মহাকাশ
যেভাবে মাপা হলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভর
মিল্কিওয়ের ভেতরে বসে আমাদের গ্যালাক্সিটির ভর কীভাবে মাপলাম আমরা? আরও সাধারণভাবে বললে, গ্যালাক্সির ভর কীভাবে মাপা হয়? শত বছরের ইতিহাস, বিজ্ঞানীদের অবদান ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা…
ভর কীভাবে মাপে?
ভাবছেন, এ আর এমন কী কঠিন প্রশ্ন! সাধারণত আমরা যে বস্তুর ভর মাপতে চাই, তাকে একটা পাল্লায় রেখে দিই। পাল্লার অন্য পাশে থাকে বাটখারা—ওটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভারী হয়, আর পরিমাণটা লেখা থাকে বাটখারার গায়ে। ব্যস! দুটো ভর সমান সমান হলে বোঝা যায়, বস্তুটার পর বাটখারাটার সমান। মোটা দাগে আমরা এভাবেই ভর মাপি।
কিন্তু অনেক বিশাল বস্তুর ভর মাপার উপায় কী? হয়তো ভাবছেন, কেন, বড় পাল্লা লাগবে! ১৯ শতকের বিখ্যাত গ্রন্থ সিনাগগ-এ এরকমই একটি দুষ্ট ছবি আছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটা সি-স রাইডের একপাশে বসে আছেন আর্কিমিডিস, অন্য পাশে পৃথিবীটা রাখা। (সি-স রাইড মানে, পার্কে ঢেঁকির মতো যে রাইড থাকে। দুপাশে দুজন বসতে পারেন। যাঁর ভর বেশি, তার পাশটা নেমে যায়। হালকা ভরের মানুষটি উঠে যান ওপরের দিকে।)
পৃথিবীর দিকটা নেমে গেছে নিচে ভরের জন্য। সঙ্গে গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের উক্তি, ‘আমাকে যথেষ্ট বড় একটা লিভার (এক্ষেত্রে তক্তা) দাও, একটা ফালক্রাম দাও ওটাকে বসানোর জন্য, আমি পৃথিবীটাকে তার কক্ষপথ থেকে সরিয়ে দেব।’
এই দুষ্ট বুদ্ধি দিয়ে অবশ্য পৃথিবীর ভর মাপা যায় না। কোনো বস্তু যখন এত বড় হয়, তখন সে জন্য একটু ভিন্ন ব্যবস্থাও চাই। পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই কাজটি করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিস। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: যেভাবে মাপা হলো পৃথিবীর ওজন)
কিন্তু বস্তুটা যদি আরও বড় হয়? নক্ষত্র কিংবা নক্ষত্রপুঞ্জ, কিংবা নক্ষত্রপুঞ্জের সমাহার তথা গ্যালাক্সি? চিন্তাটাকে ভয়ংকর পাগলামী মনে হতে পারে যদি আপনি নিজেই সেই গ্যালাক্সির ভেতরের ছোট্ট এক নক্ষত্র পরিবারের ক্ষুদ্র এক গ্রহে থাকেন। বিজ্ঞানীরা এই পাগলামী চিন্তা শুধু করেনই-নি, তাঁরা সেটাকে সত্যিই সম্ভব করেছেন। বিষয়টা বোঝার জন্য ইতিহাসটা সংক্ষেপে জানা প্রয়োজন, কিন্তু সে জন্য গ্রিক বা রোমান সভ্যতা কিংবা গ্যালিলিওর টেলিস্কোপে আকাশ দেখার প্রচেষ্টায় আমরা ফিরে যাব না। শুরুটা করব ১৯ শতক থেকে। এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীর কাজের ধারা সম্পর্কে সংক্ষেপে জানব। তাহলে মিল্কিওয়ের ভর পরিমাপের বিষয়টা বোঝা সহজ হবে।
জ্যাকবুস ক্যাপটাইন নামে এক ডাচ জ্যোতির্বিদের প্রচেষ্টা থেকে শুরু করা যাক। তিনি প্রথম মিল্কিওয়ের কাঠামো বোঝার জন্য তারা গণনার চেষ্টা করেন। তখনো অত শক্তিশালী টেলিস্কোপ মানুষের কাছে ছিল না। ‘ধূলিকণা পেরিয়ে যেসব আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে পারে না’, সেগুলোকে তিনি হিসাবে ধরতে পারেননি। তবে তারাদের আপাত ঘূর্ণনের দিক তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন, মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলো এলোমেলোভাবে ঘোরে না, এদের ঘূর্ণনের মূলত দুটি দিক বা ধারা আছে। এই ধারাগুলোকে চিহ্নিত করলেও এগুলো যে আসলে স্বয়ং মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ঘূর্ণনের প্রমাণ, তা তিনি বুঝতে পারেননি। তবে তিনি বুঝেছিলেন, নক্ষত্রের বেগ ব্যবহার করে অনালোকিত গ্যালাক্টিক বস্তুর ভর পরিমাপ করা যেতে পারে। তাঁর এই কাজ পরবর্তী মিল্কিওয়ে গবেষণার ভিত্তি গড়ে দেয়।
‘ধূলিকণা পেরিয়ে যেসব আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে পারে না’—এই কথাটা এ পর্যায়ে একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানে আগ্রহীমাত্রই জানেন, আলোর নানা রূপ আছে। এর মধ্যে দৃশ্যমান আলো, যে আলো আমরা চোখে দেখি, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৩৮০ থেকে ৭৫০ ন্যানোমিটার। অবলোহিত বা বেতার তরঙ্গের আলো বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য এরচেয়ে বড়। এগুলো আমরা চোখে দেখি না। আর দৃশ্যমান আলোর চেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মধ্যে আছে অতিবেগুনি, এক্স-রে বা গামা রশ্মি। একদম সহজ করে বললে, দৃশ্যমান আলো ধূলিকণায় বাধা পায়, কিন্তু অবলোহিত বা বেতার তরঙ্গের আলো সহজেই ওসব মহাজাগতিক ধূলিকণা পেরিয়ে আসে। কিন্তু এগুলো দেখার জন্য বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপ লাগে। এই বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপ এবং মিল্কিওয়ে নিয়ে আগ্রহ—দুইয়ে মিলে মিল্কিওয়ে জ্যোতির্বিদ্যায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ হার্লো শাপলি।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে কাজ করতেন তিনি। সেখানকার ১.৫২ মিটার ব্যাসের শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে তিনি দিনরাত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন। এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে মিল্কিওয়ের প্রায় সঠিক আকার নির্ণয় করেন। সেই ১৯১৮ সালে শ্যাপলি যা করেন, তাকে অতিমানবীয় বললেও কম হয় না। শ্যাপলি মিল্কিওয়ের ভর নির্ণয়ে বড় ভূমিকা রাখেননি সরাসরি, তবে গ্যালাক্সি কত বড়—তাঁর এই গবেষণা মিল্কিওয়ের ভর পরিমাপে বড় ভূমিকা রেখেছে।
এরপর মঞ্চে আসেন ডাচ জ্যোতির্বিদ ইয়ান ওর্ট। সূর্যের আশপাশের বিভিন্ন তারার গতি বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, তারাগুলো ‘অতিরিক্ত গতি’তে ঘুরছে। এর মানে কী? এই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায় পরে মার্কিন জ্যোতির্বিদ ভেরা রুবিনের গবেষণায়। তাঁর গবেষণা এবং তারাদের অতিরিক্ত বেগে ঘোরার বিষয়টি বুঝতে হলে জানতে হবে ডার্ক ম্যাটার বা অজানা ভরের কথা।
২.
দৃশ্যমান মহাবিশ্বের যা কিছু আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন দুরবিন বা উন্নত যন্ত্রে শনাক্ত করতে পারি, তা মহাবিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশের মতো। আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে মহাবিশ্বের বেশির ভাগ ভরের উৎস। আমরা জানি, ভর যা আছে, তার উৎস হলো পদার্থ। বিজ্ঞানীরা তাই একরকম বাধ্য হয়ে মেনে নিয়ে নিয়েছেন, মহাবিশ্বের বেশির ভাগ ভর, প্রায় ২৬.৮ শতাংশ রয়ে গেছে আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ডার্ক ম্যাটার।
‘ডার্ক’ কথাটি বলে বোঝানো হচ্ছে অচিন, অজানা, অদেখা। গুপ্ত। তাই ডার্ক ম্যাটারের বাংলা হতে পারে গুপ্তবস্তু (অনেকে ‘তমো’বস্তুও বলেন, যদিও ডার্ক ম্যাটার মোটেও ‘তমো’ বা অন্ধকার নয়)।
এই যে অচিন ভর, এর খোঁজ পাওয়া গেল কীভাবে? নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকে আমরা জানি, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ তাদের ভর বাড়লে বেড়ে যায়, দূরত্ব বাড়লে কমে যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, এ আকর্ষণ বলের মান বস্তু দুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, মহাকর্ষের উৎস আসলে ভর। পরে আইনস্টাইন দেখিয়েছেন, যেকোনো ভর তার চারপাশের স্থানকাল বাঁকিয়ে ফেলে। মহাকর্ষ আসলে স্থানকালের এই বক্রতার আরেক নাম। এটি আমাদের কাছে ধরা দেয় আকর্ষণধর্মী বল হিসেবে। আমরা দেখি, সূর্যের মতো ভারী বস্তু আশপাশের কম ভরের সব গ্রহ-উপগ্রহ-গ্রহাণুকে নিজের মহাকর্ষীয় শক্তিতে ধরে রেখেছে।
সব বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিজ্ঞানীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল ১৯৩৭ সালে। দেখা গেল, মহাবিশ্বের মোট মহাকর্ষ শক্তির মাত্র ১৫ ভাগের উৎস আমাদের জানা। বাকি ৮৫ ভাগ মহাকর্ষ কোত্থেকে আসছে, সেই জিনিসগুলো আসলে কী, এ ব্যাপারে সত্যিই আমাদের কোনো ধারণা নেই।
১৯৩৭ সালের কথা। সুইস বংশোদ্ভূত মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিদ ফ্রিৎজ জুইকি একটা বিশাল গ্যালাক্সিপুঞ্জ বা ক্লাস্টার নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এই পুঞ্জটি রয়েছে পৃথিবী থেকে প্রায় ৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। নামটি তার ‘কোমা ক্লাস্টার’। হাজারো গ্যালাক্সি এই ক্লাস্টারের কেন্দ্রকে ঘিরে এমনভাবে ঘুরে চলেছে, দেখে মনে হবে বুঝি অনেকগুলো মৌমাছি একসঙ্গে ছুটে যাচ্ছে মৌচাকের দিকে।
জুইকি জানতে চান, পুরো ক্লাস্টার বা পুঞ্জটিকে কী পরিমাণ মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে। সে জন্য তিনি কয়েক ডজন গ্যালাক্সির গতি হিসাব করতে বসলেন। দেখা গেল, গ্যালাক্সিগুলোর গড় গতিশক্তি অস্বাভাবিকরকম বেশি। গতি নিয়ে এরকম বেগতিক কাজকর্মের পেছনের বিজ্ঞানটা আসলে খুব সরল। প্রচণ্ড মহাকর্ষীয় শক্তি কোনো বস্তুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করলে তার গতিবেগ প্রবলভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে। জুইকি প্রথমে ধরে নিলেন, এই প্রবল গতিশক্তির পেছনে রয়েছে গোটা কোমা ক্লাস্টারের ভর। এই ভর হিসেবে তিনি বিশাল এক সংখ্যা অনুমান করে নিলেন। অনুমান সত্যি কি না, তা জানার সহজ উপায় আছে। পুঞ্জের ভেতরে দৃশ্যমান সব কটি গ্যালাক্সির ভর যোগ করে দিলেই হলো। তিনি তা-ই করলেন। দেখা গেল, সবার অঙ্ক মেলে, কিন্তু তাঁর অঙ্ক কিছুতেই মিলছে না। এই পুঞ্জের ভেতরের সব কটি দৃশ্যমান গ্যালাক্সি একসঙ্গে মিলেও এত বিপুল মহাকর্ষের জন্য প্রয়োজনীয় ভরের যোগান দিতে পারছে না।
সমস্যাটা কী, তা বুঝতে আমাদের মুক্তিবেগের বিষয়টি জানতে হবে। কোনো নভোযান পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে যেতে চাইলে সেটিকে প্রতি সেকেন্ডে ১১.১৮৬ কিলোমিটার বেগে ছুটতে হয়। এটিই পৃথিবীর মুক্তিবেগ। এবার ধরুন, একটা গ্রহ সূর্যের চারপাশে একটা স্থায়ী কক্ষপথে ঘুরছে। এই কক্ষপথ ধরে ঘুরতে চাইলে তাকেও সব সময় নির্দিষ্ট বেগ ধরে রাখতে হবে। বেগ কমে গেলে গ্রহটা ছুটে গিয়ে পড়বে সূর্যের ওপর। বেগ বেড়ে গেলে কক্ষপথ ছেড়ে ওটা বেরিয়ে পড়বে। একটা নির্দিষ্ট সীমার বেশি বেগ থাকলে ধীরে ধীরে ওটা ছুটে চলে যাবে সৌরজগতের একদম বাইরে। পৃথিবী যে বেগে নিজ কক্ষপথে ঘুরছে, তা যদি প্রায় দেড় গুণ বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে আমাদের গ্রহটিও সূর্যের নাগপাশ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। মিলবে মুক্তি। এই বেগের নামই মুক্তিবেগ।
একই হিসাব বিশাল গ্যালাক্সি বা গ্যালাক্সিপুঞ্জের জন্যও সত্যি। একটা ক্লাস্টারের অন্য গ্যালাক্সিগুলোর মহাকর্ষীয় টানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি গ্যালাক্সিকে একটি নির্দিষ্ট বেগে নিজ কক্ষপথ ধরে ঘুরতে হয়। কোনো গ্যালাক্সি এরচেয়ে বেশি বেগে ছুটলে ধরে নিতে হবে, পালাতে চাইছে ওটা। বেরিয়ে যেতে চাইছে গ্যালাক্সিপুঞ্জ ছেড়ে। কোমা ক্লাস্টারের জন্য এই হিসাব কষে জুইকির মাথায় বজ্রপাত হলো। দেখা গেল, এই পুঞ্জের সব কটি গ্যালাক্সিই মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি বেগে ছুটছে! এর মানে হলো, কয়েক শ কোটি বছরের সময়সীমায় এই গ্যালাক্সিপুঞ্জের অস্তিত্ব একেবারে নেই হয়ে যাওয়ার কথা। এতদিনে ওটার চিহ্নও থাকার কথা নয়। অথচ ওটার বয়স প্রায় ১০ বিলিয়ন, অর্থাৎ ১ হাজার কোটি বছর।
বিজ্ঞানীরা আজ মোটামুটি নিশ্চিত, এই অচিন ভর আসলেই আছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি গ্যালাক্সির কোথায় এই ভর থাকতে পারে, তারও একটা রূপরেখা রয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে।
এর পরের কয়েক যুগে আরও যেসব গ্যালাক্সিপুঞ্জ আবিষ্কৃত হয়েছে, দেখা গেল, সব কটাতেই একই অবস্থা। নিউটন থেকে আইনস্টাইন—কারো তত্ত্বেই মিলছে না এই অধরা ভরের রহস্য।
তবে বিজ্ঞানীরা আজ মোটামুটি নিশ্চিত, এই অচিন ভর আসলেই আছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি গ্যালাক্সির কোথায় এই ভর থাকতে পারে, তারও একটা রূপরেখা রয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে। এই রূপরেখার নেপথ্যে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি ইনস্টিটিউশনের জ্যোতিঃপদার্থবিদ ভেরা রুবিন। হ্যাঁ, এই সেই ভেরা রুবিন।
১৯৬৭ সালে তিনি হিসাব কষে দেখিয়েছেন, গ্যালাক্সিকেন্দ্রের উজ্জ্বল অংশের বাইরে—যেখানে অল্প কিছু গ্যাসমেঘ ও উজ্জ্বল নক্ষত্রের দেখা মেলে—সে অঞ্চলগুলোতে ভরের পরিমাণ দৃশ্যমান বস্তুর চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ গ্যালাক্সির দৃশ্যমান অঞ্চল যেখানে শেষ, তারপর থেকে শুরু হয়েছে সীমান্ত অঞ্চল। এই সীমান্ত অঞ্চলগুলোতেই সেই অচিন বস্তু সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রুবিনের কল্যাণে বিজ্ঞানীরা এখন প্রতিটি গ্যালাক্সির এই অঞ্চলগুলোকে বলেন ‘ডার্ক ম্যাটার হেলোস’। সোজা বাংলায়, এখানেই সেই অচিন বস্তুদের বসত।
বিষয়টা সংক্ষেপে আরেকবার যদি বলি—যেকোনো গ্যালাক্সি থেকে যে পরিমাণ আলো দেখা যায়, তা থেকে সেই গ্যালাক্সিতে কী পরিমাণ তারা আছে এবং এগুলোর মোট ভর কেমন, তার একটা আন্দাজ বিজ্ঞানীরা করতে পারেন। কিন্তু দৃশ্যমান নক্ষত্রগুলোর কক্ষীয় বেগ থেকে ভর মাপলে তা এই মানের ধারে কাছেও থাকে না। কেন্দ্র থেকে যত দূরে, এই বৈসদৃশ্য তত প্রকট হতে থাকে। অর্থাৎ একটা দূরত্বের পরে আর কোনো তারা পাওয়া যায় না, কিন্তু রয়ে যায় বিপুল অদৃশ্য পদার্থ। এই অঞ্চলগুলোই ডার্ক ম্যাটার হেলোস। সেই সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন যে গ্যালাক্সির হেলোতেই শুধু এই অধরা পদার্থ থাকে না—কেন্দ্রেও থাকে প্রচুর পরিমাণে, আর তুলনামূলক অল্প পরিমাণে ছড়িয়ে থাকে গ্যালাক্সির মূল অঞ্চলজুড়েই; কিন্তু সীমান্ত অঞ্চল বা হেলোসে সবচেয়ে বেশি থাকে।
এখানে সবচেয়ে বড় ফাঁকিটা হলো, আমরা জানি, ভরের জন্য মহাকর্ষ সৃষ্টি হয়। কিন্তু মহাকর্ষ কি কেবলই ভরের জন্য সৃষ্টি হয়? আর কিছু থেকে কি এই মহাকর্ষ পাওয়া যেতে পারে না? আমরা জানি না। হয়তো আমরা মহাকর্ষকেই বুঝতে পারছি না ঠিকঠাক। অথবা সত্যিই রয়েছে বিচিত্র কোনো অচিন পদার্থ। আমরা কিছুতেই ওগুলোকে ধরতে পারছি না।
৩.
ভেরা রুবিনের গল্প শুনতে শুনতে আমরা বুঝে ফেলেছি, তারাদের বেগ থেকে আমরা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভর মাপতে পারি। এটাও জেনেছি যে মিল্কিওয়েসহ সব গ্যালাক্সির কেন্দ্রের বাইরে, সীমান্ত অঞ্চলে থাকে অজানা ডার্ক ম্যাটার। সত্যি বলতে, শুধু সীমান্ত অঞ্চলে নয়, গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও প্রচুর পরিমাণে ডার্ক ম্যাটার থাকে। পাশাপাশি একদম কেন্দ্রে থাকে একটি অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর। বিজ্ঞানীরা এই কৃষ্ণগহ্বরের কথা শুধু জানেনই না, তাঁরা এর ছবিও তুলেছেন। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকেন্দ্রের এই কৃষ্ণগহ্বরের নাম স্যাজিটারিয়াস এ*।
সত্যিই কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের ছবি তোলা সম্ভব, এ কথা কিছুকাল আগেও হয়তো বেশির ভাগ মানুষই মানতে চাইতেন না। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রথম ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) দিয়ে একটি কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তোলা হয়। সেটা ছিল এম৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর। প্রায় ৫৩.৪৯ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের এ গ্যালাক্সি কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বরের ছবি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। একই টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর স্যাজিটারিয়াস এ*-এর ছবি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ১২ মে। দেখা গেল, এই কৃষ্ণগহ্বরটি সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪.৩ মিলিয়ণ গুণ ভারী। গ্যালাক্সিকেন্দ্রের এই কৃষ্ণগহ্বরই লাইনে রেখেছে আশপাশের সব কটি নক্ষত্রকে। এই কৃষ্ণগহ্বরকে—বলা ভালো, মিল্কিওয়ের কেন্দ্রকে ঘিরে—ঘুরে চলেছে মিল্কিওয়ের ভেতরের সূর্যসহ সব কটি নক্ষত্র।
মিল্কিওয়েতে কী কী আছে, তা তো বোঝা গেল। এবারে তাহলে বিজ্ঞানীরা ঠিক কীভাবে আমাদের গ্যালাক্সির ভর মাপেন, তা একটু ধাপে ধাপে বোঝা যাক।
প্রথম কথা হলো, ভর বলতে আমরা কী বুঝি? আমরা আসলে জানতে চাই, আমাদের গ্যালাক্সিতে কী পরিমাণ বস্তু আছে। বস্তু কীভাবে বুঝব—এটা আমরা জেনেছি। মহাকর্ষের জন্য বস্তু বা পদার্থকে দায়ী ধরে নিচ্ছি আমরা। অর্থাৎ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যত গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যাস, ধূলিকণা আমরা দেখতে পাই এবং যা দেখতে পাই না—কিন্তু তাদের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বুঝতে পারি, এর সবই ভর।
এই ভর কীভাবে মাপব? পদ্ধতিটা আমরা জেনে গেছি। মিল্কিওয়ের ভেতরে এবং এর চারপাশে তারাগুলো কীভাবে ঘুরছে, সেটা আমরা দেখব। তারাদের এই বেগটা আসলে কক্ষীয় বেগ। তারাগুলো যদি জোরে ছুটে চলে বা ঘোরে, তাহলে তাদেরকে ধরে রাখতে তুলনামূলক বেশি মহাকর্ষ শক্তি, অর্থাৎ ভর লাগবে। এভাবে আমরা তারাদের কক্ষীয় বেগ—অর্থাৎ বৃত্তাকার কক্ষপথে প্রতিটি তারা যে বেগে ঘুরছে, তা থেকে গ্যালাক্সির ভর হিসাব করতে পারব। এবারে আর আমাদের বিশেষ কোনো পাল্লায় গোটা গ্যালাক্সিটাকে বসাতে হবে না।
এই কাজটা পৃথিবীর বিভিন্ন দুরবিন তো করেই, হাবলের মতো নভোদুরবিনও কিছুটা করে। কিন্তু মিল্কিওয়ের তারাদের বেগ মাপার জন্য বিশেষভাগে বানানো হয়েছে গায়া টেলিস্কোপ। ২০১৩ সালে এই টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করা হয়। ২০২৫ সালের মার্চে সম্প্রতি এটি নিজের কাজ তথা পর্যবেক্ষণ শেষ করেছে।
গায়ার তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, মিল্কিওয়ের তারাগুলো যে বেগে ঘুরছে, এত দৃশ্যমান ভর আমাদের এ গ্যালাক্সিতে নেই। আমাদের গ্যালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ আমাদের চেনাজানা বস্তুর তুলনায় দ্বিগুণ। এটা আসলে খুব বেশি না, বরং কমই বলা চলে। কেন? কারণ, বিজ্ঞানীরা আগে ভেবেছিলেন আমাদের গ্যালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ সাধারণ পদার্থের তুলনায় ৫-১০ গুণ! এখন দেখা যাচ্ছে দ্বিগুণ।
৪
গতি মাপলেই শুধু হবে না। ভরটা তো বের করতে হবে। এ কাজটা কীভাবে করেন বিজ্ঞানীরা? খাঁটি বিজ্ঞানীরা রাগ করতে পারেন। কিন্তু সহজ করে বললে, এ জন্য একটা ছোট্ট সূত্র জানলেই চলে।
গতির বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, G এর মান 6.6743 x 10-11 m³kg⁻¹ s⁻²। রইল বাকি দূরত্ব। এই দূরত্ব কীভাবে মাপা হয়, তা জানতে পড়ুন, নক্ষত্রের পায়ের ছাপ এবং হেনরিয়েটা লেভেট: চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়।
এভাবে বিজ্ঞানীরা একটা গ্যালাক্সির মধ্যে নক্ষত্রের বেগ, দূরত্ব, বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জের ঘূর্ণন, গ্যালাক্সির বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকা অদৃশ্য ভর—সব মিলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি মিল্কিওয়ের আশপাশে যে বামন গ্যালাক্সিগুলো আছে, যেমন ম্যাগেলানের ছোট ও বড় মেঘ—এই গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণন এবং দূরত্বও মাপেন। কারণ, এই গ্যালাক্সিগুলো মিল্কিওয়েকে ঘিরে ঘোরার অর্থ, মিল্কিওয়ের মহাকর্ষ এগুলোকেও বেঁধে রেখেছে। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা মিল্কিওয়ে (বা যেকোনো গ্যালাক্সির) ভরের একটা হিসাব পান।
তার ওপর, এই সব তথ্য ইনপুট দেওয়া হয় কম্পিউটারে। সিমুলেশনের মাধ্যমে তৈরি করা হয় ভিন্ন ভিন্ন ভরের গ্যালাক্সির মডেল। দেখা হয়, কোন মডেলটি আলোচ্য গ্যালাক্সিটির মতো আচরণ করছে। এভাবে ভরের হিসাবটা বিজ্ঞানীরা আরও নির্ভুল করতে পারেন।
সব মিলে দেখা গেছে, মিল্কিওয়ের ভর ২০০ বিলিয়ন সূর্যের ভরের সমান। এসব তথ্য বের করতে গায়া টেলিস্কোপ প্রায় ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি তারার নিখুঁত গতি মেপেছে! আসলে, গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরের অঞ্চলগুলো থেকে আলো আসে কম, সেখানে নক্ষত্রের পরিমাণও কম। এ জন্য সেগুলোর ঘূর্ণন বেগ, দূরত্ব ইত্যাদি মাপা কঠিন হয়ে যায়। এ জন্যই গায়াকে বিশেষভাগে ডিজাইন করা হয়েছে। সে কারণেই গায়া এতগুলো নক্ষত্রের ভর মাপতে পেরেছে, তৈরি করেছে মিল্কিওয়ের নিখুঁত ত্রিমাত্রিক মানচিত্র।
এভাবেই আজ আমরা নিজেদের মহাজাগতিক ঠিকানাটিকে আরও ভালোভাবে জানতে শিখেছি।