মহাজাগতিক রশ্মির খোঁজে

কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটের দেখা পাওয়া বিজ্ঞানজগতে বিরল নয়। কণাপদার্থবিজ্ঞানে এ ঘটনা বরং আরও বেশি। বেশির ভাগ খুদে কণাই সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে আয়োজিত পরীক্ষায় নিজেদের উপস্থিতি জানিয়েছে। মহাজাগতিক রশ্মি আর এর কণাগুলো আবিষ্কারের প্রতিটি কাহিনি প্রায় এ রকম।

১৯১১ সাল। অস্ট্রিয়ান-মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর হেস একটা পরীক্ষা চালান। একটা বেলুন উড়িয়েছিলেন মহাকাশে, বায়ুমণ্ডলের ওপর দিকে। সেই বেলুনের সঙ্গে একটা গোল্ডলিফ ইলেকট্রোস্কোপ, যাকে বাংলায় স্বর্ণপাত তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্র বলে। এই যন্ত্রের সাহায্যে চার্জযুক্ত কণাগুলোকে শনাক্ত করা যায়। আসলে তিনি যন্ত্রটিকে আকাশে পাঠিয়েছিলেন মাটির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। কেন?

তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কোনো গ্যাসে চার্জিত কণাগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। গ্যাসটিকে এই যন্ত্রের ভেতর ঢোকালে সমধর্মী কণাগুলো এর ভেতরে পরস্পরের সমান্তরালে রাখা ধাতব পাতে এসে জড়ো হয়। পাত দুটির মধ্যে তখন বৈদ্যুতিক বিকর্ষণী বলের প্রভাব কার্যকর হয়। ফলে পাত দুটির মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। ক্রমাগত চার্জ জমা হওয়ায় একসময় এগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক বিকর্ষণ বল বাড়তে থাকে। ফলে একসময় এগুলোর মধ্যে দূরত্ব এতটাই বেড়ে যায় যে এগুলোর অবস্থান তখন ইংরেজি V বর্ণের রূপ নেয়। যতক্ষণ চার্জিত কণাগুলোর উপস্থিতি থাকে পাত দুটিতে, ততক্ষণ এগুলোর অবস্থান V-এর মতো থাকে।

তেজস্ক্রিয় রশ্মির ভেদনক্ষমতা এতটাই বেশি, চাইলেই ভূপৃষ্ঠ সেগুলোকে আটকে রাখতে পারে না। মাটি ভেদ করে, গবেষণাগারের দেয়াল পেরিয়ে আছড়ে পড়ে তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রের ধাতব পাতে।

কতক্ষণ চার্জের উপস্থিতি থাকবে এতে? যতক্ষণ না বিপরীত চার্জের কোনো কণা এর ভেতরে এসে পড়ে, ততক্ষণ। কিন্তু আশপাশে যদি তেজস্ক্রিয় বস্তু থাকে, তাহলে তেজস্ক্রিয় রশ্মি থেকে আসা বিপরীত চার্জের কণাগুলোর প্রভাবে পাত দুটির মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। ফলে চার্জ প্রশমিত হতে থাকে পাত থেকে। সঙ্গে বিকর্ষণও কমতে থাকে পাল্লা দিয়ে। একসময় সম্পূর্ণ চার্জশূন্য হয় পাত দুটি, আবার পরস্পর কাছাকাছি চলে আসে এবং সমান্তরালে অবস্থান করে।

আরও পড়ুন

তেজস্ক্রিয় বস্তু আশপাশে থাকলে এমনটা হওয়ার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখলেন, তেজস্ক্রিয় বস্তু আশপাশে না থাকলেও এমনটা হচ্ছে। কেন? এর ব্যাখ্যা পেতে বিজ্ঞানীদের সময় লাগেনি। যেকোনো পরীক্ষাগার তো মাটির ওপরেই থাকে। মাটির থেকে কতটুকুই–বা ব্যবধান। মাটির অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় মৌলের অভাব নেই। সেগুলো ক্রমাগত তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে যাচ্ছে। আর তেজস্ক্রিয় রশ্মির ভেদনক্ষমতা এতটাই বেশি, চাইলেই ভূপৃষ্ঠ সেগুলোকে আটকে রাখতে পারে না। মাটি ভেদ করে, গবেষণাগারের দেয়াল পেরিয়ে আছড়ে পড়ে তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রের ধাতব পাতে। তখন বিপরীতধর্মী চার্জের সংস্পর্শে পাত দুটির চার্জ প্রশমিত হয়। তবে এই প্রশমন খুব দ্রুত হয় না। চার্জ প্রশমিত হওয়ার আগে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণের জন্য মোটামুটি সময় পান। কারণ, ভূপৃষ্ঠ ভেদ করে আসা তেজস্ক্রিয় রশ্মির পরিমাণ এত বেশি নয়। কিন্তু কিছু কিছু পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞানীদের আরেকটু বেশি সময়ের প্রয়োজন। সেই সময়টুকু তাঁরা পাচ্ছিলেন না।

স্বর্ণপাত তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্র
ছবি: উইকিমিডিয়া

বিজ্ঞানীরা তখন নানা রকম চেষ্টা করলেন চার্জ প্রশমনে বাধা দেওয়ার। এ জন্য বাতাসের আর্দ্রতা বেশি যে অঞ্চলে, সেখানে নিয়ে গিয়ে দেখলেন। কাজ হলো না, জলীয় বাষ্প বাধা দিতে পারল না তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে। তারপর একটা সিসার পাতে মোড়ানো বাক্সে তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রটিকে স্থাপন করলেন। তাতে প্রশমনের হার কমানো সম্ভব হলো। কিন্তু একেবারে বন্ধ করা গেল না। তখন ভিক্টর হেস সেই বেলুন পরীক্ষার আশ্রয় নেন। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার ওপরে বেলুনের সঙ্গে স্বর্ণপাতটি স্থাপন করেন। তাঁর ধারণা ছিল, মাটি থেকে অনেক ওপরে থাকবে বেলুন, তাই স্বর্ণপাত দুটিতে অত সহজে চার্জ প্রশমিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু এই পরীক্ষার ফল হলো উল্টো।

শুধু তত্ত্ব দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি কম্পটন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অক্ষাংশ প্রভাব পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন, তাঁর অনুমানই ঠিক, বিষুবীয় অঞ্চলে অক্ষাংশ প্রভাব সবচেয়ে কম।

হেস লক্ষ করলেন, মহাকাশে গিয়ে স্বর্ণপাতে চার্জ প্রশমিত হওয়ার হার তো কমছে না; বরং উল্টো উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চার্জ প্রশমনের হার বাড়ছে। কেন? তখন হেসকে অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হলো। তিনি ধরে নিলেন, নিশ্চয়ই মহাকাশে তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতো চার্জযুক্ত কণাদের স্রোত আছে এবং সেগুলো নিয়মিত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ছে। সেগুলোর সংখ্যা ও ভেদনক্ষমতা অনেক বেশি। তাই দ্রুত স্বর্ণপাতে ঢুকে এর চার্জ প্রশমিত করে দিচ্ছে। হেসের এই অনুমান ঠিক ছিল। তাই ১৯৩৬ সালে কার্ল অ্যান্ডারসনকে পজিট্রন আবিষ্কারের জন্য যখন নোবেল দেওয়া হয়, যৌথভাবে সেই পুরস্কারের ভাগ পেয়েছিলেন হেস। কারণ, অ্যান্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করেছিলেন মহাজাগতিক রশ্মির তত্ত্ব–তালাশ করেই। তাই পজিট্রন আবিষ্কারের মাধ্যমেই প্রথমবার মহাজাগতিক রশ্মির অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।

দুই

হেসের পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, মহাকাশে চার্জিত কণা আছে যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু এই কণার জন্ম কীভাবে হচ্ছে? এগুলোর অন্যান্য বৈশিষ্ট্যই–বা কেমন?

কার্ল অ্যান্ডারসন

কণাপদার্থবিজ্ঞানের তখন রমরমা যুগ। তা সত্ত্বেও মহাকাশের ওই সব রহস্যময় কণা নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি হয়নি। কিন্তু ১৯২০–এর দশকের মাঝামাঝিতে নানা ক্ষেত্রেই ওই কণাগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯২৫ সালে রবার্ট অ্যান্ড্রুজ মিলিকান একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। মহাকাশে চার্জিত যেসব কণার প্রভাব দেখা যাচ্ছে, এগুলো আসলে কণা নয়, একধরনের বিকিরণ রশ্মি। মিলিকান আরও বললেন, এই বিকিরণ আসলে মাইক্রোওয়েভ, অর্থাৎ ক্ষুদ্র তরঙ্গ। এগুলোর ভেদনক্ষমতা গামা রশ্মির চেয়েও বেশি। ফলে এগুলো আরও শক্তিশালী। কিন্তু এগুলোর জন্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেননি মিলিকান। তবে তিনিই এই বিকিরণের নাম দিয়েছিলেন কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি।

আরও পড়ুন

মিলিকানের সঙ্গে একমত হতে পারেননি আরেক মার্কিন কণাপদার্থবিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন। কম্পটন ইফেক্টের জনক তিনি। সুতরাং তাঁর কথাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, মহাজাগতিক রশ্মি আসলে স্রেফ আলোকরশ্মি নয়, চার্জিত সব কণার স্রোত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আর জার্মান বিজ্ঞানীদের মধ্যে—ক্যাথোড রশ্মি আলোকতরঙ্গ, নাকি বস্তুকণার স্রোত, সে ধরনের একটা পরিস্থিতিই তৈরি হলো কম্পটনের এই মন্তব্যের মাধ্যমে। মহাজাগতিক রশ্মি আসলে বস্তুকণা, না আলোকতরঙ্গ? কিন্তু এই বিতর্ক আগেরটার মতো ডালপালা ছড়াতে পারেনি। কারণ, কম্পটন নিজেই নিজের তত্ত্বের প্রমাণ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, অতিপারমাণবিক কণাগুলোর গতিশক্তি যদি খুব বেশি হয়, তাহলে এগুলোর ভেদনক্ষমতা গামা রশ্মির চেয়েও বেশি হতে পারে। তা ছাড়া কণা হওয়ার পক্ষে শক্ত যুক্তি হলো, মহাজাগতিক রশ্মি চার্জযুক্ত। কারণ, স্বর্ণপাতের চার্জ প্রশমন করে একে নিস্তড়িৎ করে দিতে পারে এই রশ্মি। কিন্তু গামা রশ্মির মতো বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ হলে এগুলোকে চার্জ নিরপেক্ষ হতে হবে। কিন্তু স্বর্ণপাত পরীক্ষা তা বলছে না। তবু যদি কিছু ভুলচুক থাকে, তাহলে সেটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। অন্যদিকে ১৯২৯ সালে দুই জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ালথার বোথে ও ওয়ার্নার কোলহোর্স্টার দেখালেন, গামা রশ্মির পক্ষে ৪ দশমিক ১ সেন্টিমিটার স্বর্ণপাত ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। আলোকতরঙ্গ, অর্থাৎ ফোটনের যে শক্তি, তার পক্ষে এটা সম্ভব নয়।

১৯৩০ ও ’৪০–এর দশকে সারা বিশ্বে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে অনেক গবেষণা চলল। নানা রকম তথ্য হাতে জমা পড়তে শুরু করল বিজ্ঞানীদের। প্রমাণিত হলো কসমিক রশ্মির ৯০ শতাংশ আসলে প্রোটন, অর্থাৎ হাইড্রোজেন কণা দিয়ে তৈরি।

কম্পটন বললেন, মহাজাগতিক রশ্মি মিলিকানের ধারণামতো যদি সত্যিই চার্জনিরপেক্ষ হয়, তাহলে এগুলো পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হবে না। পৃথিবীর সবদিক থেকে এগুলোর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের হার সমান হবে। আর যদি এগুলো চার্জযুক্ত বস্তুকণা হয়, তাহলে এই হার সমান হবে না। এগুলোর ওপর প্রভাব ফেলবে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র। এগুলোর গতিপথকে বিচ্যুত করে ফেলবে। তাই সব অঞ্চলে এগুলোকে সমানভাবে পাওয়া যাবে না। মেরু অঞ্চলে এগুলোর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যাবে। বিষুবীয় অঞ্চলে ঘনত্ব হবে সবচেয়ে কম। এই তত্ত্বের নাম দেওয়া হলো ল্যাটিচিউড ইফেক্ট বা অক্ষাংশ প্রভাব।

শুধু তত্ত্ব দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি কম্পটন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অক্ষাংশ প্রভাব পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন, তাঁর অনুমানই ঠিক, বিষুবীয় অঞ্চলে অক্ষাংশ প্রভাব সবচেয়ে কম। বিষুবরেখা থেকে যত উত্তর বা দক্ষিণে গেলেন, মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব তত বেশি পেলেন।

আর্থার কম্পটন

কম্পটনের এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত হলেন ইতালিয়ান বিজ্ঞানী ব্রুনো বেনেদেতো রসি। ১৯৩০ সালে তিনি একটা হিসাব খাড়া করলেন। মহাজাগতিক রশ্মির গতিপথের দিক ঠিক করে দিলেন গণিতের ছাঁচে ফেলে। বিদ্যুৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্র পরস্পরের ওপর লম্বভাবে ক্রিয়া করে। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ক্রিয়াশীল। তাই বাইরে থেকে যদি কোনো বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কণাকে আসতে হয় পৃথিবীতে, তাহলে একে ঢুকতে হবে পূর্ব অথবা পশ্চিম দিক থেকে। রসি হিসাব কষে দেখিয়ে দিলেন, যদি মহাজাগতিক রশ্মি ধনাত্মক চার্জযুক্ত হয়, তাহলে সেগুলো পৃথিবীতে ঢুকবে পশ্চিম দিক থেকে। কিন্তু এর চার্জ যদি ঋণাত্মক হয়, তাহলে পূর্ব দিক থেকে পৃথিবীতে ঢুকবে।

আরও পড়ুন

রসির এই তত্ত্বের প্রমাণ মিলল অচিরেই। ১৯৩৫ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস হোপ পরীক্ষা করে দেখালেন, মহাজাগতিক রশ্মি পশ্চিম দিক থেকেই পৃথিবীতে প্রবেশ করে। তার মানে এগুলো ধনাত্মক চার্জের কণা।

তিন

হোপ দেখিয়েছিলেন, মহাজাগতিক রশ্মি ধনাত্মক কণার স্রোত। কিন্তু এই কণাগুলো আসলে কী? একসময় ক্যাথোড রশ্মি পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল, সেগুলো ইলেকট্রনের স্রোত। আলফা রশ্মি ছিল আলফা কণা, অর্থাৎ হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। তারপর দেখা গেল, বেটা রশ্মিও ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি। কিন্তু এতে সামান্য অ্যান্টিনিউট্রিনোও থাকে। তাহলে মহাজাগতিক রশ্মি কী দিয়ে তৈরি?

রবার্ট মিলিকান

১৯৩০ ও ’৪০–এর দশকে সারা বিশ্বে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে অনেক গবেষণা চলল। নানা রকম তথ্য হাতে জমা পড়তে শুরু করল বিজ্ঞানীদের। প্রমাণিত হলো কসমিক রশ্মির ৯০ শতাংশ আসলে প্রোটন, অর্থাৎ হাইড্রোজেন কণা দিয়ে তৈরি। ১৯৪০–এর দশকের শেষ দিকে এসে আরও অনেক কণার হদিস মিলল মহাজাগতিক রশ্মিতে। পাওয়া গেল আলফা কণা, অর্থাৎ হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। এ ছাড়া খুব সামান্য পরিমাণ কার্বন, লোহা ও সিসার নিউক্লিয়াসও পাওয়া গেল। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেল, বায়ুমণ্ডলের ওপরের মহাজাগতিক রশ্মি আর পৃথিবীতে পৌঁছানো মহাজাগতিক রশ্মির পার্থক্য আছে। বায়ুমণ্ডলে গ্যাসের পরমাণুতে সংঘর্ষের পর মহাজাগতিক রশ্মিতে যেমন ভাঙন ধরে, তেমন ভাঙন ধরে বায়ুমণ্ডলের গ্যাসের নিউক্লিয়াসে। তৈরি হয় ছোট ছোট অনেক কণা, মিউয়ন, ফোটন। এসবের মিশেলেই আসলে মহাজাগতিক রশ্মি তৈরি হয়।

শুধু সূর্যই নয়, মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রই এ ধরনের মহাজাগতিক রশ্মির উৎস হতে পারে। তবে অন্য নক্ষত্র থেকে মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারে না দূরত্বের কারণে।

চার

বায়ুমণ্ডলের ওপরে যে মহাজাগতিক রশ্মি, সেগুলো কোত্থেকে এল?

পৃথিবীতে যেসব মহাজাগতিক রশ্মি এসে পড়ে, এগুলোর মূল উৎস সূর্য। সূর্যের ভেতরে যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সংঘটিত হয়, সেখান থেকেই চার্জিত কণাগুলো দ্রুতবেগে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলোর একটা অংশের ভাগ পায় পৃথিবী। প্রবল বেগে ছুটে আসা সেসব কণা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। এর ফলে একটা তীব্র চৌম্বক ক্রিয়ার জন্ম হয়। তাতে কণাগুলোর শক্তি আরও প্রবল হয়ে পড়ে। ফলে কণাগুলোর বেগ আরও বেড়ে যায়। আলোর বেগের কাছাকাছি উঠে যায় এগুলোর বেগ। এই আলোড়নের ফলে জন্ম হয় সৌরবায়ুর। মেরু অঞ্চলে যে মেরুপ্রভা দেখা যায়, তারও মূল কারিগর মহাজাগতিক রশ্মি।

শুধু সূর্যই নয়, মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রই এ ধরনের মহাজাগতিক রশ্মির উৎস হতে পারে। তবে অন্য নক্ষত্র থেকে মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারে না দূরত্বের কারণে। এত দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার বহু আগেই সেসব কণা শক্তি হারিয়ে ফেলে। তবে সুপারনোভা বিস্ফোরণের কথা আলাদা। একটা নক্ষত্র যখন মৃত্যুর কাছাকাছি এসে পড়ে, তখন এর ভেতরে ঘটা নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া, কোয়ান্টাম অপবর্জনজনিত চাপ আর মহাকর্ষ বলের ত্রিমুখী প্রভাবে বিস্ফোরিত হয়। সেই বিস্ফোরণে নক্ষত্রের বহিঃপৃষ্ঠ ছিন্নভিন্ন হয়। তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য নক্ষত্রটা গোটা গ্যালাক্সির সমান উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে যে মহাজাগতিক রশ্মি উৎপন্ন হয়, সেগুলোও পৌঁছে যেতে পারে পৃথিবীতে।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: আধুনিক নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান/এ. এম. হারুন অর রশীদ, ইনসাইড দ্যা অ্যাটম/আইজ্যাক আসিমভ ও ব্রিটিনিকা ডট কম

*লেখাটি ২০২১ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন