আলোর মহাকর্ষীয় প্রতিসরণ
আলো সব সময় সোজা পথে চলে। এ ধ্রুব সত্যি। কিন্তু কেন চলে? কারণ, আলো চলার সময় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে সবচেয়ে কম সময়ের পথ বেছে নেয়। সমতলে দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে সরলরেখা। যেহেতু আমরা আগে মনে করতাম স্থান-কাল সমতল, তাই আমরা দেখতাম আলো সোজা পথে চলে। কিন্তু সত্যিটা হলো, চাইলেও আলো সব সময় সোজা পথে চলতে পারে না।
কেন পারে না? চলার পথই যদি বাঁকা হয়, তখন আর সোজাসুজি চলার উপায় থাকে না। বাঁকে বাঁকে মোড় নিতে হয় আলোকে। এই বিষয়কে আমরা বলি আলোর প্রতিসরণ।
আলো যখন এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রবেশ করে, তখন আলোর প্রতিসরণ ঘটে। আলোর প্রতিসরণ মানে আলোর দিক পরিবর্তন হওয়া। যেমন আলো শূন্য মাধ্যম থেকে পুরু কাচের দেয়ালের ভেতর প্রবেশ করলে তার দিক পরিবর্তিত হয়।
আলোর এই প্রতিসরণ নীতি ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় লেন্স। লেন্স এমন একটা কাচ, যা দূর থেকে আসা আলোকরশ্মিকে প্রতিসরিত করে একটা বিন্দুতে ফোকাস করে। বাজারে যেসব আতশি কাচ কিনতে পাই, সেগুলো হলো উত্তল লেন্স। আমাদের চশমার কাচে, টেলিস্কোপে, অণুবীক্ষণযন্ত্রে লেন্স ব্যবহার করা হয়। লেন্সের ভেতর দিয়ে কোনো বস্তুকে দেখলে তার সঠিক অবস্থানটা বোঝা যায় না। উত্তল লেন্স ব্যবহার করলে মনে হয় বস্তুটা অনেক কাছে। বস্তুটাকে সাধারণ অবস্থার চেয়ে অনেক বড় মনে হয়। আবার অবতল লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখলে মনে হয় বস্তুটা অনেক ছোট ও অনেক দূরে।
আলোর প্রতিসরণের একটা বড় মাধ্যম হলো পানি। পানির ঘনত্ব আর বাতাসের ঘনত্ব সমান নয়। আলো এক ঘনত্বের মাধ্যম থেকে অন্য ঘনত্বের মাধ্যমে গেলে প্রতিসরিত হয়। ঠিক লেন্সে যেমন প্রতিসরিত হয়, তেমনি বায়ু থেকে পানিতে গেলেও প্রতিসরিত হয়। পানি এখানে লেন্সের মতো কাজ করে। স্বচ্ছ পানির ভেতর ডুবে থাকা কোনো মাছ দেখলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেক সময় জেলেরা টেঁটা দিয়ে পানিতে মাছ ধরেন। তাঁদের তখন এই প্রতিসরণের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হয়। স্বচ্ছ পানিতে মাছ যেখানে দেখা যায়, আসলে মাছটার অবস্থান সেখানে নয়। আমরা মাছটার প্রতিবিম্ব দেখি। আসলে মাছটা থাকে তার থেকে কিছুটা দূরে। তাই ঠিক পানিতে যেখানে মাছটা আছে, সেখানে টেঁটা ছুড়লে মাছ পাওয়া যাবে না। মাছটা যদি ধরতে হয়, তাহলে টেঁটা প্রতিবিম্বের কাছাকাছি কোনো জায়গায় ছুড়তে হয়। কোথায় ছুড়তে হয়, সেই হিসাবটা জেলেরা জানেন।
১৯১৯ সালের ২৯ মে সূর্যগ্রহণের দিন দুই দল বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই তত্ত্বের প্রমাণ দিতে গেলেন। ইংরেজ জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটনের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী গিয়েছিলেন পশ্চিম আফ্রিকার প্রিন্সিপি নামের এক দ্বীপে।
এ তো গেল সাধারণ লেন্সিংয়ের ব্যাপার। মহাকর্ষীয় লেন্সিংটা আবার কী? মনে হতে পারে, মহাকাশে বিশাল একটা লেন্স ব্যবহার করে তাতে আলো ফেলা হয় বুঝি। মহাকাশে বিশাল বিশাল লেন্স অবশ্য আছে। হাবল টেলিস্কোপের লেন্স কম বড় নয়। কিন্তু এটাকে মহাকর্ষীয় লেন্সিং বলে না। মহাকাশে ভারী কোনো বস্তু, যেমন আমাদের পৃথিবী, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রগুলো এমন লেন্স তৈরি করতে পারে। সবচেয়ে ভালো লেন্সিংটা তৈরি করতে পারে আস্ত একটা গ্যালাক্সি। আর মহাকর্ষ বলকে কাজে লাগিয়ে এ ধরনের লেন্স তৈরি করা হয় বলে এর নাম মহাকর্ষীয় লেন্সিং। তবে এই মহাকর্ষীয় লেন্সিং সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে সাধারণ আপেক্ষিকতায়।
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশের আগপর্যন্ত সবাই জানত ও মানত, আলো সোজা পথে চলে। কিন্তু আইনস্টাইন দেখালেন, ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলো বেঁকে যায়। অর্থাৎ ভারী বস্তুর মহাকর্ষ বল আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। তাহলে হিসাবটা কী দাঁড়ায়? আলো চলার সময় সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ বেছে নেয়। কিন্তু যখন কোনো বস্তুর মহাকর্ষক্ষেত্রের পাশ দিয়ে যায়, তখন আলো বেঁকে যায়। তাহলে মহাকর্ষক্ষেত্রের মধ্যে আলোর ওই বাঁকানো পথ নিশ্চয়ই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ। তার মানে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর দুটি বিন্দুর মধ্যে সংক্ষিপ্ত পথটাও বাঁকানো। এখান থেকেই আইনস্টাইন ধারণা করলেন, মহাকর্ষক্ষেত্র কোনো সমতলক্ষেত্র নয়। তা বাঁকানো।
আইনস্টাইন হিসাব করে দেখলেন, দূর নক্ষত্র থেকে পৃথিবীতে আসা আলোকরশ্মি আমাদের সূর্যের মহাকর্ষক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে আসার সময় বেঁকে যায়। আমরা আকাশে একটা নক্ষত্রকে জ্বলতে দেখি। আইনস্টাইনের মতে, যেখানে নক্ষত্রটাকে জ্বলতে দেখি, তার অবস্থান সেখানে নয়। তার থেকে একটু বিচ্যুত জায়গায়। খানিকটা দূরে বা ভিন্ন জায়গায়। আইনস্টাইন হিসাব করে দেখালেন সূর্যের কোল ঘেঁষে আসার সময় ওসব নক্ষত্রের আলো কতটুকু পরিমাণ বিচ্যুত হয়। আইনস্টাইন বললেন, এই বিচ্যুতির পরিমাণ ১.৭৫ সেকেন্ড-চাপ। এক সেকেন্ড চাপ হল ১ ডিগ্রির ৩৬০০ ভাগের এক ভাগ।
নিউটনও কিন্তু জানতেন, দূর নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে আসার সময় বেঁকে যায়। তাই নক্ষত্রটাকে একটু বিচ্যুত জায়গায় আমরা দেখি। নিউটনের ব্যাখ্যা অবশ্য আলাদা। নিউটন আলোর কণাধর্মের জনক। তিনি মনে করতেন, আলো কণা বলেই মহাকর্ষ বলের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। এ জন্য দূর নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে আসার সময় বেঁকে যায়। আর কণা মানেই সেটার ওপর মহাকর্ষের প্রভাব থাকবে, এমনটাই মনে করতেন নিউটন। নিউটনের হিসাব অনুযায়ী, সূর্যের কোল ঘেঁষে আসা আলোর বিচ্যুতির পরিমাণ ০.৮৫ সেকেন্ড-চাপ। আইনস্টাইনের হিসাবে সেটা এর প্রায় দ্বিগুণ।
কার হিসাব সঠিক—নিউটন, নাকি আইনস্টাইনের? সত্যিকারের পরীক্ষার ফলটা যার সঙ্গে মিলে যাবে, নিশ্চিতভাবে তাঁর মহাকর্ষ নীতিই ঠিক। আইনস্টাইন বললেন, এটা পরীক্ষা করার উপযুক্ত সময় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দিন। কারণ, সূর্যের কোল ঘেঁষে যেসব আলো পৃথিবীতে আসার কথা, সূর্যের আলোর আড়ালে সেগুলো হারিয়ে যায়। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণই এই পরীক্ষার উপযুক্ত সময়।
১৯১৯ সালের ২৯ মে সূর্যগ্রহণের দিন দুই দল বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই তত্ত্বের প্রমাণ দিতে গেলেন। ইংরেজ জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটনের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী গিয়েছিলেন পশ্চিম আফ্রিকার প্রিন্সিপি নামের এক দ্বীপে। আরেকটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ক্রোমোলিন। তাঁরা গেলেন ব্রাজিলের সেব্রালে। ১৯১৯ সালের ৬ নভেম্বর লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি ও রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির যৌথ বার্ষিক সভায় দুই দলের পরীক্ষার ফলাফল উত্থাপিত হলো। দুই দলই সূর্যগ্রহণের সময় একটা নক্ষত্রের আলোর বিচ্যুতি পরীক্ষা করেছিল। দুই দলের একদল ফলাফল পেল ১.৯৮ সেকেন্ড চাপ, আরেক দলের ফলাফল হলো ১.৬১ চাপ। দুই ফলাফলের গড় করলে দাঁড়ায় ১.৭৯৫ সেকেন্ড চাপ। আইনস্টাইনের অনুমানের খুব কাছাকাছি ফল এল। অর্থাৎ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো, মহাকর্ষক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আলোকরশ্মি বেঁকে যায়।
গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং আরও ভালোভাবে বোঝা যায় সূর্যের বদলে গ্যালাক্সি হলে। একটা আস্ত গ্যালাক্সির ভর সূর্য থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ বেশি। গ্যালাক্সির আশপাশে স্থান–কালের বক্রতাও অনেক বেশি।
আলো সোজা পথে চলে। বেঁকে যাওয়া স্থান–কালের ভেতর দিয়ে চলতে গিয়ে আলোর গতিপথও তাই বেঁকে যায়। এ কারণে সূর্যের পাশ দিয়ে আসা কোনো নক্ষত্রের আলো সোজা পথে পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারে না। বেঁকে যায় তার গতিপথ। তাই নক্ষত্রটা আমরা ঠিক যেখানে দেখি, তার আসল অবস্থান সেখানে নয়।
এই ব্যাপারই পরীক্ষা করতে চেয়েছিল এডিংটন বাহিনী। এ জন্য তারা সূর্যগ্রহণের দিনটাকে বেছে নেয়। কারণ, সূর্যের কোল ঘেঁষে আসা নক্ষত্রের আলো সূর্যগ্রহণের দিন ছাড়া পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব পাস করল লেটার মার্ক নিয়ে। আর সেদিন থেকেই সূচিত হলো গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের। লেন্সের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আলোর পথ বেঁকে যায়। ভারী বস্তুর প্রভাবে বেঁকে যাওয়া স্থান–কালও অনেকটা লেন্সের মতো কাজ করে। লেন্সের ভেতর দিয়ে আসা আলোকে ফোকাস করে একত্র করা যায়। তেমনি গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের আলোও ফোকাস করে পৃথিবীতে এসে একত্র হতে পারে।
এডিংটনের পরীক্ষণের পর নড়েচড়ে বসেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দেয় এই গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং তত্ত্ব। ধরা যাক একটা গ্যালাক্সি আছে আমাদের সূর্যের ঠিক ওপারে। সেই গ্যালাক্সির আলো সরাসরি এসে পড়বে সূর্যের গায়ে। কিন্তু সূর্যের ভর এর আশপাশের স্থান–কালকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। তাই ওপারে গ্যালাক্সি থেকে আলো সূর্যের গায়ে পড়ে আড়াল হবে না। সূর্যের দুই পাশ দিয়ে বাঁকা পথ ধরে পৃথিবীতে এসে ফোকাস করবে। যেহেতু আলো দুই পাশ থেকে আসবে, তাই সূর্যের দুই পাশে দুটি আলাদা আলাদা প্রতিবিম্ব দেখব একই গ্যালাক্সির। আমাদের মনে হবে, একই মাপের একই রকম দুটি আলাদা গ্যালাক্সি আছে সূর্যের ডান ও বাঁ পাশে। প্রথম দিকে বিজ্ঞানীদেরও বিভ্রান্ত করেছিল মহাকর্ষীয় লেন্সের এই দৃশ্য। কিন্তু খুব বেশি দিন লাগেনি ভুল ভাঙতে। স্থান–কালের বক্রতার কারণেই সূর্যের দুই দিক থেকে আলো আসছে। আর তাতেই আমাদের মনে হচ্ছে আলো আসছে দুটি উত্স থেকে।
গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং আরও ভালোভাবে বোঝা যায় সূর্যের বদলে গ্যালাক্সি হলে। একটা আস্ত গ্যালাক্সির ভর সূর্য থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ বেশি। গ্যালাক্সির আশপাশে স্থান–কালের বক্রতাও অনেক বেশি। তাই একটা গ্যালাক্সির পেছনে আরেকটা গ্যালাক্সি থাকলে মহাকর্ষীয় লেন্সিং আরও স্পষ্ট হয়। এর সাহায্যে পেছনের গ্যালাক্সির বৈশিষ্ট্য আরও ভালোভাবে বোঝা যায়। দূর আকাশের গ্যালাক্সিকে পর্যবেক্ষণের সময় হিসাবে নেওয়া হয় এই গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং।