পর্যায় সারণিতে বর্তমানে মৌলের সংখ্যা ১১৮টি। কিন্তু পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে প্রায় ৯২টি মৌল পাওয়া যায়। হাইড্রোজেন থেকে শুরু করে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত। বাকীগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে গবেষণাগারে। কিন্তু প্রাকৃতিক মৌলগুলোর মধ্যে কিছু মৌল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, আর কিছু মৌল একেবারে বিরল। পৃথিবীর ভূত্বকে প্রাচুর্যপূর্ণ মৌল কোনগুলো?
এর উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। তাতে যে তালিকা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে যে দশটি উপাদান সবচেয়ে বেশি আছে তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
একনজরে দেখে নেই সবচেয়ে বেশি আছে কোন উপাদানগুলো। অক্সিজেন (৪৬.১ শতাংশ), সিলিকন (২৮.২ শতাংশ), অ্যালুমিনিয়াম (৮.২৩ শতাংশ), লোহা (৫.৬৩ শতাংশ), ক্যালসিয়াম (৪.১৫ শতাংশ), সোডিয়াম (২.৩৬ শতাংশ), ম্যাগনেসিয়াম (২.৩৩ শতাংশ), পটাসিয়াম (২.০৯ শতাংশ), টাইটানিয়াম (০.৫৬৫ শতাংশ) ও হাইড্রোজেন (০.১৪০ শতাংশ)।
এবার জানা দরকার, কেন এই উপাদানগুলো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আছে? এদের কাজই বা কী? শুরুতেই অক্সিজেন। পৃথিবীর ভূত্বক তৈরিতে সবচেয়ে বেশি অবদান অক্সিজেনের। ভূত্বকের প্রায় ৪৬ শতাংশ দখল করে আছে অক্সিজেন। কিন্তু মহাবিশ্বে অক্সিজেনের পরিমাণ কেমন? মহাবিশ্বে যে উপাদানগুলো সবচেয়ে বেশি আছে তার মধ্যে অক্সিজেনের অবস্থান তৃতীয়। পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অক্সিজেন। মানবদেহের উপাদানগুলোর দুই তৃতীয়াংশ জুড়েও অক্সিজেন আছে। এই উপাদানটি খুবই প্রতিক্রিয়াশীল এবং সহজেই অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিলে যৌগ তৈরি করতে পারে। এ কারণে পৃথিবীতে এবং পৃথিবীর ভূত্বকে প্রচুর অক্সিজেনের যৌগ বিদ্যমান। লোহার বিভিন্ন আকরিক এবং লোহার যৌগ তৈরিতেও অক্সিজেনের প্রয়োজন। এছাড়া তরল অক্সিজেন অত্যন্ত দাহ্য এবং এটি জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা, পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণীর বেচে থাকার জন্য দরকার অক্সিজেন।
পৃথিবীর ভূত্বকে পাওয়া উপাদানের মধ্যে সিলিকন অন্যতম। সিলিকন ভূত্বকের ২৮ শতাংশ জায়গা জুড়ে আছে। বিভিন্ন ধরণের খনিজ এবং মৌলিক পদার্থে পাওয়া যায় সিলিকন। এই মৌলটি সাধারণত অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে থাকে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সিলিকন ডাই অক্সাইড। অনেক ধরনের স্ফটিক শিলায় (কোয়ার্টাজ, অ্যামেথিস্ট) সিলিকন ডাই অক্সাইড পাওয়া যায়। এই যৌগটি অধিকাংশই বালি থেকে তৈরি হয়। অবশ্য বালি তৈরি হয় সিলিকন সমৃদ্ধ খনিজ ও পাথর দিয়ে। এছাড়া মানুষের তৈরি অনেক দ্রব্যেও সিলিকনের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন, ইলেকট্রনিকস, মাইক্রোচিপসহ বিভিন্ন ধরণের কাচের পণ্য।
সবচেয়ে বেশি পাওয়া উপাদানগুলোর তালিকায় অ্যালুমিনিয়ামের অবস্থান তৃতীয়। ভূত্বকের প্রায় ৮ শতাংশ জায়গা জুড়ে আছে অ্যালুমিনিয়াম। তবে এই উপাদানটি প্রকৃতিতে সাধারণত পাওয়া যায় না। শুধু যৌগ হিসাবেই পাওয়া যায়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় অ্যালুমিনিয়াম সালফেট এবং অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড।
পৃথিবীর ভূত্বকের ৫ শতাংশ লোহা। এই উপাদানটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ লোহা ব্যবহার করে আসছে। এমনকি লোহার প্রাচুর্যতার কারণে এই নামে একটি যুগের নামকরণ হয়েছে। লৌহযুগ। এই যুগ থেকে মানুষ ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো লোহার ব্যবহারে ভাটা পড়েনি। বরং দিনদিন লোহার ব্যবহার বাড়ছে। লোহা এবং কার্বন একত্রে মিলে তৈরি করে ইস্পাত। ঘরের ছোটখাট জিনিস থেকে সেতু কিংবা বিল্ডিং তৈরিতেও এর ব্যবহার করা হয়। লোহা জীবনের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের রক্ত এবং উদ্ভিদের ক্লোরোফিলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এটি।
মানুষের বিকাশের জন্য ক্যালসিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আমাদের হাড়ের বৃদ্ধির জন্য ক্যালসিয়াম দরকার। এছাড়াও বিভিন্ন যৌগিক উপাদানে পাওয়া যায় ক্যালসিয়াম। পৃথিবীর ভূত্বকের ৪ শতাংশ দখল করে আছে এই উপাদানটি। ক্যালসিয়াম প্রায়ই অক্সিজেন এবং পানির সংমিশ্রণ আকারে পাওয়া যায়। ক্যালসিয়াম কার্বনেট বা চুনাপাথর পৃথিবীর বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদান। এছাড়াও মার্বেল, চক বা মুক্তো হিসাবেও বিভিন্ন ধরণের ক্যালসিয়ামের শিলা পাওয়া যায়।
পৃথিবীর ভূত্বকের ২.৩ শতাংশ জুড়ে আছে সোডিয়াম। পৃথিবীতে সর্বাধিক পাওয়া উপাদানের মধ্যে সোডিয়ামের অবস্থান ষষ্ঠ। প্রকৃতিতে সাধারণত সোডিয়াম পাওয়া যায় না, তবে যৌগ আকারে পাওয়া যায়। এটি বেশিরভাগই সোডিয়াম ক্লোরাইড লবণ আকারে পাওয়া যায়। সোডিয়াম একটি জলীয় দ্রবণ। তাই সাগরের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গেই এই উপাদানটি বেশি পাওয়া যায়। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের জন্য সোডিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। সোডিয়াম আমাদের শরীরের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং পেশী তন্তুগুলোকে প্রভাবিত করে।
সাধারণত ম্যাগনেসিয়াম প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। তবে অক্সিজেন, ক্যালসিয়াম ও কার্বনের বিভিন্ন যৌগের মিশ্রণের সঙ্গে এটা পাওয়া যায়। যেমন, ডলোমাইট খনিজ। ম্যাগনেসিয়াম পৃথিবীর ভূত্বকের ২ শতাংশ জুড়ে আছে।
পটাসিয়ামও যৌগ ছাড়া পাওয়া যায় না। ভূত্বকের ২ শতাংশ পটাসিয়াম। এটি সাধারণত অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের জন্য অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। সবচেয়ে পরিচিত পটাশিয়ামের যৌগ হলো পটাসিয়াম ক্লোরাইড। এই যৌগটি সার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও পটাসিয়াম কার্বনেট সাবান ও নির্দিষ্ট কিছু কাচ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
টাইটানিয়াম সাধারণত রুটিল, ইলমেনাইট ও স্ফেনের মতো খনিজ পদার্থে পাওয়া যায়। ভূত্বকের ০.৬ শতাংশ জুড়ে আছে টাইটানিয়াম। পৃথিবীর ভূত্বকের অন্যান্য উপাদানের তুলনায় এটি কমই পাওয়া যায়। তারপরেও টাইটানিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী কিংবা খুবই হালকা উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা যায়। তাই আমরা টাইটেনিয়ামকে বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করতে পারি। এরোপ্লেন থেকে শুরু করে মানুষের হাড়ের জয়েন্টেও ব্যবহার করা হয় টাইটানিয়াম।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তার মধ্যে হাইড্রোজেন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পৃথিবীর ভূত্বকে হাইড্রোজেন মাত্র ০.১৪ শতাংশ, অবস্থান দশম। প্রকৃতিতে পাওয়া যায় একরম হাইড্রোজেনের অনেক যৌগ আছে। আবার মানুষও হরহামেশাই হাইড্রোজেন যৌগ তৈরি করতে পারে। পানির অন্যতম মূল উপাদানও এই হাইড্রোজেন। এছাড়াও অ্যামোনিয়া, মিথেন, হাইড্রোজেন পারক্সাইড ও চিনির যৌগেও পাওয়া যায় হাইড্রোজেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা
সূত্র: ওয়ার্লড অ্যাটলাস ডট কম, উইকিপিডিয়া