চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে লুকিয়ে আছে ৪০০ কোটি বছরের পুরনো রহস্য!

চাঁদের দক্ষিণ মেরুপ্রতীকী ছবি

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে নভোচারীরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যে আবার মানুষ চাঁদে নামবেন। তখন হয়তো তাঁরা এক অসাধারণ রহস্যের সন্ধান পাবেন। তাঁরা খুঁজে পেতে পারেন চাঁদের জন্মের ৪০০ কোটি বছরের পুরোনো ইতিহাস।

যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহবিজ্ঞানী জেফরি অ্যান্ড্রুজ-হ্যানা এই নতুন গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন। তিনিই এই সম্ভাবনার কথা বলছেন। ৮ অক্টোবর বিশ্বখ্যাত নেচার জার্নালে এ গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।

চাঁদের যে পিঠটি আমরা পৃথিবী থেকে দেখি সেটিকে বলে ‘নিয়ার সাইড’। এ পাশটি তুলনামূলকভাবে মসৃণ। কিন্তু এর উল্টো পিঠ মানে ‘ফার সাইড’ বিশাল বিশাল গর্ত বা ক্রেটারে ভরা। দীর্ঘদিন ধরে এই পার্থক্যের কারণ খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা।

প্রায় ৪৩০ কোটি বছর আগে সৌরজগৎ একদম নতুন ছিল। তখন একটি বিশাল গ্রহাণু চাঁদের উল্টো পিঠে আঘাত হানে। ফলে তৈরি হয় বিশাল সাউথ পোল-এইটকেন বেসিন বা সংক্ষেপে স্পা (SPA)। এটি চাঁদের সবচেয়ে বড় এবং পুরোনো সংঘর্ষের চিহ্ন। এর আয়তন উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ১ হাজার ২০০ মাইল এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ১ হাজার মাইল।

আরও পড়ুন
অ্যান্ড্রুজ-হ্যানা বলেন, ‘এর অর্থ হলো, আর্টেমিস মিশনগুলো এই গর্তের দক্ষিণ প্রান্তে অবতরণ করবে। চাঁদের গভীর থেকে ছিটকে আসা পদার্থগুলো ঠিক এখানেই জমা আছে। তাই এটিই গবেষণার জন্য সেরা জায়গা।’

বিজ্ঞানীরা এই বিশাল গর্তের আকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এটি অনেকটা অ্যাভোকাডোর মতো। এর সরু দিকটি রয়েছে দক্ষিণ দিকে। মানে গ্রহাণুটি উত্তর দিক থেকে এসে চাঁদে আঘাত হেনেছিল, দক্ষিণ থেকে নয়।

এই আবিষ্কার আর্টেমিস মিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অ্যান্ড্রুজ-হ্যানা বলেন, ‘এর অর্থ হলো, আর্টেমিস মিশনগুলো এই গর্তের দক্ষিণ প্রান্তে অবতরণ করবে। চাঁদের গভীর থেকে ছিটকে আসা পদার্থগুলো ঠিক এখানেই জমা আছে। তাই এটিই গবেষণার জন্য সেরা জায়গা।’

চাঁদের উল্টো পিঠ মানে ‘ফার সাইড’ বিশাল বিশাল গর্ত বা ক্রেটারে ভরা
প্রতীকী ছবি

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জন্মের পর চাঁদ ছিল একটি উত্তপ্ত তরল লাভা বা ম্যাগমার সাগর। ধীরে ধীরে এটি ঠান্ডা হওয়ার সময় ভারী খনিজগুলো ডুবে গিয়ে চাঁদের কেন্দ্র বা ম্যান্টল তৈরি করে। আর হালকা খনিজগুলো ওপরে ভেসে উঠে তৈরি করে চাঁদের পৃষ্ঠ বা ক্রাস্ট।

কিন্তু পটাশিয়াম, ফসফরাস ও রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসের মতো কিছু উপাদান এই স্তরগুলোতে ঠিকমতো মিশতে পারেনি। এই তিনটিকে একত্রে বলে KREEP। K মানে পটাশিয়াম, REE মানে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস এবং P মানে ফসফরাস। এগুলো শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট তরল ম্যাগমার মধ্যে ঘনীভূত হয়েছিল।

আরও পড়ুন
স্পা গর্তের নতুন বিশ্লেষণ এই তত্ত্বকেই সমর্থন করে। দেখা গেছে, গর্তটির পশ্চিম পাশে তেজস্ক্রিয় থোরিয়াম আছে প্রচুর, কিন্তু পূর্ব পাশে নেই। থোরিয়ামও এক ধরনের KREEP উপাদান।
চাঁদ
ছবি: সংগৃহীত

চাঁদের উল্টো পিঠের ক্রাস্ট সামনের পিঠের চেয়ে অনেক বেশি পুরু। অ্যান্ড্রুজ-হ্যানার তত্ত্ব অনুযায়ী, উল্টো পিঠের ক্রাস্ট যখন পুরু হচ্ছিল, তখন এটি নিচের ম্যাগমা সাগরকে চাপ দেয়। ফলে KREEP-সমৃদ্ধ ম্যাগমা টিউব থেকে টুথপেস্ট বের হওয়ার মতো সামনের পিঠে এসে জমা হয়। এ কারণেই চাঁদের সামনের পিঠে আগ্নেয়গিরির অনেক বেশি। 

স্পা গর্তের নতুন বিশ্লেষণ এই তত্ত্বকেই সমর্থন করে। দেখা গেছে, গর্তটির পশ্চিম পাশে তেজস্ক্রিয় থোরিয়াম আছে প্রচুর, কিন্তু পূর্ব পাশে নেই। থোরিয়ামও এক ধরনের KREEP উপাদান। মানে গ্রহাণুটি ঠিক সেই সীমানায় আঘাত করেছিল, যা KREEP সমৃদ্ধ এলাকাকে সাধারণ এলাকা থেকে পৃথক করেছে।

চাঁদের ইতিহাস নিয়ে এখনো অনেক রহস্য বাকি। নভোচারীরা যখন চাঁদের মাটি ও পাথরের নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন, তখন বিজ্ঞানীরা সেই রহস্য সমাধানের আরও সূত্র খুঁজে পাবেন।

এ ব্যাপারে অ্যান্ড্রুজ-হ্যানা বলেন, ‘আর্টেমিসের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীতে আবার নমুনা পাবো। তখন জানা যাবে, ওই অঞ্চল আসলে কী দিয়ে তৈরি। আমাদের গবেষণা দেখাচ্ছে, এই নমুনাগুলো চাঁদের প্রাথমিক বিবর্তন সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য দেবে। হয়তো আগে আমরা এগুলো ধারণাও করতে করিনি।

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: সায়েন্স ডেইলি

আরও পড়ুন