পরমাণু নেহাৎ একটা বিন্দু। তার আবার স্মৃতি থাকবে কোথায়? তবে এমনটা ভাবলে ভুল করবেন। কারণ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা একটা পরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন, আয়নিত পরমাণুদের মেমোরি বা স্মৃতি থাকে। সেই স্মৃতি রীতিমতো ভৌত জগতে ব্যবহার করাও সম্ভব। এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ডিপার্টমেন্ট অব ম্যাটেরিয়ালসের অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম। সম্প্রতি এ বিয়ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে নেচার ফিজিকস জার্নালে।
ভৌত জগতে স্মৃতি বা মেমোরি বললে সবার আগে আসে মানুষের মস্তিষ্কের কথা। কত স্মৃতি বয়ে বেড়ায় মানুষ! সেই স্মৃতি রোমান্থন করে কেউ আবার নস্টালজিয়ায় ভোগে। অনেকে পুরোনো আনন্দ নতুন করে উপভোগ করে। কাউকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় দুঃখের স্মৃতিগুলো। তবু মানুষ স্মৃতি নিয়ে বাঁচে।
মেমরি বা স্মৃতির আরেকটা উৎস হলো ইলেকট্রনিক চিপ। এগুলোকে স্টোরেজও বলা হয়। এসব স্টোরেজে তথ্য জমা রাখা হয় ডেটা আকারে। প্রয়োজন মতো সেই ডেটা সহজেই ব্যবহার করা যায়। তবে মেমরির যান্ত্রিক ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয় এআইয়ের জগতে। এখানে যন্ত্রকে ডেটা ইনপুট দিয়ে নানা ধরনের কাজ শেখানো হয়। শেখানো তথ্য মনে রাখে এআই বটগুলো। পরে শেখানো সেই কাজ নিজেই করতে পারে। যেমনটা পারে আমাদের মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের মেমরি সেলে এসব তথ্য জমা থাকে। অন্যদিকে এআইয়ের স্মৃতি জমা থাকে তার হোস্ট সার্ভারের মেমোরি চিপে।
নীলস বোরের পরমাণু মডেল হোক কিংবা শ্রোডিঙ্গারের মডেল, স্থিতিশীল পরমাণুর বিভিন্ন শক্তিস্তরে থাকা ইলেকট্রনগুলো মোটামুটি একই শক্তিস্তরে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে।
কিন্তু পরমাণুর স্মৃতি কোথায় থাকে? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলটি দেখেছেন, আয়ন অর্থৎ আয়নিত পরমাণুর মেমরি বা স্মৃতি থাকে। সাধারণ পরমাণু চার্জ নিরপেক্ষ। বিশেষ পদ্ধতিতে পরমাণু থেকে যদি এক বা একাধিক ইলেকট্রন যোগ করা হয়, তাহলে সেই পরমাণুটি ঋণাত্মক চার্জযুক্ত কণার মতো আচরণ করে। তেমনি কোনো পরমাণু থেকে এক বা একাধিক ইলেকট্রন সরিয়ে নিলেও পরমাণুটি আচরণ করে ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণার মতো। এ ধরনের পরমাণুকে বলে আয়নিত পরমাণু।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষক দল জাম্পিং আয়ন বা লাফ দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাওয়া আয়নিত পরমাণুদের নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, এভাবে লাফ দিয়ে জায়গা বদলের পরও আয়নিত পরমাণুগুলো তাঁদের আগের অবস্থানের কথা মনে রাখতে পারে। অর্থাৎ লাফ দেওয়ার আগে তারা কোথায় ছিল, এটা এদের স্মৃতিতে রয়ে যায়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বিশেষ করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষকেরা এই পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করেছেন বিশেষ এক ধরনের ফাঁদ। সেই ফাঁদে আটকে রেখেছেন লিথিয়াম আয়ন। আটক আয়নে শক্তি প্রয়োগ করেছেন তাঁরা।
কিন্তু কীভাবে করলেন কাজটা? নীলস বোরের পরমাণু মডেল হোক কিংবা শ্রোডিঙ্গারের মডেল, স্থিতিশীল পরমাণুর বিভিন্ন শক্তিস্তরে থাকা ইলেকট্রনগুলো মোটামুটি একই শক্তিস্তরে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে। অবশ্য ইলেকট্রনগুলো একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ—দুই অবস্থাতেই থাকে, অনেকটা মেঘের মতো। ইলেকট্রন সবসময় কম্পনশীল হলেও এরা নিজের শক্তিস্তর ছেড়ে অন্য কোথাও যায় না। কিন্তু বাইরে থেকে যদি শক্তি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে ইলেকট্রন লাফ দিয়ে উচ্চশক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর বাইরে থেকে শক্তিপ্রবাহ বন্ধ হলে ইলেকট্রন আবার ফিরে আসে নিচের আগের শক্তিস্তরে। এই ব্যাপারটাকে কোয়ান্টাম জাম্প বলে। কোয়ান্টাম জাম্প কিন্তু শুধু ইলেকট্রনের ক্ষেত্রেই হয় না। সব ধরনের খুদে কণাই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নীতি মেনে চলে। একটা পরমাণুও কোয়ান্টাম কণা। ফলে এরাও কোয়ান্টাম জাম্প দিতে পারে। আয়নও কণা বই কিছু নয়। তাই আয়নিত পরামাণুর ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটা সম্ভব। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সেই কাজটাই করেছেন। তাঁরা ব্যাটারির ভেতরের থাকা লিথিয়াম আয়নে বিশেষ আলোক রশ্মি প্রয়োগ করেছেন। এই আলো আয়নদের জুগিয়েছে শক্তি। বাড়তি এই শক্তি ওগুলোকে ফাঁদ থেকে মুক্ত করে অন্য জায়গায় নিয়ে গেছে। আয়নদের তো আর ইলেকট্রনের মতো শক্তিস্তর নেই, যে আবার আগের শক্তিস্তরে ফিরে আসবে! মানে ইলেকট্রন যেমন শক্তিস্তরের ভেতরে জাম্প দেয়, আয়নের ক্ষেত্রে সেই জাম্পটা হয় আস্ত পরমাণুর অবস্থান বদলে। তাই আয়নগুলোর কিছু কিছু আবার আগের জায়গায় অর্থাৎ ফাঁদের ভেতরেই ফিরে আসে।
গবেষকেরা মাত্র এক সেকেন্ডের কয়েক ট্রিলিয়ন ভাগ সময়ের জন্য দেখতে পেয়েছেন পরমাণুদের স্মৃতির ব্যাপরটা। তবে পরিমাপের প্রযুক্তি যত উন্নত হবে, এই ‘সময়টুকু’ আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
ব্যাপারটা এমন, আয়নগুলো যেন জানে, আগে তারা কোথায় ছিল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এ ধরনের আয়নিত পরামাণুদের মেমরি বা স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতির উৎস কী, কীভাবে সেগুলো তৈরি হয়, সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।
ব্যাপারটা সহজভাবে বোঝানোর জন্য এই গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক সাইফুল ইসলাম একটা উদাহরণ টেনেছেন। ধরা যাক, একটা পুকুরে ঢিল ছুড়বেন। পুকুরে প্রচুর পরিমাণে পানির অণু আটকে থাকে। এমনি অণুগুলো চলাচল করলেও পুকুরের পানিকে মোটাদাগে স্থির মনে হয়। এবার আপনি পুকুরে ঢিল ছুড়ুন। ঢিল যেখানে ছুড়বেন, সেখান থেকে একটা ঢেউ উঠবে। আপনি চাইলে দেখতে পারবেন, সেই ঢেউ কত দূর গেল। ঢিল যদি খুব ছোট হয় আর আপনি যদি খুব জোরে না ছোড়েন, তাহলে ছোট্ট একটা ঢেউ উঠবে। ঢেউটা হয়তো বিলীন হয়ে যাবে পুকুরের কিনার পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই। ঢিল যদি অনেক বড় হয়, আর আপনি যদি সেটা জোরে ছোড়েন, তাহলে ঢেউটা অনেক শক্তিশালী হবে এবং পুকুরের চারপাশের কিনারে ধাক্কা খেয়ে বিলীন হবে। অর্থাৎ ঢিল ছুড়লে পানির একটা প্রবাহ তৈরি হবে চারপাশে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষায় ফাঁদে আটক পরমাণুগুলোকে এভাবে আঘাত করেছেন তাঁরা। সেখানে ঢিলের বদলে ব্যাবহার করেছেন আলোর ফোটন কণা। ফলে আয়নিত পরামাণুগুলো কোয়ান্টাম জাম্প দিয়ে নিজের স্থান থেকে সরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। খুব কম সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া সেসব আয়নের গতি-প্রকৃতি মেপে দেখেছেন তাঁরা। দেখেছেন কিছু আয়ন যেন স্মৃতি ব্যবহার করে আবার নিজের জায়গায় চলে এসেছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ডেভিড লুক বলেছেন, ‘আয়নিত পরমাণুদের এই আচরণ দেখলে মনে হয় তাদের স্মৃতি আছে। তবে এটাকে কোনোভাবেই মানুষের স্মৃতির সঙ্গে মেলালে চলবে না। আয়ন তাদের গতিপথের তথ্য ধরে রাখে। এই ব্যাপারটাকে কোয়ান্টাম কোহেরেন্স বা কোয়ান্টাম মেমরি বলা যেতে পারে।’
এখন ভাবতে পারেন, পরমাণুদের এই মেমরি কী কাজে লাগবে? বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য এই গবেষণা আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, কোয়ান্টাম কম্পিউটারে মূল ভিত্তিই খুদে কণাদের কোয়ান্টাম আচরণের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
আয়নগুলো যেন জানে, আগে তারা কোথায় ছিল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এ ধরনের আয়নিত পরামাণুদের মেমরি বা স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতির উৎস কী, কীভাবে সেগুলো তৈরি হয়, সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারেও ডেটা সংরক্ষণের জন্য মেমরি প্রয়জোন হয়। পমাণুদের এই স্মৃতি বা মেমরি মনে রাখার ক্ষমতা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ডেটা প্রসেসিং ও সংরক্ষণের বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষকেরা মাত্র এক সেকেন্ডের কয়েক ট্রিলিয়ন ভাগ সময়ের জন্য দেখতে পেয়েছেন পরমাণুদের স্মৃতির ব্যাপরটা। তবে পরিমাপের প্রযুক্তি যত উন্নত হবে, এই ‘সময়টুকু’ আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। বিজ্ঞানীরা আয়নিত পরমাণুর এই আচরণটাকে ব্যবহার করতে পারবেন বিদ্যুৎ প্রবাহের ক্ষেত্রেও। কোনো বৈদ্যুতিক পদার্থ কীভাবে কোন মাত্রায় চার্জ বহন করতে পারে তা আগেভাগেই অনুমান করা সম্ভব হবে এই ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে। ভবিষ্যতের দ্রুতগতির নতুন কম্পিউটার তৈরিতে বেশ কাজে দেবে এটা।
গবেষকেরা মনে করছেন, মেমরির প্রভাব কাজে লাগিয়ে আরও উন্নত ও দ্রুত চার্জ পরিবাহী ব্যাটারি তৈরি করা সম্ভব হবে। আর ভবিষ্যতের বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য এই ধরনের ব্যাটারি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।