পদার্থ ও প্রতিপদার্থের কোয়ান্টাম বিভ্রম

কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, কণাদের নির্দিষ্ট কোনো অবস্থান বা গতিপথ নেই

আমাদের চারপাশের যে জগৎটা আমরা দেখি, তা কি আসলেই তেমন। সম্ভবত না। একটা মাছের চোখে পৃথিবী যেমন, পাখির চোখে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবার পুঞ্জাক্ষীর সাহায্যে কীটপতঙ্গ যেভাবে পৃথিবী দেখে, সেটাও আমাদের চিরচেনা পৃথিবীর চেয়ে একদম অন্যরকম। অন্য প্রাণীদের কথাই বা বলি কেন? আমাদের বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণাতেও সবসময় বিশ্বের চেহারা একরকম নয়!

আমরা যখন নিউটনের গতিবিদ্যা নিয়ে কাজ করি, তখন এর গাণিতিক হিসাব আগেভাগেই বের করা ফেলা যায়। পৃথিবী থেকে একটা মহাকাশযান চাঁদে পাঠালে ঠিক কবে ও কখন সেটা চাঁদের পৃষ্ঠে পৌঁছাবে, তা হিসাব করে আগেভাগে বলে দেওয়া যায়। এ কারণেই আমাদের চন্দ্র কিংবা মঙ্গল মিশনগুলো এত সফল। ঠিক এ কারণে পৃথিবীর বুকে বড় বড় যানবাহন ঠিকঠাক চলতে পারে, কলকারখানার যন্ত্রপাতিগুলোও কাজ কারে সফলভাবে। কিন্তু নিউটন-আইনস্টাইনের সেই পূর্বানুমানযোগ্য জগৎ ধাক্কা খায় গত শতাব্দীর শুরুতে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বদলে দেয় সব হিসাবনিকাশ। পৃথিবীর বিশাল সব যন্ত্রপাতি থেকে মহাকাশের বিশাল গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথের হদিস নিউটনের তত্ত্ব দিতে পারলেও খুদে কণাদের জগতে এর বাহাদুরি শেষ হয়ে যায়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগৎটাই অনিশ্চয়তায় ভরা। সেখানে আপনি আগে থেকে কণাদের গতি-প্রকৃতি হিসাব করতে পারবেন না। কাণ্ডজ্ঞান ধোঁকা খাবে।

গত শতাব্দীর ২০ ও ৩০-এর দশকে পল ডিরাকের গুরত্বপূর্ণ কাজের ভিত্তিতে জন্ম হয় অ্যান্টি পার্টিকেল বা প্রতিকণা তত্ত্বের। এই তত্ত্ব মতে, মহাবিশ্বে যতগুলো মৌলিক কণা আছে, তাদের প্রত্যেকটির একটি করে প্রতিকণা আছে।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, কণাদের নির্দিষ্ট কোনো অবস্থান বা গতিপথ নেই। সবকিছুই অনিশ্চয়তায় মোড়া। তবে সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনার পথ ধরে কণাদের আপনি যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই দেখতে পারবেন। কিন্তু এদের যেকোনো একটা ধর্ম ঠিকঠাক দেখতে গেলে আরেকটা ধর্ম পড়ে যাবে অনিশ্চয়তায়। গত শতাব্দীর বিশের দশকে এ কথাটিই বলেছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ আর  অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ এরইউন শ্রোডিঙ্গার। দুজনে দুটি আলাদা তত্ত্বের মাধ্যমে তা বলেছিলেন। এরপর গত এক শ বছরে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এগিয়েছে সুপারসনিক গতিতে। কত নতুন তত্ত্ব এসেছে, সেগুলোর সফল প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে, বদলে গিয়েছে পৃথিবী। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার হাত ধরে আমাদের প্রযুক্তি জগৎ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এখন। এতকিছুর পরও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তা, জটপাঁকানো বাস্তবতার ধোঁয়াশা তো কাটেইনি, বরং নতুন প্যারাডক্স যুক্ত হয়ে আমাদের কাণ্ডজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে।

গত শতাব্দীর নব্বই দশকে কোয়ান্টামের অদ্ভুতুড়ে জগতে যুক্ত হয়েছে নতুন এক পালক—হার্ডি প্যারাডক্স। এর প্রবক্তা ব্রিটিশ-কানাডিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী লুসিয়েন হার্ডি। তাঁর নামের সঙ্গে মিল রেখেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ওই প্রহেলিকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘হার্ডি প্যারাডক্স’।

২.

১৯৯২ সাল। হার্ডি একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করেন। সেই এক্সপেরিমেন্ট প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় কণা পদার্থবিজ্ঞানের একটা প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে, জন্ম হয় একটা ব্রিভ্রমের।

প্রতিটা কণা আর প্রতিকণা জোড়ার ভর একই কিন্তু চার্জ অথবা স্পিন আলাদা

গত শতাব্দীর ২০ ও ৩০-এর দশকে পল ডিরাকের গুরত্বপূর্ণ কাজের ভিত্তিতে জন্ম হয় অ্যান্টি পার্টিকেল বা প্রতিকণা তত্ত্বের। এই তত্ত্ব মতে, মহাবিশ্বে যতগুলো মৌলিক কণা আছে, তাদের প্রত্যেকটির একটি করে প্রতিকণা আছে। প্রতিটা কণা আর প্রতিকণা জোড়ার ভর একই কিন্তু চার্জ অথবা স্পিন আলাদা। যেমন, পজিট্রনের ভর ইলেকট্রনের সমান, কিন্তু চার্জ ঠিক উল্টো। ইলেকট্রনের চার্জ  -১, অন্যদিকে পজিট্রনের চার্জ +১। তেমনি কোয়ার্কের প্রতিকণা আছে অ্যান্টিকোয়ার্ক, নিউট্রিনোর প্রতিকণা অ্যান্টিনিউট্রিনো। ডিরাকের তত্ত্ব অনুযায়ী, একই জাতের কণা ও প্রতিকণা পরস্পরের সংস্পর্শে এলে তারা একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে উৎপন্ন হয় শক্তি। ডিরাকের এই তত্ত্ব শুধু খাতা কলমেই সীমাবদ্ধ নয়, বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে প্রতিকণা উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিকণার এই তত্ত্বই কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তার কবলে পড়ে হুমকিতে পড়ে যায়। তৈরি হয় প্যারাডক্স। হার্ডির প্যারাডক্স।

আরও পড়ুন

১৯৯২ সালে হার্ডি থট এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়েছিলেন, কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তার কারণে অনেক সময় কণা আর প্রতিকণার পরস্পরের সংস্পর্শে এলেও ধ্বংস হয় না, দিব্যি টিকে থাকে। অর্থাৎ একটা বিভ্রমের সৃষ্টি হয়।

হার্ডি তাঁর থট এক্সিপেরিমেন্টে ব্যবহার করেন ম্যাক-জেন্ডার ইন্টারফেরোমিটার। এই যন্ত্র কণাদের গতিপথকে দুটি ভাগে করে দেয়। কণারা এই দুই পথে একই সঙ্গে থাকতে পারে। এটা নতুন কোনো কথা নয়। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি এবং শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণেই এই তথ্য ছিল। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম কণাদের এই অদ্ভুত আচরণগুলো মেনে নিতে পারেননি। তাই বার বার এর বিরোধিতা করেছেন।

আমরা যখন নিউটনের গতিবিদ্যা নিয়ে কাজ করি, তখন এর গাণিতিক হিসাব আগেভাগেই বের করা ফেলা যায়। পৃথিবী থেকে একটা মহাকাশযান চাঁদে পাঠালে ঠিক কবে ও কখন সেটা চাঁদের পৃষ্ঠে পৌঁছাবে, তা হিসাব করে আগেভাগে বলে দেওয়া যায়।

হার্ডি তাঁর কল্পিত পরীক্ষায় দুটি ম্যাক-জেন্ডার ইন্টারফেরোমিটার ব্যবহারের কথা ভাবেন। এর একটা ইলেকট্রনের জন্য, অন্যটা পজিট্রনের। এই যন্ত্র দুটো এমনভাবে সাজানো যেন ইলেকট্রন আর পজিট্রনের পথ কোনো এক জায়গায় মিলিত হয়। দুই পথের শেষ মাথায় একটা করে ডিটেক্টর আছে। অর্থাৎ দুটি যন্ত্রে চারটি ডিটেক্টর। ইলেকট্রন ইন্টাফেরোমিটারের একটি ডিটেক্টর ইলেকট্রনের উপস্থিতি শনাক্ত করে, আরেকটি ডিটেক্টর পথে ইলেকট্রনের অনুপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে। পজিট্রনের যন্ত্রেও এমন দুটো ডিটেক্টর থাকে, যার একটা পজিট্রনের উপস্থিতি, আরেকটা পজিট্রনের অনুপস্থিতি শনাক্ত করে।

এই যন্ত্র দুটো দিয়ে একই গতির দুটো ইলেকট্রন ও পজিট্রন পাঠানো হলো। একসময় কণা দুটো এসে গেল সেই কমন পথে, যেখানে তারা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে ধ্বংস হওয়ার কথা। কিন্তু হার্ডি হিসাব কষে দেখলেন, এভাবে একই পথে এসে তারা মিলিত হলেও সব সময় ধ্বংস হচ্ছে না। কখনো কখনো ইলেকট্রন বা পজিট্রন শনাক্তকারী যন্ত্রে তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে। এখানেই তখন ওই প্যারাডক্স এসে হাজির হচ্ছে, কণা পদার্থবিজ্ঞান এমনকি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নীতি অনুযায়ী ইলেকট্রন-পজিট্রন সংঘর্ষে দুটি কণা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হচ্ছে না, এটাই আসলে হার্ডি প্যারাডক্স নামে পরিচিত।

৩.

প্রশ্ন হলো, হার্ডির এই প্যারাডক্স কি কেবলই থট এক্সপেরিন্টের ফলাফল, নাকি আসলেই এমন কিছু হয়? এ ধরনের কোনো তত্ত্ব পরীক্ষা না করে বিজ্ঞানীরা সত্যি বলে কখনোই মানবেন না। তাই এই প্যারাডক্সকেও পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে প্রথম সত্যিকারের পরীক্ষা করেন কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ান্টাম অপটিকস ও কোয়ান্টাম ইনফরমেশন বিভাগের দুই গবেষক জেফ লান্ডিন ও অ্যাফ্রেইম স্টেইনবার্গ।

তাঁরা হার্ডির মতো করে দুটি যন্ত্র তৈরি করেন। তবে তাঁদের এই যন্ত্রে ইলেকট্রনের বদলে ব্যবহার করা হয় দুটি ফোটন। এমন ফোটন যারা পরস্পরের সংস্পর্শে এলে ধ্বংস হয়ে যায়। হার্ডির নির্দেশনা মতো তাঁরা ফোটন দুটিকে পাঠান দুটি যন্ত্রে। দেখা যায় হার্ডির অনুমানই ঠিক।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা খেয়াল করেন, ফোটন দুটি পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ করেনি। তার বদলে দুটিই গিয়ে ডিটেক্টরে শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ হার্ডির অনুমান ঠিক।

কিন্তু এমনটা কেন হলো? কারণটা পরিষ্কার। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগতটা অনিশ্চয়তায় ভরা। এখানে কখনো পরম মান পাওয়া সম্ভব নয়। এখানে কণারা কণা-তরঙ্গের সুপারপজিশনেব থাকে। তাই এরা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে না থেকে সম্ভাব্য সব সবটুকু জায়গা জুড়ে অবস্থান করে। নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রেও এদের পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কণাদের চরিত্র ও ধর্মও অনিশ্চয়তার সম্ভাবনাও মোড়ানো।

আরও পড়ুন
লুসিয়েন হার্ডি

ধরা যাক, কোনো একটা কক্ষপথে ইলেকট্রন আছে। সেই ইলেকট্রন কক্ষপথের কোন বিন্দুতে আছে সেটা বলা অসম্ভব। অর্থাৎ পুরো কক্ষপথজুড়েই ইলেকট্রনটি মেঘের মতো থাকে। এর যেকোনো বিন্দুতে একে পাওয়া সম্ভাবনা আছে। এর এই সম্ভবনাগুলোই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগৎটাকে এতটা অদ্ভুত করে তুলেছে।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, কোনো কোয়ান্টাম কণিকার সমস্ত সত্তাই কণা-তরঙ্গের সুপারপজিশনে থাকে। কোনো পর্যবেক্ষক যখন কণাকে যেভাবে বা যেখানে দেখতে চায়, তখন কোয়ান্টাম কণার ওয়েভ ফাংশনে ভাঙন ধরে। ফলে তখন পর্যবেক্ষকের পাতানো পরীক্ষণ অনুযায়ী কণাদের অবস্থান বা ধর্ম প্রকাশ পায়। কণাদের সব চরিত্র ও ধর্মই সম্ভাবনার ওপর নির্ভরশীল। তাই এদের নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরেও কখনো কখনো থাকার সম্ভাবনা থাকে। কোয়ান্টাম টানেলিং তেমনই এক ব্যাপার।

ধরা যাক, কোনো একটা বাক্সে আপনি একগুচ্ছ কণাদের বন্দী করে রেখেছেন। কিন্তু শুধুই কণা নয়, এরা তরঙ্গও। তাই একগুচ্ছ কণাদের কোনো কোনোটার তরঙ্গের বিস্তার সেই বাক্সের বাইরেও পাওয়া যায়। সেই কণাগুলো তখন অনায়াসে বাক্স ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারে। সেটা হয়তো লাখে একটা বা কোটিতে একটা।

ঠিক এমনটাই ঘটে হার্ডি প্যারাডক্সে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইন্টারফেরোমিটারের ইলেকট্রন আর পজিট্রনের সংঘর্ষের কারণে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু কোয়ান্টাম জগৎ চলে সম্ভাবনার ভিত্তিতে। আর সম্ভবনা মানে কখনোই কোনো কাজ শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে সংঘটিত হওয়ার উপায় নেই। এ কারণেই ইন্টারফেরোমিটারে ইলেকট্রন-পজিট্রন সংঘর্ষে মাঝেমধ্যে কণারা ধ্বংস না হয়ে টিকে থাকে। ফলে জয় হয় হার্ডি প্যারাডক্সেরই।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: ফিজিকস ডট ওআরজি, সায়েন্স ডিরেক্ট ও রিসার্চগেট

আরও পড়ুন