কৃষ্ণগহ্বরের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স নিউজ–এর চোখে বিশ্বের সেরা ১০ তরুণ বিজ্ঞানীর একজন তিনি। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে বাংলাদেশি এই জ্যোতিঃপদার্থবিদ গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজে। কৃষ্ণগহ্বরের সাতসতেরো, এ নিয়ে তাঁর নিজের গবেষণা ও ভবিষ্যতের কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে লিখেছেন তনিমা তাসনিম অনন্যা

কৃষ্ণগহ্বর

আলোর প্রকৃতি ও উৎপত্তি

আলো একধরনের তরঙ্গ এবং দৃশ্যমান আলো সেই তরঙ্গ পরিবারের ছোট্ট একটি অংশ। দৃশ্যমান আলো বা ভিজিবল লাইটের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্রমাগত যদি বাড়ানো হয়, তাহলে সেই আলোটি লালচে হয়ে যায়, আর যদি কমানো হয়, সেটি নীলচে হতে থাকে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব বেশি বাড়ানো হলে সেটা আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। সেই তরঙ্গগুলোকে আমরা ইনফ্রারেড, মাইক্রোওয়েভ, রেডিও ওয়েভ হিসেবে চিনি। দেখতে না পেলেও এগুলো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয়। যদি তরঙ্গের দৈর্ঘ্য কমানো হয়, নীল হতে হতে আলোটি একসময় আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মিতে রূপ নেয়। অতিবেগুনি রশ্মি সূর্যের আলোতেও থাকে এবং আমাদের চামড়ার সঙ্গে বিক্রিয়া করে ভিটামিন ডি উৎপাদন করে। আরও ছোট তরঙ্গের আলো হচ্ছে এক্স-রে, যেটা সূর্যের খুব কাছে যে গরম গ্যাস আছে, সেখানে উৎপন্ন হয়। এটি ব্যবহার করা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানে। এক্স-রে সহজেই আমাদের চামড়া–মাংস ভেদ করে ভেতরের হাড় বা অন্যান্য অংশের ছবি তুলতে পারে। কারণ, এটি চামড়া-মাংস ভেদ করতে পারলেও হাড় ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারে না।

মহাকাশবিজ্ঞানে এক্স-রে রশ্মি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মহাকাশে অনেক বস্তু আছে, যার আশপাশে প্রচুর ধোঁয়াটে গ্যাস জমে আছে। এ ধরনের গ্যাস ভেদ করে দৃশ্যমান আলো কিংবা অতিবেগুনি রশ্মি বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু এই বস্তুগুলোকে এক্স-রে টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায়। এমন একটি ধোঁয়াটে পরিবেশে থাকা বস্তু হচ্ছে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর।

ব্ল্যাকহোল থিওরি

ব্ল্যাকহোল নিয়ে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা হচ্ছে, এগুলোর ভর অত্যন্ত বেশি হতে হবে। কিন্তু এ বস্তুগুলোর বৈশিষ্ট্য ভর নয়, ঘনত্ব। পৃথিবীকে যদি ৯ মিলিমিটার ব্যাসার্ধের একটি গোলকে সংকুচিত করা যায়, পৃথিবী ছোট্ট একটা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। কারণ, এর ঘনত্ব এত বেশি হবে যে আলোর কণাও সেটার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পেরিয়ে যেতে পারবে না। প্রথম এমন বস্তুর অস্তিত্বের কথা বলেন জন মিচেল নামের এক ব্রিটিশ দার্শনিক, ১৭৮৩ সালে। তাঁর সমসাময়িক ফরাসি দার্শনিক, গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী পিয়েরে সাইমন ল্যাপলাস মিচেলের প্রস্তাবনার মর্ম বুঝতে পারেন। প্রস্তাবিত ধারণাগুলোর মর্ম উপলব্ধি করতে, তিনি সেটাকে আরেকটু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু মিচেল-ল্যাপলাসের তত্ত্বটা এতটাই আনকোরা ছিল, বিজ্ঞানীদের সেটা বুঝতে প্রায় এক শতাব্দীর বেশি লেগেছিল।

আরও পড়ুন

আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নামে একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। সেটার সারমর্ম হচ্ছে, বস্তুই নির্ধারণ করে স্থানের আকৃতি এবং স্থানের আকৃতি নির্ধারণ করে বস্তুর গতি (matter tells space how to curve and space tells matter how to move)। এ থিওরি অনুযায়ী শুধু আমাদের সামনে দৃশ্যমান স্থানের আকৃতি এবং বিভিন্ন ধরনের স্থানের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, সেটা গাণিতিকভাবে বর্ণনা করা যায়। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তত্ত্ব পৃথিবীর ওপরে থাকা বস্তুর চলাচল খুব ভালোভাবে বর্ণনা করতে পারে। কিন্তু এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত ঘন বস্তুর ঠিক আশপাশের স্থান এবং সময়ের আকৃতির বর্ণনা করতে প্রয়োজন হয় আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির। কিন্তু ঘন বস্তুর থেকে যথেষ্ট দূরে গিয়ে আবার নিউটনের সূত্র প্রয়োগ করা যায়। কারণ, নিউটনের সলিউশন বা সমাধান জেনারেল থিওরির একটি বিশেষ রূপ। জেনারেল থিওরির গাণিতিক কাঠামো ব্যবহার করেই ১৯১৬ সালে প্রথম স্থবির ব্ল্যাকহোলের সমাধান প্রস্তাব করেন কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। আইনস্টাইন নিজে তখন বিশ্বাস করতে পারেননি যে এমন বস্তু আছে। ১৯৫৮ সালে এ ম্যাথমেটিক্যাল প্রস্তাবের সঠিক ভৌত বর্ণনা দেন ডেভিড ফিঙ্কেলস্টাইন। তিনি ব্ল্যাকহোলের আবরণ বা ইভেন্ট হরাইজনকে এমন একটি দেয়াল হিসেবে বর্ণনা করেন, যেখান থেকে আলোর কণার পক্ষেও সম্ভব নয় ফিরে আসা। ১৯৬৩ সালে রয় কার প্রথমবারের মতো একটি ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোলের গাণিতিক বিবরণ দেন।

এ ছাড়া কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে কিছু তাত্ত্বিক প্রস্তাব আছে। যেমন স্টিফেন হকিংয়ের হকিং রেডিয়েশন। যেকোনো স্থানে ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটার (ভার্চ্যুয়াল কণা) জোড়া জন্ম নেয় আবার মিলিয়ে যায়। হকিং প্রস্তাব করেন, ইভেন্ট হরাইজনের কাছাকাছি এমন কোনো জোড়া জন্ম নিলে জোড়ার একটি ইভেন্ট হরাইজনের ভেতরে হারিয়ে যায় এবং অন্যটি মহাকাশে থেকে যায়। নতুন এই ম্যাটার বা বস্তু মিলিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু বস্তু উৎপাদন করতে লাগে শক্তি এবং ভর-শক্তির সংরক্ষণবাদ প্রকৃতির একটি মৌলিক নিয়ম। তাই এই নতুন বস্তু উৎপাদনের শক্তিটুকু চুকিয়ে দিতে হয় ব্ল্যাকহোলটিকে এবং এভাবে শক্তি জোগাতে গিয়ে ক্ষয় হয়ে যায় ছোট ছোট ব্ল্যাকহোল।

পরীক্ষণ: অস্তিত্ব প্রমাণ ও বিভ্রান্তি

১৯৬৪ সালে প্রথমবার ব্ল্যাকহোলের সরাসরি দেখা মেলে একটি রকেট ফ্লাইটের সময়। ব্ল্যাকহোলটি আমাদের ছায়াপথ মিল্কি ওয়েতেই অবস্থিত এবং এটির নাম হচ্ছে সিগ্নাস এক্স-১। এটি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। কারণ, এটি প্রচুর পরিমাণে এক্স-রে বিকিরণ উৎপাদন করে। আরও গবেষণায় বেরিয়ে আসে যে বস্তুটির ভর সূর্যের চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বেশি, কিন্তু এটির আকার মাত্র পৃথিবীর শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

এরপর এক্স-রে, রেডিও, অপটিক্যাল, আলট্রাভায়োলেট। বিভিন্ন তরঙ্গে এমন ঘনত্বের বস্তু পাওয়া যায়, যেগুলো নিশ্চিতভাবে ব্ল্যাকহোল। কিন্তু অনেক সময় ব্ল্যাকহোল বিভিন্ন রূপে গবেষকদের সামনে আসে বলে যথেষ্ট বিভ্রান্তি ও কৌতূহলেরও জন্ম দেয়। যেকোনো তারা বা ছায়াপথ থেকে আলো পরীক্ষা করে সেখানে কোন কোন তরঙ্গের অতিরিক্ত আলো অথবা অপেক্ষাকৃত কম আলো আছে, সেটা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সেই তারা অথবা ছায়াপথে কী ধরনের পরমাণু বা উপাদান আছে। এই অতিরিক্ত অথবা কম আলোর বর্ণালিকে বলা হয় অ্যাবজরপশন অথবা ইমিশন-লাইন। কারণ, এ পরমাণুগুলো কিছু তরঙ্গের আলোর কণা শুষে নেয় (যদি পরমাণুটি ঠান্ডা থাকে) অথবা আলোর কণা বিকিরণ করে (যখন গরম থাকে)। অন্য ছায়াপথগুলো মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে আমাদের থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে এবং দূরে যাওয়ার কারণে এগুলো থেকে আসা সব আলো একটু লালচে হয়ে যায় (এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডপলার ইফেক্ট)। চল্লিশ থেকে সত্তরের দশকে ছায়াপথ ও তারার মধ্যে পার্থক্য বোঝার একটি উপায় ছিল—ছায়াপথগুলো অপেক্ষাকৃত লম্বাটে এবং তারাগুলো ছোট বিন্দুর মতো।

3c 273 নামে তারার মতো বিন্দু আকৃতির একটি আলোর উৎস বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয় ষাটের দশকে। দেখতে তারার মতো বিন্দু আকৃতির বলে ধারণা করা হয়, সেটা আমাদের ছায়াপথের ভেতরেই অবস্থান করছে। বস্তুটি রেডিও ও দৃশ্যমান তরঙ্গে দেখা যায়। এর আলো বিশ্লেষণ করে এমন বিস্তৃত কিছু ইমিশন–লাইনের (বর্ণালি রেখার) ছাপ পাওয়া যায়, যেটা সে সময় আর কিছুতে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর থেকে এমন সব তরঙ্গ পাওয়া যায়, যেটার সঙ্গে কোনো এলিমেন্টের মিল নেই। ১৯৬৩ সালে মারটেন স্মিট নামের এক গবেষক বুঝতে পারেন, উৎসটি অন্য কোনো ছায়াপথে রয়েছে। সেটার দূরত্ব আমাদের থেকে ২ লাখ আলোকবর্ষ দূরে, তাই এর ইমিশন–লাইনগুলো অত্যন্ত লালচে। কিন্তু এরপরও এটা বোঝা যায়নি, এই তারার মতো বিন্দু আকৃতির কিন্তু অন্য ছায়াপথে থেকেও দৃশ্যমান বস্তুটি আসলে কী? এই রহস্য উন্মোচন করতে আরও ২০ বছর লেগেছিল।

আরও পড়ুন
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো ব্ল্যাকহোল সংঘর্ষের কারণে তৈরি হওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করে লাইগো। এ পর্যন্ত ৫০টির বেশি তরঙ্গ ধরা পড়েছে এই যন্ত্রে

আশির দশকে আমাদের টেলিস্কোপগুলো যথেষ্ট উন্নত হয়। এরপর অন্য ছায়াপথে থাকা এ ধরনের বিন্দু আকৃতির আলোর উৎসগুলোর আশপাশে তারার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তখন তারার আলো বিশ্লেষণ করে এগুলোর গতি মেপে বোঝা যায়, এই আলোকময় বস্তুর ভর এর আকারের তুলনায় অনেক বেশি। এগুলোর ঘনত্ব এত বেশি যে সেটা শুধু কৃষ্ণগহ্বরই হতে পারে। আর এমন কৃষ্ণগহ্বর প্রায় প্রতিটি মাঝারি ও বড় ছায়াপথের ঠিক মাঝখানে পাওয়া যায়। এগুলোর ভর কয়েক মিলিয়ন থেকে কয়েক বিলিয়ন সূর্যের ভরের সমান।

আরও একটি বিভ্রান্তির কারণ ছিল। অদ্ভুত কিছু আলোর উৎসের দেখা মিলছিল বিভিন্ন তরঙ্গে—রেডিও, দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনি রশ্মি এবং তা এক্স-রে টেলিস্কোপে পর্যবেক্ষণ করা যায়। অন্য ছায়াপথের অদ্ভুত সব আলোর উৎস, যেগুলোর তারার ছাপের সঙ্গে কোনো মিল নেই। আশির দশকে ‘ইউনিফায়েড মডেল অব অ্যাকটিভ গ্যালাকটিক নিউক্লি’ ধারণাটি প্রচলিত হয়। তখন বোঝা যায়, এই অদ্ভুত বিকিরণ সব একই ধরনের উৎস থেকে আসছে। কিন্তু আমরা ভিন্ন ভিন্ন ছাপ দেখছি। কারণ, এই উৎসগুলোকে পৃথিবী থেকে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন কোণে (অ্যাঙ্গেলে)। অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো। আমরা যখন সব কটি পর্যবেক্ষণকে একত্র করে দেখি, তখন বুঝতে শুরু করি, অত্যন্ত ভারী ব্ল্যাকহোল এগুলো। সেগুলো ছায়াপথগুলোর ভেতরে অবস্থান করে। সেগুলো কেমন পরিবেশে আছে এবং কেন এগুলোর চারপাশে এত রকমের বিকিরণ দেখা যায়? যেমন এই প্রচণ্ড ভারী কৃষ্ণগহ্বরের আশপাশে ডিস্ক আকারে বস্তু জমা হয়, যা ধীরে ধীরে গহ্বরটির ভেতরে পড়ে। এই ডিস্কে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় দৃশ্যমান আলো ও অতিবেগুনি রশ্মি। এর ঠিক ওপরে বা নিচে প্রচণ্ড তাপমাত্রায় থাকে খুব কম ঘনত্বের গ্যাস। সেখান থেকে এক্স-রে উৎপন্ন হয়। কিছু কিছু ডিস্ক থেকে প্রচুর পরিমাণে বস্তুকণা অনেক দ্রুতগতিতে নির্গত হয়। একটি ব্ল্যাকহোলকে যদি আমরা এই জেট নির্গত হওয়ার অ্যাঙ্গেলে দেখি, সেটা থেকে প্রচুর পরিমাণে রেডিও বিকিরণ দেখতে পাব।

এমন অনেকগুলো ব্ল্যাকহোল আছে, যা থেকে শুধু এক্স-রে ও ইনফ্রারেড লাইট বা অবলোহিত আলো দেখা যায়। কারণ, এগুলোর আশপাশে ঘন ধোঁয়াটে গ্যাস জমাট বেঁধে থাকে। এই গ্যাস ভেদ করতে পারে শুধু অত্যন্ত শক্তিশালী এক্স-রে এবং এই গ্যাসে থাকা পরমাণু দৃশ্যমান আলো অতিবেগুনি কণা শুষে নিয়ে নির্গত করে অবলোহিত আলো। অবলোহিত আলোর আরেকটি বড় উৎস হচ্ছে সাধারণ তারা। তাই কৃষ্ণগহ্বর শনাক্ত করার সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট তরঙ্গ হচ্ছে এক্স-রে, যেটি গ্যাসঘেরা অথবা গ্যাসছাড়া সব ধরনের কৃষ্ণগহ্বরেরই সন্ধান দিতে পারে। এ পর্যন্ত যত এক্স-রে টেলিস্কোপে যত ধরনের কৃষ্ণগহ্বর দেখা গেছে, সেসব তথ্য একসঙ্গে করে বিশ্লেষণ করতে আমি একটি মডেল তৈরি করি। অত্যন্ত ভারী ব্ল্যাকহোলগুলো গত ১২ বিলিয়ন বছরে কী পরিবেশে বেড়ে উঠেছে এবং কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তা বর্ণনা করে এ মডেল। মডেলটির একটি উপসংহার হলো, মহাকাশে প্রচুর ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোল আছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী অর্ধেকের বেশি ব্ল্যাকহোল অত্যন্ত ধোঁয়াটে পরিবেশে বেড়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন
কৃষ্ণগহ্বর

উল্লেখযোগ্য কিছু পর্যবেক্ষণ

লাইগো: গত দশকে ব্ল্যাকহোল নিয়ে আরও কিছু চমৎকার এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করা হয়। এটির একটি হচ্ছে লাইগো (LIGO-Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory) এক্সপেরিমেন্ট, যেটির এক্সপেরিমেন্টাল সেটআপটি দেখানো হয়েছে ছবিতে (ছবি ১)। এখানে একটি লেজারের আলো বিভক্ত হয়ে দুটি সমান দূরত্বে থাকা আয়নার দিকে যায়। আয়না দুটি পরস্পরের সঙ্গে ৯০ ডিগ্রি কোণে অবস্থিত। আয়না দুটি প্রতিটি টানেল বা বাহুর মাথায় যুক্ত। প্রতিটি বাহুর দূরত্ব হচ্ছে চার কিলোমিটার। এই আয়নাগুলো থেকে ফিরে আসা লেজার রশ্মি একটি ফটোডায়োড দ্বারা শনাক্ত করা হয়। যেহেতু দুটি আয়নায় একই রকম সিগন্যাল যাচ্ছে, দুটি আয়না থেকে ফেরত আসা আলোটিও একই রকম হওয়ার কথা। একটি আয়না থেকে অন্য আয়নাটির আলোর সিগন্যালে যদি একটুও তারতম্য হয়, তাহলে ডায়োড সেটি ধরতে পারে। এ রকম দূরত্বে থাকা দুটি আয়নায় অনেকগুলো কারণে সিগন্যালে তারতম্য হয়ে থাকতে পারে, যেমন ভূমিকম্প অথবা ডিটেক্টরের আশপাশে যদি কোনো যানবাহন চলাচল করে অথবা খননকাজ চালানো হয়। এসব সমস্যা মাথায় রেখে খুব প্রত্যন্ত এক জায়গায় এই এক্সপেরিমেন্টগুলো সেটআপ করা হয়। একটি যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেটে, আরেকটি ওয়াশিংটন স্টেটে। দুটির মধ্যে দূরত্ব তিন হাজার দুই কিলোমিটার।

এই এক্সপেরিমেন্টের মূল আইডিয়া আসে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে। দুটি অত্যন্ত ঘন বস্তু, যেমন ব্ল্যাকহোল বা নিউট্রন স্টার যদি একটি আরেকটির কাছাকাছি আসে, তখন স্থান–কালে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। পানিতে নাড়া দিলে যেমন তরঙ্গ তৈরি হয়, অনেকটা তেমন তরঙ্গ। যদি স্থান–কাল তরঙ্গের কারণে বারবার প্রসারিত হয় বা সংকুচিত হয়, দুটি ৪ কিলোমিটার দূরত্বে রাখা ৯০ ডিগ্রি কোণে অবস্থিত আয়নার দুই বাহুতে ভিন্ন মাত্রায় প্রভাব ফেলবে। সেই প্রভাব ধরা পড়বে লেজারের আলোর তারতম্যে। যদি কোনো ভূমিকম্পের কারণে এই তরঙ্গের জন্ম না হয়, তাহলে এই তরঙ্গ দুটি লোকেশনেই একসঙ্গে ধরা পড়বে।

২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো ব্ল্যাকহোল সংঘর্ষের কারণে তৈরি হওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করে লাইগো। এ পর্যন্ত ৫০টির বেশি তরঙ্গ ধরা পড়েছে এই যন্ত্রে। যেগুলো জেনারেল রিলেটিভিটির সমাধনের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।

ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ

২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ আলোড়ন সৃষ্টি করে মেসিয়ের-৮৭ ছায়াপথের মাঝখানের কৃষ্ণগহ্বরটির ছবি তুলে। এটি একটি ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোল। এ রকম একটি ছবি তুলতে প্রয়োজন ছিল পৃথিবীর সমান একটি টেলিস্কোপের, যেটা বাস্তবে তৈরি করা সম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভব না হলেও শেপ ডলম্যান নামের স্মিথসনিয়ানের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী একটি প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, যেমন এটাকামা মরুভূমি, স্পেন, অ্যারিজোনা, হাওয়াই, দক্ষিণ মেরুতে থাকা রেডিও টেলিস্কোপগুলোকে একত্র করা যেতে পারে। এ জন্য সেগুলো থেকে বছরের পর বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হবে, তাহলে পৃথিবীর আয়তনের (সারফেসের) সমান একটি টেলিস্কোপের সমান রেজল্যুশন পাওয়া সম্ভব। প্রস্তাবটি দেওয়া হয় ১৯৯৭ সালের দিকে। এর কার্যক্রম শুরু করা হয় ২০০৯ সালে। একই বছর প্রথম ইভেন্ট হরাইজনে সম্পূর্ণ একটি ছবি তোলা হয়। একটা অ্যাক্রেশন ডিস্কসহ একটি কৃষ্ণগহ্বরের ছবি ছিল সেটা। তাতে দেখা যায়, জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুযায়ী স্থানের আকার বেঁকে যাওয়ায় ব্ল্যাকহোলের পেছনে অ্যাক্রেশন ডিস্কটির একটি অংশও ওপরে ও নিচে দৃশ্যমান। এই কৃষ্ণগহ্বর সূর্য থেকে ২৪০ কোটি গুণ ভারী। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ তথ্য সংগ্রহ করছে আমাদের ছায়াপথের মাঝখানে থাকা কৃষ্ণগহ্বর স্যাজিটারিয়াস এ*–এর ছবি তৈরি করতে। কৃষ্ণগহ্বরটা সূর্যের চেয়ে মাত্র ৪০ লাখ গুণ ভারী।

লেখক: গবেষক, ডার্টমাউথ কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র