কোয়ান্টাম ডিকোহেরেন্স : নিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তার দ্বন্দ্ব

চিরায়ত পদার্থবিদ্যার জগৎ অনেকটাই অনুমানযোগ্য। সত্যি বলতে কী, চাইলে আপনি সেই অনুমানকে ভবিষ্যদ্বাণীতে রূপান্তর করতে পারেন। তার জন্য আপনাকে জ্যোতিষী হতে হবে না। এর জন্য দরকার প্রকৃতির কিছু সূত্র সম্পর্কে জ্ঞান এবং সেগুলোর গাণিতিক হিসাব-নিকাশ। এই জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই মেকানিক্যাল, অ্যারোনটিক্যাল ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো শাখাগুলো চলছে। তাই তো বিশাল এক সেতু তৈরির আগে এর সব হিসাব-নিকাশ করে ফেলা সম্ভব। বড় বড় ভবন তৈরিতে, চাঁদে রকেট পাঠাতে, কিংবা গাড়ি নির্মাণেও এই জ্ঞান কাজে লাগে।

চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আছে বলেই আমাদের যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকঠাক কাজ করে। কোম্পানির মালিকেরা নিশ্চিন্তে ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি দিতে পারেন। বলবিদ্যা থেকে তাপগতিবিদ্যা, আলোকবিদ্যা থেকে তড়িৎগতিবিদ্যা—সবকিছুই চিরায়ত বলবিদ্যার এই ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর নির্ভরশীল। এমনকি আইনস্টাইনের বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বও সেই ধারা মেনেই কাজ করে। কিন্তু গোল বাঁধে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এসে। ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দুটি তত্ত্ব এসে কণাজগতের ‘নিশ্চয়তার’ ভিত নাড়িয়ে দেয়। প্রথমে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ অনিশ্চয়তা নীতি উপস্থাপন করেন। এর বছরখানেকের মধ্যে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার কোয়ান্টাম কণার জন্য গঠন করেন তরঙ্গ ফাংশন তত্ত্ব। পরে দেখা যায় , হাইজেনবার্গের ম্যাট্রিক্স মেকানিক্স এবং তাঁর তরঙ্গ ফাংশন তত্ত্ব দুটি পৃথকভাবে বিকশিত হলেও গাণিতিকভাবে সমতুল্য। ম্যাক্স বর্ন এবং নীলস বোর এই ধারণাকেই কোপেনহেগেন ব্যাখ্যায় আরও বিশদভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। দুটি তত্ত্বই কণার গতি-প্রকৃতি ও আচরণকে অনিশ্চিত করে তোলে।

আরও পড়ুন
সব শিল্পীকে গানের প্রতিটা শব্দ একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। সেখানকার একজনও যদি একটু আগে বা পরে গান, তাহলে পুরো দলের তাল-লয় ভেঙে পড়ে।

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি অনুযায়ী, কোনো কণার একাধিক পরিপূরক ধর্ম—অবস্থান ও ভরবেগ—একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যাবে না।

কোনো একটা ধর্ম নির্দিষ্ট করে দেখতে গেলে অন্য ধর্মগুলো অনিশ্চিত হয়ে যাবে। অন্যদিকে শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ ফাংশন বলে, একটি কোয়ান্টাম কণাকে যেখানে যেখানে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কণাটি সম্ভাব্য প্রতিটি বিন্দুতে একই সঙ্গে অবস্থান করে। কণাদের চরিত্র ও ধর্ম ব্যাখ্যার জন্য তিনি তরঙ্গ ফাংশনের অবতারণা করেন। মোদ্দা কথা হলো, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মূল ভাষ্য, কণাদের দ্বৈত সত্তা রয়েছে। অর্থাৎ এরা একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ। কোনো কণার সম্ভাব্য সব দশায় একসঙ্গে অবস্থান করার এই ধর্মকে কোয়ান্টাম সুপারপজিশন বলে।

 

দুই.

কণারা যে সুপারপজিশনে থাকে, সে বিষয়টি আইনস্টাইন ও তাঁর কিছু অনুসারী ছাড়া প্রায় সবাই মেনে নিয়েছিলেন। মানতে আসলে তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ, সব পরীক্ষামূলক প্রমাণই সুপারপজিশনের পক্ষে ছিল। প্রশ্ন হলো, কণাদের এই সুপারপজিশনের পেছনের কারণ কী? কারণ হলো কোহেরেন্স বা সঙ্গতি। প্রায়ই আমরা দলীয় সংগীত শুনি, যেখানে অনেক শিল্পী সমবেত কণ্ঠে গান করেন। সব শিল্পীকে গানের প্রতিটা শব্দ একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। সেখানকার একজনও যদি একটু আগে বা পরে গান, তাহলে পুরো দলের তাল-লয় ভেঙে পড়ে। যতই সুমধুরই হোক সেই গান, তখন আর শুনতে ভালো লাগবে না। আবার শুধু শিল্পীরা একই সুর, তাল ও লয়ে গাইলেও চলবে না, সঙ্গে যন্ত্রশিল্পীদেরও তাল মেলাতে হবে। তাদের কারও বাদ্যযন্ত্র যদি একটু এদিক-ওদিক হয়, তাহলেও পুরো দলের ছন্দ ভেঙে পড়বে। সব শিল্পী ও বাদকদলের একসঙ্গে একই সুরে, একই তালে পরিবেশনার এই ব্যাপারটিই হলো ঐক্যতান বা সঙ্গতি।

আরও পড়ুন
এখন প্রশ্ন হলো, কখন ডিকোহেরেন্সের জন্ম হয়? ধরা যাক, একটি কণা সুপারপজিশনে আছে, অর্থাৎ এটি তার সব সম্ভাব্য অবস্থায় একই সঙ্গে বিরাজ করছে।

গান আসলে এক ধরনের তরঙ্গ, শব্দ তরঙ্গ৷ একাধিক তরঙ্গের মধ্যে যখন একই দশা, ছন্দ ও কম্পাঙ্ক বজায় থাকে, তখন কোহেরেন্সের জন্ম হয়। কণার বিভিন্ন সম্ভাব্য অবস্থার মধ্যে যখন এমন কোহেরেন্স বা সঙ্গতি থাকে, তখন এটি সুপারপজিশনে অবস্থান করে। কণার তরঙ্গ ফাংশন এই কোহেরেন্স বজায় রাখে। কোনো কারণে যদি কণার তরঙ্গ ফাংশনের সঙ্গতি নষ্ট হয়, তবে তার কোহেরেন্স ভেঙে পড়ে। কোহেরেন্স ভেঙে পড়ার এই ব্যাপারটিকেই বলে ডিকোহেরেন্স। আর যখন কোনো কণা ডিকোহেরেন্সের শিকার হয়, তখন তার সুপারপজিশন অবস্থা ভেঙে পড়ে। ফলে কণাটি একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় এসে স্থিত হয় এবং বিলুপ্ত হয় অন্য সম্ভাব্য অবস্থাগুলো। অর্থাৎ, কোয়ান্টাম জগতের সব অনিশ্চয়তা ঝেড়ে ফেলে একটা নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট ধর্মই তখন পর্যবেক্ষণ করেন বিজ্ঞানীরা। শুরুতেই বলেছিলাম, কোয়ান্টাম জগৎ অনিশ্চয়তায় ভরা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যখনই কণার বিভিন্ন দশার মধ্যে ডিকোহেরেন্সের জন্ম হয় এবং তরঙ্গ ফাংশন ভেঙে পড়ে, তখনই কণার একটি নির্দিষ্ট অবস্থা বা চরিত্র নিশ্চিত হয়ে যায়।

এখন প্রশ্ন হলো, কখন ডিকোহেরেন্সের জন্ম হয়? ধরা যাক, একটি কণা সুপারপজিশনে আছে, অর্থাৎ এটি তার সব সম্ভাব্য অবস্থায় একই সঙ্গে বিরাজ করছে। এখন আপনি কণাটির একটি নির্দিষ্ট অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে চান। এর জন্য একটি ডিটেক্টর দিয়ে সেটিকে পরিমাপ করার চেষ্টা করলেন। তখনই কণার ওয়েভ ফাংশন ভেঙে পড়বে এবং আপনি তাকে শুধু একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় দেখতে পাবেন। অর্থাৎ, পরিমাপের ফলে কণাটি ডিকোহেরেন্সের শিকার হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কণাটি কেন ডিকোহেরেন্ট হলো?

আইনস্টাইনের প্রশ্ন ছিল ঠিক এখানেই। তিনি এই ব্যাপারগুলো মানতে পারেননি। এমনকি ওয়েভ ফাংশনের জনক আরউইন শ্রোডিঙ্গারও আইনস্টাইনের সঙ্গে একমত হয়ে তাঁর বিখ্যাত ‘শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল’ নামে থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষার অবতারণা করেন।এই পরীক্ষায় বাক্স খোলার আগ পর্যন্ত এর ভেতরে থাকা বিড়ালটি জীবিত না মৃত, তা বলার কোনো উপায় থাকে না। এটি একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত উভয় দশাতেই থাকে। কিন্তু বাক্স খোলার সঙ্গে সঙ্গেই বিড়ালটি ডিকোহেরেন্সের শিকার হয় এবং তার জীবিত-মৃতের সুপারপজিশন ভেঙে পড়ে। অর্থাৎ, পর্যবেক্ষকের পরিমাপের ওপরই নির্ভর করে একটি কোয়ান্টাম কণাকে কোন অবস্থায় পাওয়া যাবে। তার আগ পর্যন্ত সে সুপারপজিশনে থাকবে। এ কথা শুনে আইনস্টাইন ভীষণ চটে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি না, তখন কি সেখানে চাঁদটা থাকে না?’ চাঁদ এখানে উপমামাত্র। চাঁদ কিংবা বিড়ালের মতো বড় জিনিসের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কাজ করে না। কিন্তু কণাদের জগতে এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা অহরহ ঘটে।

আরও পড়ুন
ডিকোহেরেন্স নিয়ে আরও বিস্তারিত কাজ করেন পোলিশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী ভয়েচেক সুরেক, বিশেষ করে ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে।

তিন.

আগে বিজ্ঞানীরা মূলত অনিশ্চয়তা, তরঙ্গ ফাংশন আর সুপারপজিশন নিয়েই আলোচনা করতেন। তবে ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করেন কোহেরেন্স ও ডিকোহেরেন্সের নিয়ে। ১৯৭০ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এইচ. ডিটার তাত্ত্বিকভাবে দেখান, একটি কোয়ান্টাম সিস্টেম যখন তার পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে, তখন তার সুপারপজিশন ভেঙে যায়। কোয়ান্টাম কণার একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বাকি ধর্মগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, কণাদের অনিশ্চিত জগৎকে বাস্তবতায় রূপ দেয় ডিকোহেরেন্স।

ডিকোহেরেন্স নিয়ে আরও বিস্তারিত কাজ করেন পোলিশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী ভয়েচেক সুরেক, বিশেষ করে ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে। তিনি দেখান, ডিকোহেরেন্স প্রকৃতির এক অদৃশ্য ছাঁকনি, যা নির্ধারণ করে দেয়, কোন অবস্থাটি টিকে থাকবে এবং কোনগুলো হারিয়ে যাবে। সমস্যা হলো, ডিকোহেরেন্স তত্ত্বটি একটি প্যারাডক্সের জন্ম দেয়। ডিকোহেরেন্স ব্যাখ্যা করে, কীভাবে একটি নির্দিষ্ট অবস্থা বাস্তবে রূপ নেয়। কিন্তু ঠিক কোন অবস্থাটি নির্বাচিত হবে এবং অন্যগুলো কেন হারিয়ে যাবে, তা এই তত্ত্ব বলতে পারে না। একে বলে ‘পরিমাপ সমস্যা’। ফলে কোয়ান্টাম ডিকোহেরেন্সের প্যারাডক্সিক্যাল আচরণ এখানেই শেষ নয়।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনিশ্চয়তায় পূর্ণ, কিন্তু ডিকোহেরেন্স এসে একে একটি নিশ্চিত রূপ দেয়। সুতরাং, এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ডিকোহেরেন্স তত্ত্ব হয়তো অনিশ্চয়তাকেই বাতিল করে দেয়। কিন্তু আসলে তা নয়। এটি বরং অনিশ্চয়তা থেকেই জন্ম নেওয়া একটি ছাঁকন প্রক্রিয়া, যা কোয়ান্টাম জগৎ ও চিরায়ত জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান

আরও পড়ুন