চাঁদে কি গ্রহাণু আঘাত করবে
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে একটা গ্রহাণু আঘাত করেছিল পৃথিবীতে। তাতেই পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ডাইনোসরসহ পৃথিবীর অনেক প্রাণী। পৃথিবীতে যেন আক্ষরিক অর্থেই নরক নেমে এসেছিল সেদিন। ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর ভূপ্রকৃতি। এখন চাঁদে যদি এমন গ্রহাণু আঘাত হানে, তাহলে কী হবে ভেবে দেখুন তো!
কিন্তু এখানে হঠাৎ চাঁদের কথা উঠছে কেন?
উঠছে কারণ, একটা গ্রহাণু ধেয়ে আসছে চাঁদের দিকে। সেই গ্রহাণু ২০৩২ সালে চাঁদকে আঘাত করতে পারে। কিন্তু খবর আমরা জানলাম কী করে?
সেটা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আর বিজ্ঞানীরা জেনেছেন মানবইতিহাসের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ জেমস ওয়েবের কাছ থেকে। আর সেই গ্রহাণুটির নাম ২০২৪ ওয়াইআর৪।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের বিশাল চোখ বুলিয়ে চলেছে মহাকাশের অলিগলিতে। অনুসন্ধান করছে মহাবিশ্বের বিস্ময়কর ঘটনা ও সৃষ্টি রহস্য। আর এসব করতে গিয়ে ভালো-মন্দ অনেক মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধান মিলছে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা ২০২৪ সালে বিজ্ঞানীরা মহাকাশে বিপজ্জনক এক গ্রহাণুর সন্ধান পান। সেটার গতিপ্রকৃতি পরিমাপ করে জেমস ওয়েবের গবেষকেরা জানতে পারেন, ২০৩২ সালে আমাদের চিরসুন্দর চাঁদকে আঘাত হানতে পারে সেটি।
সময়ের হিসেবে এখনো বছর সাতেক বাকি। কিন্তু সমস্যা হলো গ্রহাণুগুলোর কক্ষপথ বড্ড গোলমেলে। কখনো আমাদের খুব কাছে চলে আসে, আবার অনেক দূরে চলে যায়। যখন কাছে আসে, তখন সহজেই তাদের ওপর নজর রাখা যায়। কিন্তু যখন দূরে যায়, এতই দূরে যে বছরের পর বছর হদিস থাকে না।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা বিজ্ঞানীরা মহাকাশে এক গ্রহাণুর গতিপ্রকৃতি পরিমাপ করে জানতে পারেন, ২০৩২ সালে আমাদের চিরসুন্দর চাঁদকে আঘাত হানতে পারে সেটি।
চলতি বছর মে মাসে জেমস ওয়েবের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে নতুন করে এই গ্রহাণুটি আবার দেখা হয়। এবার বিজ্ঞানীরা এর চলার পথ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও নিখুঁতভাবে হিসাব করতে পেরেছেন। তবে এই মুহূর্তে গ্রহাণুটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। ২০২৮ সালে এটা আবার দেখা দেবে। তারও বছর চারেক পর নতুন হিসাব বলছে, ২০৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর গ্রহাণু ২০২৪ ওয়াইআর৪ আঘাত হানতে পারে চাঁদে।
প্রশ্ন হলো, আঘাত হানবে চাঁদে, তা নিয়ে আমাদেরই বা অত দুর্ভাবনা কীসের?
চাঁদ শুধু এক সাধারণ উপগ্রহ নয়। আমাদের পৃথিবী, এখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া, এখানকার জীবনযাত্রা—সবকিছুর সঙ্গে একটুকরো উপগ্রহ চাঁদ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। চাঁদ যদি ঠিক আকার নিয়ে, ঠিক ঠিক দূরত্বে না থাকত, তাহলে পৃথিবীতে হয়তো প্রাণের অস্তিত্বই থাকত না! তাই চাঁদের বড় ধরনের ক্ষতি হলে তার প্রভাব আমাদের ওপরেও পড়বে। এমনকি হুমকির মুখে পড়তে পারে আমাদের অস্তিত্ব।
প্রশ্ন আসে, চাঁদের ঠিক কতটা ক্ষতি করতে পারে এই গ্রহাণু?
গ্রহাণুটির ব্যাস গড়ে প্রায় ৬০ মিটার। এই আকারের একটা গ্রহাণু যে বেগে চাঁদকে আঘাত করতে যাচ্ছে, তার ফল হবে ভয়ানক। এই সংঘর্ষের শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে ‘লিটল বয়’ নামে যুক্তরাষ্ট্র যে নিউক্লিয়ার বোমাটি ফেলেছিল, তার চেয়ে প্রায় ৫০০ গুণ। এহেন শক্তি যে সংঘর্ষ থেকে তৈরি হবে, তার ধ্বংসযজ্ঞ কতটা ভয়াবহ হবে, ভেবে দেখুন!
২০২৮ সালে গ্রহাণুটি আবার দেখা দেবে। তারও বছর চারেক পর নতুন হিসাব বলছে, ২০৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর গ্রহাণু ২০২৪ ওয়াইআর৪ আঘাত হানতে পারে চাঁদে।
তাই বলে কি আমাদের ভয় পাওয়া উচিত? বিজ্ঞানীরা বলছেন, খুব বেশি ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং এখান থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। এই দলে আছেন ব্রিটিশ গণিতবিদ কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালান ফিৎজসিমন্স। তিনি বলেন, ‘এই সংঘর্ষে পৃথিবীর বড় ধরনের ক্ষতি হবে না। এর ফলে চাঁদে তৈরি হবে বিশাল এক গর্ত বা খাদ। যেমন গর্ত চাঁদে আরও আছে। এভাবে গর্ত তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা বরং এ বিষয়ক গবেষণার পথ খুলে দেবে।’
এরপরও সংঘর্ষ হলে পৃথিবীর একেবারেই কিছু হবে না, তা নয়। সংঘর্ষ থেকে ছিটকে আসা পাথরের টুকরো মহাকাশে ঘুরতে থাকা স্যাটেলাইটগুলোতে আঘাত করতে পারে। ফলে স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটতে পারে। তবু বিশাল এক মহাজাগতিক ঘটনা কাছ থেকে দেখা ও গবেষণার সুযোগের কাছে এতটুকু ক্ষতি আসলে খুবই নগণ্য।
তবে একটা কথা বলে রাখি। চাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষ যে ঘটবেই, এমন কথা কিন্তু বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলছেন না। বরং তারা সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছেন। সংঘর্ষের সম্ভাবনা মাত্র ৪.৩ শতাংশ। সংখ্যাটা হয়তো ছোট। কিন্তু মহাজাগতিক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা একেবারে ফেলনা নয়।