১৯৭২ সাল কেন আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম বছর
১৯৭২ সালকে বলা হয় আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম বছর। শুধু যে রাজনৈতিক ঘটনা বা কেলেঙ্কারির কারণে বছরটা দীর্ঘ মনে হয়েছিল, তা নয়। সত্যি সে বছর দীর্ঘ ছিল। ওই বছরই মানুষ শেষবারের মতো চাঁদের বুকে হেঁটেছিল। কিন্তু এসবের বাইরেও, আক্ষরিক অর্থেই ঘড়ির কাঁটায় বছরটা ছিল অস্বাভাবিক দীর্ঘ! এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে।
প্রথমত, ১৯৭২ সালটি ছিল লিপ ইয়ার। অর্থাৎ, ফেব্রুয়ারি মাসে একটা বাড়তি দিন যোগ হয়েছিল। ২৮ দিনের পরিবর্তে মাস হয়েছিল ২৯ দিনে। কিন্তু আসল চমকটা অন্যখানে। শুধু একটা বাড়তি দিনই নয়, সে বছর যোগ হয়েছিল দুটি বাড়তি ‘লিপ সেকেন্ড’!
লিপ সেকেন্ড কী
সহজ কথায়, আমাদের ঘড়ির সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর ঘোরার সময়ের একটা সূক্ষ্ম গরমিল আছে। সেই গরমিল মেটানোর জন্যই এই লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়।
বর্তমানে আমরা সময় মাপি পারমাণবিক ঘড়ি বা ইউটিসির সাহয্যে। এগুলো অসম্ভব নিখুঁত। সিজিয়াম পরমাণুর কম্পন দিয়ে চলে এগুলো। একটা সিজিয়াম পরমাণু প্রতি সেকেন্ডে ঠিক ৯১৯ কোটি ২৬ লাখ ৩১ হাজার ৭৭০ বার কাঁপে! এই ঘড়ি লাখ লাখ বছরে এক সেকেন্ডও এদিক-সেদিক হয় না।
কিন্তু আমাদের পৃথিবীটা এত নিখুঁত নয়। পৃথিবীর ঘোরার গতি একটি এদিক-সেদিক হয়। কখনো গতি কখনো সামান্য বাড়ে, আবার কখনো সামান্য কমে। ফলে, এই নিখুঁত পারমাণবিক ঘড়ির সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর ঘোরার একটা সূক্ষ্ম ফারাক তৈরি হতে থাকে। এই সামান্য ফারাক মাত্র এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়। কিন্তু এতটুকু সময়ই আমাদের জিপিএস, ইন্টারনেট, শেয়ার বাজারের লেনদেন বা স্যাটেলাইট যোগাযোগের মতো অতিনির্ভুল প্রযুক্তিগুলোর জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে।
১৯৭২ সালটি ছিল লিপ ইয়ার। অর্থাৎ, ফেব্রুয়ারি মাসে একটা বাড়তি দিন যোগ হয়েছিল। ২৮ দিনের পরিবর্তে মাস হয়েছিল ২৯ দিনে।
অর্থাৎ, পারমাণবিক ঘড়ির সঙ্গে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি ঠিক রাখার জন্য দুটি বাড়তি লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। একটা সে বছর ৩০ জুন, আরেকটা ৩১ ডিসেম্বর। ফলাফল কী হয়েছিল? আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ দিনে পরিণত হয়েছিল সেই বছরটা!
সাধারণ ৩৬৫ দিনের বছর হয়। অর্থাৎ এক বছরে প্রায় ৩ কোটি ১৫ লাখ ৩৬ হাজার সেকেন্ড হয়। কিন্তু ১৯৭২ সালটি ছিল মোট ২৪ ঘণ্টা ২ সেকেন্ড দীর্ঘ! সেকেন্ডের হিসেবে মোট ৩ কোটি ১৬ লাখ ২২ হাজার ৪০২ সেকেন্ড।
১৯৭২ সালেই কেন দুটি লিপ সেকেন্ড যোগ করা হলো
১৯৭২ সালের জুন মাসে প্রথমবার লিপ সেকেন্ড প্রথা চালু করা হয়। কিন্তু এর আগে কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর এই টলমল গতির কারণে যে সামান্য ফারাকগুলো জমেছিল, সেই হিসাব একবারে মেলানোর জন্য বিজ্ঞানীরা ১৯৭২ সাল শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর আরও একটি বাড়তি সেকেন্ড যোগ করেন!
১৯৭০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০টি লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়েছে। কিন্তু এক বছরে দুবার লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়েছে শুধু ওই ১৯৭২ সালেই। ১৯৭২ সাল হয়তো দীর্ঘতম বছরের এই রেকর্ডটি অনেক দিন ধরে রাখবে। কারণ, ইদানীং একটা উল্টো ঘটনা ঘটছে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, পৃথিবীর ঘোরা সামান্য দ্রুত হয়ে গেছে! ফলে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের ঘড়ি থেকে একটা সেকেন্ড বাদ দিতেও হতে পারে। একে বলা হবে ‘নেগেটিভ লিপ সেকেন্ড’।
১৯৭০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০টি লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়েছে। কিন্তু এক বছরে দুবার লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়েছে শুধু ওই ১৯৭২ সালেই।
১৯৭২ সালই সর্বকালের দীর্ঘতম বছর
এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আপনার ওপর। মানে বছর বলতে আপনি কী বোঝেন, তার ওপর। মানুষের বানানো ক্যালেন্ডারের যদি কথা ভাবেন, তবে দীর্ঘতম বছরের খেতাব পাবে ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ!
কারণ, রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার যখন ক্যালেন্ডার ঠিক করছিলেন, তখন ঋতুর সঙ্গে সময়ের হিসাব মিলছিল না। তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরামর্শে তিনি সেই বছরটিতে অতিরিক্ত ৯০ দিন যোগ করেন। সব মিলিয়ে ওই বছরটি ছিল ৪৪৫ দিনের! ইতিহাস এই বছরটিকে আজও ‘বিভ্রান্তির বছর’ বা ‘ইয়ার অব কনফিউশন’ নামেই মনে রেখেছে।