মহাকাশে বয়স ধীরে বাড়ে কেন

পৃথিবীর মানুষের তুলনায় মহাকাশে নভোচারীদের বয়স ধীরে বাড়ে। এমনকি পর্যাপ্ত বেগে ছুটতে পারলে টাইম ট্রাভেলও করা সম্ভব।

একজন নভোচারী যদি এক হাজার দিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কাটান, তাহলে তিনি সময়ের ক্ষেত্রে পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ০.২৭ সেকেন্ড ভবিষ্যতে এগিয়ে থাকবেন

মহাকাশে ঘুরতে ঘুরতে কেউ বুড়ো হয়ে যেতে পারে, কথাটা শুনলে কল্পকাহিনি মনে হতে পারে। কিন্তু এটা সত্যি। পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যে তা প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

সময় সবার জন্য সর্বদা একই গতিতে সামনে এগোয় না। সময় আপেক্ষিক, এটি পরিবর্তিত হতে পারে। আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের কল্যাণে আমরা ব্যাপারটা জানি। এই তত্ত্ব বলে, কারো সাপেক্ষে আপনি বা অন্য কেউ কতটা সময় অতিক্রম করছেন, তা নির্ভর করে আপনি স্থান-কালের কোন বিন্দুতে আছেন, তার ওপর। কথাটা সরলীকরণ করে এভাবেও ভাবতে পারেন, সময় কী বেগে বয়ে যাবে, তা নির্ভর করে আপনি মহাবিশ্বের কোথায় আছেন তার ওপর।

একটা সহজ উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি কিছু টাকা খরচ করবেন। কত টাকা খরচ করবেন, তা আগে থেকে ঠিক করে রাখলেন। মাসের বাজার করার জন্য যেমন বাজেট করা হয়, সেরকম। তবে আপনার এই বাজেটের পরিমাণ হতে হবে আলোর বেগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখন এই বাজেটকে দুই ভাগে ভাগ করুন। এক ভাগ ব্যয় করবেন মহাকাশ বা স্থানের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের জন্য, আর অন্য ভাগ সময় বা কালের মধ্য দিয়ে ভ্রমণে।

আরও পড়ুন

এখন আপনি মহাকাশ তথা স্থানের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের জন্য এই বাজেটের যত বেশি খরচ করবেন, সময়ের মধ্য দিয়ে ভ্রমণে তত বাজেট কমতে থাকবে। এককথায়, আপনি আলোর বেগের যত কাছাকাছি বেগে স্থানের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন, সময় ঠিক ততটাই ধীর গতিতে চলবে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীদের কথাই ধরুন। তাঁরা প্রতি ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। অর্থাৎ আগের উদাহরণ অনুযায়ী, নভোচারীরা আলোর বেগে ভ্রমণের জন্য বেশি বাজেট খরচ করেন। ফলে সময়ের জন্য তাঁদের বাজেট কম ব্যয় হয়। তাই মহাকাশে নভোচারীদের বয়স বাড়ে ধীরে।

কেউ আলোর গতির কাছাকাছি বেগে ভ্রমণ করলে কী হবে? ধরুন, আপনি আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে পৃথিবীর চারপাশে বৃত্তাকার পথে ঘুরছেন। সেখানে কাটালেন টানা ১০ বছর।

কিন্তু কতটা ধীরে বাড়ে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা বহু দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। সময়কে আমরা যেভাবে অনুভব করি, সময় হয়তো সেরকম নয়। সময় ধীর হতে পারে, এমনকি একেবারে ভিন্নভাবে প্রবাহিতও হতে পারে।

এই রহস্যজনক বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে বিজ্ঞানীরা একটা পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষাটা করা হয়েছে স্কট কেলি এবং মার্ক কেলি নামে দুই ভাইকে নিয়ে। স্কট কেলি এক বছর মহাকাশে ছিলেন। আর মার্ক কেলি তখন ছিলেন পৃথিবীতে। স্কটের চেয়ে মার্ক ৬ মিনিট আগে জন্মেছিলেন। কিন্তু এখন তিনি স্কটের চেয়ে ৬ মিনিট ৫ মিলিসেকেন্ড বড়। কারণ স্কট পৃথিবীর চারপাশে দ্রুত গতিতে ভ্রমণ করায় তার বয়স বেড়েছে ধীরে। অর্থাৎ এতে মার্কের বয়স ৫ মিলিসেকেন্ড বেড়ে গেছে।

স্কট কেলি এবং মার্ক কেলি

এ তো মাত্র এক বছর মহাকাশ যাপনের ফলাফল। কিন্তু এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সময় সব পর্যবেক্ষকের জন্য একরকম নয়, ধীর বা দ্রুতগতির হতে পারে। তবে তা নির্ভর করে বস্তুর গতি বা মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের ওপর। কেউ যদি আলোর গতির কাছাকাছি চলতে থাকে, তাহলে তার জন্য সময় ধীরে চলে। কিন্তু যে স্থির অবস্থায় আছে, তার কাছে সময় মনে হয় স্বাভাবিক (কিন্তু আলোর বেগে চলমান মানুষটির তুলনায় তার সময় আসলে দ্রুত প্রবাহিত হয়)। এই ঘটনাকেই বলে সময়ের প্রসারণ বা টাইম ডাইলেশন।

আরও পড়ুন

একজন নভোচারী যদি এক হাজার দিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কাটান, তাহলে তিনি সময়ের ক্ষেত্রে পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ০.২৭ সেকেন্ড ভবিষ্যতে এগিয়ে থাকবেন। কারণ, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের গতি ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার। আলোর বেগের তুলনায় অনেক কম, বলা বাহুল্য। আলো সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, কেউ আলোর গতির কাছাকাছি বেগে ভ্রমণ করলে কী হবে? ধরুন, আপনি আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে পৃথিবীর চারপাশে বৃত্তাকার পথে ঘুরছেন। সেখানে কাটালেন টানা ১০ বছর। এরপর ফিরে এলেন পৃথিবীতে। ফিরে কী দেখবেন বলে মনে হয়? আপনার বাবা, মা বা আত্মীয়-স্বজনকে চিনতে পারবেন? না, পারবেন না। নিশ্চিত করে বলছি, আপনি পৃথিবীর কাউকে চিনতে পারবেন না। কারণ, পৃথিবীতে ততদিনে বয়ে গেছে প্রায় ৭ হাজার বছর। একুশ শতকে আপনি মহাকাশে গেলেও পৃথিবীতে ফিরে দেখবেন ৯১ শতাব্দী চলছে। একে সময় ভ্রমণ না বলে উপায় আছে!

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা নভোচারীরা সময়ের ওপর দুটি ভিন্ন প্রভাবের মুখোমুখি হন। প্রথমত, তাঁরা অনেক দ্রুতগতিতে ঘুরছেন। আর দ্বিতীয়ত, তাঁরা পৃথিবী থেকে অনেকটা দূরে, যেখানে মহাকর্ষের টান কম।

সময়ের আরেকটি রহস্য হলো মহাকর্ষজনিত প্রভাব। যখন কোনো বস্তু খুব বেশি ভর বা শক্তিশালী মহাকর্ষ সৃষ্টি করে, তখন তার আশপাশে সময় ধীরে চলে। একে বলা হয় মহাকর্ষজনিত সময়ের প্রসারণ। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আপনি একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের খুব কাছে আছেন। এ ক্ষেত্রে আপনার সময় পৃথিবীর তুলনায় অনেক ধীরে চলবে। ফলে আপনি ভবিষ্যতের দিকে অনেক বেশি এগিয়ে যাবেন। এভাবে শক্তিশালী মহাকর্ষ প্রভাব সময়কে প্রসারিত করে।

মহাকাশ
ফাইল ছবি: নাসা

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা নভোচারীরা সময়ের ওপর দুটি ভিন্ন প্রভাবের মুখোমুখি হন। প্রথমত, তাঁরা অনেক দ্রুতগতিতে ঘুরছেন। আর দ্বিতীয়ত, তাঁরা পৃথিবী থেকে অনেকটা দূরে, যেখানে মহাকর্ষের টান কম। উচ্চ গতির কারণে আপেক্ষিক সময় তাঁদের জন্য কিছুটা ধীরে চলে, এটা আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার নিয়ম। আবার কম মহাকর্ষের কারণে সময় কিছুটা দ্রুত চলে, এটা সাধারণ আপেক্ষিকতার নিয়ম। তবে এই দুইয়ের ভারসাম্যে দেখা যায়, গতিজনিত প্রভাবটাই বেশি কাজ করে। তাই মহাকাশে থাকাকালীন তাঁদের বয়স পৃথিবীর মানুষের তুলনায় খুব সামান্য ধীরে বাড়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস

আরও পড়ুন