পদার্থবিজ্ঞানের সহজপাঠ-৫ (তাপ)
তাপ এক ধরনের শক্তি। এটা কারও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু এটুকু তথ্য দিয়ে তাপের ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যায় না। তাই আরেকটু বাড়িয়ে বলা যেতে পারে—তাপ এমন এক শক্তি, যা আমাদের ঠান্ডা ও গরমের অনুভূতি জোগায়। সমস্যা হলো, এই তথ্য দিয়েও তাপের মহিমা বোঝা সম্ভব নয়৷ তাপের প্রকৃতি বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে শক্তি কী। শক্তি এমন কিছু, যা চোখে দেখা যায় না। অথচ একে দিয়ে বড় বড় কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব। মানুষ হাঁটতে পারে, কাজ করতে পারে, দৌড়াতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে। এজন্য দরকার হয় শক্তি৷ আর শক্তি উৎপাদনের জন্য দরকার জ্বালানি। মানুষের গায়ে যে শক্তি থাকে, যাকে আমরা ‘গায়ের জোর’ বলি, এই শক্তির জন্যও জ্বালানির দরকার। আর সেই জ্বালানি হলো খাবার। খাবার থেকে পুষ্টি শোষণ করে শক্তি তৈরি হয়। কিন্তু মানুষের গায়ে অত বেশি শক্তি থাকে না। অল্প একটু পরিশ্রম করলেই শক্তি ফুরিয়ে যায়। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাই বড় বড় কাজ করতে আমাদের বিকল্প শক্তি খুঁজতে হয়।
ধরা যাক, মামুন সাহেব ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন। পায়ে হেঁটে যেতে বহুদিন লাগবে, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তিনি যদি বাস কিংবা ট্রেন ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। বাস কিংবা ট্রেনের আছে যান্ত্রিক শক্তি। সেই শক্তি দিয়ে মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশি কাজ করানো যায়৷ তাই গাড়ি ব্যবহার করে দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারি, মানুষের নিজের শরীরের শক্তি ও সময় দুটোই বাঁচে। অন্যদিকে, বড় বড় ভবন কিংবা সেতু তৈরির সময় ক্রেন দিয়ে ভারী বস্তু তোলা হয়। পরে এসব ভবন ভাঙতে ব্যবহার করা হয় বুলডোজার। অর্থাৎ যান্ত্রিক শক্তি দিয়ে আমরা সহজেই ভারী ভারী কাজ করিয়ে নিতে পারি। আর এসব শক্তি উৎপাদনের জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় তেল বা বিদ্যুৎ। যান্ত্রিক শক্তি ছাড়া আছে রাসায়নিক শক্তি, গতিশক্তি, বিভব শক্তি, পারমাণবিক শক্তি, বিদ্যুৎশক্তি, আলোক শক্তি, শব্দ শক্তি এবং তাপশক্তি।
বহুদিন এই ‘ক্যালোরিক তত্ত্ব’ টিকে ছিল। ১৭৯৮ সালে আমেরিকান বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী কাউন্ট রামফোর্ড—যাঁর আসল নাম বেঞ্জামিন থম্পসন—তিনি ক্যালোরিক তত্ত্বকে অনেকটাই বাতিল করে দেন।
এবার মূল প্রশ্নে আসি, তাপশক্তি আসলে কী? একটু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যাক। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, তাপ এক ধরনের বস্তু। এই বস্তু অন্য কোনো বস্তুতে প্রবেশ করলে সেটি উত্তপ্ত হয় এবং বেরিয়ে গেলে হয় ঠান্ডা। বিজ্ঞানীরা সেই বস্তুর নাম দেন ক্যালোরিক। ফরাসি রসায়নবিদ অঁতোয়ান ল্যাভোসিয়ে এই ক্যালোরিক তত্ত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। আরও অনেক বিজ্ঞানী এই তত্ত্ব মানতেন। বিশেষ করে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ ব্ল্যাক, জার্মান পদার্থবিদ জোহান কার্ল ভিলকে এবং সুইডিশ বিজ্ঞানী টর্বার্ন বার্গম্যানও মনে করতেন তাপ একধরনের পদার্থ।
বহুদিন এই ‘ক্যালোরিক তত্ত্ব’ টিকে ছিল। ১৭৯৮ সালে আমেরিকান বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী কাউন্ট রামফোর্ড—যাঁর আসল নাম বেঞ্জামিন থম্পসন—তিনি ক্যালোরিক তত্ত্বকে অনেকটাই বাতিল করে দেন। একটা পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি কাজটা করেন। তখন তিনি জার্মানির মিউনিখে কামান তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কামানের নল তৈরির সময় একটা ব্যাপার খেয়াল করেন রামফোর্ড—নল ঘষলে তাপ উৎপন্ন হয়।
তিনি একনাগাড়ে নল ঘষা শুরু করেন। যত বেশি ঘর্ষণ, তত বেশি তাপ উৎপন্ন হয়। কামানের নলও তত গরম হয়। তখন তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করেন, ক্যালোরিকের প্রবাহের ফলেই যদি তাপ উৎপন্ন হতো, তাহলে বারবার ঘষার ফলে বস্তুটিতে ক্যালোরিক কণা কমত। একসময় তা ফুরিয়ে যাওয়ারও কথা। কিন্তু কিছুতেই ফুরাচ্ছে না। বরং তাপ আরও বাড়ছে। এর মানে কী?
তিনিই প্রথম জোরালো পরীক্ষামূলক প্রমাণের মাধ্যমে বুঝতে পারেন, তাপ কোনো বস্তু নয়, বরং এটি একধরনের শক্তি, যা গতির ফলে উৎপন্ন হয়।
দুই
তাপ কেমন শক্তি? এটা উৎপন্ন হয় কীভাবে? আমরা কোনো বস্তুর গতিশক্তির কথা বলি। বস্তুটা যখন ছুটতে থাকে, তখন সেই শক্তি উৎপন্ন হয়। বড় একটা গাড়ি যখন ছুটতে শুরু করে, তখন সে গতিশক্তি লাভ করে। গাড়িতে মালামাল পরিবহন করা যায়, সেটা আসলে তার গতিশক্তির কারণেই। তাপকে যখন শক্তি হিসেবে বুঝতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা, তখনো তাঁরা বোঝেননি এটা এক ধরনের গতিশক্তি। কঠিন পদার্থের অণুগুলো প্রায় গায়ে গায়ে লেগে থাকে। অন্যদিকে তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের অণুগুলো থাকে বেশ দূরে দূরে। কোনো পাত্রে না রাখলে এরা মোটামুটি স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে৷ কিন্তু পাত্র ছাড়া গ্যাস বা তরল কোথাও রাখা যায় না। একটি নদী বা সমুদ্রও পানির অণুদের জন্য পুরোপুরি স্বাধীন কোনো স্থান নয়।
তেমনি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলও আসলে স্বাধীন কোনো গ্যাসাধার নয়। পানি কিংবা গ্যাস যেখানেই থাকুক, তাদের একটা সীমানা আছে, তার বাইরে যেতে পারে না। এখন নদী বা সাগরের মতো বড় কোনো পাত্রের কথা না ভেবে একটা কাচের গ্লাসের কথা ভাবি। তাতে কিছুটা পানি রাখা যাক। পানির অণুগুলো স্বাধীনভাবে চলতে চায়। কিন্তু গ্লাসের দেয়াল ঘেঁষে থাকা অণুগুলো সেই দেয়াল ভেদ করে বের হতে পারে না।
তারা ধাক্কা খায় দেয়ালে। অন্যদিকে সেই অণুগুলোর চারপাশের অণুগুলো এসে তাদের গায়ে ধাক্কা মারে। এভাবে পুরো গ্লাসজুড়েই পানির অণুগুলোর মধ্যে ঠোকাঠুকি আর ধাক্কাধাক্কি চলে। ফলে এক ধরনের শক্তি তৈরি হয়। সেই শক্তির নামই হলো তাপ। অর্থাৎ, অণুদের চলাচল ও ধাক্কাধাক্কির ফলেই তাপশক্তি উৎপন্ন হয়।
গ্যাসের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। কোনো বোতলে বা পাত্রে যদি গ্যাসীয় পদার্থ রাখা হয়, তাহলে তাদের অণুগুলোর মধ্যেও একই রকম ধাক্কাধাক্কি হবে। এমনকি বায়ুমণ্ডলও পৃথিবীর মহাকর্ষ দ্বারা আবদ্ধ। তাই পৃথিবীর মহাকর্ষ বল কাটিয়ে গ্যাসীয় পদার্থ সহজে মহাবিশ্বে হারিয়ে যেতে পারে না।
অন্যান্য শক্তির মতো তাপকেও অন্য শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। আগুন জ্বালিয়ে যেকোনো বস্তুকে গরম করা সম্ভব।
সুতরাং এরকম আবদ্ধ জায়গায় তাদের মধ্যে ঠোকাঠুকি হবেই। ফলে উৎপন্ন হবে তাপ। অনেকে আবার মনে করেন, মহাশূন্যে বিশাল ফাঁকা জায়গাগুলোতে বোধহয় গ্যাস মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে। আসলে তাও পারে না। কারণ অণুগুলোর ভেতর আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল আছে। ফলে অনেকটা মুক্ত হলেও, তারা পুরোপুরি স্বাধীন নয়। তাই মহাশূন্যে কোথাও অনেক গ্যাস থাকলে তাদের মধ্যে এমন সংঘর্ষ হয়, তাপ উৎপন্ন করে। অন্যদিকে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে কঠিন বস্তুর অণুগুলো নিশ্চল, তাদের ছোটাছুটি করার সুযোগ নেই। ফলে কঠিন পদার্থের ভেতর থেকে কোনো তাপই উৎপন্ন হয় না। আসলে হয়। কঠিন পদার্থের অণুগুলো খুব কাছাকাছি থাকলেও তারা সবসময় কাঁপে। কাঁপতে কাঁপতে পাশের অণুর সঙ্গে ধাক্কা খায়। ফলে তৈরি হয় তাপ। মোটকথা, তাপ হলো বস্তুর অণুগুলোর সম্মিলিত গতিশক্তির ফল।
অন্যান্য শক্তির মতো তাপকেও অন্য শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। আগুন জ্বালিয়ে যেকোনো বস্তুকে গরম করা সম্ভব। ধরা যাক, চুলার আগুনের কথা। কাঠ, কয়লা বা গ্যাস পুড়িয়ে আগুন জ্বালানো হয়। এক্ষেত্রে জ্বালানির রাসায়নিক শক্তি, তাপ ও আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
আগুনে তাই একখণ্ড লোহা ধরলে সেটা গরম হয়ে ওঠে। অর্থাৎ আগুনের তাপ লোহার অণুগুলোকে ঝাঁকুনি দেয়। ফলে অণুদের কাঁপুনি বাড়ে, বাড়ে তাপও। তাপকেও নানা ধরনের শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। তাপ দিয়ে উৎপন্ন করা যায় বিদ্যুৎ। আবার মোটর গাড়ি বা ট্রেনের জ্বালানি তেল পুড়ে তাপ উৎপন্ন হয়। সেই তাপ ইঞ্জিনকে চালু রাখতে সাহায্য করে। ফলে তাপ শক্তি এখানে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তেমনি তাপশক্তি থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। মোটকথা, শক্তির এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হওয়ার যে সাধারণ নিয়ম, তাপশক্তিও সেই নিয়ম মেনে চলে।