আর্টেমিস প্রোগ্রামের আদ্যোপান্ত

গ্রিক পুরাণের গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর যমজ বোন এবং চাঁদের দেবীর নাম আর্টেমিস। তাঁর নামেই এই প্রোগ্রামের নাম রাখা হয়েছে।

প্রায় আড়াই মাস প্রতীক্ষার পর অবশেষে চাঁদের পথে ছুটল আর্টেমিস ১। আর্টেমিস প্রোগ্রামের প্রথম নভোযান এটি। বুধবার বাংলাদেশ সময় বেলা ১২টা ৪৭ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের প্যাড ৩৯বি থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় নভোযানটি। এর মাধ্যমে প্রায় ৫০ বছর পর চন্দ্রাভিযান শুরু করল মানুষ।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের লক্ষ্য মানুষকে চাঁদে ফিরিয়ে নেওয়া এবং মঙ্গলে পাড়ি দেওয়া। সেই লক্ষ্য পূরণের প্রথম ধাপ আর্টেমিস ১। এই মিশনের জন্য ব্যয় করছে কোটি কোটি ডলার। কিন্তু এতদিন পর কেন এতসব আয়োজন?

গ্রিক পুরাণের গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর যমজ বোন এবং চাঁদের দেবীর নাম আর্টেমিস। তাঁর নামেই এই প্রোগ্রামের নাম রাখা হয়েছে। ১৯৭২ সালে মানুষ সর্বশেষ চাঁদে পা রেখেছে। এরপর আর কোনো দেশ চাঁদে মানুষ পাঠানোর চেষ্টা করেনি। এর পেছনে অবশ্য যৌক্তিক কারণ আছে। চাঁদে মানুষ পাঠানোর চেয়ে রোবট পাঠালে খরচ কমে এবং সময়ও বাঁচে। যুক্তরাষ্ট্রের নভোচারীরা ছয়বার চাঁদে গিয়ে যে ধরনের গবেষণা করেছেন ও নমুনা সংগ্রহ করেছেন, তা এখন রোবট দিয়েই করা সম্ভব। সে কারণে ১৯৭২ সালের পর আর চাঁদে মানুষের পা পড়েনি। তবে এখন কেন নাসা আবার চাঁদে মানুষ পাঠাতে চায়?

শিল্পীর কল্পনায় ভবিষ্যতে চাঁদে নাসার মহাকাশ ঘাঁটি
চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রচেষ্টা নাসা শুরু করেছিল ২০০৫ সালে। সে সময় প্রোগ্রামটির নাম ছিল ‘কনস্টেলেশন প্রোগ্রাম’।

আসলে চাঁদে মানুষ পাঠানোর এই প্রচেষ্টা নাসা শুরু করেছিল ২০০৫ সালে। সে সময় প্রোগ্রামটির নাম ছিল ‘কনস্টেলেশন প্রোগ্রাম’। এ মিশনের জন্য অ্যারিস ১, অ্যারিস ৫ ও ওরিয়ন ক্রু এক্সপ্লোরেশন ভেহিকেল নির্মাণ শুরু করে সংস্থাটি। পরে যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনসহ একাধিক মিশন ও গবেষণা প্রজেক্টে বাজেট বরাদ্দ দিতে গিয়ে কনস্টেলেশন প্রোগ্রাম স্থগিত করতে বাধ্য হয়। এর সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রচেষ্টা আবার নতুনভাবে শুরু করেন। তখন মিশনটির নামকরণ করা হয় ‘আর্টেমিস প্রোগ্রাম’। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্পেস পলিসি ১-এর আওতায় এ প্রোগ্রামের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স চাঁদে মানুষ পাঠানো নিয়ে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেন। ২০২৪ সালের মধ্যে আবার চাঁদে মানুষ পাঠানোর সময়সীমা বেঁধে দেন তিনি। কিন্তু চাঁদে আবার মানুষ পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য কী?

এর দুটি কারণ আছে। মঙ্গলে যাওয়ার পথ সুগম করা এবং চাঁদের অন্ধকার অংশ সম্পর্কে জানা। চাঁদের অন্ধকার অংশ বা দক্ষিণ মেরু সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। কারণ, চাঁদ ও পৃথিবী টাইডাল লকের মাধ্যমে আবদ্ধ। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে শুধু চাঁদের একটি পাশ দেখা যায়। সূর্যের আলোও চাঁদের এ পাশে, অর্থাৎ উত্তর মেরুতে পড়ে। তাই অন্য পাশ, অর্থাৎ দক্ষিণ মেরু ডুবে থাকে অন্ধকারে।

আরও পড়ুন
মঙ্গলকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করতে ২০৩০ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে চায় নাসা।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি মিশনই ছিল চাঁদের উত্তর মেরুতে। এই প্রথম চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মানুষ পাঠাতে আগ্রহী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া চাঁদে একটি স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে নাসার। মঙ্গলে যেতে হলে প্রথমে পৃথিবী থেকে চাঁদে, তারপর চাঁদ থেকে মঙ্গলে যাওয়া সুবিধাজনক। এ জন্য প্রথমে চাঁদে একটি কলোনি তৈরি করতে চায় নাসা। সেখানে নভোচারীরা থাকবেন ও গবেষণা করবেন।

এ পর্যন্ত অনেক রোবট মঙ্গলে পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলের মাটি ও আবহাওয়া নিয়ে হয়েছে বিস্তর গবেষণা। সেই গবেষণাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে এবং মঙ্গলকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করতে ২০৩০ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে চায় নাসা। হয়তো মঙ্গলই হবে আমাদের পরবর্তী আবাসভূমি। কিন্তু মঙ্গলে যাওয়া তো মুখের কথা নয়। মঙ্গল মিশন সম্পন্ন করতে লাগবে তিন বছরের মতো। পৃথিবী থেকে শুধু মঙ্গলে যেতেই ছয়-সাত মাসের মতো লেগে যাবে। তার মানে, শুধু গিয়ে একদম দেরি না করে ফিরতি পথ ধরলেও মঙ্গলের উদ্দেশে যাত্রা করে ১৫ মাসের আগে পৃথিবীতে ফিরে আসা সম্ভব নয়। সে কারণে মঙ্গলে যাওয়ার ক্ষেত্রে চাঁদকে ব্যবহার করা যেতে পারে অস্থায়ী বিরতির স্থান হিসেবে। সেখান থেকে নভোচারীরা যাবেন মঙ্গলে। হয়তো মঙ্গলে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তৈরি করা যাবে চাঁদে। অথবা পৃথিবী থেকে জ্বালানি নিয়ে জমিয়ে রাখা যাবে। সেই জ্বালানি ব্যবহার করে পরে যাওয়া যাবে মঙ্গলে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে আর্টেমিস ১

দুই

আগেই বলেছি, ২০১৯ সালের ১৪ মে আর্টেমিস প্রোগ্রামের লক্ষ্য ঘোষণা করেছিল নাসা। লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম নাসা চাঁদে প্রথম নারী নভোচারী পাঠাবে। তাহলে কে হবেন চাঁদে পা রাখা প্রথম সেই সৌভাগ্যবান নারী?

এ প্রশ্নের উত্তর এখনো আমাদের কাছে নেই। কে প্রথম চাঁদে পা রাখবেন, তা এখনো জানায়নি নাসা। তবে আমাদের কাছে এমন কয়েকজন নারীর নাম আছে, যাঁদের একজন প্রথম চাঁদে পা রাখবেন। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি অ্যাপোলো মিশনে ১২ নভোচারী চাঁদে পা রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ নারী ছিলেন না। এখন দিন বদলেছে। নাসার নভোচারীদের তালিকায় এ মিশনের জন্য উপযুক্ত নারীর সংখ্যা অনেক। বলে রাখা প্রয়োজন, ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৭৫ জন নারী নভোচারী মহাকাশে গিয়েছেন।

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে আর্টেমিস মিশনের জন্য নভোচারীদের দল ঘোষণা করেছিল নাসা। সেই দলে ছিলেন নয়জন নারী। তাঁরা হলেন কাইল ব্যারন, ক্রিস্টিনা কোচ, নিকোল মান, অ্যানি ম্যাকক্লেইন, জেসিকা মেয়ার, জেসমিন মোঘবেলি, কেট রুবিনস, জেসিকা ওয়াটকিনস ও স্টেফানি উইলসন। তাঁদের মধ্য থেকেই কেউ হয়তো প্রথম নারী হিসেবে চাঁদে পা রাখবেন।

আর্টেমিস মিশনের ৯ নারী সদস্যের সঙ্গে ৯ পুরুষ নভোচারীর নামও ঘোষণা করেছে নাসা। চলতি বছরের আগস্টে নাসার মুখ্য নভোচারী রিড ওয়াজম্যান ঘোষণা করেন, আর্টেমিস মিশনের জন্য নির্বাচিত নভোচারীদের নাম পরে ঘোষণা করা হবে।

এসএলএসের মূল অংশ ৩২২ ফুট লম্বা।
আরও পড়ুন

তিন

আর্টেমিস প্রোগ্রামের তিনটি অংশের পরিকল্পনার কথা সবিস্তার জানিয়েছে নাসা। এই প্রোগ্রামে ব্যবহার করা হচ্ছে নাসার নতুন মেগারকেট এসএলএস এবং ওরিয়ন মহাকাশযান।

এসএলএস একদিকে আগের চেয়ে যেমন অনেক শক্তিশালী, তেমনি এতে থাকছে না কোনো লুনার ল্যান্ডার। নাসার লক্ষ্য, চাঁদের চারপাশে একটি বিশেষ কক্ষপথে লুনার গেটওয়ে স্থাপন করা। এসএলএস ওরিয়ন নভোযানকে নিয়ে যাবে সেই লুনার গেটওয়েতে। সেখানেই অবস্থান করবে এসএলএস ও ওরিয়ন নভোযান। আর আগে থেকেই একটি লুনার ল্যান্ডার থাকবে গেটওয়েতে। এই ল্যান্ডারের মাধ্যমে নভোচারীরা চাঁদে যাবেন ও ফিরে আসবেন। তারপর আবার এসএলএস নভোচারীদের নিয়ে ফিরবে পৃথিবীতে।

এসএলএসের মূল অংশ ৩২২ ফুট লম্বা। ওপরের অংশে থাকবে দুটি সলিড রকেট বুস্টার, যা নভোযানকে উৎক্ষেপণে সাহায্য করবে। আর্টেমিসের মানুষবাহী মিশনে ওরিয়ন মহাকাশযানকে চাঁদে পাঠানো হবে। ওরিয়ন নভোযান অ্যাপোলো মডিউলের চেয়েও বড়। এতে চার নভোচারীর জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। আর্টেমিস প্রোগ্রামের প্রথম মিশন আর্টেমিস ১।

আর্টেমিস ২ মিশনে থাকবেন চারজন নভোচারী। ওরিয়ন নভোযান তাঁদের পৃথিবী থেকে নিয়ে যাবে চাঁদের কক্ষপথে।

এ মিশনে অবশ্য নেই কোনো নভোচারী। মূলত এটি একটি পরীক্ষামূলক টেস্ট ফ্লাইট। এ মিশনের মাধ্যমে এসএলএস রকেটকে নিরাপদে মহাকাশে পাঠানোর পরীক্ষা করা হচ্ছে। এসএলএস রকেটটি ১৩টি ছোট নভোযানকে মহাকাশে নিয়ে গেছে। ছয় দিন চাঁদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করবে। ৪২ দিনের মিশন শেষে ২৬ নভেম্বর পৃথিবীতে ফিরে আসার কথা আর্টেমিস ১-এর।

অন্যদিকে আর্টেমিস ২ মিশনে থাকবেন চারজন নভোচারী। ওরিয়ন নভোযান তাঁদের পৃথিবী থেকে নিয়ে যাবে চাঁদের কক্ষপথে। এর আগে কোনো নভোচারী চাঁদের সম্পূর্ণ কক্ষপথ ভ্রমণ করেননি। ১০ দিনের এ মিশনে নভোচারীরা ঠিক তা-ই করবেন, চাঁদকে একবার প্রদক্ষিণ করে ফিরবেন পৃথিবীতে।

১৯৭২ সালের পর আর্টেমিস ৩ মিশনে মানুষ আবার চাঁদে ফিরবে। এ মিশনেই একজন নারী প্রথম চাঁদে পা রাখবেন। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেও এবারই প্রথম পড়বে মানুষের পা। এ মিশনে নভোচারীরা প্রায় এক সপ্তাহ চাঁদে থাকবেন। এ সময় তাঁরা গবেষণা করবেন চাঁদের অন্ধকার অংশ নিয়ে। তা ছাড়া চাঁদের মাটিতে কোথায় কলোনি তৈরি করা যায়, সেটাও খতিয়ে দেখবেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
আর্টেমিস ১ নভোযানে আছে তিনটি ডল পুতুল

চার

আর্টেমিস প্রোগ্রামের আরও কিছু লক্ষ্য আছে। যার প্রথমটির কথা আগেই বলেছি, লুনার অরবিটাল প্ল্যাটফর্ম গেটওয়ে। অর্থাৎ চাঁদের চারপাশে একটি স্টেশন তৈরি করা। ভবিষ্যতে চাঁদে অবস্থান করবে মানুষ। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় নভোচারীরা চাঁদে গিয়ে নানা রকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাবেন। এই গেটওয়ে চাঁদে নিয়ে যাওয়া হবে এসএলএস রকেটের মাধ্যমে। ওরিয়ন নভোযানের মাধ্যমে চার নভোচারী স্টেশনে প্রবেশ করবেন এবং সেখানে এক থেকে তিন মাস অবস্থান করবেন।

নভোচারীদের চাঁদের মাটিতে নামানোর জন্য ১১টি বেসরকারি কোম্পানিকে ৪ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা নভোচারীদের চাঁদের মাটিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নভোযান তৈরি করবে। এ ১১টি কোম্পানির মধ্যে রয়েছে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স ও জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন। ২০২৫ সালে আর্টেমিস ৩ মিশনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে স্পেসএক্সকে।

এ ছাড়া নয়টি ছোট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে রোবট বানানোর কাজে। তাদের বানানো রোবট বিভিন্ন মিশনে চাঁদে পাঠানো হবে। এসব রোবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে গবেষণা করে ও তথ্য বিশ্লেষণ করে সেগুলো পাঠাবে পৃথিবীতে। সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে নাসা। মূলত রোবটগুলো চাঁদের মাটিতে পানি ও খনিজ সম্পদের খোঁজ করবে। পানি থেকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আলাদা করে হয়তো রকেটের জ্বালানি তৈরি করা যাবে চাঁদের মাটিতে, এমনটি আশা করছেন নাসার বিজ্ঞানীরা।

অ্যাপোলো মিশনের পরও একাধিকবার নভোচারীরা স্পেসওয়াক করেছেন। কিন্তু সে জন্য কাউকে ভূপৃষ্ঠে পা রাখতে হয়নি। তবে আসন্ন মিশনের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কিছু স্পেসস্যুট তৈরি করেছে নাসা। এ রকম একটি স্পেসস্যুট ব্যবহার করা হবে উৎক্ষেপণ ও অবতরণের জন্য। এগুলোর একটি নভোযানের ভেতরে থাকার সময় পরবেন নভোচারীরা, আবার নভোযানের বাইরে যাওয়ার জন্য তাঁরা ব্যবহার করবেন আরেকটি স্পেসস্যুট। এ স্যুটগুলো নভোচারীদের আলাদা আলাদাভাবে পরতে হবে। আগের স্যুটগুলো পরে বেশি সময় থাকতে নভোচারীদের বেশ কষ্ট হতো। তা ছাড়া সেগুলো পরে পায়ের ব্যবহার তেমন করা যেত না। কিন্তু আসন্ন চন্দ্রমিশনে নভোচারীদের হাঁটাচলা ও পায়ের স্বস্তিকর ব্যবহারের দিকে খেয়াল রেখেই এসব নতুন স্পেসস্যুট ডিজাইন করা হয়েছে।

আপাতত নভোচারীদের অবতরণের জন্য চাঁদের দক্ষিণ মেরুকে ঠিক করা হয়েছে। এ অংশে আগে কখনো পা পড়েনি মানুষের।

পাঁচ

এ মিশনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রকেট উৎক্ষেপণ করা এবং নভোযানটিকে চাঁদের কক্ষপথে পাঠানো। মানুষকে চাঁদে পাঠানোর লক্ষ্যে এসএলএস রকেট ডিজাইন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে এসএলএস রকেটকে। প্রতি ঘণ্টায় ৪০ হাজার কিলোমিটার গতিতে ছোটার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এটি। আর্টেমিস মিশনের নভোযানগুলো উৎক্ষেপণের আট মিনিট পর মূল অংশটি খুলে যাবে এবং ভার বা নভোচারীবাহী অংশটি যাত্রা করবে চাঁদের দিকে। (বলে রাখি, আর্টেমিস ১ মিশনে নভোচারী থাকবে না। তবে তিনটি পুতুলকে পরীক্ষামূলক ভার হিসেবে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটের ভেতরে।) কথা হলো, এরপর চাঁদের কোথায় অবতরণ করবে মানুষ?

আপাতত নভোচারীদের অবতরণের জন্য চাঁদের দক্ষিণ মেরুকে ঠিক করা হয়েছে। এ অংশে আগে কখনো পা পড়েনি মানুষের। চাঁদের অন্ধকার অংশে আগে কখনো মানুষ যায়নি বলেই যে সেখানে অবতরণ করা হবে, তা নয়। আসলে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পানি থাকার সম্ভাবনা আছে। অবশ্য চাঁদের আলোকিত অংশেও পানি পাওয়া যেতে পারে। তবে দক্ষিণ মেরুর অন্ধকার অংশটি নিয়ে সেভাবে গবেষণা হয়নি বলেই এ মিশন থেকে ওই অংশ নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। সত্যিই চাঁদের বুকে পানি থাকলে নভোচারীদের জন্য পরবর্তী মিশনগুলো আরও সহজ হবে। সহজ হয়ে যাবে মঙ্গলে যাওয়ার ব্যাপারটাও। রকেটের জ্বালানি বা বিভিন্ন সরঞ্জামের কুলিং সিস্টেম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে চাঁদের পানি।

চাঁদের শাকলটন খাদের ব্যাস প্রায় ১৯ কিলোমিটার। এ খাদের গভীরে বিজ্ঞানীরা একটি স্থায়ী ছায়া দেখেছেন। এ ছাড়া এটির তাপমাত্রাও অনেক কম। তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই খাদে বরফ আকারে পানি জমে থাকতে পারে। অবশ্য ওই অঞ্চলে যেহেতু কখনো সূর্যের আলো পড়ে না, সে জন্য সেখানকার তাপমাত্রা কম হতে পারে। তবে বরফ আকারে পানি থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চাঁদের অন্ধকার অংশের বিভিন্ন গর্ত ও খাদে বরফ আকারে পানি থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

২০২৫ সাল পর্যন্ত আর্টেমিস মিশনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার।

ছয়

আর্টেমিস প্রোগ্রামের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে? সেটা নিশ্চিতভাবে জানা প্রায় অসম্ভব। ১৯৭৩ সালে অ্যাপোলো মিশনের বাজেট ছিল ২ হাজার ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার। ওই অর্থই এখন প্রায় ১৩ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমমূল্য। অর্থাৎ প্রতিটি অ্যাপোলো মিশনকে চাঁদে পাঠাতে ১৯৭০-এর দশকে প্রায় ২ হাজার ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

২০২৫ সাল পর্যন্ত আর্টেমিস মিশনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতিটি এসএলএস বা ওরিয়ন নভোযান উৎক্ষেপণের জন্য খরচ হবে ৪১০ কোটি মার্কিন ডলার।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: নাসা ও স্পেস ডটকম