দৈর্ঘ্য, ভর বা সময়ের একক এল কীভাবে

পদার্থবিজ্ঞানের সহজপাঠ - ৪

পদার্থবিজ্ঞানে রাশি এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা মাপা যায় এবং এককের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এটি দুই ভাগে বিভক্ত—মৌলিক ও লব্ধ রাশি। মৌলিক রাশিগুলোর এককও মৌলিক। একইভাবে লব্ধ রাশিগুলোর একক হলো লব্ধ একক। যেমন, তাপমাত্রা মৌলিক রাশি। এদের একক তাই মৌলিক। সেলসিয়াস, কেলভিন বা ফারেনহাইটের একক হিসেবে যেটাই ব্যবহার করি, এগুলো মৌলিক একক। কিন্তু একটা বস্তুর বেগ মৌলিক রাশি নয়। দূরত্বকে সময় দিয়ে ভাগ করলে বেগ পাওয়া যাবে। তাই বেগের ভেতর দুটি রাশি লুকিয়ে আছে—দূরত্ব ও সময়। ফলে এর এককের ভেতরও দৈর্ঘ্য আর সময়ের একক থাকবে। আমরা যেমন বলতে পারি, একটা ট্রেনের গতি সেকেন্ডে 20 মিটার। একে সাংকেতিক ভাষায় লেখা যায় 20m/s বা 20ms-1

মৌলিক রাশি মোট সাতটি। এগুলোর প্রত্যেকের মৌলিক একক আছে। যেমন, সময়ের একক সেকেন্ড (s), দূরত্ব বা দৈর্ঘ্যের একক মিটার (m), ভরের একক কিলোগ্রাম (kg), পদার্থের পরিমাণের একক মোল (mol), তাপমাত্রার একক কেলভিন (k), তড়িৎ প্রবাহের একক অ্যাম্পিয়ার (A) এবং দীপন তীব্রতার একক ক্যান্ডেলা (cd)। এই যে একক, এগুলো নির্ধারণ করা হলো কীভাবে? এর জন্য তূল্য বস্তু দরকার। পানি একসময় তূল্য বস্তু হিসেবে কাজ করত। যেমন, স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে 1 ঘনমিটার পানির ওজন 1 কেজি। অন্যভাবে বললে, 4 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় 1 লিটার (0.001 ঘনমিটার) পানির ভর প্রায় 1 কেজি।

সব মৌলের পরমাণু খুব দ্রুত কাঁপে। অর্থাৎ এক সেকেন্ডে লাখো-কোটিবার কাঁপে। এই কম্পন মাপতে পারা মানে খুব সহজেই খুব ছোট বা ক্ষুদ্র সময় মাপা।

তবে পানিও আসল তুল্য বস্তু নয়। একসময় কিছু সত্যিকারের তুল্য বস্তু রাখা হতো SI-এর গবেষণাগারে। যেমন, একটি বস্তু রাখা হয়েছিল, যার ভর ছিল 1 কেজি। তেমনি একটি মিটার দণ্ডও রাখা হয়েছিল। বাকি পাঁচটি এককের জন্যও এমন কোনো না কোনো বস্তু তুল্য হিসেবে ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন একই জিনিসকে তুল্য বস্তু হিসেবে রাখার সমস্যাও আছে। পরিবেশের পরিবর্তন, যেমন—তাপ, চাপ ইত্যাদির প্রভাবে সেসব বস্তুর ভর বা আয়তন বদলে যেতে পারে। তাই নতুন করে এককগুলোর সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য কিছু প্রাকৃতিক ধ্রুবক ব্যবহার করা হয়েছে।

 

২.

ধ্রুব জিনিস কী

পৃথিবীতে এমন কিছু মান আছে, যেগুলো পরিবর্তন হয় না। এগুলোকে বলে কনস্ট্যান্ট বা ধ্রুবক। উচ্চতর বিজ্ঞানে এগুলোকে ধ্রুব হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। যদিও ধ্রুব ও ধ্রবকের মধ্যে সংজ্ঞাগত কিছুটা পার্থক্য আছে। আমরা এখানে কনস্ট্যান্টের বাংলা ধ্রবকই লিখব। ধ্রবকের মান স্থির বা পরিবর্তযোগ্য নয়। কোনো পরীক্ষায় যদি ধ্রুবকের মান একটু কমবেশি হয়, ধরে নেওয়া হয় পরীক্ষাতেই গড়বড় আছে। যেমন শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ c একটা ধ্রুব সংখ্যা, অর্থাৎ ধ্রুবক। আলো প্রতি সেকেন্ডে 299792458 মিটার পথ পাড়ি দেয়। তেমনি আরও কিছু ধ্রুবক আছে—যেমন মহাকর্ষ ধ্রুবক G, প্ল্যাংক ধ্রুবক h, বোলৎজম্যান ধ্রুবক kB‌ ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের মৌলিক একক সাতটি। এই সাতটি এককের সংজ্ঞা তৈরির জন্য দরকার সাতটি ধ্রুবক। কোন সাতটি ধ্রুবক? যেগুলোর সাহায্যে এককগুলো ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন, 1 মিটারের সংজ্ঞা দেওয়ার জন্য আলোর বেগ c-কে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা জানি, শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ c = 299792458 ms-1

আরও পড়ুন

তাই আলোর বেগের সাহায্যে সহজেই মিটারকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে, শুধু একটু ঘুরিয়ে বলতে হবে। শূন্য মাধ্যমে আলো 1/299792458 সেকেন্ডে যে পরিমাণ দূরত্ব পাড়ি দেয়, তাকেই 1 মিটার বলে। তেমনি সময়ের একক সেকেন্ডকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে সিজিয়াম পরমাণুর একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক দিয়ে। প্রতিটি পরমাণুই তার নিজস্ব শক্তিস্তরে স্পন্দিত হয়, আর স্পন্দন থাকলেই তার কম্পাঙ্ক থাকে। কম্পাঙ্ক হলো প্রতি সেকেন্ডে একটি পরমাণু কতবার কাঁপে, সেই সংখ্যা।

সব মৌলের পরমাণু খুব দ্রুত কাঁপে। অর্থাৎ এক সেকেন্ডে লাখো-কোটিবার কাঁপে। এই কম্পন মাপতে পারা মানে খুব সহজেই খুব ছোট বা ক্ষুদ্র সময় মাপা। একসময় মানুষের হাতে 1 সেকেন্ডের কম সময় মাপার মতো কোনো যন্ত্র ছিল না। তারপর স্টপওয়াচ উদ্ভাবণ করা হয়, তখন প্রথম দিকে 1 সেকেন্ডের 10 ভাগের এক ভাগ, আরও পরে 100 বা 1000 ভাগ মাপার মতো যন্ত্রও মানুষের হাতে এসে যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের আরও সূক্ষ্ম ঘড়ি দরকার। তাই একসময় অ্যাটোমিক ঘড়ি বা পরমাণু ঘড়ি উদ্ভাবণ করলেন। পরমাণুর স্পন্দনকে কাজে লাগিয়ে এই ঘড়ি তৈরি করা হয়। সিজিয়াম-133 (Cs-133) পরমাণুর একটি নির্দিষ্ট শক্তিস্তরের কম্পাঙ্ক একটি ধ্রুব সংখ্যা। এই পরমাণুর কম্পাঙ্ক প্রতি সেকেন্ডে 9192631770 বার। একেই উল্টো করে লিখলে 1 সেকেন্ডের সংজ্ঞা পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, সিজিয়াম-133 পরমাণুর 9192631770 বার স্পন্দনের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ই হলো 1 সেকেন্ড।

কোনো বস্তুতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পদার্থের মোট পরিমাণকে মোল বলে। এখানে পদার্থ বলতে অণু কিংবা পরমাণু বোঝানো হয়েছে। মোলটাও একটা ধ্রুব সংখ্যা।

ভরের এককের সংজ্ঞাটাও বেশ ইন্টারেস্টিং। ভরের একক কিলোগ্রাম বা কেজি, তা আমাদের সবার জানা। কিন্তু এর সংজ্ঞা দিতে ব্যবহার করা হয় প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক (h), যার মান h = 6.62607015 × 10-34 Js (জুল-সেকেন্ড)। এটি kgm²s⁻¹ এককের সমান। কারণ, 1j = m2 kgm²s-2

প্ল্যাংক ধ্রুবক হলো শক্তির ধ্রুবক। কিন্তু শক্তির সঙ্গে ভর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত E = mc2 সমীকরণে দেখিয়েছেন, ভরকে সহজেই শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। সেটা কীভাবে, সেই আলোচনা এই অধ্যায়ে করার সুযোগ নেই। কাজ ও শক্তি নিয়ে যখন আলোচনা করব, তখন এটা নিয়ে কথা বলা যাবে। সুতরাং এক কিলোগ্রামের সংজ্ঞাটা আমরা দেখে নিতে পারি। কিলোগ্রামকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যেন প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক h-এর মান নির্দিষ্টভাবে 6.62607015 × 10⁻³⁴ kg·m²·s⁻¹ হয়, যেখানে মিটার ও সেকেন্ডকে যথাক্রমে আলোর বেগ (c) এবং সিজিয়াম কম্পাঙ্ক (ΔνCs​) দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

আরও পড়ুন

তাপমাত্রাও একটা মৌলিক রাশি৷ তাই এর এককগুলোও মৌলিক। এমকেএস বা আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসারে তাপমাত্রার একক হলো কেলভিন। আর 1 কেলভিনের সংজ্ঞা দিতে ব্যবহার করা হয়েছে বোলৎজম্যান ধ্রুবক kB​। এর মান kB​ = 1.380649 × 10⁻²³ JK⁻¹, যা 1.380649 × 10⁻²³ kgm²s⁻²K⁻¹ এককের সমান। সুতরাং, কেলভিনকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যেন বোলৎজম্যান ধ্রুবক kB​-এর মান নির্দিষ্টভাবে 1.380649 × 10⁻²³ JK⁻¹ হয়। অর্থাৎ কোনো বস্তুর তাপশক্তি 1.380649 × 10-23 জুল পরিবর্তন করলে ১ কেলভিন পরিমাণ তাপমাত্রার পরিবর্তন হবে।

এরপর আমরা আলোচনা করব মোল নিয়ে। কোনো বস্তুতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পদার্থের মোট পরিমাণকে মোল বলে। এখানে পদার্থ বলতে অণু কিংবা পরমাণু বোঝানো হয়েছে। মোলটাও একটা ধ্রুব সংখ্যা। এটাকে অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যাও বলে। অ্যাভোগেড্রোর সংখ্য NA = 6.02214076 × 10²³ mol⁻¹। অর্থাৎ, এক মোল পরিমাণ পদার্থে 6.02214076 × 1023 টি কণা (যেমন: অণু, পরমাণু বা আয়ন) থাকে। তাহলে 1 মোলের সংজ্ঞাটি দাঁড়ায়, যে পরিমাণ পদার্থে ঠিক 6.02214076 × 10²³ টি কণা থাকে, তাকে 1 মোল বলে।

স্টেরেডিয়ান ব্যাপারটা আরও জটিল করে দিয়েছে। আমরা যখন আলোকবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করব, তখন এই বিষয়টা আরও সহজ করে বোঝার চেষ্টা করব।

সবশেষে আলোচনা করা যাক দীপন তীব্রতা নিয়ে। দীপন তীব্রতা মানে আলোর উজ্জ্বলতা। কোথাও আলো কম নাকি বেশি, তা আমরা বুঝি উজ্জ্বলতা দেখে। তাই আলোর উজ্জ্বলতাও পরিমাপযোগ্য রাশি। আর এর একক হলো ক্যান্ডেলা (cd)। একে সংজ্ঞায়িত করা হয় আরেকটি ধ্রুবক দিয়ে। সেটি হলো দীপন কার্যকারিতা বা Kcd​। এর মান 540 × 1012 হার্জ কম্পাঙ্কের আলোর জন্য নির্দিষ্টভাবে 683 লুমেন/ওয়াট (lm/W) ধরা হয়। এর সংজ্ঞাটা একটু জটিল। কোনো নির্দিষ্ট দিকে একটি আলোক উৎসের দীপন তীব্রতা 1 ক্যান্ডেলা হবে, যদি উৎসটি 540 × 1012 হার্জ কম্পাঙ্কের একরঙা আলো বিকিরণ করে এবং ওই নির্দিষ্ট দিকে তার বিকিরণ তীব্রতা 1/683 ওয়াট/স্টেরেডিয়ান হয়।

আগেই বলেছি, এই সংজ্ঞাটা একটু জটিল। স্টেরেডিয়ান ব্যাপারটা আরও জটিল করে দিয়েছে। আমরা যখন আলোকবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করব, তখন এই বিষয়টা আরও সহজ করে বোঝার চেষ্টা করব। আপাতত সংজ্ঞাটা আমাদের জানা রইল।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন