পদার্থবিজ্ঞানের সহজপাঠ - ৯
প্রতিটি বস্তুর ভেতরে একটা শক্তি লুকিয়ে আছে। সেটাই বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তি। বস্তুর ভেতরকার অণু-পরমাণুর মধ্যে সব সময় ধাক্কাধাক্কি হয়। এর ফলেই বস্তুর মধ্যে তৈরি হয় গতিশক্তি। এই শক্তি এমনিতে বোঝা যায় না। তবে বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তিকে বাড়ানো-কমানো সম্ভব। এ জন্য বস্তুতে তাপ প্রয়োগ করতে হবে। তাপ প্রয়োগ করলে বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তি বেড়ে যাবে, বেড়ে যাবে বস্তুর তাপমাত্রাও। অর্থাৎ, বস্তুর ভেতরকার অণু-পরমাণুগুলোর গড় গতিশক্তিও বেড়ে যাবে। এটাই হলো বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তির সঙ্গে তাপের সম্পর্ক।
আপনি নিজেও একটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। লোহার একটা রড নিন। এবার তাতে তাপ প্রয়োগ করুন। দেখবেন, রডটি গরম হয়ে উঠছে। এমনিতে লোহার ভেতরকার পরমাণুগুলো পানির অণুর মতো সহজে চলাচল করতে পারে না। কিন্তু ভেতরের পরমাণুগুলো কাঁপতে পারে। আপনি যখন বাইরে থেকে তাপ দিচ্ছেন, তখন লোহার পরমাণুগুলোর কম্পনও বেড়ে যাবে। তাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে আরও বেড়ে যাবে কম্পন। ফলে প্রতিটা পরমাণু তার পাশের পরমাণুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইবে। পরমাণুগুলোর ভেতর রাসায়নিক বন্ধন থাকে। এই বন্ধনের কারণেই পরমাণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে কঠিন লোহা। লোহার মতো ধাতব পদার্থের রাসায়নিক বন্ধন অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই পরমাণুগুলো খুব শক্তভাবে গায়ে গায়ে লেগে থাকে। আপনি যখন তাপ প্রয়োগ করছেন, পরমাণুগুলোতে তখন কম্পন বেড়ে যায়। ফলে এরা পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে। তখন বন্ধন কিছুটা আলগা হয়ে যায়।
একটি ইটের দেয়ালের কথা ভাবুন। বিশাল একটা হাতুড়ি দিয়ে এক-দুইটা বাড়ি মারেন। দেয়ালটা ভাঙবে না। কারণ ইটগুলোর ভেতরে বালু ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি একধরনের বন্ধন রয়েছে। সেটা বেশ শক্তিশালী। হাতুড়ির এক আঘাতে সেই বন্ধন ভাঙবে না। কিন্তু বার বার যদি একই জায়গায় আঘাত করেন, তাহলে বালু-সিমেন্টের সেই বন্ধন দুর্বল হতে থাকবে। ক্রমাগত আঘাত চালিয়ে গেলে বন্ধন ভেঙে যাবে এক সময়। তখন দেয়ালও ভেঙে পড়বে।
লোহার ক্ষেত্রেও এমনটা ভাবুন। দেয়ালের ক্ষেত্রে আপনি হাতুড়ি দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করছিলেন, এখানে হাতুড়ির জায়গায় ব্যবহার করছেন তাপ। ক্রমাগত তাপ দিতে থাকলে পরমাণুগুলোর কম্পন আরও শক্তিশালী হবে এবং সেগুলো পরস্পরকে আরও জোরে ধাক্কা দেবে। বার বার ধাক্কার কারণে রাসায়নিক বন্ধন দুর্বল হয়ে একসময় ভেঙে পড়বে। লোহার পরমাণুগুলো মুক্তভাবে চলাচল করতে পারবে তখন। কঠিন লোহা তখন পরিণত হবে তরলে।
গলিত লোহাতেও যদি তাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন, তাহলে এদের অণুগুলোর মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়বে। বাড়বে ঠোকাঠুকি, গতিশক্তি এবং তাপমাত্রাও।
২.
আগের পর্বগুলোতে বলেছি, তাপ প্রয়োগ করলে বস্তুর গড় গতিশক্তি বাড়ে। অর্থাৎ, বাড়ে তাপমাত্রা। লোহার ক্ষেত্রে তাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে এক সময় ১ হাজার ৫৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যাবে। তখন লোহার অণুগুলো গলে মুক্তভাবে চলাচল করবে। কঠিন লোহা পরিণত হবে তরলে। এটিই আসলে লোহার গলনাঙ্ক।
অন্যদিকে, বরফের গলনাঙ্ক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বরফ আসলে তরল, অর্থাৎ পানির আকারে থাকে। পৃথিবীর উত্তর মেরুর কাছাকাছি দেশগুলোতে মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা নেমে যায়। তাই ওসব দেশে পানি কঠিন, অর্থাৎ বরফের রূপে থাকে।
গলিত লোহাতেও যদি তাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন, তাহলে এদের অণুগুলোর মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়বে। বাড়বে ঠোকাঠুকি, গতিশক্তি এবং তাপমাত্রাও। এভাবে চলতে থাকলে একসময় তাপমাত্রা উঠে যাবে ২ হাজার ৮৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তখন আর লোহার পরমাণুগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ থাকবে না বললেই চলে। তরল লোহা তখন হয়ে যাবে বাষ্প।
এই যে তাপ দেওয়ার ফলে বস্তুর ভেতরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বদলে গেল, কেন এমনটা হলো?
এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন জেমস প্রেসকট জুল, জুলিয়াস রবার্ট ফন মায়ার এবং হারমান ফন হেলমহোলৎসের মতো বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলেছিলেন, মহাবিশ্বের মোট যে শক্তি আছে, তার কোনো হেরফের হয় না কখনো। শক্তি কখনো সৃষ্টি হয় না বা একে ধ্বংসও করা যায় না। শুধু এক রূপ থেকে আরেক রূপে বদলানো যায়। তাঁরা দেখান, বাইরের তাপ কোনো পদার্থের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে বদলে দিতে পারে। এখানে তাপশক্তি রূপান্তরিত হয়ে অভ্যন্তরীণ শক্তিতে পরিণত হয়। এ সূত্রটি তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র নামে পরিচিত। একে শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতিও বলা হয়।
এখন ব্যাপারটা যদি বিপরীত দিক থেকে ঘটানো যায়, তাহলে কী হবে? নাইট্রোজেনের কথাই ধরুন। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এটা বাষ্প অর্থাৎ গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। একে চাইলেই আপনি তরলে রূপান্তর করতে পারেন। সেজন্য চাপ বাড়াতে পারেন বা কমাতে পারেন তাপমাত্রা। কিন্তু আমাদের আলোচনা তাপ নিয়ে। তাই আমরা তাপমাত্রা কমিয়ে কীভাবে কাজটা করা যায়, সেটাই দেখাব।
একটা কাচের পাত্রে কিছু নাইট্রোজেন গ্যাস নিন। তারপর এর থেকে তাপ সরিয়ে নিন। তাপ সরালে তাপমাত্রা কমতে থাকবে। প্রথমে বরফের ভেতর রাখতে পারেন। কিন্তু বরফের সাহায্যে তাপমাত্রা কমিয়ে বড়জোর শূন্য ডিগ্রিতে নিয়ে আসতে পারবেন। আরও কমাতে হলে চাই বিশেষ কিছু। ধরা যাক, একটা হিমাগার আছে আপনার ল্যাবরেটরিতে। সেখানকার তাপমাত্রা কমাতে পারেন ইচ্ছামতো। কিন্তু মনে রাখবেন, তাপমাত্রা কখনো মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামানো সম্ভব নয়। এটা পদার্থবিজ্ঞানের অপরিবর্তনীয় নীতি।
ধরা যাক, আপনার হিমাগারের মাইনাস ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেওয়া যায়। আপনি নাইট্রোজেনের পাত্রটা সেখানে রেখে ধীরে ধীরে তাপ কমানোর ব্যবস্থা করলেন। তাপ কমালে গ্যাসের অণুগুলোর মধ্যে ঠোকাঠুকি, ধাক্কাধাক্কি কমতে শুরু করবে। কমবে গড় গতিশক্তিও, অর্থাৎ তাপমাত্রাও। দেখবেন তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ১৯৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসার পর নাইট্রোজেন গ্যাস তরলে পরিণত হবে। অর্থাৎ, এদের মধ্যে গতিশক্তি কমে এসেছে। অনেকটাই শান্ত হয়ে উঠছে অণুগুলো। এরপরেও তাপ কমানো অব্যাহত রাখুন। ফলে তাপ কমে এক সময় মাইনাস ২১০ ডিগ্রিতে নেমে আসার পর হবে আসল মজা। আপনার চোখের সামনে কাচের পাত্রের ভেতর তরল নাইট্রোজেন কঠিন বস্তুতে পরিণত হবে! অর্থাৎ নাইট্রোজেনের গলনাঙ্ক মাইনাস ২১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং স্ফুটনাঙ্ক প্রায় মাইনাস ১৯৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে।
নাইট্রোজেনের ক্ষেত্রে মনে হতে পারে, আমরা তো তাপ প্রয়োগ করছি না, তাহলে কেন এটা হলো? এখানে তাপ প্রবাহের একটা ব্যাপার আছে।
৩.
এখন আমরা আরেকটা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। লোহা বাষ্পীভূত হলে কী হবে বলুন তো? নিশ্চয় তা মেঘের মতো বাতাসে উড়ে বেড়াবে না। কারণ, পরিবেশের তাপমাত্রা লোহার গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্কের চেয়ে অনেক কম। তাই দ্রুত বাষ্পীভূত লোহা তাপ হারাতে শুরু করবে। অর্থাৎ বাতাসই লোহার বাষ্প থেকে তাপ শোষণ করবে। ফলে দ্রুতই লোহা তরলে পরিণত হয়ে কঠিনে পরিণত হবে।
একইভাবে যদি কঠিন নাইট্রোজেনের পাত্রকে হিমঘর থেকে বের করে বাইরে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা হয়, তাহলে দ্রুত সেই কঠিন নাইট্রোজেন ফুটতে শুরু করবে। পরিণত হবে তরলে। তারপর দ্রুত তরল নাইট্রোজেন আবার বাষ্পে পরিণত হবে।
নাইট্রোজেনের ক্ষেত্রে মনে হতে পারে, আমরা তো তাপ প্রয়োগ করছি না, তাহলে কেন এটা হলো? এখানে তাপ প্রবাহের একটা ব্যাপার আছে। তাপ সবসময় উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নিম্ন তাপমাত্রার দিকে প্রবাহিত হয়।
ধরা যাক, আপনার ল্যাবরেটরির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেখানে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার একটা লোহার ব্লক রাখলেন। দ্রুত লোহার ব্লক থেকে তাপ ল্যাবরেটরির বাতাসে প্রবাহিত হবে। যতক্ষণ না ব্লক আর ল্যাবরেটরির ভেতরের তাপমাত্রা সমান হচ্ছে, ততক্ষণ ব্লক থেকে তাপ প্রবাহিত হতে থাকবে। এতে ল্যাবরেটরির বাতাসের তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে, কমতে থাকবে লোহার তাপমাত্রা। ধরা যাক, লোহার ব্লক থেকে তাপমাত্রা এসে ২৬ ডিগ্রিতে স্থির হলো। অন্যদিকে ব্লকের তাপমাত্রাও কমে ২৬ ডিগ্রিতে স্থির হলো। এখন সমান হলো পুরো ল্যাবরেটরির তাপমাত্রা। এই অবস্থাকে বলে সাম্যাবস্থা। আগে ল্যাবরেটরির সাম্যাবস্থা ছিল ২৫ ডিগ্রিতে। এখন সেটা স্থির হলো ২৬ ডিগ্রিতে।
ধরুন, এবার আপনি বিশাল একটা বরফ খণ্ড নিয়ে ল্যাবরেটরিতে রাখলেন। বরফের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে ল্যাবরেটরির তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সুতরাং, বরফের তাপমাত্রা অনেক কম। তাই ল্যাবরেটরির বাতাস এমনকি ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সেই লোহার ব্লক থেকেও তাপ বরফের দিকে প্রবাহিত হবে। ফলে বরফের তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়বে। বরফ গলে পানি হবে। পানির তাপমাত্রাও তখন অনেক কম। তাই পানিও তাপ শোষণ করতে থাকবে। ওদিকে ল্যাবরেটরি ও লোহার ব্লক তাপ হারাচ্ছে। তাই এদের তাপমাত্রা কমতে থাকবে। এক সময় পানি আর ব্লকসহ গোটা ল্যাবরেটরির তাপমাত্রা সমান হয়ে যাবে। কিন্তু ল্যাবরেটরি যেহেতু বরফ-পানিকে নিজের তাপ ধার দিয়েছে, তাই গোটা ল্যাবরেটরির তাপমাত্রা ধরা যাক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যাবে। অর্থাৎ ২৩ ডিগ্রিতে এসে সাম্যাবস্থায় পৌঁছুবে। মানে ল্যাবরেটরির বাতাস, লোহার ব্লক ও পানির তাপমাত্রা তখন ২৩ ডিগ্রিতে এসে স্থির হবে।
এখানে একটা কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিই, তাপ সবসময় উষ্ণ বস্তু থেকে ঠান্ডা বস্তুর দিকে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ, শেষ কথা হলো, বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর তাপের প্রভাব ব্যাপক। তাপ যেমন বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তি বাড়িয়ে দিয়ে বস্তুর আকার ও আচরণ বদলে দিতে পারে, তেমনি তাপ কমিয়ে বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তি কমিয়ে ফেলাও সম্ভব। এক্ষেত্রে বস্তুর আকার ও আচরণ বদলে যায়। বরফ, পানি ও বাষ্পের আকার যেহেতু এক নয়, এদের অণুগুলোর আচরণও তাই আলাদা।