কথাটা হয়তো অনেকেই শুনেছেন—গোটা মানবজাতিকে একটা ছোট্ট চিনির দানার ভেতর আঁটানো সম্ভব। ব্যাপারটা শুনতে গাঁজাখুরি বলে মনে হতে পারে। আর সাইফাইয়ের পাঁড় ভক্তদের কাছে ব্যাপারটাকে সায়েন্স ফিকশন মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
গুগল করলেই জানতে পারবেন, পৃথিবীতে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। স্বাভাবিকভাবেই মাথায় চিন্তা আসবে, এত সংখ্যক মানুষকে ছোট্ট একটা চিনির দানায় আঁটানো কি চাট্টিখানি কথা! এক কথায় অসম্ভব! কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন, কথাটা সত্য। নিশ্চয়ই প্রশ্ন করে বসবেন, সেটা কীভাবে? কেন সম্ভব?
এর কারণ, পরমাণুর বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য। বস্তু বা পদার্থ, তথা পরমাণুকে বাইরে থেকে যতটা কঠিন বা নিরেট বলে মনে হয়, বাস্তবে আসলে তা নয়। বরং পরমাণুর ভেতরের রয়েছে বিশাল এক শূন্যতা। অনেক বড় ফাঁকা জায়গা।
স্কুল থেকেই পরমাণুর একটা চিত্রের সঙ্গে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত। পরমাণুর একেবারে মাঝখানে ছোট্ট একটা নিউক্লিয়াস এবং তার চারপাশে ঘুরছে ইলেকট্রন কণারা। অনেকটা আমাদের সৌরজগতের সূর্যের চারপাশে নিজ নিজ কক্ষপথে গ্রহগুলো ঘোরার মতো ব্যাপার। কিন্তু এটা আসলে পরমাণুর সঠিক চিত্র নয়। এই ছবি থেকে পরমাণুর ভেতরের বিপুল ফাঁকা জায়গা সম্পর্কেও সঠিকভাবে বোঝা যায় না। আবার কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা বলেন, ইলেকট্রনকে শুধু কণা হিসেবে ভাবাটা ভুল। কারণ ইলেকট্রন আসলে কোয়ান্টাম অবজেক্ট। এটি দ্বৈত প্রকৃতির—অর্থাৎ এর একইসঙ্গে কণা এবং তরঙ্গের মতোর ধর্ম রয়েছে। ইলেকট্রন সবসময়ই একটা কম্পাংকে কাঁপছে। এভাবে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ক্লাউড বা মেঘের মতো ঘিরে রয়েছে ইলেকট্রন। সে মেঘ হলো সম্ভাবনার মেঘ। এই মেঘের ঘনত্ব কোথাও বেশি, কোথাও-বা কম।
পরমাণু সম্পর্কে এতসব খুঁটিনাটি ব্যাপার জানতে বিজ্ঞানীদের পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। আর সে যাত্রার সূচনা হয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসে। সে যুগে গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস মনে করতেন, কোনো বস্তুকে একটানা ভাঙতে থাকলে শেষ পর্যন্ত এমন একটি ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যাবে, যাকে আর ভাঙা যাবে না। তিনি এর নাম দেন অ্যাটম। গ্রিক সেই শব্দের অর্থ অবিভাজ্য। বাংলায় একেই বলা হয় পরমাণু। কিন্তু পরমাণু এত ছোট যে একে সরাসরি দেখা যায় না। তাই এর প্রমাণ খুঁজে পেতে বিজ্ঞানীদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও অনেক অনেক বছর। পরমাণু নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যেও ততদিন চলেছে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচাল। তাই এ সম্পর্কে তাদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ আর তর্কবির্তকও কম হয়নি।
১৮৯৬ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল প্রথম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। তিনি দেখতে পান, ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ খনিজ থেকে নিজে নিজেই অবিরাম শক্তি বেরিয়ে আসছে।
পরমাণু নিয়ে অনেক ঘটনার ঘনঘটার পর ১৮২৭ সালে ব্রিটশি উদ্ভিদবিদ রবার্ট ব্রাউন পানিতে ভাসমান পরাগরেণুর অদ্ভুত এলোমেলো নৃত্য দেখতে পান। কিন্তু এর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা সেকালে কারও জানা ছিল না। পরাগরেণুর এই রহস্যময় নাচের নাম দেওয়া হলো ব্রাউনিয়ান মোশন বা ব্রাউনিয়ান চলন। প্রায় ৭৮ বছর পর, ১৯০৫ সালে এই রহস্যের সমাধান করেন জার্মান পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বললেন, পরাগরেণুগুলো আসলে পানির অণুগুলোর ক্রমাগত ধাক্কার কারণেই এভাবে নাচে। এ সম্পর্কে একটা গাণিতিক তত্ত্বও দেন আইনস্টাইন। সেটা ব্যবহার করে কয়েক বছর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরমাণুর আকার নির্ণয় করলেন জঁ ব্যাপতিস্ত পেরাঁ। তিনি হিসাব কষে দেখেন, একটি পরমাণুর প্রস্থ প্রায় এক মিটারের দশ বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ!
পরমাণুর আকার না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এর গঠন কেমন?
সেটা জানতে আমাদের ঢুঁ মারতে হয়েছে আরও গভীরে, আরও ক্ষুদ্র ও রহস্যময় এক জগতে। সেই অনুসন্ধান পর্বে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে পরমাণুর তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিওঅ্যাকটিভি। ১৮৯৬ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল প্রথম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। তিনি দেখতে পান, ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ খনিজ থেকে নিজে নিজেই অবিরাম শক্তি বেরিয়ে আসছে। পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ব্যাপারটা স্রেফ ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা। পরমাণু এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে সেবার বিজ্ঞানীরা খুবই অবাক হয়েছিলেন। এ বিষয়ে গবেষণা আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যান কুরি দম্পতি—ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়েরে এবং মেরি কুরি। আস্তে আস্তে সে ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানার রহস্য ভেদ হতে থাকে। এরপর এ গবেষণায় হাত দেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেষ্ট রাদারফোর্ড। সহকর্মী ফ্রেডেরিক সডিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রমাণ করেন, তেজস্ক্রিয় পরমাণু আসলে এক অস্থিতিশীল ভারী পরমাণু, যা শক্তি বিকিরণ করে হালকা উপাদানে রূপান্তরিত হয়।
এই বিকিরিত কণাগুলোর মধ্যে একটি ছিল আলফা কণা। কিছুদিন পর রাদারফোর্ড এবং তরুণ জার্মান পদার্থবিদ হ্যান্স গাইগার প্রমাণ করেন যে আলফা কণা আসলে হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস। মানে এই আলফা কণায় কোনো ইলেকট্রন নেই, স্রেফ নিউক্লিয়াসই সম্বল। ১৯০৩ সালে, রাদারফোর্ড তেজস্ক্রিয় রেডিয়াম থেকে নির্গত আলফা কণার গতি মাপেন। সেটা ছিল অবিশ্বাস্য, সেকেন্ডে প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার। এরপর রাদারফোর্ড ভাবলেন, এই দ্রুতগতির কণাগুলো অন্য পরমাণুতে আঘাত করল কী ঘটবে? এভাবে কি পরমাণুর ভেতরের গঠন উন্মোচন করা যাবে? সেটা যাচাই করতে একটা দারুণ পরীক্ষার আয়োজন করেন তিনি।
পর্যবেক্ষণগুলোর মাধ্যমে পরমাণুর গহীনে ঠিকই উঁকি দিতে পারলেন রাদারফোর্ড। এর উপর ভিত্তি করে তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছান। পরমাণু রহস্য ভেদে সেটিই ছিল মানুষের জন্য বেশ বড় একটি লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা।
গোল্ড ফয়েল এক্সপেরিমেন্ট বা স্বর্ণপাত পরীক্ষা নামে সেটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। সে পরীক্ষার ধারণাটা ছিল বেশ সহজ-সরল। সোনার পাতের মতো অতি পাতলা ধাতব পাতের ওপর অবিরামভাবে আলফা কণা ছুড়ে মারা। যদি পরমাণুর ভেতরে কোনো শক্ত কিছু থাকে, তবে কণাগুলো বিক্ষিপ্ত হবে। আর তাতেই পরমাণুর ভেতরটা কেমন তা বোঝা যাবে। এ যেন পরমাণুর গহীনে উঁকি দেওয়ার মতো ব্যাপার। গাইগার এবং তরুণ নিউজিল্যান্ডীয় পদার্থবিদ আর্নেস্ট মার্সডেনকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষাটি করেন রাদারফোর্ড। পরিকল্পনা মতো, রেডিয়াম থেকে নির্গত আলফা কণার একটি সরু রশ্মি সোনার পাতের ওপর ফেলা হলো।
এদিকে স্বর্ণপাত পরীক্ষার বেশ কবছর আগে, ইলেকট্রনের মতো একটি ক্ষুদ্র কণিকা আবিষ্কৃত হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে সেটি আবিষ্কার করেছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জে. জে. টমসন। এরপর টমসন ভাবলেন, ধনাত্মক চার্জের একটি গোলকের মধ্যে ইলেকট্রনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেকটা পুডিংয়ের মধ্যে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকা কিসমিসের মতো। সে কারণেই টমসনের প্রস্তাবিত পরমাণুর মডেলকে বলা প্লাম-পুডিং মডেল।
সেই মডেলটি সঠিক কিনা, সেটাও স্বর্ণপাত পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলেন রাদারফোর্ড। কিন্তু তাঁদের পরীক্ষায় একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটল। দেখা গেল, বেশিরভাগ আলফা কণাই সোজা পাত ভেদ করে চলে যাচ্ছে। তবে কিছু কণা সামান্য কোণে বেঁকে গেল, আর খুবই অল্প সংখ্যক কণা (প্রতি ৮০০০টির মধ্যে একটি) প্রায় সরাসরি ফিরে এল! সহকর্মীদের কাছে ফলাফলটা শুনে চোখ কপালে উঠে গেল রাদারফোর্ডের। কারণ টমসনের পরমাণুর মডেল অনুযায়ী, এ ধরনের ফলাফল পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ব্যাপারটা দেখে রাদারফোর্ড সেই বিখ্যাত মন্তব্যটা করেন, ‘ঘটনাটা ছিল অবিশ্বাস্য। ব্যাপারটা যেন আপনি একটা টিস্যু পেপার লক্ষ্য করে ১৫ ইঞ্চি গোলা ছোড়ার পর সেটা ধাক্কা খেয়ে আপনাকেই আঘাত করার সামিল।’
এই পর্যবেক্ষণগুলোর মাধ্যমে পরমাণুর গহীনে ঠিকই উঁকি দিতে পারলেন রাদারফোর্ড। এর উপর ভিত্তি করে তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছান। পরমাণু রহস্য ভেদে সেটিই ছিল মানুষের জন্য বেশ বড় একটি লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। রাদারফোর্ড সিদ্ধান্তে আসেন, প্রথমত, পরমাণুর বেশিরভাগ স্থানই ফাঁকা। কারণ বেশিরভাগ আলফা কণা কোনো বাধা ছাড়াই সোনার পাত ভেদ করে চলে গেছে। তাই পরমাণুর ভেতরের বেশিরভাগ স্থানেই কিছুই নেই—স্রেফ ফাঁকা। কারণ পরমাণু যদি নিরেট হতো, তাহলে বেশিরভাগ কণারই বাধা পাওয়ার কথা ছিল। দ্বিতীয়ত, পরমাণুর কেন্দ্রে অবশ্যই একটি ক্ষুদ্র, ভারী এবং ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস আছে। সেটি বোঝা গিয়েছিল, খুব অল্প সংখ্যক আলফা কণার বড় কোণে বিক্ষিপ্ত হওয়া এবং কিছু কণার বিকর্ষিত ফিরে আসার ঘটনা থেকে। এ থেকে বোঝা যায় যে পরমাণুর কেন্দ্রে একটি অত্যন্ত ছোট কিন্তু ভারী বস্তু রয়েছে। আর বস্তুটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত কারণ ধনাত্মক চার্জযুক্ত আলফা কণা হয়ে ফিরে এসেছে। এই ভারী ও ধনাত্মক চার্জযুক্ত অংশটিই হলো নিউক্লিয়াস।
রাদারফোর্ডের এই আবিষ্কারের মাধ্যমে পাওয়া গেল পরমাণুর একটি নতুন চিত্র—একটি ক্ষুদ্র সৌরজগতের মতো, যেখানে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে। তবে রাদারফোর্ডের সোলার মডেলও নিখুঁত ছিল না।
নিউক্লিয়াস কতটা ছোট, তা বোঝাতে রাদারফোর্ড বললেন, এটা অনেকটা একটা বড় গির্জার মধ্যে ছোট্ট একটা মাছির সমান। আর বিখ্যাত নাট্যকার টম স্টপার্ড এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন, ‘আপনি যদি মুঠো পাকান, আর মুঠোটা যদি একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সমান হয়, তাহলে পুরো পরমাণুর আয়তন হবে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের মতো।’ আর পরমাণু? সেটা কত বড়?
আগেই বলেছি পেরাঁর হিসেবে পরমাণুর প্রস্থ প্রায় এক মিটারের দশ বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ! তাতে মনে হয় অনেকেই কিছুই বুঝতে পারছেন না। সহজভাবে বোঝাতে বিজ্ঞানীরা বলেন, একটি বাক্যের শেষে থাকা ছোট্ট ফুলস্টপের প্রস্থ অতিক্রম করতেও প্রায় এক কোটি পরমাণু সারিবদ্ধভাবে বসাতে হয়! বুঝতেই পারছেন, একটা পরমাণু কত বড়।
যাই হোক, রাদারফোর্ডের এই আবিষ্কারের মাধ্যমে পাওয়া গেল পরমাণুর একটি নতুন চিত্র—একটি ক্ষুদ্র সৌরজগতের মতো, যেখানে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে। তবে রাদারফোর্ডের সোলার মডেলও নিখুঁত ছিল না। অচিরেই রাদারফোর্ডের এই মডেলের একটা ত্রুটি খুঁজে পাওয়া গেল। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎচুম্বকীয় তত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী, ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করে ক্রমেই নিউক্লিয়াসে ভেতরে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে পরমাণুর অস্তিত্বই থাকারই কথা নয়! তাই মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান একবার বলেছিলেন, ‘চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পরমাণুর অস্তিত্ব পুরোপুরি অসম্ভব।’ কিন্তু মহাবিস্ফোরণের পর থেকে প্রায় ১৪ শ কোটি বছর ধরে পরমাণু টিকে আছে বহাল তবিয়তে। তা না হলে, আমরাসহ আমাদের চারপাশের বস্তুজগৎ টিকে আছে কীভাবে! তার পেছনের কারণ কী? পদার্থবিজ্ঞান কি এখানে কাজ করছে না!
না, ব্যাপারটা তা নয়। সেটা ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন পড়ল নতুন পদার্থবিজ্ঞান। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র জগতে কাজ করে না। সেই নতুন পদার্থবিজ্ঞানের নাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব। সেটি ব্যবহার করে পরমাণুর এ ধাঁধার সমাধান করেন সুইডিশ পদার্থবিদ নীলস বোর। পরবর্তীতে একে আরও নিখুঁত করে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করান ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, আরউইন শ্রোডিঙ্গার, পল ডিরাকের মতো অন্যান্য কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানীরা। সমাধানটা আসলে লুকিয়ে আছে কোয়ান্টাম তত্ত্বে। ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্মই পরমাণুকে স্থিতিশীলতা দান করে। কারণ ইলেকট্রনের তরঙ্গ ছড়িয়ে থাকে এবং এর একটি ন্যূনতম জায়গার প্রয়োজন হয়। একে নিউক্লিয়াসে গুঁজে দেওয়া যায় না। তাই পরমাণু টিকে থাকে—আর সে কারণেই আমরাসহ টিকে আছে আমাদের এই বস্তুজগত।
এবার আসি মূল প্রশ্নে, পরমাণুর ফাঁকা জায়গা আসলে কতটুকু? গোটা মানবজাতিকে কি সত্যিই একটা ছোট্ট চিনির দানার ভেতর আঁটানো সম্ভব?
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, পরমাণু এত ফাঁপা কেন? এর উত্তরটাও লুকিয়ে আছে কোয়ান্টাম তত্ত্বে। এ তত্ত্ব আমাদের ক্ষুদ্রতম কণাগুলোর অদ্ভুত আচরণ ব্যাখ্যা করে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমেই আমরা লেজার, কম্পিউটার বা পারমাণবিক চুল্লির মতো প্রযুক্তি পেয়েছি।
এর ইঙ্গিত আগেও দিয়েছি। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন, একটা পরমাণুর আকার যদি একটি ফুটবল মাঠের সমান ধরা হয়, তাহলে তার কেন্দ্রে অবস্থিত নিউক্লিয়াসটি হবে একটি মার্বেল পাথরের সমান। আর এই মার্বেল পাথরেই থাকে পরমাণুর প্রায় সব ভর। আর ইলেকট্রনগুলো, যারা ঋণাত্মক চার্জ বহন করে এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা নেয়, তারা এই কেন্দ্র থেকে মাঠের সীমানার কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করে। আর মাঝখানের বিশাল এলাকাটি? সেটা প্রায় পুরোটাই ফাঁকা! অর্থাৎ, পরমাণুর প্রায় ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ শতাংশ জায়গাই ফাঁকা! তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে পৃথিবীর প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের দেহের পরমাণুগুলোর নিউক্লিয়াস (ওখানেই তো সব ভর) ঠেসে ঠেসে এই পুরো ফাঁকা জায়গা পূরণ করা হতো, তবে সত্যিই সবাইকে একটি চিনির টুকরোর ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলা যেত। তবে হ্যাঁ, সেই চিনির টুকরোটি হতো অবিশ্বাস্য রকম ভারী!
ব্যাপারটা সায়েন্স ফিকশনের মতো মনে হলেও আসলে সত্যি। বাস্তবেও তার প্রমাণ পেয়েছেন জ্যোতির্বিদরা। নিউট্রন তারা কথা নিশ্চয়ই অনেকের জানা আছে। এ ধরনের নক্ষত্রে প্রবল মহাকর্ষের টানে পরমাণুগুলো প্রবল বেগে চিড়েচ্যাপ্টা হতে থাকে। তাতে পরমাণুর ভেতরের এই ফাঁকা স্থান মহাকর্ষের চাপে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়। একসময় নিউক্লিয়াসের প্রোটন কণার সঙ্গে ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে তৈরি হয় নিউট্রন কণা। তাই একটি নিউট্রন তারার আকার হয়তো মাউন্ট এভারেস্টের সমান হলেও তার ভর হতে পারে আমাদের সূর্যের সমান! একইভাবে চিনির দানার মতো একটুখানি নিউট্রন তারার ভরও পুরো মানবজাতির সমান হতে পারে!
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, পরমাণু এত ফাঁপা কেন? এর উত্তরটাও লুকিয়ে আছে কোয়ান্টাম তত্ত্বে। এ তত্ত্ব আমাদের ক্ষুদ্রতম কণাগুলোর অদ্ভুত আচরণ ব্যাখ্যা করে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমেই আমরা লেজার, কম্পিউটার বা পারমাণবিক চুল্লির মতো প্রযুক্তি পেয়েছি। এ তত্ত্বই ব্যাখ্যা করে, সূর্য কেন আলো দেয় আর মাটি কেন এত কঠিন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব এতই নির্ভুল যে, পরীক্ষার ফলাফল দশমিকের পর বহু ঘর পর্যন্ত সঠিকভাবে পাওয়া যায়। শুধু প্রযুক্তিগত সাফল্যই নয়, কোয়ান্টাম তত্ত্ব আমাদের বাস্তবতার এক নতুন ও অদ্ভুত জগতে নিয়ে যায়। যেখানে একটি কণা একই সঙ্গে থাকতে পারে দুটো ভিন্ন জায়গায়। সেখানে মহাবিশ্বের দুই প্রান্তে থাকা দুটি পরমাণুও একে অপরের উপর তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলতে পারে!
কোয়ান্টাম জগতের মূল রহস্য হলো কণার দ্বৈত প্রকৃতি। তারা কখনো ক্ষুদ্র কণার মতো আচরণ করে, আবার কখনো ছড়িয়ে পড়ে তরঙ্গের মতো। ইলেকট্রন বা আলোর কণা ফোটনের মতো পরমাণুর মৌলিক কণাগুলো আসলে ঠিক কণা বা তরঙ্গ কোনোটিই নয়—এরা এমন কিছু, যার সঙ্গে আমাদের রোজকার জীবনের কোনো তুলনা করা চলে না। এমনকি আমাদের ভাষায় এর জন্য কোনো উপযুক্ত শব্দও নেই। ডুয়ালিটি বা দ্বৈততা এবং কোয়ান্টাম জগতের এই অদ্ভুতুড়ে দিকটি আরও ভালোভাবে বোঝা যায় একটি মজার ঘটনায়। ব্রিটিশ পদার্থবিদ জে. জে. থমসন ইলেকট্রনকে কণা প্রমাণ করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। অন্যদিকে ইলেকট্রনকেই তরঙ্গ প্রমাণ করে নোবেল জেতেন তাঁরই ছেলে জর্জ থমসন!
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র জগতে কাজ করে না। সেই নতুন পদার্থবিজ্ঞানের নাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব। সেটি ব্যবহার করে পরমাণুর এ ধাঁধার সমাধান করেন সুইডিশ পদার্থবিদ নীলস বোর।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কণা যত ছোট, তার কোয়ান্টাম তরঙ্গ তত বড়। ইলেকট্রন হলো সবচেয়ে ছোট পরিচিত কণা, তাই এর তরঙ্গও সবচেয়ে বড়। এই কারণেই ইলেকট্রনের তরঙ্গ এত বেশি জায়গা জুড়ে থাকতে চায় যে, পরমাণুকে নিউক্লিয়াসের তুলনায় বিশাল ও ফাঁকা হতে হয়।
পরমাণুর ভেতরের বিশাল শূন্যতা এবং এর ক্ষুদ্র আকার—এই দুটো বিষয়ই মহাবিশ্বের এক গভীর রহস্য উন্মোচন করে। আপাতদৃষ্টিতে কঠিন মনে হওয়া এই জগৎ আসলে অবিশ্বাস্য রকম ফাঁপা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত। এক অর্থে পরমাণু হলো প্রকৃতির লেগো ব্লকের মতো। বিভিন্ন আকারের এই ব্লকগুলো জুড়ে দিয়েই তৈরি হয়েছে মহাবিশ্ব, আমাদের চারপাশের সবকিছু—ফুল, পাখি, প্রকৃতি। সবকিছু নির্ভর করে এই ক্ষুদ্র কণাগুলোর বিন্যাসের কারণে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের হাত ধরে আমরা সেই রহস্যময় জগতের কিছুটা আভাস পেয়েছি।
পরমাণুর সম্পর্কিত এই জ্ঞান যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে রিচার্ড ফাইনম্যান একবার বলেছিলেন, কোনো মহাপ্রলয়ে সমস্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যদি হারিয়ে যায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটিমাত্র বাক্য রেখে যেতে হয়, তবে সেটি হবে: ‘সবকিছু পরমাণু দিয়ে তৈরি।’ আপনি চাইলে এই বাক্যের সঙ্গে যোগ করতে পারেন আরেকটু: ‘পরমাণুর সিংহভাগই ফাঁপা।’
