২০২২ সালের ৩০ জুলাই। পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে চীনের লং মার্চ ৫বি রকেট। এর বছর খানেক আগে রকেটটা সফলভাবে পৌঁছে গিয়েছিল মহাকাশে। নির্দিষ্ট কাজ শেষ করে ফিরছিল পৃথিবীতে। আর তখনই অতিরিক্ত ভরের কারণে তা ধ্বংস হয়ে যায়। সেসব ধ্বংসাবশেষ আছড়ে পরে মালদ্বীপের কাছে, ভারত মহাসাগরে। এ ঘটনায় অনেকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কোথায় পড়বে, সেখানকার মানুষজন কি সব মারা যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে ওই শহর—এমন নানা প্রশ্ন ঘুরছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে। যদিও এই রকেটের আঘাতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু মানুষের এমন আতঙ্কিত হওয়াও তো অমূলক নয়। কারণটা তো বোঝাই যাচ্ছে, যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় পড়তে পারে এমন রকেট বা স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ। এ ছাড়াও আরও কারণ আছে। আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে মহাকাশ থেকে আসা একটি গ্রহাণুর কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ডাইনোসরসহ অন্যান্য প্রাণী। ফলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, মহাকাশ থেকে রকেট বা স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ, অর্থাৎ স্পেস জাঙ্ক কিংবা গ্রহাণুর পৃথিবীতে আঘাত করা আশঙ্কা কতটুকু? আরেকটু গুছিয়ে এককথায় বললে, মহাকাশের কোনো বস্তুর পৃথিবীর আঘাত করার আশঙ্কা কতটা? সেই আঘাতে কি আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন?
এই টুকরোগুলোর কিছু কিছু পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের টানে ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে।
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ছোট্ট করে একটু বলে নিই, মাথায় পড়ার জন্য মহাকাশে ধ্বংসাবশেষ আসলে কীভাবে তৈরি হয়? যখন কোনো স্যাটেলাইট বা রকেট মহাকাশে কাজ শেষ করে, তখন সেগুলোকে সাধারণত ভূপৃষ্ঠে ফিরিয়ে আনা হয় বা মহাকাশেই একটা নিরাপদ কক্ষপথে পাঠানো হয়। কিন্তু সব সময় সেটা সম্ভব হয় না। কিছু কিছু উপগ্রহ বা রকেটের অংশ মহাকাশে আটকে থাকে, পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে যায় সেগুলো। এগুলোকেই বলা হয় ‘স্পেস জাংক’ বা মহাকাশীয় বর্জ্য। এই টুকরোগুলোর কিছু কিছু পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের টানে ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে।
এবারে প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাক। মহাকাশ থেকে স্পেস জাঙ্ক বা গ্রহাণুর মতো বস্তুর পৃথিবীতে আঘাত করার আশঙ্কা প্রবল। আসলে প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে ঢুকে পড়ে এসব জিনিস। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতে, গত ৫০ বছরে প্রতিদিন গড়ে এক টুকরো মহাকাশীয় বস্তু পৃথিবীতে পড়ছে। তথ্যটা শুনতে ভয়ংকর লাগছে, যেন বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু ঘটনা সত্যি। গড়ে প্রতিদিন মহাকাশ থেকে কিছু না কিছু পৃথিবীতে পড়ছে। একইরকম আরেকটা উদাহরণ দিই। প্রতিদিন পৃথিবীতে কমপক্ষে ৩টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বেশির ভাগই অ-বাণিজ্যিক ও হালকা বিমান। কিন্তু এই তথ্যও যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মহাকাশীয় বস্তু পড়া বলুন আর বিমান দুর্ঘটনাই বলুন, এতে কিন্তু কোনো মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না তেমন। মহাকাশীয় বস্তু পড়ায় গত ৫০ বছরে কোনো মানুষ আহতও হয়নি। কারণ, এসব বস্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানোর আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফলে অনেক ওপর থেকে পড়লেও ছোট গ্রহাণু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।
স্পেস জাঙ্ক অর্থাৎ রকেট বা স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ নিয়েও তেমন ভয়ের কিছু নেই আসলে। নাসা এবং অন্য মহাকাশ সংস্থাগুলো নিয়মিতই এদের দিকে নজর রাখে। রাডার এবং ইলেকট্র-অপটিক্যাল সেন্সরের মাধ্যমে দেখা হয়, এগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে যে কক্ষপথে ঘুরছে, সেখানে কোথায় আছে, কোনদিকে যাচ্ছে। শুধু বড় কোনো গ্রহাণু যদি পৃথিবীতে ঢুকে পড়ে, যা ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানোর আগে পুড়ে ছাই হবে না, তাহলে বিপদ হতে পারে। কিন্তু এতেও ভয়ের কিছু নেই। কারণ, নাসা সেগুলোর দিকেও নিয়মিত নজর রাখে। এমন কোনো বস্তু দেখলে মহাকাশে থাকা অবস্থায় সেগুলোর গতিপথ বদলে দেওয়ার সক্ষমতা এখন মানুষের আছে। এ জন্য আলাদা একটি প্রকল্পই রয়েছে নাসার। নাম ডার্ট মিশন। ইতিমধ্যে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, এই প্রকল্পের অধীনে বানানো বিশেষ নভোযান দিয়ে আঘাত করে বড় গ্রহাণুর গতিপথ বদলে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ সেটি আর পৃথিবীতে এসে পড়বে না, অন্যদিকে সরে যেতে বাধ্য হবে।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসা যাক। মহাকাশীয় সেই বস্তু, সেটা হোক স্পেস জাঙ্ক বা গ্রহাণু, আপনার মাথায় পড়ার আশঙ্কা কতটুকু? এই আশঙ্কাও খুব কম। পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ বাস করে ঠিকই, তবু পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গা ফাঁকা। পানি ও বন-জঙ্গলে ঢাকা। পৃথিবীর সব মানুষ যদি ঘরের বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ায়, তাতেও মাত্র ০.০০০২ শতাংশ জায়গা ভরবে। সুতরাং নাসার চোখ ফাঁকি দিয়ে যদি কোনো বড় গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে, তবু ৯৯.৯৯৮ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে যে ওটা ফাঁকা জায়গায় পড়বে। এই সম্ভাবনার মানে হলো, প্রতি ১ হাজার ৩০০ বছরে একজন মানুষ মারা যেতে পারেন মহাকাশীয় বস্তুর আঘাতে। ফলে মহাকাশ থেকে পড়া কোনো বস্তু আপনার মাথায় পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবু দুর্ঘটনার ওপর কারো হাত নেই। চীনের লং মার্চ ৫বি রকেটের পৃথিবীতে আছড়ে পড়া সে ইঙ্গিতই দেয়। তবু যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করা হয় এগুলো প্রতিরোধে। নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়, এ ধরনের কিছু যদি পৃথিবীতে ঢুকে পড়েও, তবু যেন জনবহুল এলাকায় ঢুকে না পড়ে।
ঠিক ধরেছেন, আপনি-আমি-আমরা যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারি, সারাক্ষণ যেন তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আকাশে তাকিয়ে থাকতে না হয় বা ডাইনোসরদের মতো অসহায়ভাবে গ্রহাণুর আঘাতে বিলুপ্ত না হয়ে যায় মানব সভ্যতা, তার সব ব্যবস্থাই মোটামুটি বিজ্ঞানীরা নিয়েছেন। শুধু নিজেদের হাত থেকে আমাদের সভ্যতাটাকে বাঁচানোর বাস্তব কোনো সমাধান এখনো মেলেনি। সে কারণেই এত যুদ্ধ আজও দেশে দেশে।