‘ইনফিনিট স্ক্রলিং মানুষের জন্য ক্ষতিকর’—আমান্ডা বগান, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

অনেকেই রাতে ঘুমানোর আগে মাত্র ৫ মিনিটের জন্য একটু ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামটা চেক করেন। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রল শুরু করলে আর খেয়াল থাকে না, ৫ মিনিট হলো নাকি ৩০ মিনিট! তখন নিজের ওপর রাগ হয়। মনে হয়, কেন ফালতু সময় নষ্ট করলাম! এই যে নিজের ওপর বিরক্তি, ঘুমের ব্যাঘাত আর মনের ভেতর একটা শূন্যতা, এসব কিন্তু এমনি এমনি হয় না। এর পেছনে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপগুলোর ডিজাইন বা নকশার কারসাজি।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গবেষক আমান্ডা বগান এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন। বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর সেই সাক্ষাৎকার বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন শিউলী সুলতানা

প্রশ্ন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ডিজাইন পরিবর্তন করে কি মানুষের মন ভালো করা সম্ভব? এমন একটা উদাহরণ দেবেন?

আমান্ডা: অবশ্যই সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ডিজাইনই ঠিক করে দেয়, আমরা ওখানে কেমন আচরণ করব। আমরা একটা পরীক্ষায় দেখেছি, ডিজাইনে সামান্য পরিবর্তন আনলেই অনলাইনে মানুষের ঝগড়া বা নেতিবাচক আচরণ কমানো যায়। যেমন, আমরা একটা ফিচার তৈরি করেছিলাম। যখনই কমেন্ট বক্সে দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি বা ঝগড়া শুরু হতো, সিস্টেম তাদের পরামর্শ দিত; ‘আপনারা কি ইনবক্সে গিয়ে কথা বলবেন?’ মানুষ এটা খুব পছন্দ করেছিল। এটা অনেকটা বাস্তব জীবনের মতো। রাস্তায় ঝগড়া না করে আড়ালে গিয়ে মিটিয়ে ফেলার মতো।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন: আপনি আপনার গবেষণায় ‘৩০ মিনিটের ইক্য ফ্যাক্টর’ নামে একটা অদ্ভুত বিষয়ের কথা বলেছেন। এটা আসলে কী?

আমান্ডা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটাকেই বলা হচ্ছে ’৩০ মিনিটের ইক্য ফ্যাক্টর’। অ্যাপগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে আপনি অনন্তকাল ধরে স্ক্রল করতে পারেন। এটা আমাদের মস্তিষ্কে লটারির টিকিট কাটার মতো একটা নেশা তৈরি করে। মস্তিষ্ক ভাবে, ‘আর একটু স্ক্রল করলেই হয়তো দারুণ কিছু দেখব!’ আসলে মানুষ ভাবে মাত্র ৫ মিনিট স্ক্রল করব, কিন্তু সে ৩০ মিনিট কাঁটিয়ে দেয়। যখন তার সম্বিৎ ফেরে, তখন নিজের ওপর এক ধরনের হতাশা কাজ করে। মনে হয় শুধু শুধু অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলল। এই অনুশোচনাটাই হলো ‘ইক্য ফ্যাক্টর’।

প্রশ্ন: আপনি বলছেন এটা আসক্তি বা নেশা নয়, বরং ডিসোসিয়েশন। কেন?

আমান্ডা: ডিসোসিয়েশন হলো এমন একটা মানসিক অবস্থা, যখন আপনি নিজের কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ধরুন, আপনি থালাবাসন মাজছেন, কিন্তু মন চলে গেছে অন্য ভাবনায়। আপনি জানেনও না আপনার হাত কী করছে। অথবা সিনেমা দেখতে দেখতে এতই ডুবে গেছেন যে, কখন আপনার পা অবশ হয়ে গেছে টেরই পাননি।

সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঠিক এটাই ঘটে। আপনি স্ক্রল করছেন, কিন্তু আপনার ‘আমি’ সত্তাটা তখন বাস্তবে নেই। ঘোর কাটার পর মনে হয়, কী হলো এতক্ষণ? মাঝেমধ্যে বিশ্রামের জন্য এমনটা হওয়া ভালো, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এটা যখন তখন হয় এবং আমাদের সময়ের বারোটা বাজিয়ে দেয়।

প্রশ্ন: আপনারা এটা কীভাবে মাপলেন?

আমান্ডা: আমরা চার্প (Chirp) নামে এক্সের মতো একটা নকল অ্যাপ বানিয়েছিলাম। ৪৩ জন মানুষ এটা ব্যবহার করেছিল। অ্যাপ ব্যবহারের সময় আমরা হুটহাট তাদের প্রশ্ন করতাম, ‘আপনি কি এখন মনোযোগ দিয়ে অ্যাপ চালাচ্ছেন, নাকি ঘোরের মধ্যে আছেন?’ ফলাফল ছিল চমকে দেওয়ার মতো। দেখা গেল, ৪২ শতাংশ মানুষই নিয়মিত ঘোরের মধ্যে বা ডিসোসিয়েশনে চলে যাচ্ছে। তারা সময়ের হিসাব রাখতে পারছে না।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন: এর সমাধান কী? আপনারা তো কিছু পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। কোনটা কাজে দিয়েছে?

আমান্ডা: আমরা চার ধরনের উপায় বা ইন্টারভেনশন চেষ্টা করেছি। এর মধ্যে দুটি খুব ভালো কাজ করেছে। আমরা ইউজারদের বাধ্য করেছি তাদের ফিড ভাগ করে ফেলতে। যেমন, বন্ধু, খবর বা খেলাধুলা। যখন তারা পুরো জগাখিচুড়ি ফিড না দেখে শুধু নির্দিষ্ট তালিকার পোস্ট দেখেছে, তখন তাদের ঘোর কম লেগেছে। আর যখনই তাদের নতুন সব পোস্ট দেখা শেষ হয়েছে, আমরা একটা মেসেজ দিয়েছি; ‘আপনার সব দেখা শেষ’। এতে তারা বুঝতে পেরেছে যে, আর স্ক্রল করার দরকার নেই। তবে সময় বেঁধে দেওয়া বা টাইম লিমিটের ওয়ার্নিং খুব একটা কাজে আসেনি। উল্টো ওটা দেখে মানুষ বিরক্ত হয়েছে এবং ইগনোর করেছে।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গবেষক আমান্ডা বগান

প্রশ্ন: তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোর কী করা উচিত?

আমান্ডা: ইনফিনিট স্ক্রল মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এর বদলে কাস্টম লিস্ট বা ক্যাটাগরি করে দিলে মানুষ অনেক সচেতনভাবে অ্যাপ ব্যবহার করতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের গবেষণায় দেখেছি, এতে মানুষের অ্যাপ ব্যবহারের সময় কমেনি, কিন্তু তাদের ঘোর বা ডিসোসিয়েশন কমেছে। অর্থাৎ, কোম্পানিগুলোর ব্যবসার ক্ষতি না করেও মানুষকে ভালো রাখা সম্ভব।

প্রশ্ন: সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

আমান্ডা: প্রথমত, নিজের ওপর দোষ চাপানো বন্ধ করুন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক চালালে নিজেকে দোষ দেবেন না। কারণ, হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ারের কাজই হলো আপনাকে স্ক্রিনে আটকে রাখা। তাই আপনি হেরে গেলে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, অ্যাপের ভেতরেই কিছু টুলস আছে, সেগুলো ব্যবহার করুন। যেমন টিকটকে ব্রেক রিমাইন্ডার সেট করা যায়, যা এক ঘণ্টা পর আপনাকে বিরতি নিতে বলবে। এক্স বা ফেসবুকে লিস্ট বানিয়ে নিন, যাতে সবকিছু দেখতে না হয়।

আরও পড়ুন