পূর্ণিমার রাতে কি সত্যিই ঘুম কম হয়

পূর্ণিমার চাঁদছবি: আফরিন সুলতানা সেতু

পূর্ণিমার রাতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন? চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় ঘুম আসছে না? যুগ যুগ ধরে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে, চাঁদের কোনো এক জাদুকরী ক্ষমতা আছে। চাঁদ নাকি মানুষের ঘুম কেড়ে নিতে পারে, অদ্ভুত আচরণ করাতে পারে, এমনকি মানুষকে পাগলও করে দিতে পারে! ইংরেজি ‘লুনাসি’ (Lunacy) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘লুনা’ থেকে। এর অর্থ চাঁদ। আর লুনাসি মানে পাগলামি।

অনেক পুলিশ অফিসার বা হাসপাতালের কর্মীরাও হয়তো বলবেন, পূর্ণিমার রাতে তাঁদের ডিউটি অনেক বেশি ব্যস্ততায় কাটে। কিন্তু বিজ্ঞান কি এ কথা মানে? নাকি পুরোটাই দাদি-নানির গালগল্প?

আসলে, উত্তরটা গল্পের চেয়ে একটু জটিল। গবেষণা বলছে, পূর্ণিমার চাঁদ আমাদের ঘুমকে সামান্য প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে।

অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ণিমার ঠিক আগের কয়েক রাতে মানুষ সত্যিই একটু অন্যভাবে ঘুমায়। তখন চাঁদের আলো সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়টায় আমরা গড়ে ২০ মিনিট কম ঘুমাই। ঘুম আসতেও যেন একটু বেশি সময় লাগে। আমাদের গভীর ঘুমের পরিমাণও কমে যায়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর সবচেয়ে সহজ এবং সম্ভাব্য কারণ হলো আলো। পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলো আমাদের শরীরের ভেতরের ঘড়িটাকে বোকা বানায়। এই আলো মস্তিষ্ককে বলে, ‘এখনো ঘুমানোর সময় হয়নি।’ ফলে আমাদের ঘুম-পাড়ানি হরমোন, অর্থাৎ ‘মেলাটোনিন’ ঠিকমতো বের হতে পারে না। তাই মস্তিষ্ক সজাগ থাকে।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর সবচেয়ে সহজ এবং সম্ভাব্য কারণ হলো আলো। পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলো আমাদের শরীরের ভেতরের ঘড়িটাকে বোকা বানায়।

তবে এই প্রভাব খুব সামান্য। মাত্র ১৫-৩০ মিনিটের ঘুম কম হয়। আর এই প্রভাবটা সেসব জায়গাতেই বেশি দেখা যায়, যেখানে কৃত্রিম আলো নেই। যেমন, কোনো গ্রামে বা বনে তাঁবুতে থাকলে ব্যাপারটা বেশি টের পাওয়া যায়।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ বিশ্বাস করত, পূর্ণিমার আলো মানসিক রোগীদের আরও অসুস্থ করে তোলে। তাদের ধারণা ছিল, ওই উজ্জ্বল চাঁদের নিচে ঘুমালে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না।

আধুনিক বিজ্ঞান এখানে একটা মজার পরিবর্তন এনেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, চাঁদের সঙ্গে পাগলামির সরাসরি কোনো যোগ নেই। আসল ভিলেন হলো ‘স্লীপ ডিসরাপশন’ বা ঘুম নষ্ট হওয়া।

এটা প্রমাণিত যে, ঘুম নষ্ট হওয়াই মানসিক সমস্যার একটা বড় কারণ। মাত্র এক রাতের ঘুম খারাপ হলেই আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আর এটা যদি চলতেই থাকে, তবে তা বিষণ্ণতা বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

অর্থাৎ, পূর্ণিমার কারণে যে সামান্য ১৫-২০ মিনিটের ঘুম কম হচ্ছে, সেটাও হয়তো সেই সব মানুষের জন্য ক্ষতিকর, যারা আগে থেকেই কোনো মানসিক ঝুঁকিতে আছেন।

তবুও একটা ‘কিন্তু’ আছে। বিজ্ঞানীরা যখন বড় পরিসরে, যেমন হাসপাতালের হাজার হাজার রোগীর তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন, তখন অবাক হয়ে দেখেছেন, পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে হাসপাতালে রোগী বেড়ে যাওয়া বা অদ্ভুত আচরণের কোনো নির্ভরযোগ্য সম্পর্কই নেই!

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানীরা বলছেন, চাঁদের সঙ্গে পাগলামির সরাসরি কোনো যোগ নেই। আসল ভিলেন হলো ‘স্লীপ ডিসরাপশন’ বা ঘুম নষ্ট হওয়া।

হ্যাঁ, ভারত বা চীনের দু-একটি ছোট গবেষণায় পূর্ণিমার সময় হাসপাতালে সামান্য বিশৃঙ্খলা বাড়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই ফলাফল বিশ্বের অন্য কোথাও মেলেনি। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর পেছনে হয়তো চাঁদের আলোর চেয়েও স্থানীয় সংস্কৃতি বা হাসপাতালের কাজের চাপ বেশি দায়ী।

ভাবতে পারেন, যদি প্রমাণই না থাকে, তবে আমরা এটা এত বিশ্বাস করি কেন? এর পেছনে একটা মজার মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। একে বলে ‘ইলিউসরি কোরিলেশন’ বা বিভ্রমকারী পারস্পরিক সম্পর্ক।

ব্যাপারটা সহজ। ধরুন, এক রাতে আপনার হাসপাতালে খুব ভিড় হলো এবং সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আপনার মস্তিষ্ক দুটো ঘটনাকে এক করে ভাববে, ‘আরে! পূর্ণিমার কারণেই আজ এত ভিড়!’

কিন্তু যে দশটা রাতে পূর্ণিমা ছিল না, অথচ ভিড় ছিল, সেই রাতগুলোর কথা আপনার মস্তিষ্ক মনে রাখবে না। আমরা শুধু সেই ঘটনাই মনে রাখি, যা আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়।

তাছাড়া, চাঁদ আকাশের এত বড় একটা জিনিস যে, একে দোষ দেওয়া খুব সহজ! মানসিক চাপ বা কফি খাওয়ার মতো ছোট কারণগুলোকে আমরা অতটা পাত্তাই দিই না।

আরও পড়ুন
পূর্ণিমার চাঁদ
ছবি: গেটি ইমেজ

আসলে ভিলেন হলো আলো। পূর্ণিমার চাঁদ আমাদের পাগল না বানালেও একটা শিক্ষা ঠিকই দেয়; রাতে আলো জ্বালিয়ে ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। আমাদের শরীর সূর্যের আলোর সাহায্যে দিন ও রাতের পার্থক্য বুঝতে পারে। সন্ধ্যায় যদি বেশি আলো জ্বলে, তাহলে শরীরের স্বাভাবিক চক্র নষ্ট হয়ে যায়। তা চাঁদের আলোই হোক, রাস্তার বাতির আলোই হোক, বা আপনার হাতে থাকা মোবাইলের নীল আলো।

সত্যি বলতে, পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে আপনার মোবাইল ফোনের নীল আলো ঘুমের বেশি ক্ষতি করে। তাই পূর্ণিমার রাতে যদি আপনার ঘুম না আসে, তবে বুঝতে হবে আপনি হয়তো সবটা ভাবছেন না। চাঁদের আলোর একটু হলেও দায় থাকতে পারে, কিন্তু আপনার যদি প্রায়ই ঘুম না আসে, তবে আকাশের দিকে না তাকিয়ে আপনার হাতের ফোনটার দিকে তাকান। আসল ভিলেন হয়তো ওটাই!

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট

আরও পড়ুন