আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - ৬

মহাবিশ্ব নিয়ে মানুষের বিস্ময়-আগ্রহ পুরকালের। পৌরাণিক যুগ থেকেই প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানভান্ডার। আধুনিক যুগে এসে আমূলে বদলে গেছে মহাকাশবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস। মানুষ এখন অনন্ত মহাবিশ্বের গভীর থেকে গভীরে ডুব দিতে চায়। কতটুকু সফল সে চেষ্টায়? ইতিহাস আর বিজ্ঞানের খেরোখাতায় চোখ রাখা যাক।

প্রথম পর্ব: আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - ১

দ্বিতীয় পর্ব: আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - ২

তৃতীয় পর্ব: আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - ৩

চতুর্থ পর্ব: আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - ৪

পঞ্চম পর্ব: আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - ৫

উজ্জ্বল তারাদের তালিকা

নিচের টেবিলে আমরা উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশ মিলিয়ে আকাশের ২২টি উজ্জ্বল তারার তালিকা দিয়েছি। এই তারাদের প্রতিটির ব্যাস সূর্য থেকে বেশি। তাদের প্রতিটির উজ্জ্বলতাও সূর্য থেকে অনেক বেশি। তার মানে এই নয় যে আকাশের প্রতিটি তারা সূর্য থেকে উজ্জ্বল, বরং এর উল্টোটাই সত্যি। অর্থাৎ আকাশের বেশির ভাগ তারাই সূর্য থেকে ছোট এবং কম উজ্জ্বল। সেই অনুজ্জ্বল তারাদের বেশির ভাগকেই খালি চোখে দেখা যায় না, তাই আমাদের রাতের আকাশ শুধু অতিকায় তারাদের দীপ্তিতে ভরা। বাণরাজা (রিজেল) আর আর্দ্রা (বেটেলজুস) আমাদের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, ৮০০ আর ১ হাজার ৪০০ আলোকবর্ষ দূরে। কিন্তু যেহেতু এ দুটি খগোল বস্তু আমাদের সূর্য থেকে অনেক গুণ বেশি উজ্জ্বল, শুধু সেই জন্যই আমাদের আকাশে তারা দুটি ভালোভাবে দৃশ্যমান। আর্দ্রা একটি লাল অতিদানব তারা, সেটির ব্যাস সূর্যের ব্যাসের ১ হাজার ১৮০ গুণ, সেটির দীপ্তি সূর্য থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার গুণ বেশি।

১ নম্বর টেবিলের প্রায় সব তারাই বাংলাদেশের আকাশ থেকে দেখা যায়। এখানে কলামের নম্বর হিসাবে (১) তারাদের বাংলা নাম, (২) ইংরেজি বা বৈজ্ঞানিক নাম, (৩) আলোকবর্ষের হিসাবে দূরত্ব, (৪) দৃশ্যমান উজ্জ্বলতার মাত্রা, (৫) সূর্যের তুলনায় তারার জ্যোতিষ্মতা বা উজ্জ্বলতা—এই হিসাবে লুব্ধকের সামগ্রিক শক্তি বিকিরণের মাত্রা সূর্যের চেয়ে ২৫ দশমিক ৪ গুণ বেশি, (৬) সূর্যের তুলনায় তারার ভর, (৭) সূর্যের তুলনায় তারার ব্যাস ও (৮) বর্ণালি বা spectral টাইপ।

হারত্স্প্রুং রাসেল চিত্র

জ্যোতির্বিদ্যার ওপর যেকোনো প্রাথমিক আলোচনাতেই হারত্স্প্রুং রাসেল (Hertzsprung-Russel) নামের চিত্রটির উল্লেখ থাকতে হবে। এই রেখচিত্রটি তারাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে খুবই সাহায্য করেছে। দুজন জ্যোতির্বিদ, ডেনমার্কের আইনার হারত্স্প্রুং ও মার্কিন হেনরি নরিস রাসেলের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে চিত্রটি ১৯ শতকের প্রথম দিকে গঠন করা হয়েছিল। এই রেখচিত্রটি মূলত তারাদের বর্ণালি শ্রেণির সঙ্গে তাদের উজ্জ্বলতার সম্পর্ক বর্ণনা করলেও নক্ষত্রের পৃষ্ঠ, তাপমাত্রা, ভর, ব্যাস ও আয়ু সম্বন্ধে এর থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।

HR চিত্রটিতে উল্লম্ব (vertical বা y) অক্ষটিতে তারার পরমমান বা ঔজ্জ্বল্য দেওয়া হয়েছে (সৌরীয় এককে) এবং অনুভূমিক (horizontal বা x) অক্ষে তারার পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা বা বর্ণালি শ্রেণি বর্ণিত হয়েছে। তারাদের বর্ণালি শ্রেণিসমূহ OBAFGKM থেকে তাদের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা নির্ধারণ করা যায়। এই চিত্রের বিশেষ অংশটি হলো প্রধান বা মূল সারণি (Main sequence), যা কোনাকুনিভাবে চিত্রটির ওপরে বাঁ দিক থেকে নিচে ডান দিক পর্যন্ত বিস্তৃত। নক্ষত্ররা তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই মোটামুটি প্রধান সারণির একটি বিন্দুতে কাটিয়ে দেয়। এই বিস্তৃত সময় ধরে তারারা তাদের কেন্দ্রে ফিউশনের মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম ও শক্তি উত্পাদন করে। আমাদের সূর্য মূল সারণিতে প্রায় ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি বছর থাকবে। জীবনের শেষে দানব (প্রধান সারণির অল্প ওপরে এবং ডানে) হয়ে অবশেষে শ্বেতবামনে (প্রধান সারণির নিচে) পরিণত হবে।

পৃষ্ঠ তাপমাত্রা (কেলভিন)

তারাদের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা তাদের বর্ণালি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া যায়। যেমন হাইড্রোজেনের বামার (Balmer, অনেকে বালমার উচ্চারণ করেন) শোষিত-আলো লাইন হাইড্রোজেনের দ্বিতীয় কক্ষপথে কোনো ইলেকট্রন আছে কি না, তার ওপর নির্ভর করে। দ্বিতীয় কক্ষপথের ইলেকট্রন তারার অভ্যন্তর থেকে নির্গত নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে শোষণ করে নেয়। ফলে বর্ণালিতে ওই জায়গাটি কালো দেখায়। যখন তারার পৃষ্ঠ তাপমাত্রা ৭ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার কেলভিন (বা সেলসিয়াস), তখন ওই কক্ষপথে ইলেকট্রন থাকার সম্ভাবনা আছে, এই তারাদের A টাইপ তারা বলা হয়। কিন্তু তাপমাত্রা যত বাড়ে, তত দ্বিতীয় কক্ষপথে ইলেকট্রন থাকার সম্ভাবনা কমে যায়, উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণুরা ছোটাছুটি করে, তাদের সংঘর্ষ হয়। ফলে পরমাণু আয়নিত হয়, ইলেকট্রন হারায়। তাই B টাইপ (তাপমাত্রা ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার কেলভিন) তারার বামার হাইড্রোজেন শোষিত লাইনের পরিমাণ A থেকে কম এবং O টাইপে (৩০ হাজার কেলভিন থেকেও উষ্ণ) তো আরও কম।

HR চিত্রে তারাদের ব্যাস ওপরের ডান দিক থেকে নিচের বাঁ দিকে কমছে। যেমন অতিদানব M-type আর্দ্রার ব্যাস ১ হাজার সৌর ব্যাসের থেকে একটু বেশি, অন্যদিকে A-type লুব্ধক B-এর (একটি শ্বেতবামন, যা কিনা উজ্জ্বল লুব্ধককে পরিভ্রমণ করে) ব্যাস মাত্র দশমিক ০১ সৌর ব্যাস।

একইভাবে মূল সারণিতে তারাদের ভর ওপর থেকে নিচে কমছে। বিজয় বা বেটা সেন্টাউরি তারাটি আসলে তিনটি তারার সমষ্টি। এর মূল দুটি তারা, যাদের প্রতিটির ভর ১০ সৌরভরের মতো, মাত্র চার জ্যোতির্বিদ্যা একক দূরত্বে একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে। এদের একটিকে ছবিতে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে, সূর্য ছাড়া আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা M-type লালবামন প্রক্সিমা সেন্টাউরির ভর দশমিক ১ সৌরভরের সমান। অতিসম্প্রতি এর একটি গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে।

ঔজ্জ্বল্যের ভিত্তিতে নক্ষত্রের শ্রেণিবিভাগ

মূল সারণিতে তারাদের ভর ওপর থেকে নিচে কমে, অন্যদিকে তাদের আয়ু ওপর থেকে নিচে বাড়ে। বিজয় নামের নক্ষত্র যেখানে ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি বছর জ্বলবে, সেখানে প্রক্সিমা সেন্টাউরি ১ হাজার বিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি বছরের বেশি বাঁচবে। একটা তারার ভর যত বেশি হয়, তত সে উজ্জ্বলভাবে জ্বলে। তারার জ্যোতিষ্মতাকে যদি L বলা হয় আর ভরকে M, তাহলে L জ্বলবে M3.5 সমানুপাতে। অর্থাত্, সূর্য থেকে ১০ গুণ বেশি ভরের একটা তারা ১০৩.৫ বা প্রায় ৩,০০০ গুণ বেশি উজ্জ্বলতায় জ্বলবে। বোঝাই যাচ্ছে, এত দ্রুত জ্বললে জ্বালানি দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। যদি তারার আয়ু বা সময়কালকে t দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, তবে t=M/L=1/M2.5। অর্থাত্ সূর্য থেকে ১০ গুণ ভারী তারাটি সূর্য থেকে ১/১০২.৫ বা ৩০০ গুণ কম সময় বাঁচবে। তাই সূর্যের আয়ুষ্কাল যদি ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি বছর হয়, তবে বিজয় তারার সময়কাল হবে ৩ কোটি বা ৩০ মিলিয়ন বছরের মতো।

অর্থাত্ সূর্য যত দিন বাঁচবে তত দিন প্রায় ৩০০টি বিজয়ের মতো তারার পরপর জন্ম ও মৃত্যু হবে (সুপারনোভা বিস্ফোরণে)। তাই এরকম দানব তারার গ্রহগুলিতে প্রাণের আবির্ভাব ও বিকাশ প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। HR চিত্র যখন প্রণীত হয়েছিল, তখন আমাদের ধারণাই ছিল না যে তারাদের শক্তির উত্স কী। পরবর্তীকালে এই চিত্র নক্ষত্রদের পদার্থবিজ্ঞান বুঝতে খুবই সাহায্য করেছে।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিদ ও অধ্যাপক, রিভারসাইড কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত