মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পদার্থ কোথায় লুকিয়ে আছে

শিল্পীর কল্পনায় রহস্যময় মহাবিশ্বছবি: গেটি ইমেজ

টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশের দিকে তাকালে আপনি অসংখ্য গ্যালাক্সি দেখতে পাবেন। প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে আছে একটি বিশাল ব্ল্যাকহোল, আর তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি নক্ষত্র ও গ্রহমণ্ডলী। মহাবিশ্ব যেন এসব বিশাল ও দর্শনীয় বস্তুতেই ভরা। স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পদার্থ এসব বড় বড় জিনিসের মধ্যেই জমা আছে।

কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টো। এই সত্যটাই বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীদের জন্য এক বড় ধাঁধা হয়ে ছিল। বিগ ব্যাং তত্ত্ব বলছে, মহাবিশ্বের মোট উপাদানের প্রায় পাঁচ শতাংশ হওয়া উচিত সাধারণ পরমাণু দিয়ে তৈরি পদার্থ। সেগুলোর গঠন প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি। সমস্যা হলো, এই পরমাণুগুলোর বেশিরভাগকেই নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে এগুলো গেল কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে মাথা ঘামিয়েছেন। এই লেখায় আপনি জানবেন, কীভাবে বিজ্ঞানীরা এই হারিয়ে যাওয়া পদার্থের খোঁজ পেয়েছেন এবং কোথায় লুকিয়ে ছিল এই বিপুল পরিমাণ বস্তু।

কসমিক ওয়েব বা মহাজাগতিক জাল
ছবি: নাসা

গ্যালাক্সিগুলোর ভেতরে যদি এই পদার্থ না থাকে, তাহলে সবচেয়ে যৌক্তিক ধারণা হলো, এগুলো লুকিয়ে আছে গ্যালাক্সিগুলোর মাঝখানের অন্ধকার জায়গায়। মহাকাশকে আমরা প্রায়ই শূন্যস্থান বলে ভাবি, কিন্তু সেটা পুরোপুরি খালি নয়। নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির মাঝখানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আলাদা আলাদা কণা ও পরমাণু। এগুলো মিলেই তৈরি করে এক ধরনের অদৃশ্য সুতোর মতো জাল, যার নাম কসমিক ওয়েব বা মহাজাগতিক জাল।

আরও পড়ুন
বিগ ব্যাং তত্ত্ব বলছে, মহাবিশ্বের মোট উপাদানের প্রায় পাঁচ শতাংশ হওয়া উচিত সাধারণ পরমাণু দিয়ে তৈরি পদার্থ। সেগুলোর গঠন প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি।

২০২৫ সালের জুন মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীদের একটি দল একটি অভিনব রেডিও পদ্ধতি ব্যবহার করে মহাবিশ্বের সাধারণ পদার্থের পূর্ণ গণনা সম্পন্ন করেছেন। এখন দেখা যাক, বিজ্ঞানীরা কী খুঁজে পেয়েছেন।

সাধারণ পদার্থ খোঁজার প্রথম ও সহজ জায়গা হলো নক্ষত্র। মহাকর্ষের কারণে নক্ষত্রগুলো একসঙ্গে জড়ো হয়ে গ্যালাক্সি তৈরি করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব জুড়ে গ্যালাক্সি গুনতে পারেন।

এই হিসাব অনুযায়ী, মহাবিশ্বে আছে কয়েক শ বিলিয়ন গ্যালাক্সি, আর প্রতিটি গ্যালাক্সিতে আছে কয়েকশ বিলিয়ন নক্ষত্র। সংখ্যাগুলো পুরোপুরি নির্দিষ্ট নয়, কারণ অনেক নক্ষত্র গ্যালাক্সির বাইরেও ঘুরে বেড়ায়। সব মিলিয়ে মহাবিশ্বে আনুমানিক ১০২৩টি গ্যালাক্সি আছে। এই সংখ্যা পৃথিবীর সব সমুদ্রতটের বালুকণার সংখ্যার চেয়েও কয়েকশ গুণ বেশি। অন্যদিকে, পুরো মহাবিশ্বে আনুমানিক পরমাণু আছে ১০৮২টি।

মহাবিশ্বে কয়েক শ বিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে
ছবি: ব্রিটানিকা

সংখ্যা এত বিশাল হলেও বিগ ব্যাং তত্ত্ব যে পরিমাণ পদার্থের কথা বলছে, এগুলো তার তুলনায় অনেক কম। হিসাব করে দেখা যায়, নক্ষত্রের ভেতরে আছে মহাবিশ্বের মোট সাধারণ পদার্থের মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ। এর চেয়ে প্রায় দশ গুণ বেশি পরমাণু মহাকাশে মুক্তভাবে ভাসছে। আর হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম ছাড়া অন্য মৌল রয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। এই অন্যান্য মৌলের মধ্যে আছে কার্বন ও জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো।

আরও পড়ুন
মহাবিশ্বে আনুমানিক ১০২৩টি গ্যালাক্সি আছে। এই সংখ্যা পৃথিবীর সব সমুদ্রতটের বালুকণার সংখ্যার চেয়েও কয়েকশ গুণ বেশি। অন্যদিকে, পুরো মহাবিশ্বে আনুমানিক পরমাণু আছে ১০৮২টি।

এবার গ্যালাক্সিগুলোর কেন্দ্রে যাওয়া যাক। গ্যালাক্সিগুলোর মাঝের স্থানকে বলা হয় ইন্টারগ্যালাকটিক মাধ্যম। এটি প্রায় সম্পূর্ণ শূন্য বলে মনে হলেও পুরোপুরি খালি নয়। সেখানে প্রতি ঘনমিটারে মাত্র একটি পরমাণু থাকে। এটি পৃথিবীর বাতাসের ঘনত্বের এক বিলিয়ন ভাগের এক বিলিয়ন ভাগেরও কম। কিন্তু মহাবিশ্বের আকার এত বিশাল যে, এই অতি বিরল পদার্থ মিলিয়েও বিপুল পরিমাণ হয়।

এই ইন্টারগ্যালাকটিক মাধ্যম খুবই গরম, তাপমাত্রা লাখ লাখ ডিগ্রি। একে দেখা খুব কঠিন, যদি না এক্স-রে টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হয়। কারণ, এত গরম গ্যাস খুব ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এক্স-রে বিকিরণ করে। আবার এক্স-রে টেলিস্কোপগুলোর সংবেদনশীলতাও সীমিত, কারণ সেগুলো সাধারণ অপটিক্যাল টেলিস্কোপের তুলনায় আকারে ছোট।

গ্যালাক্সিগুলোর মাঝের স্থানকে বলা হয় ইন্টারগ্যালাকটিক মাধ্যম
ছবি: ব্রিটানিকা

এই সমস্যার সমাধানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন একটি নতুন হাতিয়ার, ফাস্ট রেডিও বার্স্ট। এগুলো খুবই শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গের বিস্ফোরণ। এক মিলিসেকেন্ডে সূর্য তিন দিনে যত শক্তি ছাড়ে, ততটাই শক্তি ছাড়তে পারে। এগুলো প্রথম আবিষ্কৃত হয় ২০০৭ সালে।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই বিস্ফোরণগুলো দূরবর্তী গ্যালাক্সিতে থাকা অতি ঘন নাক্ষত্রিক অবশেষ থেকে আসে। মহাকাশ পেরিয়ে আসতে আসতে এদের শক্তি অনেকটা কমে যায়। পৃথিবীতে পৌঁছানোর সময় এই সংকেত এত দুর্বল হয়ে পড়ে যে, চাঁদ থেকে নির্গত একটি মোবাইল ফোন সিগন্যাল ধরার চেয়েও প্রায় এক হাজার গুণ দুর্বল হয়।

আরও পড়ুন
ফাস্ট রেডিও বার্স্ট খুবই শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গের বিস্ফোরণ। এক মিলিসেকেন্ডে সূর্য তিন দিনে যত শক্তি ছাড়ে, ততটাই শক্তি ছাড়তে পারে। এগুলো প্রথম আবিষ্কৃত হয় ২০০৭ সালে।

২০২৫ সালের শুরুতে প্রকাশিত গবেষণায় জানা যায়, এই বিস্ফোরণগুলোর উৎস এক ধরনের অতিঘন নিউট্রন নক্ষত্র, যার চারপাশে থাকে খুবই শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র। নিউট্রন নক্ষত্র গঠিত হয় একটি বিশাল নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর, যখন নক্ষত্র নিজেই ভেঙে পড়ে। যে নিউট্রন নক্ষত্রগুলো রেডিও বিস্ফোরণ ঘটায়, সেগুলোকে বলা হয় ম্যাগনেটার। এদের চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে প্রায় এক হাজার ট্রিলিয়ন গুণ শক্তিশালী।

যদিও বিজ্ঞানীরা এখনো ফাস্ট রেডিও বার্স্ট পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি, তবে এগুলো ব্যবহার করে গ্যালাক্সিগুলোর মাঝের অঞ্চল পরীক্ষা করা যায়। বিস্ফোরণগুলো যখন মহাকাশ পেরিয়ে আসে, তখন ইন্টারগ্যালাকটিক গ্যাসের ইলেকট্রনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার কারণে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি ধীরে চলে। ফলে রেডিও সংকেত ছড়িয়ে যায়। প্রিজম যেমন সূর্যের আলো ভেঙে রংধনু বানায়, অনেকটা সেভাবে। এই ছড়িয়ে পড়ার পরিমাণ মেপেই বিজ্ঞানীরা হিসাব করেন, সংকেতটি পৃথিবীতে আসতে কতটা গ্যাসের ভেতর দিয়ে গেছে।

কম্পিউটার সিমুলেশনে দেখা যাচ্ছে ইন্টারগ্যালাকটিক গ্যাসের ছড়িয়ে থাকা চিত্র
ছবি: উইকিপিডিয়া

২০২৫ সালের জুনে প্রকাশিত নতুন গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেক ও হার্ভার্ড সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের বিজ্ঞানীরা ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ১১০টি রেডিও টেলিস্কোপ নিয়ে তৈরি একটি অ্যারে ব্যবহার করে ৬৯টি ফাস্ট রেডিও বার্স্ট বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, মহাবিশ্বের সাধারণ পদার্থের প্রায় ৭৬ শতাংশ রয়েছে গ্যালাক্সিগুলোর মাঝখানে। আরও প্রায় ১৫ শতাংশ আছে গ্যালাক্সির হ্যালোতে, মানে দৃশ্যমান নক্ষত্রগুলোর চারপাশে। আর বাকি প্রায় ৯ শতাংশ আছে নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির ভেতরের ঠান্ডা গ্যাসে।

আরও পড়ুন
যে নিউট্রন নক্ষত্রগুলো রেডিও বিস্ফোরণ ঘটায়, সেগুলোকে বলা হয় ম্যাগনেটার। এদের চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে প্রায় এক হাজার ট্রিলিয়ন গুণ শক্তিশালী।

এই পূর্ণ হিসাব বিগ ব্যাং তত্ত্বকে শক্তভাবে সমর্থন করে। তত্ত্বটি যে পরিমাণ সাধারণ পদার্থের কথা বলেছিল, সেই প্রায় পাঁচ শতাংশই বাস্তবে খুঁজে পাওয়া গেছে। এ দিক থেকে বলা যায়, তত্ত্বটি একটি বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

ইতিমধ্যে কয়েক হাজার ফাস্ট রেডিও বার্স্ট শনাক্ত করা হয়েছে। সামনে আসছে নতুন রেডিও টেলিস্কোপ অ্যারে, যা হয়তো বছরে দশ হাজার পর্যন্ত এই বিস্ফোরণ শনাক্ত করতে পারবে। এত বড় সংখ্যক পর্যবেক্ষণ ফাস্ট রেডিও বার্স্টকে জ্যোতির্বিদদের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার বানাবে। ভবিষ্যতে রেডিও বার্স্ট শুধু পরমাণু না গুনে কসমিক ওয়েবের ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরিতেও সাহায্য করবে।

তবে এখানেই গল্প শেষ নয়। বিজ্ঞানীরা এখন সাধারণ পদার্থের পূর্ণ চিত্র পেয়েছেন বটে, কিন্তু মহাবিশ্বের বেশিরভাগ অংশ তৈরি যে উপাদান দিয়ে, যেগুলো তাঁরা এখনো পুরোপুরি বোঝেন না।

ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বের দ্রুত প্রসারণ ঘটাচ্ছে
ছবি: নাসা

মহাবিশ্বের সবচেয়ে বেশি অংশ জুড়ে আছে ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি। ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বের দ্রুত প্রসারণ ঘটাচ্ছে। আর ডার্ক ম্যাটার হলো সেই অদৃশ্য শক্তি, যা গ্যালাক্সি আর বড় কাঠামোকে একসঙ্গে ধরে রেখেছে।

একটি বড় রহস্যের সমাধান হয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় রহস্য এখনো রয়ে গেছে। ডার্ক ম্যাটার আজও অজানা হলেও আমরা অন্তত জানি, আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব কোথায় আছে। আর এই জানাটাও বিজ্ঞানের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়!

লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, শশিকর, মাদারীপুর

সূত্র: স্পেস ডটকম

আরও পড়ুন