হীরের বৃষ্টি ঝরা লেবু আকৃতির অদ্ভুৎ গ্রহ খুঁজে পেয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ
মহাকাশ নিয়ে আমাদের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম যখন সৌরজগতের বাইরের গ্রহ বা এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কৃত হলো, তখন থেকেই একের পর এক চমক আসছে। কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এবার যা দেখাল, তাতে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়েছেন।
কারণ, গ্রহ সাধারণত গোল হয়। পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি গ্রহ তো প্রায় গোলগালই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এবার এমন এক গ্রহের খোঁজ পেয়েছেন, যেটা গোল নয়। এটা দেখতে অবিকল একটা লেবু বা রাগবি বলের মতো চ্যাপ্টা!
গ্রহটির খটমটে নাম ‘পিএসআর জে২৩২২-২৬৫০বি’। নাম যা-ই হোক, এর স্বভাব-চরিত্র মহাকাশ বিজ্ঞানের সব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে। এই গ্রহটি এক মৃত নক্ষত্র বা পালসারের চারপাশে ঘুরছে। এই পালসারগুলো মহাকাশের লাইটহাউসের মতো। এরা সেকেন্ডে ৭০০ বার পর্যন্ত ঘুরতে পারে এবং মারাত্মক রেডিয়েশন ছড়ায়।
লেবু আকৃতির গ্রহটি তার পালসার নক্ষত্রের খুব কাছে, মাত্র ১৬ লাখ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৃথিবী সূর্যের চেয়ে যত দূরে, তার চেয়ে এটা ১০০ গুণ কাছে! মানে পৃথিবী তো সূর্য থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এই গ্রহটি তার নিজ নক্ষত্র থেকে পৃথিবীর তুলনায় ১০০ গুণ কাছে। মাত্র ৮ ঘণ্টায় এটি তার নক্ষত্রকে একবার ঘুরে আসে। আর পৃথিবীর লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন।
লেবু আকৃতির পিএসআর জে২৩২২-২৬৫০বি গ্রহটি তার পালসার নক্ষত্রের খুব কাছে, মাত্র ১৬ লাখ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৃথিবী সূর্যের চেয়ে যত দূরে, তার চেয়ে এটা ১০০ গুণ কাছে!
নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ বল এ গ্রহটিকে এত জোরে নিজের দিকে টানছে যে বেচারা গ্রহ গোল থাকার সুযোগই পাচ্ছে না। টানে লম্বা হয়ে লেবুর আকার ধারণ করেছে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে টাইডাল ফোর্স।
তবে এই গ্রহের আরও চমক আছে। তা হলো গ্রহটির আবহাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি ইনস্টিটিউশন ফর সায়েন্সের গবেষক পিটার গাও বলছেন, ‘আমরা ডেটা হাতে পাওয়ার পর বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এটা আমাদের সব প্রত্যাশা ওলট-পালট করে দিয়েছে।’
সাধারণত এক্সোপ্ল্যানেটগুলোতে আমরা পানি, মিথেন বা কার্বন ডাই-অক্সাইড খুঁজি। কিন্তু এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এসবের বালাই নেই। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ঝাং জানাচ্ছেন, এখানে আছে শুধু হিলিয়াম আর কার্বন। তাও সাধারণ কার্বন নয়, মলিকিউলার কার্বন। মানে কার্বন-২ এবং কার্বন-৩।
সবচেয়ে রোমাঞ্চকর তথ্য হলো, এই গ্রহে কার্বনের ঘন কালো মেঘ আছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই ঝুল বা সুট (Soot) জমে সেখানে হীরের বৃষ্টি হতে পারে! ভাবুন তো, আকাশ থেকে পানির বদলে হীরা পড়ছে! এই পুরো সিস্টেমটাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ব্ল্যাক উইডো পালসার। কালো বিধবা মাকড়সা যেমন তার পুরুষ সঙ্গীকে খেয়ে ফেলে, এই পালসারটিও তার সঙ্গীকে (মানে আমাদের এই গ্রহটিকে) নিজের রেডিয়েশন দিয়ে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলছে বা বাষ্পীভূত করে দিচ্ছে।
গ্রহটি তার নক্ষত্রের সঙ্গে টাইডাল লক অবস্থায় আছে। মানে এর এক পিঠ সব সময় নক্ষত্রের দিকে থাকে (দিন), আর অন্য পিঠ উল্টো দিকে (রাত)। দিনের তাপমাত্রা থাকে ২ হাজার ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাতের তাপমাত্রা ৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ঝাং জানাচ্ছেন, এখানে আছে শুধু হিলিয়াম আর কার্বন। তাও সাধারণ কার্বন নয়, মলিকিউলার কার্বন। মানে কার্বন-২ এবং কার্বন-৩।
তবে এখানেও রহস্যের শেষ নয়। এই গ্রহ তৈরি হলো কীভাবে, তা নিয়েই বিজ্ঞানীরা ভাবছেন? সাধারণ নিয়মে এমন গ্রহ তৈরি হওয়া অসম্ভব। কোনো নক্ষত্রের ওপরের স্তর খসে গিয়েও যদি গ্রহটি তৈরি হতো, তবুও তাতে এত বিশুদ্ধ কার্বন থাকার কথা নয়। নিউক্লিয়ার ফিজিকসের কোনো নিয়ম দিয়েই এর জন্মরহস্য ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক রজার রোমানি অবশ্য একটা ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, হয়তো নক্ষত্রটি ঠান্ডা হওয়ার সময় এর ভেতরের কার্বন আর অক্সিজেন ক্রিস্টাল বা দানা বাঁধতে শুরু করে। হালকা কার্বন ওপরের দিকে ভেসে ওঠে এবং হিলিয়ামের সঙ্গে মিশে এই অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে। কিন্তু অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন গেল কোথায়? সেটা এক রহস্য!
তবে বিজ্ঞানীরা হতাশ নন। রোমানি হাসিমুখেই বললেন, ‘সবকিছু না জানাটাই আসলে মজার। মহাকাশ আমাদের জন্য একটা ধাঁধা রেখে দিয়েছে। আর সেটা সমাধান করার আনন্দই আলাদা।’