সৌরজগতে নতুন রহস্যের সন্ধান, নবম গ্রহের সম্ভাবনায় বড় ধাক্কা
সৌরজগতে একটি নতুন বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। প্লুটোর চেয়েও অনেক দূরে সেটা, ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন অ্যামোনাইট। এই আবিষ্কার হয়তো সৌরজগৎ নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনাই পাল্টে দেবে।
জাপানি জ্যোতির্বিদেরা হাওয়াইয়ের সুবারু টেলিস্কোপের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছেন এই অদ্ভুত বস্তু। আনুষ্ঠানিকভাবে এর নাম দেওয়া হয়েছে ২০২৩ কেকিউ১৪। কিন্তু সবাই একে ডাকছেন অ্যামোনাইট বলে। এই নাম এসেছে এক প্রাচীন সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিল থেকে। সেই প্রাণীরা ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি এই আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হয়েছে নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে।
অ্যামোনাইট কিন্তু কোনো গ্রহ নয়। এটি একটি সেডনয়েড। এ ধরনের বস্তু বিরল। এখন পর্যন্ত মাত্র চারটি সেডনয়েড খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। প্রশ্ন হলো, সেডনয়েড কী? এই শব্দ বা নাম দিয়ে সে সব বস্তুকে বোঝায়, যেগুলো নেপচুন গ্রহের কক্ষপথের বাইরে থেকে সূর্যের চারপাশে ঘোরে। অর্থাৎ এগুলোর কক্ষপথ হয় অনেক লম্বাটে—উপবৃত্তাকার। বামন গ্রহ সেডনার কক্ষপথও এমন।
হয়তো একসময় সত্যিই একটি গ্রহ ছিল। পরে সেটি কোনো কারণে সৌরজগৎ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। আর সেই কারণেই এখন আমরা এত অদ্ভুত কক্ষপথগুলো দেখতে পাচ্ছি।
অ্যামোনাইটের কক্ষপথটা সত্যিই অবাক করা। রহস্যময় এই বস্তুটা যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে, তখন দূরত্ব হয় ৬৬ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট বা এইউ। বাংলায় বলা হয় সৌরজাগতিক একক। অর্থাৎ পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্বের ৬৬ গুণ। আর সবচেয়ে দূরে থাকলে এ দূরত্ব হয় ২৫২ এইউ। তুলনাটা প্লুটোর সঙ্গেই যদি দিই—বামন গ্রহ প্লুটো সূর্য থেকে মাত্র ৩৯ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরে। আর অ্যামোনাইটের দূরত্ব তারচেয়েও ছয় গুণ বেশি।
এতদিন বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, এটিই হয়তো আমাদের কাঙ্ক্ষিত নবম গ্রহ। এই সন্দেহের পেছনেও কারণ আছে। সেই কারণটাও বেশ মজার। কুইপার বেল্টের কিছু ছোট বস্তুর আচরণ খুব অদ্ভুত। ছয়টি বস্তু একেবারে একই ধরনের লম্বা কক্ষপথে ঘুরছে। সেগুলো হলো সেডনা, ২০১২ ভিপি১১৩, ২০০৪ ভিএন১১২, ২০১০ জিবি১৭৪, ২০১৩ আরএফ৯৮ এবং ২০০৭ টিজি৪২২।
এটা নিছক কাকতালীয় হতে পারে না। দেখে মনে হয়, কোনো বড় বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে ওগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের রাইস বিশ্ববিদ্যালয় আর প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, ওই ছয়টি বস্তুর মাঝে নবম গ্রহ থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৪০ ভাগ।
কিন্তু অ্যামোনাইটের আবিষ্কার এই পুরো তত্ত্বে পানি ঢেলে দিয়েছে। কারণ, এর কক্ষপথ অন্য সেডনয়েডদের মতো নয়। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে ঘুরছে। জাপানের ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরির বিজ্ঞানী ইউকুন হুয়াং বলছেন, অ্যামোনাইটের কক্ষপথ অন্যদের সঙ্গে মিলছে না। ফলে নবম গ্রহ থাকার সম্ভাবনা আরও কমে যাচ্ছে।
২০২৩ সালের মার্চ, মে ও আগস্ট মাসে সুবারু টেলিস্কোপে এই সেডনয়েডকে প্রথম দেখতে পান বিজ্ঞানীরা। পরে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপ দিয়ে নিশ্চিত করা হয়।
তবে ইউকুন হুয়াং একটি মজার কথাও বলেছেন। তিনি বলেন, ‘হয়তো একসময় সত্যিই একটি গ্রহ ছিল। পরে কোনো কারণে সৌরজগৎ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। আর তাই এখন আমরা এত অদ্ভুত কক্ষপথগুলো দেখতে পাচ্ছি। যদি নবম গ্রহ আসলেই থাকে, তাহলে সেটি হয়তো আরও বহু দূরে লুকিয়ে আছে।’
অ্যামোনাইট খুঁজে বের করার গল্পটাও কিন্তু বেশ চমৎকার। এটি পাওয়া গেছে ‘ফসিল’ নামের এক প্রকল্পের অংশ হিসেবে। ফসিল মানে ‘ফরমেশন অব দ্য আউটার সোলার সিস্টেম: অ্যান আইসি লিগ্যাসি’। এ কারণেই এর ডাকনাম রাখা হয়েছে অ্যামোনাইট। আসলে, জীববিজ্ঞানের ভাষায়, অ্যামোনাইট হলো একধরনের শামুকজাতীয় প্রাণীর ফসিল।
২০২৩ সালের মার্চ, মে ও আগস্ট মাসে সুবারু টেলিস্কোপে এই সেডনয়েডকে প্রথম দেখতে পান বিজ্ঞানীরা। পরে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপ দিয়ে নিশ্চিত করা হয়। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, পুরোনো ছবিতেও এর চিহ্ন পাওয়া গেছে। ১৯ বছরের পুরাতন আর্কাইভে এর ছবি খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই দীর্ঘ সময়ের তথ্য দিয়েই তাঁরা এর কক্ষপথ সঠিকভাবে বের করতে পেরেছেন।
অ্যামোনাইটের এই আবিষ্কার আমাদের জন্য নতুন রহস্যের দরজা খুলে দিয়েছে। সৌরজগতের একেবারে প্রান্তে কী আছে, তা আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না। সেখানে এখনো লুকিয়ে আছে অসংখ্য রহস্য। নবম গ্রহ থাকুক বা না থাকুক, এমন আবিষ্কার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, সৌরজগৎ সম্পর্কে আমরা এখনো অনেক কিছু জানি না।