ত অবস্থা কোত্থেকে এল? এদেরকে কেন সুবিন্যস্ত করা গেল? এটা কীভাবে সম্ভব? এখানে সমস্যাটা হলো, আমরা সব সময় সুবিন্যস্ত অবস্থা নিয়ে শুরু করি। শেষে এসে কখনো সুবিন্যস্ত অবস্থা পাওয়া যায় না। মহাবিশ্বের একটা নিয়ম হলো, সব সময় সবকিছু সুশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খলতার দিকে যায়। এখানে ‘শৃঙ্খলা’ বা ‘অর্ডার’ ও ‘বিশৃঙ্খলা’ বা ‘ডিসঅর্ডার’—পদার্থবিজ্ঞানের টার্ম বা প্রতিশব্দ। বাস্তব জীবনে আমরা এসব শব্দকে যে অর্থে ব্যবহার করি, এ ক্ষেত্রে এগুলো ঠিক সেই অর্থ দেয় না। শৃঙ্খলা মানুষ হিসেবে আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং হওয়ার দরকার নেই। ঘটনা হলো, এটা একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থা—হয় এক ধরনের সব একপাশে থাকবে, অন্য ধরনেরগুলো অন্যপাশে [শৃঙ্খলা]; আর নাহয় এগুলো মিশ্রিত হয়ে যাবে [বিশৃঙ্খলা]। এটাই এখানে শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলা।
প্রশ্ন হলো, কোনো সাধারণ ঘটনার দিকে তাকালে শুরুতে তা কীভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় পৌঁছায় এবং কেন? উত্তরটা এরকম হতে পারে—শুরুর এই ঘটনা আসলে শুরু নয়; এটা আসলে সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খল অবস্থা নয়, আংশিক সুশৃঙ্খল অবস্থা। এ থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি, ঘটনাটা এই অবস্থায় পৌঁছেছে আরও সুশৃঙ্খল অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে। আমি যদি একটা পানির টাংকির দিকে তাকাই, যেখানে একপাশের পানি গাঢ় নীল, অন্যপাশের পানি একদম স্বচ্ছ, আর মাঝের অংশটা নীলচে; আর আমি জানি, টাংকিতে পানিগুলো বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট ধরে রয়েছে; তখন আমি অনুমান করব, আগে নীল ও স্বচ্ছ পানি আরও আলাদা ছিল। ধীরে ধীরে নীল খানিকটা মিশে গিয়ে এ অবস্থায় পৌঁছেছে। আমি যদি আরও কিছু সময় অপেক্ষা করি, তাহলে নীল ও স্বচ্ছ পানি আরও মিশবে। আমি যদি জানতে পারি, এটাকে যথেষ্ট সময় এভাবে ফেলে রাখা হয়েছে, তবে আমি এর অতীত অবস্থার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব। বর্তমানে যে কিনারার দিকে পানিটা যথেষ্ট ‘সুশৃঙ্খল’, এর একমাত্র কারণ হতে পারে, আগে এটা আরও সুশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। নীল ও স্বচ্ছ পানি আগে আরও বেশি আলাদা ছিল। কারণ, আগে যদি এটা আরও বেশি আলাদা না থাকত, তাহলে এতক্ষণে নীল আরও বেশি মিশে যেত, পানি আরও বেশি নীলচে হয়ে উঠত। এভাবে বর্তমান থেকে অতীতের ব্যাপারে কিছু কিছু বিষয় বলা সম্ভব।
তবে সত্যি বলতে, পদার্থবিদরা আসলে অতীত নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না। পদার্থবিজ্ঞানীরা ভাবতে পছন্দ করেন, আপনার কাজ শুধু বলা—এগুলো হলো বর্তমান অবস্থা, তাহলে এর পর কী হবে? তবে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোর সমস্যা বা চিন্তা পুরো ভিন্ন। আসলে, আর যত কিছু নিয়ে মানুষ গবেষণা করে—ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ইতিহাস—সবকটি সমস্যাই এ ধরনের। অর্থাৎ তাঁদের অতীত নিয়ে কাজ করতে হয়; এবং অনুমান করে এর সত্যতা প্রমাণ করতে হয়। আমি যতটা বুঝি, পদার্থবিজ্ঞানীদের তুলনায় তাঁদের পুরো ভিন্ন ধরনের অনুমান করতে হয়।
মহাবিশ্ব কীভাবে সুশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছাল, এ নিয়ে কিছু মানুষের প্রস্তাবনা আছে। শুরুতে মহাবিশ্ব ছিল শুধু কিছু অনিয়ত গতি। ঠিক মিশ্রিত পানির মতো। আমরা দেখেছি, অনেক্ষণ অপেক্ষা করলে, অল্প কিছু অণু থাকলে [নীল ও স্বচ্ছ] পানি আলাদা হয়ে যেতে পারে।
একজন পদার্থবিদ বলেন, ‘এই এই শর্ত সত্যি হলে আমি তোমাকে বলে দেব এরপর কী হবে।’ কিন্তু একজন ভূতত্ত্ববিদ বলবেন, ‘আমি মাটি খুঁড়ে নির্দিষ্ট একধরনের হাড় পেয়েছি। আমার ধারণা, তুমি মাটি খুঁড়লেও একই ধরনের হাড় পাবে।’ ইতিহাসবিদ যদিও অতীত নিয়ে কথা বলেন, তবে তিনি সেটা বলেন ভবিষ্যবাচ্যে। তিনি যখন বলেন, ফরাসি বিপ্লব ১৭৮৯ সালে হয়েছে, তিনি আসলে বোঝান, আপনি যদি ফরাসি বিপ্লবের ব্যাপারে অন্য কোনো বই খুলে দেখেন, তাহলেও একই সন-তারিখ পাবেন। অর্থাৎ তিনি জীবনে কখনো দেখেননি, এমন কিছু নিয়ে অনুমান করেন। যেমন কিছু কাগজপত্র হয়তো এখনো পাওয়া যায়নি, তিনি এর কথা অনুমান করবেন। অনুমান করবেন, আমাদের হাতে থাকা কাগজপত্রে নেপোলিয়নের ব্যাপারে যা লেখা আছে; যে কাগজটা পাওয়া যায়নি, তাতে থাকা লেখাজোকা এর সঙ্গে মিলে যাবে। প্রশ্ন হলো, এটা কীভাবে সম্ভব? এটা শুধু তখনই সম্ভব, যদি বিশ্বের ইতিহাস এই অর্থে বর্তমানের চেয়ে আগে আরও সুশৃঙ্খল থেকে থাকে। যেমন নেপোলিয়নকে নিয়ে লেখা কোনো কাগজ বা ছেঁড়া পৃষ্ঠা আগে ছেঁড়া ছিল না, ছিল কোনো ডায়েরির অংশ। এখন তা ছিঁড়ে, মাটির গহিনে কোথাও চাপা পড়ে আছে। অর্থাৎ সুশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছেছে।
মহাবিশ্ব কীভাবে সুশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছাল, এ নিয়ে কিছু মানুষের প্রস্তাবনা আছে। শুরুতে মহাবিশ্ব ছিল শুধু কিছু অনিয়ত গতি। ঠিক মিশ্রিত পানির মতো। আমরা দেখেছি, অনেক্ষণ অপেক্ষা করলে, অল্প কিছু অণু থাকলে [নীল ও স্বচ্ছ] পানি আলাদা হয়ে যেতে পারে। (এক শতাব্দী আগে) কিছু পদার্থবিদ বললেন, এই গোটা মহাবিশ্ব—সদা চলমান—‘ফ্লাকচুয়েট’ করেছে। এটুকুই ব্যাস, আর কিছু হয়নি। (ফ্লাকচুয়েট একটা প্রতিশব্দ। সাধারণ সুষম অবস্থা একটু এলোমেলো হয়ে গেলে, শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়।) এই যে ফ্লাকচুয়েট করেছে, এলোমেলো হয়ে গেছে; এ থেকে আবারও সুষম অবস্থায় ফিরে যাওয়া, অর্থাৎ ফ্লাকচুয়েশনের প্রভাব থিতিয়ে আসাটুকু দেখছি আমরা বর্তমানে। হয়তো বলতে পারেন, ‘কিন্তু দেখুন, এরকম একটা ফ্লাকচুয়েশনের জন্য আপনাকে কত সময় অপেক্ষা করতে হবে?’ তা বটে। কিন্তু যদি বিবর্তনের জন্য যথেষ্ট ফ্লাকচুয়েট না করে, যদি এর ফলে বুদ্ধিমান প্রাণ সৃষ্টি না হয়, তাহলে তো আমরা সেটা দেখতে পেতাম না। তাই আমাদের নিজেদের বেঁচে থেকে ওটা দেখার মতো যথেষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। অন্তত সে পরিমাণ বড় ফ্লাকচুয়েশন হতেই হবে, এ ছাড়া উপায় নেই।
তবে আমি নিজে মনে করি, এই ধারণা সঠিক না। কিছু কারণে এটাকে আমার হাস্যকর মনে হয়। মহাবিশ্ব যদি যথেষ্ট বড় হয়, আর পরমাণুগুলো যদি সবটাজুড়ে ছড়িয়ে থাকে, পুরো মিশ্রিত থাকে ঘটনার শুরুতে; তারপর আমি শুধু এক জায়গার কিছু পরমাণুর দিকে তাকালাম, দেখলাম, ওগুলো আলাদা; এর ওপর ভিত্তি করে আমি কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারব না যে অন্য জায়গাতেও পরমাণুগুলো আলাদা হয়ে গেছে। সত্যি বলতে, এটা যদি একটা ফ্লাকচুয়েশনই হয় আর আমি যদি এরকম অদ্ভুত কিছু দেখি, এর সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা হতে পারে—আর কোথাও এরকম অদ্ভুত কিছু নেই। অর্থাৎ অন্যখান থেকে ‘অদ্ভুত’ ধার করতে হবে আমাকে এই অংশটাকে ভারসাম্যহীন করতে। আর এভাবে বেশি বেশি ধার করে কোনো লাভ নেই।
মহাশূন্যটা শীতল—উত্তপ্ত ও শীতল পদার্থের এই আলাদা অবস্থাই হয়তো ফ্লাকচুয়েশন। কিন্তু এমনটা হলে ‘ফ্লাকচুয়েশনের ধারণা’ অনুযায়ী, আমরা যেসব জায়গা এখনো দেখিনি, সেখানে তাকালে নক্ষত্রগুলোকে মহাশূন্যের সঙ্গে মিশে থাকতে দেখার কথা
বিষয়টাকে সেই নীল ও স্বচ্ছ পানির পরীক্ষণের মাধ্যমে ভাবা যাক। আমরা যখন টাংকির একপাশে একটা বাক্স রেখে দিলাম, ওই বাক্সের মধ্যকার অণুগুলো দীর্ঘ সময় পর আলাদা হয়েছে সত্যি, কিন্তু এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো, বাক্সের বাইরে টাংকির বেশির ভাগ পানিই তখনো মিশ্রিত। তাই আমরা যখন নক্ষত্র বা মহাবিশ্বের দিকে তাকাই, দেখি সবকিছু সুশৃঙ্খল; যদি আসলেই ফ্লাকচুয়েশন হয়ে থাকে, এই ধারণা বলে—আমরা আগে যেসব জায়গা দেখিনি, সেগুলো যদি পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব ওই অংশগুলো বিশৃঙ্খল, এলোমেলো হয়ে আছে। হতে পারে, আমরা যে নক্ষত্রদের দেখি, এদের ভেতরের পদার্থগুলো প্রচণ্ড গরম; আর মহাশূন্যটা শীতল—উত্তপ্ত ও শীতল পদার্থের এই আলাদা অবস্থাই হয়তো ফ্লাকচুয়েশন। কিন্তু এমনটা হলে ‘ফ্লাকচুয়েশনের ধারণা’ অনুযায়ী, আমরা যেসব জায়গা এখনো দেখিনি, সেখানে তাকালে নক্ষত্রগুলোকে মহাশূন্যের সঙ্গে মিশে থাকতে দেখার কথা, আলাদা পাওয়ার কথা না। কিন্তু আমাদের, অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার একটা সফল অনুমান হলো [মহাবিশ্ব সবদিকে সুষম, তাই] যেসব জায়গা আমরা দেখিনি, সেখানেও নক্ষত্রগুলো আমরা যেগুলো দেখি, ওগুলোর মতোই হবে। কিংবা নেপোলিয়নের ব্যাপারে আমরা একই বিবৃতি পাব; মাটি খুঁড়ে পাওয়া নতুন হাড়গুলো হবে আগে পাওয়া হাড়গুলোর মতোই। আর বিজ্ঞানের এসব শাখার সাফল্য বলে দেয়, মহাবিশ্ব ফ্লাকচুয়েশন থেকে আসেনি। বরং এসেছে আরও সুশৃঙ্খল, আলাদা, সুবিন্যস্ত এক দশা থেকে। অর্থাৎ বর্তমানের চেয়ে অতীতের মহাবিশ্ব ছিল আরও সুশৃঙ্খল। তাই আমি মনে করি, ভৌত সূত্রগুলোর মধ্যে এই হাইপোথিসিসটাও যুক্ত করা উচিৎ—অতীতে মহাবিশ্ব আরও সুশৃঙ্খল ছিল বর্তমানের চেয়ে, এ দিক থেকে, তাত্ত্বিকভাবে। আমার ধারণা, অপ্রত্যাবর্তীতাকে বুঝতে, সবকিছুর অর্থ অনুধাবন করার জন্য এই বাড়তি বিবৃতিটুকু প্রয়োজন।
এই বিবৃতিটা নিজেও অবশ্য কালের সাপেক্ষে ভারসাম্যহীন। কারণ এটা বলে, অতীতের কিছু একটা ভবিষ্যৎ থেকে ভিন্ন। তবে এটা আমরা সাধারণত যেগুলোকে ভৌত সূত্র বলি, তার আওতার বাইরে। কারণ যেসব নিয়ম মেনে মহাবিশ্ব গড়ে উঠেছে, সেগুলো যেসব ভৌত সূত্র দিয়ে পরিচালিত হয়; আর যেসব সূত্র মহাবিশ্ব অতীতে কেমন ছিল সে কথা বলে—এ দুই ধরনের সূত্রকে আজ আমরা আলাদা করার চেষ্টা করছি। দ্বিতীয় ধরনের সূত্রগুলোকে [অর্থাৎ যেগুলো মহাবিশ্বের অতীতকে বর্ণনা করে] জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ইতিহাস বা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল হিস্ট্রি বলে ভাবা হয়। হয়তো কোনোদিন এগুলোও ভৌত সূত্রের অংশ হয়ে উঠবে।