সাক্ষাৎকার
আমরা পৃথিবীর বাইরে এমন জায়গা খুঁজছি যেখানে প্রাণ থাকতে পারে—নোজাইর খাজা, গ্রহ বিজ্ঞানী
শনির চাঁদ এনসেলাডাস। বরফে মোড়া এক রহস্যময় জগৎ। বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই জানেন যে সেখানে পানি আছে, তাপ আছে, এমনকি আছে জৈব উপাদানও। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, সেখানে চলছে আরও জটিল সব রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া। তাহলে কি এই বরফশীতল চাঁদে সত্যিই প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব?
জার্মানির বার্লিনের ফ্রেই ইউনিভার্সিটির প্ল্যানেটারি সায়েন্টিস্ট নোজাইর খাজা কাজ করছেন বরফাবৃত চাঁদের বাসযোগ্যতা নিয়ে। তিনি সম্প্রতি অ্যাস্ট্রোনমি ম্যাগাজিনে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরছেন কাজী আকাশ।
প্রশ্ন: এনসেলাডাস আসলে কী?
নোজাইর খাজা: সহজ করে বললে, শনির মাঝারি আকারের একটি চাঁদ এনসেলাডাস। ওপরটা পুরু বরফের চাদরে মোড়া, কিন্তু ঠিক তার নিচেই রয়েছে তরল পানির বিশাল এক মহাসাগর। এই মহাসাগর অনেকটা আমাদের পৃথিবীর মহাসাগরের মতোই। এটি সরাসরি এনসেলাডাসের পাথুরে কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। মজার ব্যাপার হলো, এই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে বরফের ফাটল দিয়ে ফোয়ারার মতো পানি ছিটকে বেরিয়ে আসে।
প্রশ্ন: কেন এই ফোয়ারা?
নোজাইর খাজা: এর মূল কারণ শনি গ্রহ। এনসেলাডাস যখন বিশাল শনি গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে, তখন শনির প্রবল মহাকর্ষ বলের টানে এই চাঁদটি ক্রমাগত সংকুচিত আর প্রসারিত হয়। অনেকটা রাবারের মতো। এই টানা-হেঁচড়ায় প্রচুর ঘর্ষণ হয়। আর তা থেকে জন্ম নেয় তাপ। তাপের কারণে এনসেলাডাসের সাগরের তলদেশে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট বা উষ্ণ প্রস্রবণ তৈরি করে। সেখান থেকেই পানির বাষ্প ও বরফকণা প্রচণ্ড বেগে ওপরের দিকে উঠে আসে। ফলে ফাটল দিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার উঁচুতে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: এনসেলাডাস নিয়ে বিজ্ঞানীদের এত আগ্রহ কেন?
নোজাইর খাজা: আমরা পৃথিবীর বাইরে এমন জায়গা খুঁজছি যেখানে প্রাণ থাকতে পারে বা অতীতে ছিল। একটা জায়গা বাসযোগ্য হতে হলে তাকে তিনটি সবুজ সংকেত বা শর্ত পূরণ করতে হয়। আর এনসেলাডাস এই তিনটিতেই পাস মার্ক পেয়েছে! প্রথম শর্ত, তরল পানি থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, শক্তির উৎস লাগবে (এখানে ওই যে বললাম, ঘর্ষণ থেকে তৈরি তাপ)। আর তৃতীয়ত, প্রাণ তৈরির জন্য কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস, সালফার ও জৈব অণুর মতো সঠিক উপাদান দরকার। এনসেলাডাসে আমরা এগুলোর সবই খুঁজে পেয়েছি।
প্রশ্ন: আপনার দল নতুন কী পেল?
নোজাইর খাজা: আমরা এনসেলাডাসের ফোয়ারা থেকে ছিটকে আসা বরফকণায় নতুন এবং জটিল সব জৈব যৌগ খুঁজে পেয়েছি। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। ক্যাসিনি মহাকাশযান ২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শনির রাজ্যে ছিল। আগে আমরা শনির ই-রিংয়ে জমে থাকা পুরোনো বরফকণা নিয়ে গবেষণা করতাম। কিন্তু এবার আমরা ক্যাসিনির সংগ্রহ করা একদম টাটকা বরফকণা পরীক্ষা করেছি। সেগুলো এনসেলাডাস থেকে বের হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেই নমুনা ও পুরোনো নমুনা নিয়ে গবেষণা করে আমরা একই ধরনের জটিল জৈব যৌগ থাকার প্রমাণ পেয়েছি। মানে এই জটিল রাসায়নিক উপাদানগুলোর উৎস এনসেলাডাসের ভেতরের সেই মহাসাগর। অর্থাৎ, শনির এই উপগ্রহটির মধ্যে বেশ জটিল রসায়নের খেলা চলছে!
প্রশ্ন: তার মানে কি সেখানে প্রাণ আছে?
নোজাইর খাজা: আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, এনসেলাডাসে প্রাণ টিকে থাকার তিনটি প্রধান ভিত্তিপ্রস্তরই আছে। তাই এটি বাসযোগ্য হওয়ার শক্তিশালী প্রার্থী। আমি আরেকটু এগিয়ে বলব, যদি ভবিষ্যতে আমরা সেখানে প্রাণের দেখা নাও পাই, তবুও এই গবেষণা বিফলে যাবে না। তখন আমরা উল্টো প্রশ্ন করতে পারব—পানি, তাপ আর জৈব উপাদান থাকার পরও কেন প্রাণ নেই? কীসের অভাব ছিল? এই উত্তরটা বিজ্ঞানকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে?
নোজাইর খাজা: আমরা ক্যাসিনির পাঠানো ডেটাগুলো আরও গভীরভাবে ঘেঁটে দেখছি। ভবিষ্যতে এনসেলাডাস বা বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপায় কী ধরনের যন্ত্রপাতি পাঠাতে হবে, সেটাও আমরা গবেষণা করছি। মহাকাশবিজ্ঞানের জন্য সামনে অনেক রোমাঞ্চকর সময় অপেক্ষা করছে!
