অ্যারিস্টটল থেকে নিউটন যেভাবে গতির রহস্য সমাধান করলেন

একটা বনের ছবির দিকে তাকান। চারপাশে সুনসান নীরবতা। ছবি দেখলে মনে হয়, সবকিছু থেমে আছে। আপনি ধরে নিতেই পারেন, ছবি তোলার সময় জঙ্গলের গাছপালা সব স্থির ছিল। এবার আরেকটা ছবির দিকে তাকান। ছবিতে সবকিছু স্থির, তবুও আপনি বুঝতে পারছেন যে ছবি তোলার সময় আসলে কিছুই স্থির ছিল কিনা। আসলে জঙ্গলের যে ছবিকে আপনি স্থির মনে করছেন, সেটিও স্থির নয়। ছবি তোলার সময় হয়তো জঙ্গলে মৃদু বাতাস বইছিল। তাই গাছের ডালপালা বা পাতা নড়ছিল। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, সেই মুহূর্তে বাতাস বইছিল না, তবুও ছবিতে যা কিছু আছে, তার সবই স্থির থাকা সম্ভব নয়।

হয়তো কোনো একটি গিরগিটি একটি পাতায় টোকা দিচ্ছিল। একই সময়ে কোনো পাখি হয়তো পাতার পেছনে ছিল লুকিয়ে। কিংবা ছবিতে সামনের সারির গাছগুলোর পেছনে হয়তো একদল হরিণ ঘাস খাচ্ছিল। আপনার চারপাশের কিছু জিনিসকে হয়তো কখনো নড়তে দেখবেন না। কিন্তু বেশিরভাগ জিনিসই নড়াচড়া করতে দেখবেন।

গাছপালা বাতাসে দোলে, গাড়ি ছোটে, পশু-পাখিরা হেঁটে বেড়ায়, এমনকি ঘুমন্ত মানুষেরও শ্বাস-প্রশ্বাস চলে। কিন্তু একটি বিশাল বড় পাথর, কংক্রিটের তৈরি বাড়িঘর বা সেতুকে কখনো নড়তে দেখবেন না। এগুলো আপাতদৃষ্টিতে স্থির। এই স্থির থাকা বা চলা আসলে কী?

একটা ছোট্ট চারাগাছ আছে মাটিতে। মনে হতে পারে, এই চারাগাছটি তো অবস্থান পরিবর্তন করছে না, তাই এটি স্থির। কিন্তু আসলে তা নয়। অবস্থানের পরিবর্তন যে শুধু ডানে-বাঁয়ে বা সামনে-পেছনেই হতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই।

প্রকৃতির নিয়ম ব্যাখ্যা করাই পদার্থবিজ্ঞানের কাজ। বিজ্ঞানের এই শাখার যাত্রাই শুরু হয়েছিল স্থিরতা আর গতির ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে। হাজার হাজার বছর আগেও মানুষ জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করত। গ্রিক সভ্যতায়, এমনকি তারও আগে প্রাচীন ভারতীয়, চৈনিক, মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতায় জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা ছিল। গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচলের খবর তারা রাখত।

তারা আরও জানত, এদের গতির কারণেই দিন-রাত হয় এবং চাঁদের গতির কারণে হয় অমাবস্যা-পূর্ণিমা। নক্ষত্রদের গতির কারণেই বছরের বিভিন্ন সময়ে আকাশে সেগুলোর অবস্থান পরিবর্তিত হয়। পৃথিবীকে স্থির মনে করলেও আকাশের অন্যান্য বস্তু যে গতিশীল, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু বস্তুর গতি নিয়ে আলাদাভাবে কী ভেবেছিল তারা?

গ্রিক সভ্যতার আগে মানুষ গতি নিয়ে সেভাবে ভাবেনি। অথবা ভাবলেও সেই ইতিহাস হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে গ্রিক যুগে এসে গতি নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ভাবতে শুরু করে মানুষ।

আরও পড়ুন

২.

গতি নিয়ে দার্শনিক চিন্তার খোরাক প্রথম জোগান গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস। তাঁর মতে, মহাবিশ্বে কিছুই স্থির নয়, সবকিছুই সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। অন্যদিকে পারমেনিদিস নামে আরেক দার্শনিক বলেছিলেন উল্টো কথা। তাঁর মতে, পরিবর্তন আসলে এক ধরনের বিভ্রম। এখন আপনি বলতেই পারেন, পরিবর্তনের সঙ্গে গতির কী সম্পর্ক? সময়ের সঙ্গে কোনো বস্তু যদি পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে নিজের অবস্থান পরিবর্তন না করে, তবে বস্তুটি স্থির। আর সময়ের সঙ্গে পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে অবস্থান পরিবর্তন করলে তাকে গতিশীল বস্তু বলে। অবস্থান পরিবর্তনের এই ঘটনাকেই বলে বস্তুর গতি। অর্থাৎ, অবস্থান পরিবর্তনই হলো গতি।

জঙ্গলের যে ছবিকে আপনি স্থির মনে করছেন, সেটিও স্থির নয়। ছবি তোলার সময় হয়তো জঙ্গলে মৃদু বাতাস বইছিল। তাই গাছের ডালপালা বা পাতা নড়ছিল। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, সেই মুহূর্তে বাতাস বইছিল না, তবুও ছবিতে যা কিছু আছে, তার সবই স্থির থাকা সম্ভব নয়।

ধরা যাক, একটা ছোট্ট চারাগাছ আছে মাটিতে। মনে হতে পারে, এই চারাগাছটি তো অবস্থান পরিবর্তন করছে না, তাই এটি স্থির। কিন্তু আসলে তা নয়। অবস্থানের পরিবর্তন যে শুধু ডানে-বাঁয়ে বা সামনে-পেছনেই হতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। এটি ওপর-নিচেও হতে পারে। চারাগাছটি সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। এটাও এক ধরনের গতি। ধরুন, গাছ থেকে একটি পাতা নিচে পড়ছে। অর্থাৎ, সময়ের সঙ্গে তার অবস্থান বদলাচ্ছে। একইভাবে, কুয়ার ভেতর একটি ঢিল ফেললে সেটাও সময়ের সঙ্গে অবস্থান বদলে নিচে পড়তে থাকে। স্থির একটা পাহাড়ও হঠাৎ ধসে পড়তে পারে। পাহাড়ে থাকা মাটির কণাগুলো সময়ের সঙ্গে অবস্থান বদলায়। তাই এগুলোও গতিশীল। আসলে সব ধরনের পরিবর্তনই এক প্রকার গতিশীল প্রক্রিয়া।

অন্যদিকে অ্যারিস্টটল নিজের মতো করে গতির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, প্রতিটি বস্তুরই একটি ‘প্রাকৃতিক স্থান’ আছে। কোনো কারণে বস্তু তার প্রাকৃতিক স্থান থেকে সরে এলে, সেটি আবার তার আগের স্থানে ফিরে আসার চেষ্টা করে। ফলে বস্তুটি গতিশীল হয়।

আরও পড়ুন

অ্যারিস্টটলের ধারণা অনুযায়ী, বস্তু তার ‘প্রাকৃতিক স্থান’ থেকে বিচ্যুত হলেই প্রাকৃতিক স্থানে ফিরে আসার জন্য গতিশীল হয়। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি পানির কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, পানির জন্য নিচু জায়গা হলো সেই প্রাকৃতিক স্থান। তাই কোথাও পানি রাখলে গড়িয়ে নিচের দিকে চলে যেতে চায়। অন্যদিকে, যেকোনো ভারী বস্তুর জন্য তিনি পৃথিবীকে তার প্রাকৃতিক স্থান বলেছিলেন। তাই কোনো কিছু ওপরে ছুড়ে দিলে তা আবার পৃথিবীতেই ফিরে আসে। তিনি আরও বলেছিলেন, আগুন, ধোঁয়া বা বাষ্পের মতো হালকা বস্তুর প্রাকৃতিক স্থান হলো আকাশ। তাই সেগুলো ওপরের দিকে উঠে যায়।

অ্যারিস্টটল
ছবি: সংগৃহীত

তাঁর মতে, কোনো বস্তুকে তার প্রাকৃতিক গতির বাইরে গতিশীল রাখতে হলে বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করতে হবে। যতক্ষণ বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করা হবে, ততক্ষণ বস্তুটি গতিশীল থাকবে। বল প্রয়োগ বন্ধ করলে বস্তুটি আবার স্থির হয়ে যাবে।

কোনো বস্তুকে তার প্রাকৃতিক গতির বাইরে গতিশীল রাখতে হলে বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করতে হবে। যতক্ষণ বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করা হবে, ততক্ষণ বস্তুটি গতিশীল থাকবে। বল প্রয়োগ বন্ধ করলে বস্তুটি আবার স্থির হয়ে যাবে।

আপাতদৃষ্টিতে একেই ঠিক বলে মনে হবে। যেমন কোনো গাড়িকে গতিশীল করতে হলে ইঞ্জিন চালু রাখতে হয়। আর ইঞ্জিন চালু রাখতে দরকার জ্বালানি। জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়, গাড়ি আর চলে না। এই ছিল গ্রিক যুগের দার্শনিকদের গতি সম্পর্কিত ধারণা।

এই ধারণায় এখন অনেকটাই বদল এসেছে। আর এই বদলের সূচনা হয়েছিল ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলির হাত ধরে। ষোড়শ শতকের শেষভাগ এবং সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে তিনি গতির ধারণাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেন। গ্যালিলিও বলেন, কোনো বস্তুর গতি বজায় রাখার জন্য বাহ্যিক বলের প্রয়োজন নেই। কোনো বস্তু একবার গতিশীল হলে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে, যদি কোনো বাহ্যিক বল তাকে বাধা না দেয়। কিন্তু বাস্তবে ঘর্ষণ বলের মতো বিভিন্ন ধরনের বাধাজনিত বল বস্তুর ওপর কাজ করে। এই বাধাই গতিশীল বস্তুকে থামিয়ে দেয়। ভূপৃষ্ঠে ঘর্ষণের কারণে গাড়ির চাকা থেমে যায়। আর ওপর থেকে পড়া বস্তু বাতাসের বাধার কারণে হয় ধীরগতির।

আরও পড়ুন
গ্যালিলিও মহাকর্ষকে পতনের কারণ হিসেবে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে এর প্রভাবে বস্তুর গতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। তবে গ্যালিলিও মহাকর্ষ এবং ঘর্ষণের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি।
স্যার আইজ্যাক নিউটন
ব্রিটানিকা

যদি ঘর্ষণ না থাকত, তবে একটি বস্তু একই গতিতে অনন্তকাল ধরে চলত। তিনি তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রমাণ করেন—বিনা বাধায় পতনশীল বস্তুর গতি তার ভরের ওপর নির্ভর করে না। তিনি একটি ঢালু তলে ভিন্ন ভরের দুটি বস্তু গড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে, ভারী ও হালকা উভয় বস্তুই প্রায় একই সময়ে নিচে পৌঁছায়। অর্থাৎ তাদের ত্বরণ একই থাকে। কথিত আছে, তিনি পিসার হেলানো মিনার থেকে দুটি ভিন্ন ভরের বস্তু ফেলেও এই পরীক্ষাটি করেছিলেন। তবে এই ঘটনার কোনো সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তাই আধুনিক বিজ্ঞানীরা এ কাহিনিকে সন্দেহের চোখে দেখেন।

যাই হোক, গ্যালিলিও মহাকর্ষকে পতনের কারণ হিসেবে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে এর প্রভাবে বস্তুর গতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। তবে গ্যালিলিও মহাকর্ষ এবং ঘর্ষণের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি।

গ্যালিলিওর এই যুগান্তকারী ধারণাই পরে আইজ্যাক নিউটনের জন্য পথ তৈরি করে দেয়। সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করে নিউটন তাঁর বিখ্যাত গতির সূত্রগুলো প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সে গল্প আজ নয়, আরেকদিন শোনাবো।

 

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন