নিউক্লিয়ার বলের কাহন (পর্ব ৪)

মহাজাগতিক রশ্মির উৎপত্তি কোথায়? বস্তুর বৈদ্যুতিক চার্জ ও বিকিরণ গবেষণার সূত্র ধরে কেমন করে আবিষ্কৃত হলো এই রশ্মি? কীভাবে জানা গেল, সব কণারই রয়েছে প্রতিকণা? পৃথিবীতে বসে মহাবিশ্বের গোপন রহস্যভেদের এ এক রোমাঞ্চকর কাহিনি...

ভিক্টর হেসের বেলুন উড্ডয়নের প্রস্তুতি চলছে, মাঝখানে বিজ্ঞানী হেস

কোনো বস্তু বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করছে কি না, তা জানার উপায় কী? সে জন্য প্রথমে অন্য একটি চার্জকে প্রথম চার্জের কাছে আনতে হয়। ফলে এর ওপর আদৌ বল প্রযুক্ত হচ্ছে কি না, তা জেনে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। কিন্তু সেই চার্জের মান কত, তা বের করা একটু ঝামেলার কাজ। এ জন্য এককালে ইলেকট্রোস্কোপ নামে একটা যন্ত্র ব্যবহার করতে হতো। এর মাঝখানে দুটি সংযুক্ত ধাতব পাতে চার্জ জমা হলে পাত দুটির মধ্যে পারস্পরিক বিক্ষেপ বেড়ে যেত। যন্ত্রটি পারিপার্শ্বিক সবকিছু থেকে বিযুক্ত রাখলে এর ভেতর থেকে চার্জ বের হওয়ার কথা নয়। তবু ইলেকট্রোস্কোপে যদি কোনো চার্জ রেখে দেওয়া হয়, তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে—ঠিক যেভাবে গ্যাসে ভরা রাবার বেলুন ধীরে ধীরে চুপসে যেতে থাকে। একে আমরা সংক্ষেপে ডিসচার্জ (Discharge) বলব। ইলেকট্রোস্কোপের পাত দুটির মাঝখানের দূরত্ব ধীরে ধীরে কমছে, তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা এটা বুঝতে পারি।

এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে, যদি বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকে। সে ক্ষেত্রে পাত থেকে চার্জ বাতাসে বিমুক্ত হতে পারে। তবে ইলেকট্রোস্কোপের মাঝখানে জলীয় বাষ্প নিরোধের ব্যবস্থা রাখা থাকে। তার মানে, এ ঘটনার অন্য কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে। এটা নিয়ে প্রথমে লোকজনের খুব বেশি মাথাব্যথা ছিল না। তবে কুরি দম্পতি আর বেকেরেল তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিও–অ্যাকটিভিটি আবিষ্কার করার পর বিজ্ঞানীরা দেখলেন, তেজস্ক্রিয়তায় পাওয়া আলফা, বিটা কণার কারণে ইলেকট্রোস্কোপের বিক্ষেপণ কমছে।

হেস এই বেলুন অভিযান দিনে ও রাতে চালাতে থাকেন। এই ধারায় ১৯১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঘটা পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় ৫ হাজার ৩০০ মিটার উচ্চতায় বেলুন নিয়ে আরোহণ করেন তিনি।

এ থেকে বোঝা গেল, আমাদের চারপাশের পরিমণ্ডলেও তেজস্ক্রিয় কণার উৎস রয়ে গেছে। বিশেষ করে পৃথিবীর ভেতরে। এখন আমরা জানি, দৈনন্দিন জীবনে যে কলা (ফল) খাই, তার ভেতরেও সামান্য তেজস্ক্রিয় পটাশিয়াম রয়েছে। কিন্তু এর পরিমাণ অত্যন্ত কম। একজনকে তেজস্ক্রিয়তা থেকে অসুস্থ হতে গেলে তাই প্রায় কয়েক লাখ কলা খেতে হবে। অতএব পাকা কলা খেতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

আরও পড়ুন

১৯০৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী থিওডর উলফ ইলেকট্রোস্কোপ ব্যবহার করে আইফেল টাওয়ারের চূড়ায় (৩০০ মিটার উঁচুতে) আয়নাইজেশন বা আয়নায়নের হার পরিমাপ করেন। তেজস্ক্রিয়তার প্রাকৃতিক উৎস যদি শুধু পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকে, তাহলে আমরা ভূপৃষ্ঠ থেকে যত ওপরে উঠব, এই ডিসচার্জের হার তত কমতে থাকবে, আবার তা ঘটবেও দ্রুত। কিন্তু উলফের পর্যবেক্ষণে সেটা পাওয়া গেল না; বরং দেখা গেল, আয়নাইজেশনের মান ভূপৃষ্ঠের অর্ধেকের কাছাকাছি। সেটা ছিল প্রত্যাশার চেয়ে যথেষ্ট বেশি। তাহলে কি এর জন্য অন্য কোনো উৎস দায়ী?

ক্লাউড চেম্বারে পাওয়া তেজস্ক্রিয় উৎস থেকে পাওয়া আলফা কণার গতিপথ

এ ধারণার সত্যতা নির্ণয় করতে ১৯১১-১২ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী ভিক্টর হেস বায়ুমণ্ডলে বিকিরণ মাপার জন্য একটি ইলেকট্রোস্কোপ নিয়ে বেশ কবার বেলুনে চড়েন। ১৯১১ সালে ভিক্টর হেসের বেলুন প্রায় ১ হাজার ১০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছেছিল। কিন্তু হেস ভূপৃষ্ঠের তুলনায় বিকিরণের পরিমাণে ‘কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন’ খুঁজে পাননি। তাহলে প্রশ্ন আসে, ভূমির তেজস্ক্রিয়তার বাইরেও অন্য কিছু কি আয়নাইজেশনের জন্য দায়ী? আমাদের সূর্য কি এটার উৎস হতে পারে?

কসমিক রশ্মিতে থাকা কণাগুলোর শক্তির মান অনেক বেশি থাকায় তেজস্ক্রিয়তায় পাওয়া কণা দিয়ে যেসব বিক্রিয়া সম্ভব হচ্ছিল, এর চেয়ে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা বিজ্ঞানীরা দেখতে পেতে শুরু করলেন।

হেস এই বেলুন অভিযান দিনে ও রাতে চালাতে থাকেন। এই ধারায় ১৯১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঘটা পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় ৫ হাজার ৩০০ মিটার উচ্চতায় বেলুন নিয়ে আরোহণ করেন তিনি। যেহেতু গ্রহণের সময় বায়ুমণ্ডলের আয়নীকরণ কমেনি, তাই হেস যুক্তি দেন যে বিকিরণের উৎস সূর্য হতে পারে না, এটি অবশ্যই মহাকাশ থেকে আসছে। বায়ুমণ্ডলের উচ্চ স্তরে তিনি উচ্চ শক্তির কণার একটি প্রাকৃতিক উৎস আবিষ্কার করেছিলেন—মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে।

এদিকে বিজ্ঞানী উইলসন ক্লাউড চেম্বার নামে একটি মেশিন বানান, যার মাধ্যমে একটি ফ্লাস্কের ভেতরেই ঘন কুয়াশা তৈরি করা যায়। ইলেকট্রোস্কোপ দিয়ে চার্জের উপস্থিতি বের করা গেলেও কোনো বিচ্ছিন্ন চার্জের গতিপথ দেখা সম্ভব ছিল না, কিন্তু এবার সেটা সম্ভব হলো। কারণ, চার্জ কুয়াশার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় কুয়াশায় ভেসে থাকা জলীয় বাষ্পকে একত্র করে শিশিরবিন্দু তৈরি করে। রেডিয়াম বা ইউরেনিয়াম থেকে বের হওয়া আলফা, বিটা রশ্মিগুলো এই ক্লাউড চেম্বারে যে রকম শিশিরকণার ‘ছাপ’ দেখাচ্ছিল, ঠিক একই ঘটনা এই মহাজাগতিক রশ্মি ঘটাচ্ছিল; অর্থাৎ ফ্লাস্কের দেয়ালে জমা এই শিশিরকণা দিয়েই অবশেষে মহাজাগতিক রশ্মিকে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ‘দেখতে’ পেলেন।

কসমিক রশ্মিতে থাকা কণাগুলোর শক্তির মান অনেক বেশি থাকায় তেজস্ক্রিয়তায় পাওয়া কণা দিয়ে যেসব বিক্রিয়া সম্ভব হচ্ছিল, এর চেয়ে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা বিজ্ঞানীরা দেখতে পেতে শুরু করলেন।

আরও পড়ুন

২.

এদিকে পদার্থবিজ্ঞানে ঘটে গেছে একগুচ্ছ মহাবিপ্লব। আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতা প্রণয়ন করেন ১৯০৫ সালে। তারপর এল কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। সেটা ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি এসে একটা পরিপূর্ণ আকার ধারণ করতে শুরু করল। কিন্তু এই দুই স্তম্ভের মাঝখানে পরিপূর্ণ যোগসূত্র দাঁড় করাতে কিছুটা সময় লাগল। শ্রোডিঙ্গার প্রথমে বিশেষ আপেক্ষিকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি সমীকরণ প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু তাতে পাওয়া হাইড্রোজেনের বর্ণালি নীলস বোরের বের করা ফলাফলের সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না।

এ ছবি থেকেই আবিষ্কৃত হয় পজিট্রন

এ সমস্যার সমাধান এল পল ডিরাকের হাত ধরে। তাঁর দেওয়া নতুন সমীকরণে দুটি নতুন জিনিস স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে এল। এক, ইলেকট্রনের মতো কণাদের তিন মাত্রার জগতে অবস্থান ছাড়াও স্পিন নামে নিজস্ব একটি সত্তা রয়েছে। অনেকে স্পিন শব্দটি বাংলায় ‘ঘূর্ণন’ লিখতে চাইলেও আমি এর বিপক্ষে। কারণ, লাটিমের ঘূর্ণনের সঙ্গে ‘স্পিন’-এর বিশাল পার্থক্য রয়েছে। আমরা লাটিমের ঘূর্ণন মাপতে চাইলে যেকোনো মান পেতে পারি, কিন্তু ইলেকট্রনের স্পিনের শুধু দুটি মান হতে পারে। সেটা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না।

তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তাবিত হলেও এই ধারণা কতটুকু ঠিক, তা নির্ণয় করার জন্য চাই পরীক্ষাগারে বা প্রকৃতিতে প্রমাণ। ১৯২০-এর দশকে পরীক্ষাগারে প্রতিকণা তৈরির কোনো কৌশল পদার্থবিজ্ঞানীদের জানা ছিল না।

গুডস্মিথ ও উহলেনবেক নামে দুই বিজ্ঞানী পরমাণুর বর্ণালি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইলেকট্রনের জন্য স্পিনের মতো দুই মানসম্পন্ন একটি লেবেল দেন। কিন্তু এর কোনো গাণিতিক ব্যাখ্যা ছিল না। ডিরাকের সমীকরণের মাধ্যমে ইলেকট্রন স্বাভাবিকভাবেই স্পিনের মতো একটি ধর্মের অধিকারী হলো। পাশাপাশি দ্বিতীয় আরেকটি ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল। ডিরাকের সমীকরণে দেখা গেল, প্রতিটি ইলেকট্রনের জন্য এর বিপরীত চার্জবিশিষ্ট একটি কণা রয়েছে। তার ভর ঠিক ইলেকট্রনের সমান, যার নাম দেওয়া হয় পজিট্রন। এই প্রথম তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে পাওয়া যায়নি, এমন একটি কণার উপস্থিতির ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। ধারণাটি এখন প্রতিষ্ঠিত যে প্রতিটি চার্জযুক্ত মৌলিক কণার বিপরীত চার্জের ও সমান ভরের আরও একটি মৌলিক কণা রয়ে গেছে।

তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তাবিত হলেও এই ধারণা কতটুকু ঠিক, তা নির্ণয় করার জন্য চাই পরীক্ষাগারে বা প্রকৃতিতে প্রমাণ। ১৯২০-এর দশকে পরীক্ষাগারে প্রতিকণা তৈরির কোনো কৌশল পদার্থবিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। এ সময়ে তাঁরা কসমিক বা মহাজাগতিক রশ্মির ধর্ম জানার জন্য উৎসাহী ছিলেন। কোনো চার্জিত কণা চৌম্বকক্ষেত্রে প্রবেশ করলে তার গতিপথ, চার্জ ও চৌম্বকক্ষেত্রের দিক অনুসারে বাঁক নেয়। এই বাঁকের দিক ও আদি গতিপথ জানা থাকলে আমরা সহজেই কণার চার্জ ধনাত্মক নাকি ঋণাত্মক, তা বলতে পারি এবং বক্রপথের ব্যাসার্ধ (যা ক্লাউড চেম্বারে তোলা ছবি থেকে জ্যামিতি ব্যবহার করে নির্ণয় করা যায়) জানলে কণার ভরবেগও গণনা করা যায়। এ জন্য তাঁরা ক্লাউড চেম্বারগুলোকে চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে রাখার কৌশল বের করছিলেন। এ রকম একটি যন্ত্র নিয়ে ক্যালটেকে (বিশ্ববিদ্যালয়) কাজ করছিলেন বিজ্ঞানী কার্ল অ্যান্ডারসন।

আরও পড়ুন
ডিরাকের সমীকরণের মাধ্যমে ইলেকট্রন স্বাভাবিকভাবেই স্পিনের মতো একটি ধর্মের অধিকারী হলো। পাশাপাশি দ্বিতীয় আরেকটি ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল। ডিরাকের সমীকরণে দেখা গেল, প্রতিটি ইলেকট্রনের জন্য এর বিপরীত চার্জবিশিষ্ট একটি কণা রয়েছে।

অ্যান্ডারসন তাঁর তোলা ছবিগুলোতে একটি কণার গতিপথ পেলেন, যা দেখতে ক্লাউড চেম্বারে দেখা ইলেকট্রনের মতো। কিন্তু তার গতিপথ তো হওয়ার কথা উল্টো! তাহলে কি এটাই ডিরাকের প্রণীত সেই পজিট্রন? এই গতিপথের দিক নিয়ে সংশয় দূর করার জন্য একটা নতুন বুদ্ধি বের করলেন তিনি। ক্লাউড চেম্বারের মধ্যে ৬ মিলিমিটার পুরুত্বের একটি ধাতব পাত বসিয়ে দিলেন, যাতে তা ভেদ করার সময় কসমিক কণাগুলো শক্তি হারিয়ে ফেলে আর কম শক্তির চার্জিত কণা চৌম্বকক্ষেত্রে বেশি বাঁকে। ১৯৩২ সালে অ্যান্ডারসন অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ছবিটি তুলতে পারলেন।

ওপরের ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, নিচ থেকে বেশি শক্তির কণা ধাতব পাতটি ভেদ করে ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কারণ, পাতের নিচের বক্রতা কম আর ওপরেরটি বেশি। এ ছবির কারণেই ডিরাকের প্রতিকণার ধারণাটি প্রমাণিত হয় এবং এন্ডারসন নোবেল পুরস্কার পান ভিক্টর হেসের সঙ্গে যৌথভাবে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পৃথিবীর মতো ক্ষুদ্র একটি গ্রহে বসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা আমাদের চারপাশের এই বিশাল মহাবিশ্বের গোপন রহস্য বের করতে পারছি। এটা আসলেই একটা চমকপ্রদ ব্যাপার!

(চলবে)

লেখক: অধ্যাপক, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

*লেখাটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত