তাপ ও তাপমাত্রা এক নয়; তাহলে তাপমাত্রা কী

তাপ আর তাপমাত্রা এক নয়। অনেকে ভাবেন, তাপমাত্রা মানে তাপের পরিমাপ। এটাও ঠিক নয়। তাহলে তাপমাত্রা আসলে কী? আমরা যখন থার্মোমিটার দিয়ে মাপি, কী মাপি?

কোনো বস্তুর মধ্যে অণুরা ছোটাছুটি, ধাক্কাধাক্কি করে। ফলে যে শক্তির জন্ম হয়, তা-ই তাপ। কিন্তু তাপ আর তাপমাত্রা এক নয়। পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে যে ছোটাছুটি হয়, কিংবা ধাক্কাধাক্কি, এর মানে হলো অণুগুলো গতিশীল। কিন্তু কার গতি কত, সেটা মাপা দুঃসাধ্য। একে তো খুব ছোট কণা। তার ওপর তাদের অবস্থান—কেউ খুব সামান্য একটু পথ পড়ি দিয়ে হয়তো ধাক্কা খাচ্ছে আরেকটা অণুর সঙ্গে, কেউ বা পাড়ি দিচ্ছে অনেকখানি পথ। এলোমেলো অবস্থা।

একটা পাত্রে খানিকটা তরল বা বায়বীয় পদার্থ নিন। তাতে অণুর পরিমাণ কত, বলতে পারবেন? আসলে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অণু আছে এর ভেতরে। প্রতিটা অণুর গতি আলাদা করে বের করা অসম্ভব। তাই বলে কি ওই পাত্রে তরল বা বায়বীয় পদার্থের অণুদের অবস্থা, ধর্ম ইত্যাদি জানতে পারব না? নিশ্চয়ই পারব। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দির্ষ্ট একটা বস্তুর মধ্যে কতগুলো অণু আছে, তার হিসাব বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই কষে ফেলেছেন। বিশেষ করে ফরাসী বিজ্ঞানী অ্যামাদিও অ্যাভোগেড্রোর প্রকল্প থেকে সেটা জানা যায়। অ্যাভোগেড্রোর প্রকল্পে দেখানো হয়েছিল, কোনো একটা বস্তুর ১ মোলে পরমাণুর সংখ্যা সব বস্তুর ক্ষেত্রেই সমান। সেটা হলো 6.02214076×1023। তার মানে, এক মোল বস্তুতে ৬,০২,২১,৪০,৭৬,০০,০০,০০, ০০,০০,০০,০০০টি অণু বা পরমাণু থাকে।

খুব সামান্য একটা জায়গায় এত কণা থাকলে সেখানে কণাদের ভেতর ধাক্কাধাক্কি হবেই। ফলে কণারা গতিশীল হবে, কিন্তু এই গতি কোনো একটা নির্দিষ্ট দিকে হবে কি না, তা বলা মুশকিল। ধরা যাকা, ঢাকার গুলিস্তান। এখানে বিকেলে প্রচণ্ড ভিড় হয়। এই ভিড়ে কোনো একটা সোজা পথে চলা কঠিন। ধরা যাক, সায়েম নামে এক ছেলে সেই ভিড়ের মধ্যে হাঁটছে। দুই পা হাঁটার পর সামনের একটা লোকের সঙ্গে মৃদু ধাক্বা খেল সে। ফলে সে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে ডান দিকে দুই পা সরে যায়। কিন্তু সেদিকেও সোজাসুজি যাওয়ার উপায় নেই। আরেকটা লোক তার মুখোমুখি পড়ে। তখন সায়েম আবার ডান দিকে কিছুটা সরে যায়। আবার চার পা হাঁটার পর আরেকজনের মুখেমুখি হয়। তখন সায়েম খেয়াল করে, ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকে যাওয়ার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে পিছিয়ে যায় তিন পা। কিন্ত সেদিকেও তিন পা হাঁটার পর আরেকজনের সঙ্গে ধাক্কা খায়। তখন সায়েম বাঁ দিকে ঘুরে ছয় পা এগোয়। এভাবে গোটা বিকেল আর সন্ধ্যা হেঁটেও সায়েম গুলিস্তানের মোড় থেকে বেরোতে পারে না কিছুতেই। 

গ্যালিলিও থার্মোস্কোপ ব্যবহার করে তাপমাত্রা মাপতে সক্ষম হন ১৫৯২ সালে। এরপর ১৭১৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট এবং ১৭৪২ সালে সুইডিশ বিজ্ঞানী অ্যান্ডারস সেলসিয়াস আধুনিক থার্মোমিটার উদ্ভাবন করেন।

সায়েমের মোবাইল ফোনে জগিং অ্যাপ আছে, সেটা দেখে অবাক হয়। চার ঘণ্টা ধরে এক পা-দুই পা করে হেঁটেই সে ১৪ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছে। কিন্তু মাত্র ২০০ মিটার ব্যাসের এতটুকু এলাকায় ১৪ কিলোমিটার পথ কীভাবে পাড়ি দিল সে? রাস্তায় যদি অত মানুষের মধ্যে ধাক্বা না খেত, তাহলে হয়তো সায়েম এতক্ষণে গুলিস্তান থেকে গাবতলী বাস টার্মিনালে পৌঁছে যেত।

সায়েমের কাছে না হয় স্মার্টফোনের জগিং অ্যাপ ছিল, তাই সে বুঝতে পেরেছে কত কিলোমিটার হেঁটেছে। কিন্তু অন্যরা এই ব্যাপারটা খেয়ালই করেনি। ভিড়ের মধ্যে শুধু ঘুরেই মরেছে। তাই তাদের গতি আমাদের অজানা।

আরও পড়ুন

২.

ধরা যাক, বিজ্ঞানী মকবুল হক গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে লোকজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন। ধরা যাক, ওই চার ঘণ্টায় গুলিস্তানে ১০ লাখ লোক জড়ো হয়েছিল। এত লোক, কে কত পা হাঁটল, কার কতটুকু গতি ছিল, তার হিসাব রাখা কি মকবুল সাহেবের পক্ষে সম্ভব?

সম্ভব কি অসম্ভব, সেটা একটু পরে বলি। এখন ধরা যাক, আপনার কাছে গুলিস্তানের বদলে একটা বদ্ধ পাত্র আছে, এক লিটার আয়তনের। সেই পাত্রে আছে গ্যাসীয় পদার্থ। তাতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরিমাণ মোল আছে। আবার প্রতিটা মোলে ৬,০২,২১,৪০,৭৬,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০০টি করে অণু আছে। তাহলে মোট কত অণু আছে সেই পাত্রে, ভাবা যায়! প্রতিটা অণুই ছুটছে, আর একে-অপরের সঙ্গে ধাক্বা খাচ্ছে। আবার ধাক্কা খাচ্ছে পাত্রের দেয়ালের গায়েও। পাত্রটা আবদ্ধ, তাই অণুগুলো ধাক্কা খেয়ে বেরোতেও পারছে না। পুরোপুরি গুলিস্তানের মোড়ের মতো অবস্থা।

ওই পাত্রের অণুগুলোর বেগ কি বের করা সম্ভব? 

কঠিন, ভয়ানক কঠিন। তারচেয়ে বরং অণুগুলোর গড় বেগ বের করার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটাও আসলে ভয়ানক কঠিন। কিন্তু একটা ব্যাপার বরং সহজ। সেটা হলো শক্তি। অণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে শক্তি। তাপশক্তি। যে অণুর বেগ যত বেশি, সেই অণুর ধাক্কায় তত শক্তি উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ তাপ উৎপন্ন হয়। এই শক্তির গড় মান হলো তাপমাত্রা। অর্থাৎ অণুগলোর গতিশক্তির গড় মানকেই বলে তাপমাত্রা।

কিন্তু কথা হলো, আজ থেকে ৪৩৩ বছর আগে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এই গড় মান বের করার পদ্ধতি কীভাবে আবিষ্কার করলেন? 

গ্যালিলিও থার্মোস্কোপ ব্যবহার করে তাপমাত্রা মাপতে সক্ষম হন ১৫৯২ সালে। এরপর ১৭১৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট এবং ১৭৪২ সালে সুইডিশ বিজ্ঞানী অ্যান্ডারস সেলসিয়াস আধুনিক থার্মোমিটার উদ্ভাবন করেন।

তবে এসব ইতিহাসের দিকে না তাকিয়ে, আমরা বরং সহজভাবে তাপমাত্রা মাপার ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। এ জন্য আবার আমরা ফিরে যাব গুলিস্তানের মোড়ে। সেখানে আছেন আমাদের বিজ্ঞানী মকবুল হক। এখন তিনি জানেন কত লোক আছে ওখানে। তবে কার কত গতি, সেটা জানেন না।

অণুদের পা নেই, তাদের জুতা পরানোও অসম্ভব। তাই বেলুন ওড়ানোর প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানেন, ঠিক কতগুলো অণু সেখানে আছে। আসলে গ্যাসের ঘনত্ব জানতে পারলেই আপনি জানতে পারবেন, ঠিক নির্দিষ্ট একটা জায়গায় কী পরিমাণ অণু আছে।

ধরা যাক, আজ তিনি খুব ভোরে গুলিস্তানের মোড়ে এসেছেন। কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্যে ওখানে যত লোক এসেছে, সবাইকে একজোড়া করে বিশেষ জুতা পরিয়ে দিয়েছেন। সেই জুতার সোলের ভেতরে আছে ছোট্ট একটা জেনারেটর, একটা ছোট্ট গ্যাস চেম্বার। আর আছে ২০টা করে বেলুন। লোকগুলো যখন হাঁটছে, প্রতি পদক্ষেপে শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। সেই শক্তি জেনারেটরকে সচল করছে। ফলে জেনারেটর বিদুৎ উৎপাদন করছে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্যাস চেম্বারের মুখ খুলে দিচ্ছে। ফলে গ্যাস গিয়ে জমা হচ্ছে বেলুনে। ধরা যাক, প্রতি ১ কিলোমিটার হাঁটার পর একটা বেলুন পুরোপুরি গ্যাসে ভর্তি হয়ে যায়। তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই ছোট্ট বেলুন জুতা থেকে ছুটে আকাশে উড়াল দেয়।

ধরা যাক, আকাশে কিছু ড্রোন চালু করা আছে। সেগুলোর কাজ হলো, যে কটা বেলুন আকাশে উড়ছে, তার হিসাব রাখা। প্রতিটা বেলুনে ছোট্ট একটা চিপ বসানো আছে। সেই চিপে প্রতিটা বেলুনের মালিকের নাম লেখা আছে। বেলুনটা আকাশে উড়লেই ড্রোন সেটা পড়তে পারে।

আরও পড়ুন

ড্রোনের সঙ্গে একটা কম্পিউটারের সংযোগ দিয়ে রেখেছেন মকবুল হক। তথ্য পাওয়া মাত্রই সেটা কম্পিউটারে চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর তিনি কম্পিউটারে ফলাফল দেখলেন। দেখলেন, মোট লোক ছিল আজ ১০ লাখ। মোট বেলুন উড়েছে ৯০ লাখ। প্রতি ১ কিলোমিটার হাঁটলে একটা করে বেলুন ওড়ে। অর্থাৎ গড়ে একেকজন ৯টি করে বেলুন উড়িয়েছেন। অর্থাৎ একেকজন ৯ কিলোমিটার করে হেঁটেছেন। সবাই তো একই গতিতে হাঁটতে পারে না। কিন্তু কম্পিউটারে সব হিসাব আছে। তিনি দেখলেন, ৭৮০ জন লোক ২০টা করে বেলুন উড়িয়েছে। তারচেয়ে বেশি আর কেউ পারেনি। সবচেয়ে কম অন্তত ২ হাজার জন। তাদের একজনও একটা করে বেলুন ওড়াতে পারেননি। 

এখানে প্রতিটা বেলুনকে আমরা একটা লোকের গতিশক্তি হিসেবে ধরতে পারি। যারা ২০টা করে বেলুন উড়িয়েছেন, তাদের গতিশক্তি ২০। আর যারা ৫টা উড়িয়েছেন, তাদের ৫। অর্থাৎ যে যতটা বেলুন উড়িয়েছেন, তিনি তত গতিশক্তি উৎপন্ন করেছেন। আর সবার গতিশক্তির গড় করলে সেটা হবে ৯। 

এখন ধরা যাক, গুলিস্তানের বদলে একটা ছোট্ট শিশি আছে। তার ভেতর আছে একটা গ্যাস। তাতে ১০ লাখ অণু আছে। আর সেই অণুগুলোর গড় গতিশক্তি ৯। অর্থাৎ সেই গ্যাসের তাপমাত্রা সেলসিয়াস স্কেলে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

৩.

অণুদের পা নেই, তাদের জুতা পরানোও অসম্ভব। তাই বেলুন ওড়ানোর প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানেন, ঠিক কতগুলো অণু সেখানে আছে। আসলে গ্যাসের ঘনত্ব জানতে পারলেই আপনি জানতে পারবেন, ঠিক নির্দিষ্ট একটা জায়গায় কী পরিমাণ অণু আছে। এবার আপনি সেই শিশি-বোতলে তাপ প্রয়োগ করলেন, অণুরা ছোটাছুটি করল, গতিশীল হলো, গতিশক্তি উৎপন্ন করল। সেই গতিশক্তির গড় মান আপনি বের করতে পারবেন। সেটা কীভাবে?

আপনার আরেক বন্ধুর থার্মোমিটার আছে। সেটা আপনাদের দুজনার কারও সঙ্গে মেলে না। তার সেই থার্মোমিটারটা আপনার ওই শিশিতে রেখে দেখলেন, পারদের উচ্চতা গিয়ে ঠেকেছে ১২২-এর ঘরে।

আপনি জানেন, তাপ প্রয়োগ করলে বস্তু প্রসারিত হয়। সুতরাং আপনি একটা কাচের নলের ভেতর পারদ ঢুকিয়ে নলটার মুখ ভালো করে এঁটে দিলেন। এরপর আপনি কাচের নলে কিছু দূর পর পর দাগ কাটলেন। এবার সেই নলটার নিচের প্রান্ত আপনি ধরলেন ওই গ্যাসের শিশিতে। দেখলেন, কাচের নলের ভেতরে থাকা পারদ প্রসারিত হচ্ছে। এবং দ্রুত ওপর দিকে উঠছে। আপনি দেখলেন, ৫০তম দাগ ছুঁয়েছে পারদের মাথাটা। তারপর থেমে গেছে। আপনি প্রতিটা দাগ দিয়ে গতিশক্তি পরিমাপ করলেন। প্রতিটা দাগের মান দিলেন ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাহলে ওই শিশিতে থাকা গ্যাসের অণুগুলোর গড় গতিশক্তি পেলেন ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটাই আসলে শিশির ভেতরে থাকা গ্যাসের তাপমাত্রা। আর কাচের ওই নলটার নাম থার্মোমিটার।

আপনি যখন এই পরীক্ষা করছেন, তখন আপনার বন্ধুও হয়তো একই পরীক্ষার জন্য একটা থার্মোমিটার তৈরি করেছেন। তিনিও একটা কাচের নলের ভেতর পারদ রেখে সমান দূরত্বে কিছু দাগ কাটলেন। কিন্তু তার দাগগুলো একটু অন্যভাবে কাটা। দাগগুলোর দূরত্বও আপনার সঙ্গে মেলে না। তার দাগগুলো আরও অন্যরকম। তার থার্মোমিটার ধরলেন আপনার শিশিতে, দেখলেন পারদের উচ্চতা ৩২৩-এর ঘরে গিয়ে ঠেকেছে। তিনি অবশ্য প্রতিটা ঘরের সঙ্গে ডিগ্রি জোড়েননি। তিনি বলছেন, আপনার গ্যাসের তাপমাত্রা ৩২৩ কেলভিন। 

আপনার আরেক বন্ধুর থার্মোমিটার আছে। সেটা আপনাদের দুজনার কারও সঙ্গে মেলে না। তার সেই থার্মোমিটারটা আপনার ওই শিশিতে রেখে দেখলেন, পারদের উচ্চতা গিয়ে ঠেকেছে ১২২-এর ঘরে। তিনি বললেন, এই শিশির তাপমাত্রা ১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। 

আপনারা তিনজন তিনটি থার্মোমিটার দিয়ে যে তাপমাত্রা মাপলেন, তিনটির মান আলাদা এলো। আসলে কিন্তু সমান। পার্থক্য ওই দাগ কাটায় আর কিছু হিসেব-নিকেষে। সেই হিসেব-নিকেষ আরেকদিন করা যাবে। আজকের শেষ কথা হলো, থার্মোমিটারের দাগ মেপে যে তাপমাত্রা পেলেন, তা আসলে অণুদের গড় গতিশক্তি।

আরও পড়ুন